নীলাঞ্জন হাজরা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
আমার মনের দেওয়াল ভাঙা পাঁচখানা
কোকোরেচ — ইস্তানবুল
‘কুকুরেৎসু’-র সঙ্গে কুকুরের কোনও সম্পর্ক নেই৷ যার আছে তার অন্য নামগুলো হল— কোকোরেচ৷ কোকোরেৎসি৷ চিজিবিজি৷ জাঘুর বাঘুর৷ আমরা অবিশ্যি তাকে ‘কোকোরেচ’ বলেই ডাকব, কারণ আমার বন্ধু হাকান গুলস্বেন সেই নামেই ডাকছিল৷ তুর্কিরা সে নামেই ডাকে৷
ভাবছিলাম আমাদের জীবনে খাবারের গুরুত্বের কথা৷ খাবার না খেলে প্রাণী বাঁচে না— সে গুরুত্বের কথা বলছি না কিন্তু৷ আমি ভাবছিলাম খাবারের সংস্কৃতির কথা— Culinary culture! আমাকে এক ধন্বন্তরী ডাক্তার বন্ধু বলেছিল— শোন, এক পিস চারা-পোনা, এক বাটি ডাল, এক হাতা তরকারি আর একটু ভাত খেয়ে একটা মানুষ দুনিয়ার যে কোনও জায়গায় দিব্যি থাকতে পারে৷ আর কিচ্ছু খাওয়ার দরকার নেই সুস্থ থাকার জন্য৷ শুনে শিউরে উঠেছিলাম৷
কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি শিউরে ওঠার কোনওই কারণ নেই৷ কারণ নেই, কারণ, তেমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই৷ দুনিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে যে ভয়ঙ্কর ক্ষুধার মহামারি, দুবেলা দুমুঠো খাবারের অভাবে যে কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিয়ত মৃত্যু, তার সমাধান করে কেউ সারা দুনিয়ার সবাইকে চারা পোনা, ডাল, ভাত খেয়ে থাকতে বাধ্য করবে না৷ করতেই পারে না, কারণ সভ্যতার ইতিহাসই হল খাবারকে সুস্বাদু করার ইতিহাস৷
আমি ঠিক অন্য জীবজন্তুর কথা বলতে পারি না৷ কুকুর, বেড়াল, পাখি, মাছ, কচ্ছপ— এ সবই পুষে দেখেছি, এদের প্রত্যেকে সুস্বাদু খাবার খেতে ভালোবাসে৷ কিন্তু এরা খাবারকে সুস্বাদু করার জন্য কতদূর যেতে পারে? আমাকে উত্তরবঙ্গের গরুমারা জঙ্গলের গভীরে নিয়ে গিয়ে এক ৮৬ বছরের শিকারি ২৫ বছর আগে দেখিয়েছিলেন ওই অঞ্চলে হাতির প্রিয় খাদ্য কী— বুনো এলাচের শিকড়৷ আবার বাঁকুড়ার জঙ্গলের হাতির পাল দেখে মনে হয়েছে, বাঁশের কচি কোঁড়— ইংরেজিতে ‘ব্যাম্বু শুট’— খেতে তারা খুব ভালোবাসে৷ কিন্তু বুনো এলাচ বা কচি বাঁশের কোঁড় নিয়ে দুপাল হাতিতে ঘামাসান লড়াই বেধেছে, এমনটা দেখিনি, শুনিনি, পড়িওনি কখনও৷
কিন্তু মানুষ সে কাণ্ড করেছে৷ শত শত বার৷ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ৷ খাবারের ভীষণ অভাব, তাই খাবারের দাবিতে যুদ্ধ— না, সে কথা বলছি না৷ বলছি চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়, মানে আঙুল চুষে, ঠোঁট চেটে, কনুই ডুবিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাবার জন্য ভয়াবহ যুদ্ধ৷ খিদের তাগিদে নয়, আনন্দের তাগিদে৷ পেটের তাগিদে নয়, জিভের তাগিদে৷
দু-একটা উদাহরণ দিই৷ মানুষ যদি পশুদের মতো যা খেয়ে সুস্থভাবে বাঁচা যায়, তাই খেয়ে দিব্যি থাকত তা হলে আমাদের সভ্যতা থেকে অনায়াসে এমন একটা জিনিস বাদ দিয়ে দেওয়া যেত যা আমরা আজ কল্পনাই করতে পারি না— নুন৷ আমাদের দেহে অতি সামান্য একটু সোডিয়ামের দরকার হয়৷ সেটা নুন থেকে আসে বটে৷ কিন্তু সে চাহিদাটা এতই সামান্য যে, বহু শাক-সবজি-ফল-মূল (যেমন পেয়ারা, গাজর, কুমড়ো, বেগুন, আলু, বিট, পালং) বা দুধ বা বিভিন্ন মাছ (যেমন যে কোনও চিংড়ি বা সামুদ্রিক মাছ)— এ সব খেলেই দেহের সোডিয়াম-চাহিদা দিব্যি মিটে যেতে পারে৷ কেমন সে চাহিদা? ৫০০ মিলিগ্রামই যথেষ্ট৷ বড় এক চামচ, জাস্ট এক চামচ, নুনে থাকে প্রায় ৭০০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম৷ যেটাতে শরীরের কোনও প্রয়োজন নেই, বরং তাতে ক্ষতি হওয়ারই আশঙ্কা৷
