সৌগত ভট্টাচার্য
“মা! ভাইকে সময় মত ডেকে স্কুল পাঠাস!”— সুলেখা পিঙ্কিকে বলে। ঘুমন্ত ছেলের কপালে একটা চুমু খেয়ে পিঙ্কির মাথায় একবার হাত ছুঁইয়ে সুলেখা সাইকেল নিয়ে চার কিলোমিটার দূরের স্টেশনের দিকে রওনা হয়। আটটা সাতের ক্যানিং লোকাল ধরতে না পারলে কাজে পৌঁছানো মুশকিল হয় ওর। সাইকেলটা কোনওমতে স্ট্যান্ডে রেখেই ঘাম মুছতে মুছতে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায় সুলেখা। এসময় লেডিস কামরায় পা রাখার জায়গা থাকে না। তবু ট্রেনের দুলুনিতে চোখ লেগে আসে সুলেখার। ট্রেন শিয়ালদা সাউথের আউটারে ঢুকলে সিন্থেটিক শাড়ির কুচি ঠিক করে ভীড় ঠেলে দরজার সমানে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। রানিং ট্রেন স্লো হয়ে প্ল্যাটফর্ম ছুঁলেই মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে চায় সুলেখা। ট্রেন থেকে নেমেই শিয়ালদা মেইনের ‘সুলভ শৌচালায়’-এর দিকে দৌড় লাগায় সে। টয়লেটে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ায় সুলেখা। ঘাড়ের রেক্সিনের ব্যাগ থেকে একটা বড় মেরুন টিপ কপালে পরে, তারপর একে একে লাল মোটা চুড়ি, কানের দুল, প্রতিদিন ব্যবহারে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া লালচে লিপস্টিক লাগিয়ে দুটো ঠোঁটকে ঘষে নেয়। একটু এদিক ওদিক তাকিয়েই সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুরের ছোঁয়া দেয়, কয়েকশ জোড়া চোখের সামনে সুলেখা প্রতিদিন এক নিঃশব্দ ব্যস্ততার অভিনয় করে সে। শিয়ালদা নর্থ থেকে বেরিয়ে ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে এমজি রোডের ক্রসিংয়ে এসে দাঁড়ায় বাসের জন্য। ব্যস্ত সুলেখা সাজলে মুখের রেখাগুলো আরও স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে সুলেখা পাড়ার মোড়ে মুদি দোকানে সাইকেল নিয়ে দাঁড়ায় বাজার নেওয়ার জন্য। ব্লাউজের ভেতরে রাখা ব্যাগের ভেতর থেকে টাকা বের করে দোকানের পাওনা মিটিয়ে, বাজারের ব্যাগটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলায়। সাইকেলটা পিঙ্কির স্কুল থেকে দেওয়া। পিঙ্কিই সুলেখাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে বছর সাঁইত্রিশের সুলেখার শরীরের খাঁজ মাপে স্বপন। স্বপনের দিকে না তাকিয়েও স্বপনের দৃষ্টি সে বুঝতে পারে। ওর শরীরে রহস্য লেগেছে ইদানীং! সুলেখা সেটা জানে।
খোকনের বন্ধু ছিল স্বপন। খোকন যখন এনআরএসে ভর্তি, স্বপন প্রায়ই দেখা করতে আসত। টাকা নেই কড়ি নেই হাড়ে চামড়ায় শীর্ণ শরীরের সুলেখা এনআরএসের সিঁড়ির নিচেই রাত কাটাত। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, বাড়ির কাউকে সব সময়ের জন্য থাকতে। প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পরে থাকা বৃদ্ধ শ্বশুর আর দুটি ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কেই বা আছে সুলেখার তিনকুলে। গ্রাম থেকে মেডিক্যাল কলেজে যাতায়াতের সময় সুলেখা প্রথম কলকাতা দেখে। কলকাতাতে কাজ থাকলে ফেরার পথে স্বপন এসে হাসপাতালে দেখা করে যেত খোকনের সঙ্গে। খোকন চলে যাওয়ার পর স্বপনের চোখ দুটোই বদলে গেছে।
