Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্যালেটবিদ্ধ অডিও পোস্টকার্ডের শব্দেরা: উজমা ফলকের কথা ও কবিতা

উজমা ফলকের কথা ও কবিতা -- সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, সোহেল ইসলাম

সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

 

কবিতার অনুবাদ: সোহেল ইসলাম

 

অপারেশন ক্যাচ অ্যান্ড কিল জিন্দাবাদ
অপারেশন হৃদয় এবং মন জিন্দাবাদ
অপারেশন সদভাবনা জিন্দাবাদ
অপারেশন সম্প্রীতি জিন্দাবাদ
অপারেশন শুট টু কিল জিন্দাবাদ
অপারেশন কাম ডাউন জিন্দাবাদ
অপারেশন সঙ্গম জিন্দাবাদ
অপারেশন অল আউট জিন্দাবাদ
অপারেশন মৈত্রী জিন্দাবাদ
অপারেশন উজালা জিন্দাবাদ
কর্ডন এবং সার্চ জিন্দাবাদ…

পরিচয় করিয়ে দিই। এটা উজমা ফলকের লেখা অডিও পোস্টকার্ড-এর একটা অংশ। কয়েকদিন হল এসে পৌঁছেছে। উজমা যে কবি সেটা নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝেছেন। কিন্তু ও মোটেই শুধু একজন কবি নয়। সত্যিকারের কাশ্মিরের রক্তক্ষরণ নিয়ে উজমা নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর করেন, তথ্যচিত্র বানান… উজমা মানেই আরও অনেক কিছু। এক কথায় উজমা অসম্ভব… নতুন ভাবনা বা উপস্থাপনায় অনবদ্য। ওর কবিতা পড়তে পড়তে আমার কেন জানি মনে হয় ওর মাথার ভেতর একটা স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান রয়েছে, বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে সব সময় খুঁজে চলেছে শত্রুকে… আর আচমকা সামনে পড়লেই নিমেষে বেরিয়ে আসে ওর হাজার হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেইসব শব্দেরা, যারা নাগা রেজিমেন্টের থেকেও তীক্ষ্ণ এবং ক্ষিপ্র।

উজমাই আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় কাশ্মিরের প্যালেট গানের হিংস্রতা, প্যালেট আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হামিদের সঙ্গে। হামিদ ছিল উত্তর কাশ্মিরের বাসিন্দা, দশম শ্রেণির এক ছাত্র। ঘটনার সময় পালহালানের এক টিউটোরিয়ালে সে পড়তে যাচ্ছিল। সে সময় একদল মানুষ ১৯৯০র ২১মে-তে হাওয়াল গণহত্যার ২৫ বর্ষ পূর্তিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। হাওয়ালের সেই ঘটনাটি ছিল আসলে এক ধর্মীয় নেতার শেষকৃত্যের মিছিল, যে মিছিলে অংশগ্রহণকারী ৬০ জন শোকার্ত মানুষকে ভারতীয় সেনা এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে। সেই গণহত্যার ২৫ বর্ষ পূর্তির বিক্ষোভকে হটাতেই সেদিন সেনা যে প্যালেট ছোঁড়ে তাতে হামিদের মাথা ও মুখ কয়েক ডজন প্যালেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। হামিদকে দ্রুত পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেনা রাস্তা অবরোধ করে রাখার কারণে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। এক ঘণ্টা পর তার পরিবার তাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে, কিন্তু ক্রমাগত তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ফলে তাকে আরও দুটো নার্সিংহোমে স্থানান্তরিত করতে হয়। তার মাথার ভেতর ২টি এবং স্কালে ১০০টিরও বেশি প্যলেট আটকে ছিল। ডাক্তাররা অপারেশন করেও তার ডান চোখ বাঁচাতে পারেনি।