কিন্তু ইতিহাস বলবে, নুনের জোরে গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্য, নুনের খোঁজে বদলে গেছে জাতির ইতিহাস, নুন-কর আদায় করে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ভয়ঙ্কর অত্যাচারী উপনিবেশ, নুন-বিদ্রোহ হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার৷ ঠিক একই কথা বলা যায় লবঙ্গ-দারুচিনি-জায়ফল-জয়িত্রী হরেক রকমের মশলার ক্ষেত্রেও৷ মশলা বাণিজ্যের জলপথ আর স্থলপথের ওপর দখল শত শত বছর ধরে উপনিবেশ তৈরি করেছে আর ভেঙেছে৷ সে ইতিহাস নুনের থেকেও বেশি রক্তমাখা৷ কিন্তু এমন কোনও মশলা আছে, যা না-খেলে মানুষ মারা পড়বে?
মূল কথা হল, ইতিহাসের সঙ্গে স্বাদের সম্পর্ক গভীর৷ আমার মনে হয় খিদে নয়, আধুনিক মানবসভ্যতার চালিকাশক্তি স্বাদ! সম্পূর্ণ অকারণে, অপ্রয়োজনে, শুধু খাবারকে সুস্বাদু করতে মানুষ, এবং একমাত্র মানুষই, সারা দুনিয়ায় যে সব কাণ্ড করেছে, করেই চলেছে এবং করেই চলবে তা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়৷
আর দুনিয়া না-ঘুরলে মালুমই চলে না, এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের স্বাদের কী দুস্তর তফাৎ হতে পারে! আমরা আম বাঙালিরা যে খাবারের কথা শুনলে নাক সিঁটকাব, বহু জায়গায় গিয়ে দেখেছি সেখানকার মানুষ সেটা তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে৷ দেখি তো একটু খেয়ে৷ ওমা! এ তো অতি সুস্বাদু৷ খাই না কেন আমরা? তার হরেক কারণ থাকতে পারে— মূলত ভৌগোলিক (সে জিনিসটা হয়তো এখানে পাওয়াই যায় না) আর সাংস্কৃতিক (মা-মাসিমা-বাপ-দাদাকে কখনও খেতে দেখিনি, ধর্মে বারণ ইত্যাদি)৷ কিন্তু সেটাকে যারা কুসংস্কারের পর্যায়ে নিয়ে যায়, তারা স্রেফ স্টুপিড৷ আমি খাই না৷ আরে ভাই একবার খেয়ে দেখ্, ভালো না লাগলে আর খাবি না! না, আমি খাই না৷ বোঝো৷ এই হল মনের দেওয়াল৷ এই দেওয়াল আমরা ভাঙতে পারি না বলেই, দুনিয়া জুড়ে এত পারস্পরিক ঘৃণা, এত অবিশ্বাস এত অর্থহীন রক্তক্ষয়৷ ওরা গরু খায়— ছিঃ৷ ওরা শুয়োর খায়— ওয়াক৷ ওরা নাড়িভুড়িও খেয়ে ফেলে— বর্বর৷ ওরা কেবল ঘাস-পুস-শাক-পাতা খায়— কী বোকা! সারাক্ষণ এই চলেছে৷ আমার তো মনে হয় বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে আরও বেশি বেশি করে ‘খাদ্য-পর্যটন’ বা ‘culinary tourism’-এর ব্যবস্থা করা উচিত৷
খাবার সুস্বাদু করার জন্য মানুষ কী কাণ্ড করতে পারে আর আমরা বাঙালিরা যার নাম শুনলেই নাক সিঁটকাই তা যে কী সুস্বাদু হতে পারে তার জিভে-টাকরায় প্রমাণ মিলেছে অনেক জায়গাতেই৷ যেমন সে দিন শেষ বিকেল গড়িয়ে গোধূলির আগে তাকসিম স্কোয়্যারে৷ আমার ইস্তানবুলের বন্ধু হাকান গুলস্বেনকে ধরেছিলাম, ‘চলো আজ খাস তুর্কি খানা খাব৷’ সেই অনুরোধে সে আমায় যা খাইয়েছিল, তাকে ‘স্ট্রিট ফুড’ বলা যায়৷ মানে রেস্তোরাঁয় নয়, রাস্তার পাশে এক চিলতে দোকান থেকে কিনে তার সামনেই টুল পেতে খাওয়া৷ সে খানা আগে কখনও খাইনি৷ আর সে খানায় কামড় দেওয়া মাত্র জিভ থেকে মস্তিষ্ক একটা অনুভূতি বয়ে গেল তার সঙ্গে মার্মারা সমুদ্রেরই তুলনা চলতে পারে এই নিরিখে যে, তার একটাই রং, একমাত্রিক৷ কিন্তু তা গভীর৷ আর তা সমুদ্রের জলের মতোই ভারী৷