মোড়ের মাথার দোকান থেকে সুলেখাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা খুবই সরু। এই রাস্তাটুকু অন্ধকারে ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরে সুলেখা। খোকন থাকাকালীন সন্ধের পর বাড়ি থেকেই কখনও একা বেরোয়নি সে। গত বছর এমনই এক সন্ধ্যায় খোকনের ডেডবডি এই সরু রাস্তা দিয়ে অনেক কষ্ট করে আনা হয়েছিল বাড়ির উঠানে। ফোনে কী কথা বলছে শোনার চেষ্টা করেও শুনতে না পেয়ে, “সুলেখা নাকি…” বলে পাশের বাড়ির গণেশের মা ডাকে। সুলেখা দাঁড়ায়। “ফিরতে এত দেরি হল…?” জিজ্ঞেস করে গণেশের মা। “সামনে পুজো তাই কাজের চাপ বেশি…” সাইকেল স্ট্যান্ড করতে করতে সুলেখা বলে। “অ! তুই তো আজকাল খুব ওভারটাইম মারছিস দেখছি, অন্ধকারের আগে বাড়িই ফিরিস না!” সুলেখা কী কাজ করে সেটা কলোনির লোকের কাছে স্পষ্ট না। সুলেখাও নিজের কাজ নিয়ে মুখ খোলেনি। শুধু বলে “সেলসের কাজ!” অস্পষ্টতা সন্দেহ বাড়ায়! ভোলা সারাদিন পর মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে।
সন্ধ্যায় পিঙ্কি আর ভোলা পাড়ার কোচিংয়ে কাছে ‘অল সাবজেক্ট’ পড়তে যায়। দিনে স্কুলে মিড ডে মিলে খায় ওরা। শুধু রোববার মা ছেলে মেয়ে এক সাথে খেতে বসে। রান্না করে শ্বশুরকে ওষুধ দিয়ে, খেতে দিয়ে, কাজ সেরে সুলেখার বিছানায় যেতে অনেক রাত। সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীর আর চোখে ঘুম নিয়ে ভোলাকে জড়িয়ে ধরে সুলেখা। খোকন চলে যাওয়ার পর রাতগুলো যেন ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে ওঠে সুলেখার। শুয়ে সুলেখার মনে পড়ে অনামিকা দিদিমণির সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। উনি খুব ভালোবাসেন ক্লাস নাইনের পিঙ্কিকে। বই দিয়েছেন অনেক। খোকন চলে যাওয়ার পর বাড়িতেও এসেছিলেন। নিজে ডেকে খোঁজখবর নেন সবসময়। প্রথম দেখে সুলেখা ভেবেছিল মাঝবয়সি দিদিমণি হয়ত ওরই মত স্বামীহারা। সাদা সিঁথি, খালি হাতে ঘড়ি ছাড়া অন্য গয়না বা সধবার সাজ নেই। কিন্তু ওনার ছেলে মেয়ে স্বামী নিয়ে সংসার। পিঙ্কি বলেছিল দিদিমণি বলেন যে এগুলো আসলে সংস্কার। অপ্রয়োজনীয় চাপিয়ে দেওয়া সমাজের। আরও অনেক কঠিন কথা নাকি যা পিঙ্কিও ভালো বোঝেনি। কিন্তু দিদিমণি মানুষটা খুব ভালো। অনেক কিছু জানার আছে ওনার কাছে সুলেখার। যাবে একদিন সময় করে।
“এত দেরি করে উঠেছিস” অনিতা কলতলায় দাঁড়িয়ে গিয়ে সুলেখাকে বলে।
“আজ রোববার, তাই একটু শুয়ে ছিলাম!”