প্যালেট গান শব্দটা শুনলে অনেকটা খেলনার মত মনে হয়। কিন্তু প্যালেট গান বন্দুকের বুলেটের থেকেও মারাত্মক। এবং প্যালেট গানের কারণে তৈরি ক্ষত আক্রান্তকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দেয়। সাধারণভাবে ক্ষত চোখেই পড়ে না বা খুবই ছোট বলে মনে হয়। নির্দিষ্ট কোনও জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এতটাই বিস্তৃত থাকে যে চিকিৎসা করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্যালেট গান চলে মূলত কম্প্রেসড এয়ার মেকানিজম পদ্ধতিতে। এর একটা কার্ট্রিজের ভেতর ৫০০ ছোট ছোট বল বিয়ারিং-র মত প্যালেট থাকে, গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো প্রচণ্ড গতিতে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত শিকারিরা এগুলো ব্যবহার করে। এই ধরনের এ্যমুনেশন কখনওই বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর ব্যবহার করার জন্য তৈরি হয়নি। ২০১০-এর ১৪ আগস্টে সোপোরেতে প্রায় ৩০০০ বিক্ষোভকারী যখন রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ক্যাম্প আক্রমণ করে তখন জম্মু-কাশ্মির পুলিশ প্রথম প্যালেট গান ব্যবহার করে। এবং সেই প্যালেট গানের কারণে সে বছর ১২০ জন কাশ্মিরী মারা যায়। তার সঙ্গে সঙ্গে ৭০০র মত মানুষ চিরদিনের মত অক্ষম হয়ে যান, যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের হয় একটা অথবা দুটো চোখই অন্ধ হয়ে যায়।

প্যালেট গানের কারণে আহতদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কাশ্মিরের হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো এই ধরনের চিকিৎসার জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। বেশিরভাগ আক্রান্তকেই কাশ্মিরের বাইরের হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু আর্থিকভাবে বেশিরভাগ পরিবারই অসমর্থ হবার কারণে তাদের কোনও চিকিৎসাই হয় না। তাছাড়া চিকিৎসা হলেই যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে এমন কোনও গ্যারান্টিও নেই। আরও একটা বড় সমস্যা হল, যেহেতু প্রতিটি বড় হাসপাতালে পুলিশের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকে, সেকারণে গ্রেফতারি বা হয়রানির ভয়ে অনেকেই ওই জায়গাগুলো এড়িয়ে চলে।

২০১৬র জুলাইয়ে বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পরবর্তী ৭ মাসে প্যালেট গানের কারণে আহতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৬০০০-এরও বেশি, যাদের মধ্যে ৭৮২ জনের আঘাত মূলত চোখে। আর একটি উল্লেখ করার মত বিষয় হল যারা আহত হচ্ছেন তারা যে প্রত্যেকেই বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত তা একেবারেই নয়। যেমন সাবকাল নাজির ওয়াসেম, ২৫ বছরের ওয়াসেম বিজবেহেরার বাসিন্দা। ঈদের নামাজের দিনে সে আক্রান্ত হয়েছিল। তার শরীরের উপরের অংশে ১০০র মত প্যালেট ঢুকেছিল, সে এখন পুরোপুরি অন্ধ। ওই একদিনে আরও ৪ জন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ১০ বছরের অনন্তনাগের বাসিন্দা আসিফ আহমেদ শেখের ডান চোখে প্যালেট ঢুকে গিয়েছিল। সে চোখে সে আর দেখতে পায় না। সে কারণে এখন ইস্কুলে পড়াশুনো করতে আসিফের খুব অসুবিধে হয়। ১৮ বছরের ফৈজ ফিরদৌজের শরীরে ২০টি প্যালেট ঢুকেছিল, যার মধ্যে দুটো ঢুকেছিল তার ডান চোখে। ফৈজের এখন একটাই জিজ্ঞাসা, “কেন আমাকে নিশানা করলো ওরা, কী দোষ ছিল আমার, কেন আমার জীবনটা… ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে দিল ওরা?”