কোকোরেচ৷ তুরস্কের সব থেকে জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড৷ তবে এ খানার রকম-ফের মিলবে আরও কয়েকটি দেশে, যে সব দেশের সঙ্গে রয়েছে তুরস্কের হয় ভৌগোলিক বা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক৷ যেমন পাশের গ্রিসে আরোমানিয়ান ভাষাভাষীরা একে বলবে— কুকুরেৎসু৷ গ্রিকভাষীরা বলবে— কোকোরেৎসি৷ আজেরবাইজান-এর লোকেরা বলবে— চিজ়িবিজ়ি আবার ইরানের তুরস্ক সীমান্তে এর নাম— জাঘুর বাঘুর!
ব্যাপারটা কী? এরকম— প্রথমে ভেড়ার কলিজা, পাকস্থলি, ফুসফুস, কণ্ঠনালী, যকৃৎ, জিভ এবং মোটামুটি যা-যা অংশ আমরা ভদ্রলোকেরা ফেলে দিই, যাকে রান্নার পরিভাষায় ইংরেজিতে বলে ‘offal’, সেই সব অংশ কিছুটা চর্বির সঙ্গে হাফ-ইঞ্চি টুকরো করে কেটে নিতে হবে৷ সেই সব এক সঙ্গে মেখে নিতে হবে লেবুর রস, অলিভ অয়েল, ওরেগানো মশলা, নুন-গোলমরিচ আর অল্প আদা দিয়ে৷ ভালো করে মেখে বেশ কয়েক ঘণ্টা রেখে দিতে হবে৷ এর পর লাগবে মায়ের দুধ ছাড়েনি এমন একটি কচি ভেড়ার ফুট দুয়েক লম্বা অন্ত্র, ইন্টেসটাইন৷ এটিকে ভালো করে ধুয়ে ভিতরটা বাইরে টেনে বার করে উলটে ফেলতে হবে৷ তারপর তাতে হালকা নুন, লেবুর রস আর জলে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রাখতে হবে৷
এবার একটা লম্বা শিকে মাংসের টুকরোগুলো গেঁথে সেই অন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে শিকটা বার করে নিতে হবে৷ যাতে অন্ত্রটা টাইট হয়ে ভর্তি হয়ে যায়৷ অন্ত্রের মুখটা বেঁধে নিতে হবে৷ তা হলে বেশ ফুট দুয়েকের একটা টিউবের মতো হল৷ এই বার সেই টিউবটাকে লম্বালম্বি একটা শিকে ফুঁড়ে কাঠকয়লার আঁচে গ্রিল করতে হবে, যতক্ষণ না চর্বির তেল বেরিয়ে ব্যাপারটা লাল থেকে গাঢ় খয়েরি হয়ে যায়৷ ব্যস কোকোরেচ রেডি৷
এবার সেটা ঠান্ডা হলে কুচিকুচি করে কেটে নাও৷ সঙ্গে একটু টোমাটো কুচি আর অল্প পার্সলে পাতা দিয়ে শুকনো তাওয়ায় একটু ভেজে নাও৷ তারপর পাউরুটির মধ্যে দিয়ে স্যান্ডুইচ বানিয়ে মোক্ষম হাঁ করে (স্যান্ডুইচ খেতে যত বড় হাঁ করতে হয়, তেমনটি আর কোনও খানার ক্ষেত্রে দেখিনি!), মোক্ষমতর এক কামড়৷ সে এক অসাধারণ রসনাভিজ্ঞতা৷ ব্যাপারটা একটু চিবোতে হয়— চিউয়ি৷ তাই স্বাদের ঢেউটা ছড়িয়ে পড়তে একটু সময় লাগে৷ কিন্তু যখন পড়ে, সেটা গভীর৷ তবে একমাত্রিক— বিরিয়ানির মতো বহুমাত্রিক নয়৷
সঙ্গে এল এক গ্লাস ‘আয়রান’৷ এটা একেবারেই আমাদের ঘোল! একটু পাতলা৷ ইরানে এ জিনিসই খেয়েছি, নাম ‘দুঘ’৷ সঙ্গের ঘোলটা জিভ থেকে স্বাদটা মুছে দিয়ে জিভটাকে নিরপেক্ষ করে দেয়৷ ফের কামড়, ফের স্বাদের ঢেউ৷ এইভাবে চলতে থাকে যুগলবন্দি৷
ভালো কথা, কোকোরেচ তৈরির সব উপকরণই কিন্তু কলকাতায় দিব্যি মেলে৷ কাঠকয়লার আঁচ ঝামেলা হলে, ওটিজি-তেও দিব্যি গ্রিল করে নেওয়া যায়৷ আমরা কি একবার বাড়িতে তৈরির চেষ্টা করব? নাকি, নাক সিঁটকাব?