মালার দিকে তাকিয়ে মঞ্জু বলে,
“আমাদের তো আর শহরে চাকরি নেই, আমাদের আর কী রবি, কী সোম!” সুলেখা প্লাস্টিকের বালতিটা একটু এগিয়ে কলের সামনে নিয়ে আসে, কপালে মেরুন টিপের আঠার দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। মালা বলে, “রানি মহারানিদের ব্যাপার!” মালা মঞ্জুর বিদ্রূপ শুনে টানাটানা কালো দুটো চোখের পাতা নামায় সুলেখা।
“এই তোরা কথা বলবি নাকি জল ভরবি!” বলে খেঁকিয়ে ওঠে অনিতা। অনিতার সুলেখার প্রতি একটা মৌন স্নেহ আছে, নীরব প্রশ্রয় আছে।
“আমাদের তো কাজ করে খেতে হবে, আমরা তো আর শহরে কাজ করি না, যে রোববার বেলা অবধি ঘুমোব, আর ঘুম থেকে উঠে কলতলা ফাঁকা চাইব!” মালা বলে। “আমাদের গতর খাটিয়ে কাজ করে কামাই! একটা ইজ্জত আছে! গতর দেখিয়ে কামাই না, সোয়ামীর ঘর করি!” মঞ্জু বলে। সুলেখা অনিতাকে বলে, “দিদি আমি একটু আসছি, জলের বালতিটা দেখো, ভোলা উঠল মনে হয়!” মালা-মঞ্জুর বিদ্রূপগুলো সুলেখাকে কষ্ট দিলেও মুখচোরা সুলেখা ওপরে দেখায় সে খুব একটা গায়ে মাখে না। সুলেখার এই ছদ্ম উদাসীনতা পাড়ার মেয়ে বউদের আরও বিস্মিত করে! সুলেখাকে রহস্যময়ী করে তোলে। সুলেখার মত ‘মেয়েছেলে’র কোনও গোপন জীবিকা সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তারা।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনে ওঠার আগে দৌড়তে দৌড়তে সুলেখা আবার শিয়ালদার সুলভ শৌচালয়ে ঢোকে। এক এক করে মেরুন টিপ, পলার মত দেখতে লাল চুড়ি, কানের দুল খুলে ব্যাগে ভরে দিনের শেষে অবশিষ্ট লিপস্টিক ন্যাপকিন পেপারের মুছে ফেলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সিঁথির কোণের সিঁদুর ন্যাপকিন পেপার দিয়ে মুছে ফেলে। মুখে চোখে জল দিয়ে আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে টয়লেট থেকে দৌড় লাগায় সাউথের দিকে। ট্রেন মিস হলে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। ভীড়ঠাসা ফিরতি ট্রেনে কখনও যদি লেডিসে না উঠে সাধারণ কামরায় ওঠে, অনেক প্যাসেঞ্জার সুলেখার শরীরের স্পর্শ চায়। প্রায় অন্ধকার স্টেশনে বাড়ি ফেরার ট্রেন ঢুকলে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কৌতূহলী নজর সুলেখার সস্তা রহস্যময়তা গিলতে থাকে। ট্রেনের হওয়ায় মাথার চুল মুখে এসে পড়ে।
স্টেশনের থেকে বেরিয়েই আজ মনোরঞ্জনের সঙ্গে দেখা সুলেখার। সুলেখাকে শহরে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল মনোরঞ্জন। বেঁটে, মোটা চেহারার মনোরঞ্জন পানের দোকানে দাঁড়িয়ে গুটকা মুখে একটা দামি মোবাইলে কথা বলছিল আর পিক ফেলছিল। মনোরঞ্জনের বোতাম খোলা শার্টের নীচ দিয়ে গলায় একাধিক মোটা সোনার চেন দেখা যায়, হাতে সোনার বালা, সাদা রঙের চটি। কালি পরে যাওয়া খুদে চোখ নিয়ে মনোরঞ্জন সুলেখাকে জিজ্ঞেস করে,
“কাজ কেমন চলছে?”
“চলছে!”
“পেমেন্ট পাচ্ছিস ঠিক মত?”
“হ্যাঁ!”
“কোনও আসিবিধে হলে বলবি!”
“ঠিক আছে।”
“দেখে শুনে বাড়ি যা!”
পাট সাপ্লাইয়ের ব্যবসা দিয়ে মনোরঞ্জনের ব্যবসার শুরু। শোনা যায় ইদানীং নাকি শহরতলিতে প্রোমোটারিও করছে। উঁচুতলার লোকদের সঙ্গে ওঠাবসা মনোরঞ্জনের। মনোরঞ্জন ছিল খোকনের বাল্যবন্ধু। খোকন মারা যাওয়ার পর ওদের বাড়িতে দেখা করতে গেলে কাজের প্রস্তাব দেয় সুলেখাকে। মনোরঞ্জন বলে, “বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তো। বাঁচতে গেলে টাকা দরকার। সব শালা নীতিকথা মারাবে কিন্তু কোনও শালা তোর বাচ্চাকে খেতে পড়তে দেবে না!” অনেক দ্বিধা জড়তা কাটিয়ে সুলেখা শহরে কাজে যায়। প্রথম দিন মনোরঞ্জন সুলেখাকে স্টেশনের সামনে থেকে তাঁর দামি এসইউভি করে নিয়ে গেছিল শহরে।