বিক্ষোভকারী ছাড়াও প্যালেটের কারণে কাশ্মিরে সাধারণ যে কোনও মানুষ, যে কোনও সময় যে আহত হয় তার সব থেকে ভালো উদাহরণ শ্রীনগরের ফতেহ কাদাল এলাকার ১৭ বছরের হারিশ আহমেদ। ২০ আগস্টের (২০১৯) ঘটনা, সে এখনও শের-ই-কাশ্মির মেডিকেল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মাথা, মুখ, ঘাড়, এমনকি পাকস্থলির বাইরের পর্দা.. শরীরের এমন কোনও জায়গা নেই যে প্যালেট ঢোকেনি। সে যে কীভাবে এখনও বেঁচে আছে সেটা ভেবেই ডাক্তাররা অবাক। কিন্তু কীভাবে ঘটল ঘটনাটি, হারিশের অপরাধই বা কী? সে রাতে সাড়ে ৯টা নাগাদ হারিশ খাওয়ার পর কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনতে বেরিয়েছিল। সে তার বন্ধুদের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে দোকানের সামনে যায় এবং বন্ধুরা সকলে মিলে মোবাইলে গেম খেলতে শুরু করে। হঠাৎই একটা পুলিশের গাড়ি ওদের পাশ দিয়ে যায় এবং তারপরই একটা গুলি চলার শব্দ হয়। ওর বন্ধুরা আহমেদকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে। পুলিশের গুলি চালানোর পেছনে যুক্তি হল সেদিনটা নাকি ছিল ৩৭০ ধারা বিলোপের ২০তম দিন, সে কারণে জনগণের চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। এরকম একটা নিষিদ্ধ পরিস্থিতিতে পুলিশের কাছে বন্ধুদের সঙ্গে মোবাইলে গেম খেলাটাও তাই অন্যায়। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আহমেদই সবচেয়ে বড়। বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য সে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করত। কিন্তু আচমকাই আহমেদের জীবনটা একটা রাতের ঘটনায় আমূল বদলে গেল, আহমেদ কবে সুস্থ হবে, সুস্থ হলেও চোখে দেখতে পারবে কিনা এখন কেউ জানেন না।

একইরকম ঘটনা ঘটেছে ১৬ বছরের অনন্তনাগের আকুব জাহোর পামপোর, সহেরির ৩৫ বছরের সাকেলা বেগম, অনন্তনাগের ২৬ বছরের হাবিদ হুসেন কাসাব, ২৩ বছরের বারামুল্লার মহম্মদ আসিফ ডার, আচাবালের ১৬ বছরের শাহিদ আহমাদ ওয়ানি, ১৫ বছরের সোপিয়ানের ইনশা মালিকের মত আরও অনেকের সাথে। আকুবের বাঁ-চোখের রেটিনায় প্যালেট ঢুকে যাবার কারণে তার বাঁ-চোখে এখন শুধুই অন্ধকার। সাকিলার ক্ষেত্রে কয়েক ডজন প্যালেট ওর বুকে, মুখে ঢুকে গিয়েছিল। বিশেষ করে বাঁ-চোখে একটা আর ডান-চোখে দুটো প্যালেট ঢুকে যাবার কারণে এখন মাত্র ১০ শতাংশ দৃষ্টিশক্তি রয়েছে সাকিলার। হাবিদ আর ডানচোখে দেখতে পায় না। আসিফ আগে ক্রিকেট খেলত। কিন্তু আটবার অপারেশনের পরেও আসিফ মাত্র ১০ শতাংশ দেখতে পায়। শাহিদের শরীরে ৯৩টি প্যালেট ঢুকেছিল, তার মধ্যে বাঁ-চোখে ঢুকেছিল ২টো। তিনবার অপারেশনের পরও এখন সে শুধু যে কোনও কিছুর একমাত্র ছায়াই দেখতে পায়। ইনশার ঘটনাটা আরও অবাক করা। ইনশা যখন আক্রান্ত হয় তখন ও রাস্তাতেও ছিল না বা ওর গ্রামে ওই সময় কোন প্রতিবাদও চলছিল না। ও ছিল বাড়ির দোতলায়। ঠিক তেমনি একটা মুহূর্তে জানলা লক্ষ্য করে প্যালেট ছেড়ে সেনারা। প্যালেট লাগার সঙ্গে সঙ্গে ইনশা আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে যায়। এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওর মুখ ফুলে যায়। এরপর ইনশা তিনদিন অজ্ঞান ছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার ইনশাকে দেখেই বলেন, “ওর বাঁ-চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, ডান চোখের ক্ষেত্রেও সঠিক কিছু বলা যাবে না”। ইনশা এখন কেমন আছে আমরা জানি না, তবে অন্য কারও সাহায্য ছাড়া যে সে চলতে পারে না সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