লিসান অল-বকর — ওয়াশিংটন ডিসি
নিহাল-কে ভুলব না অনেক কারণে৷ নিহাল রিজ়্ক্৷ আগের চাকরিতে আমার কায়রোর সহকর্মী৷ বছর ১৬ আগে ওয়াশিংটন ডিসি-তে আমাদের একটা ট্রেনিংয়ে সে এসেছিল মিশর থেকে৷ ইয়া লম্বা৷ লম্বাটে মুখ৷ টিকোলো নাক৷ কাঁধ অবধি লালচে কোঁকড়ানো চুল৷ পরনে সর্বদা ট্রাউজার আর শার্ট৷ দু আঙুলের মাঝখানে প্রায়শই লম্বা সিগারেট৷ সাংঘাতিক ছটপটে মেয়ে৷ এহেন নিহালের অনেক গুণের একটি একেবারে অসাধারণ৷ মার্কিন সরকারের পয়সাতেই আমাদের সক্কলের যাওয়া৷ সকলেই যতদূর পারতাম প্রতিটা মুহূর্ত নিংড়ে ঘুরে বেড়াতাম নিজের নিজের পছন্দমতো পাড়ায়, মিউজিয়ামে, রেস্তোরাঁয়, পার্কে৷ সে সুযোগও ছিল ভরপুর৷ একটাই ঝামেলা ছিল— একেবারে সকাল আটটা থেকে শুরু হত নানা সেশন৷ মোটামুটি মাঝ-দুপুরে শেষ৷ তারপর রাত্রি দুটো আড়াইটে পর্যন্ত টোটো করে ঘোরাঘুরি, রেস্তোরাঁবাজি বা স্রেফ কারও একটা ঘরে বসে বোতল খুলে গুলতানি৷ কাজেই ঘুম হত সামান্যই৷
আর এখানেই ছিল নিহালের খেল! প্রত্যেক সেশনে প্রথমে বক্তা মিনিট ৪০ কিছু বিষয়ে বললেন, তারপর প্রশ্নোত্তর, আলোচনা— এমনটাই ছিল দস্তুর৷ প্রত্যেক সেশনে বক্তা ঠিক ৩০-৪০ সেকেন্ড বলার পর থেকেই পাশে বসে শুনতে পেতাম নিহালের গাঢ় নিশ্বাসের ঠিক পরের ধাপের নাক ডাকা— মৃদু, বহু দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির মতো৷ বক্তারাও দিব্যি বুঝতে পারতেন৷ কিন্তু কী আর বলবেন? তবে নিহালের এই অঘোর ঘুমটা বড় কথা নয়৷ বড় কথা হল, বক্তব্যের পর বক্তা যখন বলতেন— ‘এবার তোমরা বলো তোমাদের কী কী প্রশ্ন আছে?’, স্তম্ভিত হয়ে দিনের পর দিন দেখেছি প্রথম যে হাতটি উঠেছে সেটি নিহালের৷ বললে বিশ্বাস করা কঠিন, প্রত্যেকবার সে এক্কেবারে মূল বিষয়ের ওপর মোক্ষম প্রশ্ন করে জমাটি তর্কবিতর্ক শুরু করে দিত!