আজ সুলেখা সাইকেল আনেনি। স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা টোটোতে ওঠে। আশ্বিন মাসের রাতের আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। কয়দিন বাদেই পুজো। গরম একটু কমেছে বলে মনে হয়। ছেলেমেয়েদের নিয়ে পুজোর বাজার করতে যেতে হবে। চারিদিকে পুজোর প্যান্ডেলের জন্য বাঁশ পড়েছে। বাতাসে হালকা শরতের গন্ধ। এমন দিনগুলোতে সুলেখাকে নিয়ে খোকন পুজোর বাজার করতে যেত। সুলেখা সারাদিনের কাজ সেরে স্নান করে সাজগোজ করে অপেক্ষা করত বাজার যাওয়ার জন্য। সেবার তো পুজোর বাজার করে ‘বই’ দেখে ফিরেছিল সুলেখা আর খোকন। সংসারে অভাব থাকলেও প্রতি বছর ঠাকুর ছোঁয়ানোর জন্য লাল পেড়ে শাড়ি আর আলতা সিঁদুর কিনে দিয়েছে সুলেখাকে খোকন। সুলেখার পৃথিবী ছিল খোকনের ব্যস্ততা ঘিরে। পুজোয় একদিনই সপরিবারে আশেপাশের ঠাকুর দেখতে বেরোত ওরা, আর ছিল দশমীর দিন সিঁদুর ছোঁয়ান। সেবার সুলেখার পায়ে নতুন চটি থেকে ফোস্কা পড়ে, এদিকে ভোলা ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোলাকে কোলে নিয়ে সুলেখা অন্য হাতে চটি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। পিঙ্কি খোকনের হাত ধরেছিল। ফেরার সময় কালিতলা মোড় থেকে চাউমিন রোল খেয়ে বাড়ি ফিরছিল ওরা।
কালিতলার মোড় থেকে আওয়াজ ভেসে আসে। সুলেখার চমক ভাঙে। “ডার্লিং পুজোয় কী প্ল্যান?” একটি গলার স্বর। “আরে এদের সব শহরের ক্লায়েন্ট, ফ্লাইং মারে, আমরা কী আর পাব!” অন্ধকারে অন্য আরেকটি গলাভাঙা যুবকের আওয়াজ ভেসে আসে! কানাঘুষো শোনা যায় অনেকেই সুলেখাকে সধবার সাজগোজে কলকাতার রাস্তা দেখেছে। কলোনিতে সে নিয়ে অনেক ফিসফাস। সাজ মুছে ফেলার পরেও সিঁথিতে সামান্য লালের আভা থাকে তা নজর এড়ায় না পাড়ার কারও। মুছে ফেলা সাজের আভা যেন মুখ শরীর জুড়ে লেগে সাঁইত্রিশের সুলেখাকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে কলোনিতে। সে তাঁর এই শরীরকে নতুন করে চিনেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব সুন্দরী লাগে সুলেখার। সে নিজেই শরীরের খাঁজগুলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। খোকন যতদিন ছিল সে এভাবে তাকায়নি নিজের দিকে। খোকন চলে যাওয়ার পর সে বাইরের পৃথিবীতে কাজে বেরিয়েছে। শহরের সূর্যে তাপে সুলেখার গায়ের রং তামাটে হয়ে গেলেও, কিছু রোজগার তার ব্যক্তিত্বে একটা লাবণ্য এনেছে। বাড়ির বাইরে কাজ করতে যাওয়া মেয়েদের শরীরী ভাষা বা চোখের ভাষা অন্যরকম সপ্রতিভ হয়। বাইরের পৃথিবীর চাহনি সুলেখাকে নিজেকে দেখার দৃষ্টিও পাল্টে দিয়েছে।
আজ সকাল থেকে বউনি হয়নি সুলেখার। তাঁর কাস্টমাররা সব শহরের মধ্যের কলোনি বা নিম্নবিত্ত এলাকার। দরজায় কড়া নাড়ার পর কেউ দরজা খুলছে না, আবার কড়া নাড়া। দরজা খুলতেই ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য! দরজার উল্টো দিক থেকে একটা বিস্ময়বোধক শব্দ…
“ওমা! সুলেখা বৌদি তুমি! এখানে? এসো এস”
“মানে, আমি…”
“তুমি…. মানে এখানে, এই ড্রেসে বৌদি! খোকনদা তো…” সীমা আশ্চর্য হয়ে তাকায় সুলেখার দিকে। সুলেখা মাথা নীচু করে চুপ করে থাকে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা সুলেখার জানা নেই। কী করবে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সুলেখা। পা দুটো যেন আঠার মত মাটির সঙ্গে লেগে আছে সরছেই না। তেষ্টায় গলা কাঠ, সারা শরীর ঘামে ভিজে জামাকাপড় শরীরে লেপ্টে গেছে।
“ভেতরে এসো, ভেতরে এসো!” সীমা সুলেখাকে ডাকে।
কলোনির সীমার শহরে বিয়ে হয়েছে বছর কয়েক হল। সুলেখাকে সীমা ঘরে বসিয়ে এক গ্লাস জল এনে দেয়। সুলেখা মুখ তুলে স্থির চোখে সীমার দিকে তাকিয়ে বলে—
“এবার বলো বৌদি ব্যাপারটা কী!”