এই প্যালেট বিষয়টা সত্যিই বড় অদ্ভুত। প্রাথমিকভাবে প্যালেট আক্রান্ত কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার শরীরের ভেতরে প্যালেট রয়ে গেছে। একমাত্র এক্স-রেতেই সেটা ধরা পড়ে। তাছাড়া চিকিৎসকরাও মনে করেন প্যালেটগুলো বের করাটা খুবই বিপজ্জনক। সেকারণে ক্ষতিগ্রস্তের দেহে সেগুলো অন্ধত্বের মতই স্থায়ীভাবে থেকে যায়। সবথেকে বড় কথা সারা বিশ্বের অনেক মানবাধিকার সংগঠনই মনে করেন, এই অস্ত্রটি মোটেই ব্যবহার করা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী এর ব্যবহার কোনওভাবেই মান্যতা পায়। আইনানুযায়ী একমাত্র দোষীকেই তুমি তোমার লক্ষ্যবস্তু করতে পারো। কিন্তু প্যালেট গানের ক্ষেত্রে যেহেতু প্যালেটগুলো যেকোনও দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেহেতু কে আহত হবে কে হবে না সে গ্যারান্টি কোনও কর্তৃপক্ষই দিতে পারবে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় অন্ধত্বের মত এরকম ভয়ানক পরিণতি সত্ত্বেও এই অস্ত্রগুলির ব্যবহার বন্ধ করবার জন্য আন্তর্জাতিক প্রেসার তৈরি করতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। ড্রোন, মিসাইল বা পুলিশ যে ধরনের অস্ত্র আজকাল বাবহার করে সে হিসেবে প্যালেট গানকে ক্ষুদ্র বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু এতক্ষণ যাদের কথা, যাদের পরিণতি আমরা শুনলাম তারপরও কী মনে করা যায়, প্যালেট গান “নন-লেথাল”?

 

এরপর উজমা আমাদের পরিচয় করাতে নিয়ে যায় হাসপাতালের বেডে শোওয়া ৯ বছরের এক প্রাইমারি ছাত্র আমির আহমেদ আহানজের সাথে, আসলে পরিচয় করাতে নিয়ে যায় টিয়ার গ্যাসের বীভৎসতার সঙ্গে। ২০১৫র ৯ অক্টোবর উধমপুর জেলাতে মুসলিম ট্রাক ড্রাইভারকে পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে ১১ অক্টোবর শ্রীনগরের পুরোন শহরে সাধারণ মানুষ যখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন সে সময় আমির সে পথ দিয়েই দুধ আনতে যাচ্ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পুলিশের ছোঁড়া টিয়ার গ্যাস সোজা এসে লাগে আমিরের শরীরে। আমিরের হাত পুড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায়। তার মুখ ও চোখের কর্নিয়াও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমিরের আঘাত টিয়ার গ্যাসের কারণে নাকি ফ্ল্যাশ ব্যাঙ্ক গ্রেনেডের কারণে তা নিয়ে অনেকের মত ডাক্তারাও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে টিয়ার গ্যাসের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। ২০১০ জুনের একটি ঘটনায় তুফেল আহমেদ মাত্তো নামে একজনের মাথায় টিয়ার গ্যাসের ক্যানেস্টার সোজাসুজি এসে লাগে এবং মাত্তো সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ২০১৬র আগস্টে নাউহাট্টায় ১৮ বছরের ইরফান আহমেদের বুকের দিকে টিয়ার গ্যাসের শেল সরাসরি এসে লাগে এবং ইরফানের মৃত্যু হয়। পরের মাসেই কুলগাম জেলার আরেক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ার কারণে মারা যায়।

 