এই নিহাল একবার আমাদের জনা কয়েককে বলল, ‘তোমরা আরবি খাওয়া খেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি৷ একটা দারুণ লেবানিজ রেস্তোরাঁ আমার জানা আছে৷’ এখানে বলে রাখা ভালো ওয়াশিংটন ডিসি-কে অনায়াসেই দুনিয়ার রেস্তোরাঁ-রাজধানী বলা যায়৷ বিশেষ করে জর্জটাউন পাড়ায় যেমন সারা দুনিয়ার রেস্তোরাঁ আছে, তেমনটা আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না৷ আমি তো শুনেই এক পায়ে খাড়া৷ কলকাতায় তখনও পাড়ায় পাড়ায় লেবানিজ অমুক, লেবানিজ তমুক নামের দোকান গজিয়ে ওঠেনি৷ যে দেশের খাবারের নাম ‘বাবা ঘনুশ’, না জানি কেমন হবে সে দেশের খানা দানা৷ ফত্তুশ, হুমুস, তাহিনি, এমন আরও কত কী৷
ছোট্ট এক চিলতে রেস্তোরাঁ৷ দুধ-সাদা উর্দি পরা সাড়ে ছ ফুট লম্বা ওয়েটার বিশাল একটা গোল অ্যালুমিনিয়াম ট্রে-তে ছোট ছোট বাটিতে সাজিয়ে রেখে গেল বহু রকমের খানা৷ তার মাঝখানে ছড়নো একটা বড়সড় চিনেমাটির বোল-এ একটা হলদেটে থকথকে ঝোল৷ দেখা গেল সেটিই একমাত্র আমিষ খানা৷ পাশে থাক করা ছোট ছোট সাদা রুটির টুকরো— পিতা ব্রেড৷
কিন্তু মাঝখানে ওটা কী? ‘লিসান অল-বকর,’ জানায় নিহাল৷ সেটা কী? উত্তর শুনে একটু ধাক্কা খাই— গরুর জিভের মাখামাখা ঝোল৷ বিফ টাং! আমাদের দেশে এ খাদ্যটি বিরল৷ আসলে আমাদের দেশে ভদ্রলোকেদের মহলে, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিশ্চান, বাঙালি-বিহারি-মাদ্রাজি-কাশ্মিরী-মারাঠি মানুষদের মধ্যে ছাগল-গরু-ভেড়া-মোষ হরেক রকমের মাংসই চলে৷ কিন্তু একটু উচ্চবিত্ত বাড়িতে কোনও পশুরই মাথার কোনও অংশ সাধারণত ঢোকে না৷ বাঙালিদের বাড়িতে তো নয়ই৷ (এখানে বলে রাখা ভালো, Mutton বলে ছাগলের মাংস খাওয়াটা এক ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া দুনিয়ার আর কোত্থাও নেই৷ Mutton মানে ভেড়ার মাংস, পাঁঠা নয়৷ তার সরল ইংরেজি— goat meat৷) কোনও বড় ‘বিফ’-এর দোকানে পয়সা দিলেও ‘জুবান’ মিলবে না৷ সেটা কিনতে গেলে ব্রড স্ট্রিটের কিছু বিশেষ দোকানে ঢুঁ মারতে হবে৷
এহেন খানায় মোটেই অভ্যস্ত নই৷ কাজেই একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম৷
নিহাল সেটা লক্ষ করেই যেন এক হাতা তুলে নিজে তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে আমায় বলল, ‘ত্রাই ইত৷ ওয়ান্দারফুল৷’ কাজেই জয় মা বলে হাত বাড়ালুম৷ তার পর যে নির্লজ্জপনা করেছিলুম, তাতে আরও দু প্লেট লিসান অল-বকর অর্ডার করতে হয়েছিল নিহালকে৷ মুখে দিতেই ব্যাপারটা গলে গেল৷ চিবানোর প্রয়োজন সামান্যই৷ আর গলে যেতে যেতে মুখের প্রত্যেকটা স্বাদ-মুকুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি খেলা করে গেল, তেমনটা বিফ-এর আর কোনও রান্নায় কখনও খাইনি৷ কলকাতার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁ ‘অ্যাম্বার’-এ ‘ব্রেন মসালা’ (মানে ছাগলের মস্তিষ্কের গাঢ় ঝোল) বলে একটা খানা মেলে৷ লিসান অল-বকর আস্বাদনের অভিজ্ঞতা কিছুটা তার কাছাকাছি বলে আমার মনে হয়েছিল৷ কিন্তু তার যে ফ্লেভার— যে গন্ধ— সেটা অনেক প্রগাঢ়, বিফ-এর মতোই৷ সেটাকে বলা যায় মূল গন্ধ— Base flavour৷ তার সঙ্গে মিলেছে ভাজা