হিন্দোল ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
এতদিনে করোনাকে আমার বেশ রহস্যময় এক চরিত্র বলে মনে হচ্ছে। করোনা কি আদপেই একটি ভাইরাস? না কি সে আমাদের ভিতরে থাকা আমাদের না চিনতে পারা এক অনিবার্যতা? হয়তো অসুখটা করোনায় নেই, রয়েছে আমাদের মধ্যে। হয়তো বা আমরা উন্মাদের মতো অথবা মৃত্যুর দিকে ছুটে যাওয়া অভিশাপগ্রস্ত পতঙ্গের মতো ছুটে চলেছি তার দিকে। মৃত্যুর যেমন এক একটি কারণ লাগে, তেমন, আমাদের এই অনিবার্যতার মধ্যে ঝাঁপ দেওয়ারও একটা কারণ দরকার। আর সেই কারণ হল এই করোনা। ভাবলে, মনে হয়, এই পৃথিবীর হয়তো লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন, নিজেদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মারণ এক রোগেই। কিন্তু এই রোগের সূত্রপাত কোথায়? যে রোগগুলিকে আমরা নিজেরাই বহন করছি? আমরা কি অনেক বেশি করে মরছি না আমাদের নিজেদের মধ্যে বহন করে চলা নিজেদের সভ্যতার দ্বারাই? এ পর্যন্ত এসে মনে হয়, তবে কি কাফকার সেই পোকার মতোই একদিন সকালে উঠে দেখব আমরা এক একটা ভাইরাস হয়ে গেছি?
আসলে কাজ না থাকলে যা হয়! মনের মধ্যে নানা চিন্তা ভর করে আসে। আর তার সঙ্গে যদি সঙ্গত করে একটি চূড়ান্ত কমিক মঞ্চ, তাহলে তো কথাই নেই। আর সেই মঞ্চটা যদি হয় আমাদের নিত্য ব্যবহার্য ফেসবুক, তাহলে তা দেখব না কি দেখব না করতে করতে শেষ পর্যন্ত দেখা, অংশগ্রহণ করা এবং বাজে বকায় দাঁড়িয়ে যায়। আর তখনই মনের মধ্যে এই সব চিন্তা ভর করে আসে। আবার এও বুঝি মনকে একটু উঁচু তারে বেঁধে না রাখলে কখনওই ভাল লেখা সম্ভব নয়। সারাদিন যদি মানুষের লোভ, হিংসে, প্রতিহিংসা, ছোটাছুটি, রাগ, কুচুটেপনার মধ্যে থাকতে হয়, তাহলে মনে বিষ জাগ্রত হতে বাধ্য। আর এই বিষ মনের মধ্যে যে যে ক্ষয়ের জন্ম দেয়, সেগুলির অন্যতম হল, মন সারাদিন ব্যস্ত হয়ে থাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে মানুষের নীচতাগুলিকে জানতে। অথচ মন জানে, এই নীচতাগুলিকে জানলে মনের কোনও উপকারই হবে না। কিন্তু মন ক্ষুধার্ত পিঁপড়ের মতো ছুটে যায় এই নীচতাগুলির কাছে। কিন্তু তাতে কি মন উঁচু তারে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারে? পারে না। সুতরাং শুরু হয়, নিজের যেটুকু প্রেরণালব্ধ জ্ঞান, সেটুকু জ্ঞানের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে। অথচ মন তা স্বীকার করতেও চায় না। ফলে, একটা নির্দিষ্ট পরিসরে শুরু হয় কুস্তি কুস্তি খেলা। কম বোধিসম্পন্ন, কম জ্ঞানসম্পন্ন, কম অনুভূতি সম্পন্ন মানুষেরা নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে করতে নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে, শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিজ্ঞাপনও করে। এই যে ক্ষয়, এতে মানুষের মনের রোগপ্রতিরোধক্ষমতা যে অনেকটাই কমে যায়, এ সম্পর্কে মানুষ কোনও হিসেবই করে না।
কিন্তু মনের মৃত্যুর কথা আর কবেই বা মানুষ মনে রাখে? না হলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই যে মানুষ মনের মধ্যে এক ভয়ংকর মারণ ভাইরাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিয়ে কি মানুষ আদৌ চিন্তিত? আর সে ভাইরাস হল করোনার চেয়েও ধ্বংসাত্মক। কারণ মনের মধ্যে জন্ম নেওয়া আর তীব্র সংক্রামক এই ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশে, জাতি থেকে জাতির ভিতর। এই ভাইরাসের নাম বিদ্বেষ। এই ভাইরাসের চরিত্র বিশ্বাসঘাতকতা। সন্দেহ এর মজ্জাগত। আর অপরের উপরে প্রভুত্বস্থাপন