Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্মরণ: শম্ভু রক্ষিত

শম্ভু রক্ষিত | কবি

সৈয়দ কওসর জামাল

 

 লেখক বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক। দীর্ঘদিন প্রসারভারতীতে রেডিও ব্রডকাস্টারের দায়িত্ব সামলেছেন। বিশ্বভারতীর আমন্ত্রিত অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে টেকনো ইন্ডিয়ায় মিডিয়া স্টাডিজের আমন্ত্রিত অধ্যাপক।

 

 

 

১৯৭১ সালের শেষদিকে কোনও এক বিকেলে কফিহাউসের টেবিলে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। সে বছরই ওর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’সময়ের কাছে আমি বা কেন মানুষ’ বেরিয়েছে। গ্রন্থটি আমাকে দিয়েছিল কি না মনে নেই। তবে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘প্রিয়ধ্বনির জন্য কান্না’ আমাকে দিয়েছিল কফিহাউসে বসেই। দিনটিকে এখনও মনে করতে পারি। মনে থাকার কারণ বইটি নিয়ে শম্ভুর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। আমাকে অনেকক্ষণ ধরে শম্ভু ‘প্রিয়ধ্বনি’র জন্য তার ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার কথা খুব আবেগপ্রবণ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছিল। শম্ভু তখন থাকত হাওড়ায়, ফলে অনেক সময় পর্যন্ত কফিহাউসের আড্ডায় থাকতে পারত।

শম্ভু রক্ষিত বললেই ছোটখাটো চেহারার অনুজ্জ্বল মানুষটির চেহারা সবার চোখে ভাসে। তবে অগোছালো বেশবাস, কখনও বেশ মলিন, জীর্ণ কাঁধের ব্যাগ, যা প্রায় মাথার ওপর ওঠানো, গালে না-কামানো কয়েকদিনের দাড়ি, গ্রামীণ সরলতা ইত্যাদি দেখে কেউ যদি শম্ভুকে বিচার করতে বসেন, নির্ঘাৎ ভুল করবেন। এই আপাত অগোছালো, সরল ও ভবঘুরে শম্ভু আসলে আদ্যন্ত আত্মমর্যাদাপূর্ণ একজন মানুষ। জীবনযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক। মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন, দুর্বার ও জেদি। আর্থিক সঙ্গতিহীন অথচ আত্মরক্ষায় উদাসীন, নিরাপত্তাহীন অথচ ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী, কর্মহীন অথচ কর্মসংস্থানের জন্য হতোদ্যম। সংবাদপত্র জগতের এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, তিনি শম্ভুকে সাতের দশকেই খবরের কাগজে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন, শম্ভু হেসে এড়িয়ে গেছে। এই ছিল শম্ভু রক্ষিত। তার হাসিই ছিল তার ওই চারিত্র্যের প্রতীক, সমাজ ও ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করার প্রতীক।

শম্ভুর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হয়ে আছে দেশে জরুরি অবস্থার সময় তার বিদ্রোহ। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর লাগাম পরানোর চেষ্টা হয়েছিল। আর এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী জ্যোতির্ময় দত্ত অনুশাসন অগ্রাহ্য করে তাঁর সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকার জরুরিশাসন বিরোধী সংখ্যা প্রকাশ করেন। তখনকার দৃষ্টিতে এ ছিল গর্হিত অপরাধ। এই পত্রিকায় লিখেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত। আর আমাদের শম্ভু ইন্দিরা গান্ধিকে মনে রেখে কবিতা লিখেছিল— ‘বুড়ি হুম’। এঁদের সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। প্রথমে গৌরকিশোর ও বরুণ সেনগুপ্ত গ্রেফতার হন, তারপর ধরা হয় জ্যোতির্ময়কে, এবং সবশেষে শম্ভুকে। অদ্ভুতভাবে, জেলে শম্ভুর কাছ থেকে কোনও তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ। সে ছিল নির্ভয় ও দৃঢ়চিত্ত। ব্যক্তিগতভাবে যারা তাকে দেখতেন, তারা কি কখনও এই শম্ভুকে চিনতেন?

যে মানুষ রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানকে হেসে অবজ্ঞা করতে পারে, বিদ্রোহ করতে পারে, তার পক্ষে সাহিত্যের কোনও ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির কাছে কবি হিসেবে আত্মসমর্পণ বা অনুগ্রহভিক্ষা মৃত্যুর সামিল। শম্ভু এই মৃত্যুর কাছে নিজেকে তুলে দেয়নি। যে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তার বিদ্রোহ, সে কী করে সাহিত্যপ্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী হবে? চিরবিদ্রোহীকে প্রতিষ্ঠানও দূরে রাখতে চায়।

কবিতাতেও শম্ভু স্বতন্ত্র, যে কাব্যভাষা আয়ত্ত তার, তা সাধারণ জনপ্রিয়তার পরিপন্থী। জনচিত্ত আহ্বানের দায় সে কখনও নিজের ওপর তুলে নেয়নি। ফলত ভক্তজনের আনুকূল্য পাওয়ার কথা তার ছিল না। সাতের দশকে শম্ভুর কবিতা বেশ জটিল ও আপাত দুর্বোধ্য অথচ আবেগধর্মী এমন ভাবতেন অনেকেই। মনে পড়ছে, ১৯৭৩ অথবা ৭৪ সালে আমাদের চেনাজানা কারও আহ্বানে মহাজাতি সদনের এক কবিসভায় গেছি শম্ভু ও আমি। দুজনেই গেছি কফিহাউস থেকে। আমাদের পাশে বসেছিলেন সাধনা মুখোপাধ্যায়, যিনি সেসময় দেশ পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লিখতেন, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। আমি শম্ভুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়ামাত্র বলে উঠলেন, ‘আমি আপনার কবিতা পড়ে ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু আমার মনে হয় আপনার কবিতার মধ্যে একটা বিশেষ কিছু আছে।’ এই বিশেষ কিছুর সন্ধান পাঠককে করে যেতে হয় ভালো কবিতার মধ্যে, আপাত কাঠিন্যের মধ্যে। শম্ভুর ‘প্রিয়ধ্বনির জন্য কান্না’ থেকে একটি কবিটা এইরকম:

স্থিতিশীল মুদ্রা ও পালক ও পশুপাখীর রূপায়ণ হে অন্যরূপ
কয়েক শত বৎসর, কেউ নতুন কৌশল খুঁজে আর পারে
আমি মেরুবিন্দুর অবস্থান-নিচে, অনুকরণে রূপায়িত; প্রকৃতই বিরাট যারা
ধ্বংস নিয়ে কান্তনগরের রত্নমন্দিরেরই মতো দেহ রূপায়ণ করেছিল
চিরকাল ভেঙে ভেঙে প্রত্যুষের আবর্তের মধ্যে সমাসীন যেন
প্রকৃতই অনুমান সমানুপাতিক রক্ষিত প্রস্তরে, সম্বন্ধীয়
গণনার পাহাড় লুপ্ত হয়ে— যেমন রূপালী অবস্থান
ভৌগোলিক আধোঘুমে সৌন্দর্যমণ্ডিত— অপরিসীম ধৈর্য আকস্মিকভাবে
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে ঈষৎ স্থূল রূপায়ণে
উষ্ণতর উদ্ভাসিত পাহাড় প্রয়োগগত লুপ্ত হয়ে গড়িয়ে যায়
প্রীতিময়ী সরস্বতী তুমি, নানারকম ধারণা কো মতামত প্রকাশ করে যাও
রঙে ও সবুজে বরফস্তূপে, বিস্ময়কর অভিকর্ষের সম্ভারে
যেমন নিয়মের কোনখানে পদার্থের বা ভূমিকম্পের পূর্বাভাষ দেওয়ার সার্থকতা

শব্দের পুনরাবৃত্তি, সিনট্যাক্সের বিপর্যয়, আকস্মিক বিপরীতধর্মী শব্দের ব্যবহার শম্ভুকে আমাদের সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল বলেই সে কবি হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কবিতাটিকে প্রেমের কবিতা বলতে চাইবেন না কেউ। ওর আর একটি কবিতার শেষ অংশ উদ্ধৃত করছি:

আমি এক বন্দীর জীবনযাপন করেছি, তুমি আমায় ইশারা দাও
আমি সারাদিন দু’হাত আলোকিত করে লজ্জাহীন ঘুমিয়ে পড়েছি
আমি আলোকবিন্দু সম্মুখে রেখে পরিশ্রান্ত হয়ে শান্ত হতে চাই

আমি প্রায় নগ্ন কৃষ্ণকায় মানুষ,
আমি গৈরিক জানালার নীচে মাংশাসী ফুলের মত
তোমাকে গ্রাস করতে আশ্চর্য উৎসুক

আমার শাশ্বত আনন্দ হয় যখন দেখি তোমার চোখে রূপের আকর

আমি তোমার শাপে জরাগ্রস্ত হয়েছি, তুমি আমার বাধা পেরিয়ে যাও
তুমি স্থির, নিঃশব্দ রক্তমাংস, তোমার যৌনাঙ্গকে আমার প্রণতি
তোমার উন্মুখ স্তনে মুখ দিয়ে আমি ব্যবধাহীন বেঁচে রয়েছি
আমি এতদিন আত্মায় বিশ্বাসী ছিলাম, তোমায় গর্ভবতী করে রেখেছিলাম
আমি চন্দ্রমাশীতল রাত্রে খুঁজেছিলাম তোমার গাল আমার পাশে
আমি উত্তরঙ্গ জলোচ্ছ্বাসে তোমাকে ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিলাম—

সব মানুষ জন্মকাল থেকে সমান

যে কবি বলতে পারে— ‘কবিতা ছাড়া অন্য কোনও পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই’, তার নিজের কবিতা সম্পর্কে বিশ্বাসী হওয়াই স্বাভাবিক। তবু প্রকৃত কবির মতো শম্ভু জানত কবির নিয়তি। কতটা স্বচ্ছ দৃষ্টি থাকলে লেখা সম্ভব— “আমরা সকলেই পরীক্ষা দিতে বসেছি, খাতা জমা রেখে যেতে হবে, মহাকাল কাকে কত নম্বর দেবে তার ওপরেই নির্ভর করছে কবি ও কবিতার ভবিষ্যৎ। খাতা জমা দিয়ে চলে যাব, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর খাতাগুলো দেখা হবে, যদি সারবস্তু থাকে পাস করবেন, না হলে গোল্লা।” শম্ভুর পক্ষেই এই ভাষায় কথা বলা সম্ভব।

সম্প্রতি পৃথিবী ছেড়ে তার কল্পিত মহাপৃথিবীর দিকে পাড়ি দিয়েছে শম্ভু রক্ষিত, আমাদের প্রায় পঞ্চাশ বছরের বন্ধু। আমি নিশ্চিত জানি যে পরীক্ষার কথা ও বলে গেছে, সেই মহাকালের হাতে পাসমার্ক ঠিক পাবে।