পিঁয়াজের গন্ধ, হালকা দারুচিনির গন্ধ, আর সব থেকে বড় কথা, জাফরানের আশ্চর্য সুবাস৷ গরুর জিভের ছোট ছোট টুকরোর সঙ্গে মিশে আছে একেবারে মাখনের মতো নরম বড় বড় পিঁয়াজের টুকরো৷ মজা হল, পুরো খাদ্যটাই কিন্তু মুখে দিলেই মাখন বা আইসক্রিমের মতো গলে যাচ্ছে না, কিছুটা চিবোতে হচ্ছে৷ কারণ ছোলা৷ ছাল ছাড়ানো কাবুলি ছোলা৷ স্বাদের দিক থেকে বলতে গেলে, সাধারণভাবে গোল মরিচের হালকা ঝাল দেওয়া নোনতা স্বাদের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা মিষ্টি— কিশমিশ৷ স্বাদের আর গন্ধের এমন আশ্চর্য লুকোচুরির অভিজ্ঞতা আর খুব কম খানা মুখে দিয়েই আমার হয়েছে৷
সিদল, থুড়ি হিদল — আগরতলা
আমি আর এমন একটিও খানার কথা জানি না যার কথা উঠলেই এমনকী ঘোর যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরাও পক্ষে বিপক্ষে ভাগ হয়ে রুচির তলোয়ার হাতে একে অপরের সঙ্গে ঘামাসান অসিক্রীড়ায় নেমে পড়েন৷
১৬৮৯— এ তারিখটার কথা উঠলেই আমরা ইতিহাসের ছাত্ররা দুলে দুলে পড়তে শুরু করব— ‘ইহা পশ্চিমি গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় বৎসর৷ ওই বৎসরই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ‘অধিকার সনদ’ বা ‘Bill of Rights’ অনুমোদনের মাধ্যমে সম্রাটের নিরঙ্কুশ অধিকার খর্ব করিয়া পশ্চিমী দুনিয়ায় গণতন্ত্রের প্রথম বীজ বপন করে৷’ আপনি বলবেন, ‘দূর মশাই! খানাদানার আজগুবি অভিজজ্ঞতার দু কথা পড়তে এসেছিলুম, আপনি খামখা গণতন্ত্রের ইতিহাস কপচাচ্ছেন কেন?’
হক কথা৷ আসলে গণতন্ত্রের ইতিহাস নয়, আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলাম ওই ১৬৮৯ তারিখটার প্রতি৷ কারণ সম্প্রতি একটি বই আবিষ্কার করে আমি বেশ উত্তেজিত— A Voyage to Suratt, In the Year 1689৷ লেখক— J Ovington৷ জন ওভিংটন৷ আজ থেকে ৩২৭ বছর আগে, যে দিন অভিষেক হল সম্রাট তৃতীয় উইলিয়াম আর মহারানি মেরি-র, ঠিক সেই দিনটিতেই, ইংল্যান্ডের ডরসেট এবং মিডলসেক্স জমিদারির বেলেল্লা জমিদার-সর্দার, থুড়ি ‘Earl’, চার্লস স্যাকভিলের বাড়ির পাদরি জন সাহেব জাহাজে চড়ে দেশ ছাড়লেন কালা পানি পার করে গুজরাট পাড়ি দিতে৷ কিন্তু শুধু তারই আশ্চর্য বর্ণনা নয় এই বই৷ বইটির প্রথম পাতা খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে আরও কী সব মণি-মুক্তো রয়েছে এ বইয়ের পাতায় পাতায়৷ সাড়ে তিনশো বছর আগের পর্তুগালের মাদেইরা দ্বীপ, আফ্রিকার উপকূল, গুজরাট, বম্বে, আরব্য দুনিয়ার মাস্কাট শহরে এক ইংরেজ পাদরির নানা অভিজ্ঞতার তাজ্জব কাহিনি পড়তে পড়তে চমকে উঠলাম এক্কেবারে শেষের দিকে— ৫৬৯ নম্বর পাতায় শুরু হওয়া অধ্যায়টিতে এসে— Inhabitants of Arracan৷ চমকে উঠলাম কারণ, তার ঠিক পরের পাতাতেই রয়েছে আরাকানবাসীদের খানাদানা প্রসঙ্গে এই বর্ণনা— ‘Fish they never eat, but when putrid and Corrupted, affirming them then to have the sweetest Relish. Of these also they make a kind of Mustard, which they call Sidol… No man can pass the places, where ‘tis prepar’d without stopping his Nose’৷ (বানান অপরিবর্তিত)