এর পরের বিষয় ‘চরবৃত্তি’। পুলিশ কিভাবে কাশ্মিরী শিশু-কিশোরদের চর হবার জন্য বাধ্য করছে সেটা দেখাল উজমা। যে ছেলেটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল তার নাম ডেনিস। ডেনিসকে পুলিশ প্রথম তোলে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগে। টানা ৮ দিন পুলিশ ওর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালায়। তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শুরুটা হয়েছিল অনেকটা এরকম… একটা ল্যাপটপে পাথর ছোঁড়ার ভিডিও দেখিয়ে ডেনিসকে অপরাধীদের শনাক্ত করতে বলে পুলিশ। কিন্তু চুপ করে থাকবার জন্য ওর ওপর টর্চার চালায় পুলিশ। পুলিশ তাকে রাতের তল্লাশিতে যাবার জন্যও জোর করে। ডেনিস প্রাথমিকভাবে পুলিশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু বিশেষ করে দুজন কিশোরের ঠিকানা না বলা পর্যন্ত পুলিশ ওর ওপর টর্চার চালাতেই থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ওই দুই কিশোর ডেনিসেরই বন্ধু ছিল। পুলিশ জিপে থাকবার সময় ডেনিসের হাই ফিভার শুরু হয় এবং তার অবস্থার অবনতি হয়। এরপর আদালতে তোলার আগে পুলিশ তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায় এবং সে যেন তার স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়ে কোনরকম কিছু আদালতে না প্রকাশ করে তা নিয়ে সতর্ক করে দেয়। আদালতকে বিভ্রান্ত করার জন্য পুলিশের নির্দেশ মত ডেনিসকে বলতে হয় মাত্র চারদিন হল সে পুলিশি হেফাজতে রয়েছে। আদালত অবশ্য সব শুনে ডেনিস সহ চার কিশোরকে জামিন দিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরও তাকে অন্য একটা থানার লকআপে ৮ দিন আটকে রাখা হয়। তার পরিবারকে পর্যন্ত কোনও খবর জানানো হয় না। রাগে দুঃখে সেই দিনগুলোতে ডেনিস লকআপের দেওয়ালে মাথা ঠোকে, চিৎকার করে। কিন্তু কেউ শোনেনি ডেনিসের চিৎকার। শনাক্ত করবার জন্য আবার তাকে নতুন করে চাপ দেওয়া শুরু হয়। সে বলে, “একজন পুলিশ আমার মাথায় আঘাত পর্যন্ত করে। আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়। আমার প্যান্ট পর্যন্ত ওরা খোলার চেষ্টা করে কিন্তু আমি বাধা দিই। আমার জামা খুলে আমার বগলে ওরা লঙ্কার গুঁড়ো ঘষে দেয়। কোনও ওষুধ পর্যন্ত তারা আমাকে দিতে অস্বীকার করে। পুলিশ আমাকে ভয় দেখায় যে তারা আমার বিরুদ্ধে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের অভিযোগ দায়ের করবে। তারা আমার ওপর পুলিশ কর্তাকে বোমা মারার ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছিল। পরে আবার সেটা পাল্টে ওদের বাঙ্কারে বোমা মারারও অভিযোগ করেছিল। ওরা যে কীভাবে মিথ্যাচার করে তা অবিশ্বাস্য। প্রতিদিন সকাল হলেই ওরা আমার মুখের সামনে একটা খবরের কাগজ ঝুলিয়ে দিত। আমার পরিবারকে ভয় দেখাবার ওটাই ছিল ওদের একটা পদ্ধতি। পুলিশ আমার ওপর এতটাই নজরদারি চালিয়েছে যে আমি আমার ফোন নম্বরটা পাল্টাতে বাধ্য হই। গ্রেফতার হওয়া অন্য ছেলেদের সঙ্গে আমার ভুলবোঝাবুঝি তৈরি করবার জন্য পুলিশ ওদের বলে, আমি নাকি পুলিশের খোঁচোড়… পয়সার বিনিময়ে এই কাজ করি। এবং মিথ্যাটাকে সত্যি বানাবার জন্য ওদের সামনে পুলিশের একজন আমার কাঁধে হাত রেখে খোশগল্প করার ভাব করে। আসলে আমাদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস, আর ভুলবোঝাবুঝি তৈরি করাটাই ছিল পুলিশের মূল উদ্দেশ্য।” পুলিশ যাতে কিছুতেই তার নাগাল না পায় তার জন্য সে তার সিমটা পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছিল।