“আমি আলতা-সিঁদুর বিক্রি করি সীমা…. সঙ্গে কসমেটিক্সও!”
“কিন্তু এই ড্রেসে?”
“বিধবার হাতের সিঁদুর কেউ পরে না, আর কুমারীরা সিঁদুর পরে না। তাই সধবাই সাজি!”
“রোজ?”
“সীমা পেট তো রোজই চালাতে হয়, বাড়িতে বাচ্চা দুটো আছে, শ্বশুর আছে!”
“বিধবা হয়ে সিঁদুর পড়ায় পাড়ার লোক কিছু বলে না”
“তারা জানে শুধু সেলসের কাজ করি, আড়ালে অনেকেই তো অনেক কথা বলে, এখন আর গায়ে মাখি না।”
“তোমার অমঙ্গল হবে না বউদি!”
“জানি না সীমা।”
“কবে থেকে এ কাজ করছ?”
“বছর খানেক হল, কোম্পানির ওরা যদি জানতে পারে আমি বিধবা আমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেবে!”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকে ঘরটা। ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে সীমা সুলেখাকে বলে, “তুমি আজ খেয়ে যেও।” সুলেখা টিফিন বক্স দেখিয়ে বলে না সে খাবার নিয়ে এসেছে। এখন সে উঠবে।
সুলেখা সীমাকে বলতে থাকে অনেক অনেক দিনের জমানো কথা। যেন সে একজনকে পেয়েছে অনেকদিন বাদে মনের কথা বলার। সীমার সঙ্গে সুলেখার তেমন সখ্য না থাকলেও বলে যায়—
“যখন তোমার দাদা বেঁচে, ভাবতাম পিঙ্কির ইস্কুলের অনামিকা দিদিমণি কেন স্বামী থাকতেও সিঁদুর পরে না! সোয়ামি বেঁচে থাকতেও সিঁদুর না পরলে তাঁর অমঙ্গল হয় না! শুনেছিলাম উনি বলেন এগুলো নাকি অর্থহীন। আমি মন থেকে মানিনি। ভালো লাগেনি জানো। আর আজ আমাকে দ্যাখো, আমার সোয়ামি না থাকলেও আমি বাচ্চাগুলোর জন্য ডেইলি একবার এয়ো হই। আমি কিন্তু সিঁদুরে বিশ্বাস করি সীমা। কিন্তু এখন মনে হয় এটা পরা বা না-পরা দুটোই আসলে মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপারই না। কারও ক্ষতি নেই এতে। এটুকু পরায় বা না পরায়। কিন্তু আমার নিজের ভাত নিজে জোগাড়ের জন্য আমি এটা পরি আজ। আবার মুছিও। তোমার দাদাকে ভালোবাসি একইরকম।”
সীমা স্কুলকলেজে লেখাপড়া করা মেয়ে। বিএ পাশ। স্কুলের গণ্ডি না পেরনো সুলেখার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভাবে অনামিকা দিদিমণির মত অনেকে হয়ত সিঁদুর না-পরাটাকেই ঠিক মনে করে, যারা পরে অনেকে তাদের অশিক্ষিত মনে করে। আবার ও নিজে বা ওর মত অনেকেই সিঁদুর পরাটা একটা পবিত্র ব্যাপার ভাবে। মনে করে, স্বামীর ভালোমন্দ জড়িয়ে আছে, ভেবে খুব আবেগ নিয়ে ভালবেসে সিঁদুর পরে। যেমন অনেক মেয়েই নিরাপত্তার চিহ্ন ভাবে একে। কিন্তু সুলেখা তো সকলের সব ধারণার মূলেই ধাক্কা দিয়েছে, অজান্তেই! সিঁদুর পরা বা না-পরা দুইয়ের প্রতিই যে এতটা উদাসীন, তাকে কোন দলে রাখবে সীমা?
সুলেখা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে— “আসি আজ! ছেলেমেয়েদের মুখে ভাত দেওয়ার জন্য এটুকু ছলনাকে নাহয় আমার অভিনয়ের মেকাপ হিসেবেই দেখো! রোজগারের জন্য এই এক চিলতে মেকআপে কোনও দোষ নেই আমি জানি।”