এই ভাইরাসের জীবনীশক্তি। আমরা কীভাবে মুক্তি পাব এই ভাইরাস থেকে তা আমরা জানি না। নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, প্রযুক্তির মাধ্যমে পেশীর আস্ফালন দেখাই। দর্শনকে পরিণত করি ধর্মে। ধর্ম আর ক্ষমতা এই ভাইরাসের দুই উপসর্গ। অনেক সময়েই এই দুই উপসর্গ চুপিচুপি বসে থাকে। যাকে বলে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক। তাকে চেনা যায় না, বোঝা যায় না। কিন্তু আড়ালে থেকেও ইন্দ্রজিতের মতো সে ধ্বংস করে যায় আমাদেরকেই। আমরাই এই ভাইরাসের বাহক এবং আমরাই এই ভাইরাস দ্বারা নিহত হই। আমরা কি ভাবি এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন কোথায় আছে তা নিয়ে? ভেবেছি কি আমরা ক্রমশ এবং ক্রমশ যে বিগত একশ বছরে নিজেদেরকে আরও অনেক বেশি ছোট করে ফেলছি, তা নিয়ে? মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই, ধর্মকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদ উঠেছে এক মারণ ব্যাধির মতো, হয়ে উঠেছি চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক। আমাদের মধ্যে গত একশ বছরে সম্ভবত সেই মাপের কোনও প্রতিভার জন্মও হচ্ছে না এই কারণেই। কিন্তু তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। মনের এই ভাইরাসের সঙ্গে সহবাস করতে করতে আমরা যে ক্রমশ মানবপ্রজাতি থেকে ভিন্ন এক আত্মধ্বংসী প্রজাতি হয়ে উঠেছি, তা নিয়ে আমরা নিজেরা খুব আশঙ্কিত নই। বরং ব্যাধিকে ‘ব্যাধি’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আমাদের যথেষ্ট আপত্তি আছে। যখন আমরা দেখি চরম উন্নত শহর, চরম গতিশীল সভ্যতা, চরম আত্মকেন্দ্রিক অথচ আড়ম্বরে সাজানো জীবন, আমরা তাকে ব্যাধি হিসেবে দেখি না। দেখি সমৃদ্ধি হিসেবে।
তাহলে কি এই ভাইরাস আমাদের দেখার ক্ষমতাকেও সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে দেয়? আমরা যা দেখতে চাই, তা আমরা দেখতে পাই না, যা দেখতে পাই, তা দেখতে চাই না। কিন্তু আমরা যা দেখি, তা বিশ্বাস করি। শুধু তাই নয়, সেই বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই রচিত হয় আমাদের স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে এই মারণ ভাইরাস। আমাদের বশ করে ফেলে। আমাদের স্বপ্নের বাস্তবতার মধ্যে এই ভাইরাস তার নানা মায়াবী রূপ তুলে ধরে। একেই কি কবি সবুজ ডাইনী বলেছেন? করোনা, এই ভাইরাসের কাছে অতি তুচ্ছ। করোনা, এই ভাইরাসের এক রূপ মাত্র। এক বাহ্যিক রূপ। যেমন আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা একধরনের বাহ্যিক রূপ, যেমন আমাদের প্রযুক্তি একধরনের বাহ্যিক রূপ এই ভাইরাসের, তেমনই করোনা ওই ভাইরাসেরই একধরনের বাহ্যিক রূপ। শুধু সমস্যা হল্, করোনাকে বাগে আনতে পারছে না আমাদের মানবমস্তিষ্ক। সে হঠাৎ হাতের বাইরে চলে গেছে। যেমন একটা সময় হাতের বাইরে চলে গেছিল পরমাণু বোমার কৌশল। আর তার পর আজ পর্যন্ত তার কুফল আমরা হয় প্রত্যক্ষ ভাবে, নয় পরোক্ষভাবে ভোগ করছি।
হিরোশিমা নাগাসাকির পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের মতোই হয়তো, করোনা ভাইরাসের দাপট কমে আসবে। কিন্তু দাপট কমবে না মনের মধ্যেকার সেই ভাইরাসের। করোনার আগেও, করোনা থাকাকালীনও এবং সম্ভবত করোনার পরেও যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা বহাল থাকবে বলে মনে হয়। মানবপ্রজাতি নিশ্চিহ্ন করাই যার উদ্দেশ্য।
কিন্তু আমরা কি পারব না তার বিরুদ্ধেই এক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে?
(ক্রমশ)