ডেনিসের ঘটনাটি একটা উদাহরণমাত্র। কিন্তু একক বা বিচ্ছিন্ন নয়। কাশ্মিরে এরকম জোর করে পুলিশের চর বানাবার চেষ্টা অহরহ হয়ে থাকে। এবং তার জন্য অনেক কাশ্মিরী কিশোর বা যুবককেই শারীরিক বা মানসিক লাঞ্ছনা সইতে হয়।

 

“মিস্টেরিয়াস কিলিং” অর্থাৎ রহস্যজনক হত্যা বিষয়টি কী তার সন্ধান দিতে উজমা আমাদের সামনে খুলে ধরে ২০১৫র মে মাস। নিয়ে চলে উত্তর কাশ্মিরের সোপোর-এ। আমরা দেখি অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাহিনীর হাতে ২২ দিনে ৬ জনকে খুন হতে। যোগাযোগ পরিষেবাকে লক্ষ করে উত্তর কাশ্মিরের একের পর এক টেলিযোগাযোগ পরিকাঠামোর ওপর হামলা চলেছিল সে সময়।

২৫ মে রফিক আহমেদ নামে টেলিকমিউনিকেশনের এক সেলস রিপ্রেজেন্টিটিভকে তার কেবিনের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন একইভাবে গোলাম হাসান দার নামে এক ফল ব্যবসায়ী নিজের বাড়িতে নিহত হন। তার বাড়ির উঠোনে একটা সেলফোনের টাওয়ার ছিল। ৯জুন বাড়ি ফেরার পথে শেখ আলতাফ উর রহমান খুন হন। যিনি একটা সময় কাশ্মিরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঘটনার কয়েকদিন আগেই পুলিশের স্পেশাল গ্রুপ তাকে জিজ্ঞাসবাদ করেছিল। ১৪ জুন প্রাক্তন মিলিটেন্ট মেহরাজ উদ্দিন তার বাড়ির কাছে নিজের মুরগির দোকানেই খুন হন। আইজাজ আহমেদ জঙ্গি সন্দেহে ২০০৬ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন, ১২ জুন সেই মামলার শুনানিতে যোগ দেবার জন্য আদালতে যাবার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। প্রতিটি খুনের সঙ্গেই অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীর যোগ রয়েছে।

পুলিশ বলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে হিজবুল মুজাহিদিনের থেকে বেরিয়ে আসা একটা অংশ লস্কর ই ইসলাম দায়ী। কিন্তু সোপোরের বাসিন্দারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। বিভিন্ন অ্যাক্টিভিস্টরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য “সন্ত্রাসবাদীদের দিয়েই সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করার কাজে লাগানো উচিত”— প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্যকেই দায়ী করেন। এবং এই মন্তব্য ৯০ দশকের ‘ইখওয়ান’-এর সেই বীভৎস দিনগুলোর কথাই আবার মনে করিয়ে দেয়।

ধারাবাহিক খুনের এই ঘটনার কারণে বেশ কয়েকটি পরিবার সোপোর ছেড়ে চলে যায়। এবং অন্যরাও আক্রমণের আশঙ্কায় ভয়ে ভয়ে দিন কাটান। দীর্ঘ নীরবতার পর সরকার তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুলিশ সন্দেভাজনদের পোস্টারও প্রকাশ করে, এবং সকলকে অবাক করে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে পাশের জেলার এক ব্যবসায়ীর ছবি ছাপে তারা। এবং আততায়ীকে খোঁজার অজুহাতে পুলিশি তল্লাশি এতটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয় যে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রমজান মাসে। কিন্তু এত কিছুর পরও আততায়ী অধরাই রয়ে যায়। “রহস্যজনক হত্যা” শীতের কুয়াশার মতই আলো-আঁধারি রহস্যেই হারিয়ে যায়, যেভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছে কাশ্মিরের হাজার হাজার যুবক।

এই পর্যন্ত এসে মনে হতে পারে উজমার কাহিনি বোধহয় এবার শেষ হল। কিন্তু না, উজমার কাহিনি এত সহজে শেষ হবার নয়। কারণ এ দেশের রাষ্ট্রনীতির কারণে কাশ্মিরের আরও কত প্রজন্মকে যে আরও কত ধরনের নরকযন্ত্রণা সইতে হবে কে জানে। আর সেকারণেই হয়ত সেইসব কাহিনি নিয়ে উজমাকে, উজমার মত আরও অনেককেই আবার ফিরে আসতে হবে আপনাদের কাছে।

 

উজমা ফলকের নির্বাচিত কিছু কবিতা

অনুবাদ: সোহেল ইসলাম

১.

আমার শোক
পিঁপড়েরা ভাগ করে নিচ্ছে
হাঁটুমুড়ে বসে
দুঃখ প্রকাশ করছে— আমার জন্য

 

২.

আমি যখন পিঁপড়ের মত হুড়োহুড়ি করে ছুটতে থাকি
রাস্তায় চলতে শুরু করেই পড়ে যাই
নিজেকে বোঝাতে শুরু করি―
চেষ্টা করো… চেষ্টা
আবার চেষ্টা করো
বাবার জন্য
বাবার দীর্ঘস্বপ্নের জন্য

 

৩.

একা বসে আছি
কাছেই হাড়হিম করা
সেনাট্রাকের শব্দ
রাস্তার কুকুররাও চুপ মেরে গেছে
হঠাৎ মনে হল–
ট্রাকটা যেন কাদা ছিটিয়ে চলে গেল
দেখলে মনে হবে
গণহত্যার ছবি

রাত কিছুতেই ফুরোতে চায় না
শেষের অপেক্ষা নিয়ে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি
পাশে সঙ্গী তখন মেষশাবক

উপরে তাকাতেই
আকাশটাকে ক্যানভাস মনে হল
চোখ দিয়েই আঁকতে লাগলাম
কবরের গায়ে বৃষ্টি ঝরার ছবি
কবরের নম্বর… ১,৪০,১০০
“সত্যিই তিনি করুণাময়, যেই তুমি নিরাশ হতে আরম্ভ করবে,
ওমনি তিনি অনুগ্রহের বৃষ্টি নিয়ে হাজির…”
ও মুসাফির
ও আমার প্রিয় শিল্পী
আপনি কি আবার আঁকবেন আমাদের?
ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির মতন
যেভাবে স্মৃতি ফিরে আসে ধ্বংসের মুখ থেকে

আমার মন তো পাঁচিল ঘেরা পোড়া বাড়ি
যার উঠোনে
আইভি গাছ বেড়ে উঠছে
অবাধে… সঙ্গীহীন

 

৪.

ডাক এসেছে

সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাব এবার
শুধু আমার সালামকে পৌঁছে দিও তোমরা
এই চলে যাওয়াই সাক্ষী হয়ে থাকবে
কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়
আবার দেখা হবে আমাদের

 

৫.

হাতে তুলে নিয়েছি বুলেট
নিজেই বেছে নিয়েছি এই পথ
জীবন মানেই তো জোয়ার-ভাঁটা
আমাকে ক্ষমা করবেন
বন্ধুরাও ক্ষমা কোরো
যদি কখনও কোনও জুলুম করে থাকি

প্রার্থনা করি
আমার মৃত্যুই যেন আমার হয়ে সাক্ষ্য দেয়

 

৬.

এ কবিতা অহিংসার নয়
এ কবিতা নয় শান্তি প্রতিষ্ঠার
এমন কি শান্তিপূর্ণও নয়
এ কবিতা নয় রাস্তা পেরোনোর
এ কবিতা নয় আরোগ্য নিকেতনের
এ কবিতা মোটেও অসামরিক নয়
এ কোনও সাধারণ কবিতা নয়
এ কবিতা নয় নন্দনকানন
এ কবিতা নয় কোনও দ্বন্দ্বের

এ শুধু শ্বাস নেওয়া এবং
শ্বাস ছাড়ার কবিতা

এ কবিতা হিংসাত্মক
এ কবিতা প্রবলভাবে সশস্ত্র
এ কবিতা আন্দোলনের, মাটির
এ কবিতা ভূগর্ভস্থ
এ কবিতা অধিকারসর্বস্ব
এ কবিতা প্রতিরোধী
এ কবিতা শ্বাসরুদ্ধকর

এ হল ভিড়ের কবিতা
এ কবিতা সন্ত্রাসবাদী, অশিক্ষিত, চরমপন্থী
এ হল সংগ্রামের কবিতা

এটা কোনও কবিতাই নয়