সিদল৷ যাকে খাস সিলেটিরা বলবেন— হিদল৷ সেই জিভে-জল-নাকে-জল আগুন-ধারালো স্বাদের দাপুটে খানা, যার হাফ বাটি দিয়ে আমি অনায়াসে সাবড়ে দিতে পারি দেড় থালা ভাত৷ সাড়ে তিনশো বছর আগে এক ইংরেজ পাদরির দেওয়া এ খানার বর্ণনার সঙ্গে আজকের আম পশ্চিমবঙ্গবাসীর সে খানা সম্পর্কে ধারণার কী আশ্চর্য মিল! জন সাহেবের ভাষায়— ‘মাছ তো এমনি খায় না ওরা৷ দুর্গন্ধময়, পচা হলে তবেই হয়ে ওঠে তারিয়ে তারিয়ে খাবার বস্তু৷ তা দিয়ে বানায় এক রকমের কাসুন্দি, ওরা যাকে বলে— সিদল৷’
মুঘল সম্রাট অওরঙ্গজেবের আমলে এক সাহেবের প্রাচ্য দেশের বর্ণনায় যে এই সাড়ে তিনশো বছর পার করেও উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মানুষ, উত্তরপূর্ব ভারতের লোকজন আর আজকের বাংলাদেশ এবং মায়ান্মারের বিশাল অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় ‘সিদল’ নামক খানার এমন বর্ণনা মিলবে তা কল্পনাও করিনি৷ কী সেই খানা? আদতে শুঁটকি মাছ৷ যার নাম শোনা মাত্র পশ্চিমবঙ্গের ৯০ শতাংশ আম বাঙালির নাক যেন নিজের অজান্তই দুর্গন্ধের কল্পনায় কুঁচকে যায়, খাওয়া তো দূরের কথা৷ আর সেই দলে ছিলাম আমিও— এই বছর কুড়ি আগে অবধি৷
তারপর একদিন হাজির হলাম ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়৷ বদলে গেল সব কিছু৷ আর সে বদলের মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন ‘ত্রিপুরা দর্পণ’ দৈনিকের সম্পাদক সমীরণ রায়৷ রোগা ছিপছিপে চেহারা৷ সারাক্ষণ মুখে একটা হাসি লেগেই আছে৷ পাতলা কুচকুচে কালো চুল৷ সরু গোঁফ৷ বয়স বোঝা অসম্ভব৷ এক্কেবারে কাষ্ঠ বাঙাল৷ এমন দিল-দরিয়া মানুষ কমই দেখেছি জীবনে৷ এই সমীরণদাই একদিন বললেন, ‘শুন, আইZ সন্ধ্যায় হোটেলের খাবার অফ্ কইরা দাও৷ রাতের খাবার আমরাই তুমারে খাওয়াইব, হোটেলেই৷ বুZলা৷’ ‘আমরা’ হল সমীরণদা, ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধিকর্তা স্বপনদা, আর ত্রিপুরা পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল অমিতাভ-দা৷ আগরতলায় গেলেই এই ছিল আমার আড্ডার কোর গ্রুপ৷ উত্তম প্রস্তাব৷ পষ্ট মনে আছে পেল্লায় সাইজের জোড়া ইলিশ হাজির করে অমিতাভদা হোটেলের ম্যানেজারকে হুকুম করে ছিলেন একটার ভাজা হবে, আর একটার সরষে বাটা দিয়ে ঝোল৷ আর তার সঙ্গে সমীরণদা নিয়ে এলেন প্রমাণ সাইজের একটি বাটিতে মাখা-মাখা একটি রক্তবর্ণ বস্তু৷ বোঝার চেষ্টা করছি খাদ্যটি কী৷ বোমাটা পড়ল তখনই— ‘তুমার একটু Zhাল খাওনে প্রবলেম নাই তো? শুঁটকি মাইছ একটু Zhাল না অইলে Zমে না৷ খাইয়া দ্যাহ, সিদল৷ Zানো তো? মাটির হাঁড়িতে ভইরা মাটির তলায় রাইক্কা ফার্মেন্ট করন লাগে৷ ভালো সিদলের তুলনা নাই৷’
কাম সারছে! একে তো আমি বাঁকড়োর বান্দা৷ তার ওপর বিন্দুমাত্র ঝাল মুখে পড়লেই অ্যাইসন হেঁচকি উঠতে থাকে যে নাকের জলে চোখের জলে একাকার৷ কিন্তু সে সবের থেকেও বড় কথা, সন্তোষপুরে থাকার সময় পাশের ফ্ল্যাট থেকে মাঝেসাঝে ভেসে আসা পাড়ামাতানো গন্ধ শুঁটকি মাছের বিষয়ে আমার মনে যে ধারণা গেঁথে দিয়েছিল তার সঙ্গে ওই জন সাহেবের বর্ণনার অবিকল মিল! খাওয়াদাওয়ায় এমনিতে আমি বেশ সাহসী৷ কিন্তু এই একটি খানার ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনের সাহস যে কখনও হবে না তা নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না৷ সমীরণদার কথা শুনেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসা সেই গন্ধের ঢেউ নির্ঘাৎ আমার মুখের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, কারণ সঙ্গে সঙ্গে তিনি যোগ করে দিলেন, ‘আগে কখনও খাও নাই বুZhি? Zুর কইরা খাওনের প্রয়োZন নাই৷ একটু চাইখ্খা দ্যাহ৷ ভালো না লাগলে খাইতে অইব না৷’
কী লজ্জার কথা৷ তাড়াতাড়ি ডাহা মিথ্যে বলে পরিস্থিতির সামাল দিই, ‘আরে না-না৷ আমার তো অনেক দিন ধরেই খাওয়ার খুব শখ৷ কিন্তু আসলে আমার বাড়িতে কেউ রাঁধতেই পারে না৷’ পরে জেনেছিলাম সে রান্না হতে পারে নানা কিসিমের৷ যেমন চালকুমড়ো পাতায় সিদলের বড়া৷ যেমন খাসিদের টুংটাপ৷
ভালো কথা, সব সিদলই এক রকমের শুঁটকি মাছ বটে, কিন্তু সব শুঁটকিই সিদল নয়৷ যেমনটা বলছিলেন সমীরণদা— মাছ আঁশ ছাড়িয়ে, পিত্ত-টিত্ত বার করে পরিষ্কার করে হপ্তা খানেক কড়া রোদে শুকিয়ে তৈরি হয় শুঁটকি মাছ৷ (তার ভর্তাও অসাধারণ খেতে৷) এর পর সেই শুঁটকি মাছের পিঠের বড় কাঁটাটা পাঁজরের কাঁটা শুদ্ধু বের করে, তাকে ভালো করে জলে ভিজিয়ে বাড়তি জল বার করে দিয়ে, আচ্ছা করে সরষের তেল মাখিয়ে হাঁড়ির মধ্যে দিন তিনেক রেখে দিতে হবে৷ সেই তেল মাখানো মাছ হাঁড়ি থেকে বার করে, মাদুরে ছড়িয়ে হালকা লাল লঙ্কার (ওঁরা বলবেন লাল মরিচ) গুঁড়ো মাখিয়ে ফের রোদে শুকোতে দিতে হবে৷ ইত্যবসরে একটা মাটির হাঁড়ি ভিতরে বাইরে সরষের তেল মাখিয়ে আঁচে গরম করতে হবে ততবার, যতক্ষণ হাঁড়ির মাটি আর তেল টানতে না-পারে৷ এবার সেই ফের শুকানো মাছ সরষের তেল দিয়ে চটকে মেখে নিয়ে সেই তেলা হাঁড়ির মধ্যে রেখে, মাটির সরা দিয়ে তার মুখ টাইট করে সিল্ করে দিয়ে কোনও ঠান্ডা অন্ধকার জায়গায় মাটির নীচে পুঁতে দিতে হবে৷ মাস তিনেক ছোঁয়াও চলবে না৷ তারপর যা বেরোবে তার নাম সিদল৷
কাজেই জন সাহেব ও তাঁর আধুনিক বাঙালি ঘটি সংস্করণেরা, সিদলকে আর কোনও দিন বোকার মতো ‘putrid, corrupted’— সোজা বাংলায় ‘পচা’ বলে ভুল করবেন না প্লিজ৷ একশো শতাংশ পরিচ্ছন্ন এই খানা৷ হ্যাঁ, রান্নার সময় একটা ভীষণ কড়া গন্ধ বের হয় নিঃসন্দেহে৷ কিন্তু, সাহেব, আপনাদের সাধের (এবং সত্যিই অপূর্ব স্বাদের) হাজার কিসিমের Cheese-এর অনেকগুলি শুঁকলেও তো আম বাঙালির অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে পারে!
সমীরণদার কল্যাণে সে দিন খেয়েছিলাম পুঁটি সিদলের চাটনি৷ সে অভিজ্ঞতা শব্দে বর্ণনা করা কঠিন৷ ঝটকা লাগা বলতে কী বোঝায় তা যেমন বিদ্যুতের শক্ খেয়ে বোঝা যেতে পারে তেমনি বোঝা যেতে পারে সিদল চাটনি খেয়েও৷ অন্তত অনভ্যস্ত রসনায়৷ ভিভিআইপি-দের চলার পথ যেমন পুলিশের দল নির্দয়ভাবে আম পাবলিকের ভিড় সরিয়ে সাফ করে, ঠিক সেইভাবেই একটা ঝালের ঝিলিক সারা মুখের অন্য সব আগে-থেকে-লেগে-থাকা স্বাদ সরিয়ে সাফ করে দিল৷ তারপরে ধীরে ধীরে এল অন্য স্বাদগুলো, প্রায় এক সঙ্গে— ভিভিআইপি-রা যেমন চ্যালা-চামুন্ডা নিয়ে চলাফেরা করেন! মধ্যমণি হল একটা প্রগাঢ় মেছো স্বাদ, সঙ্গে চটপটে নোনতা স্বাদ, একটা টকসা স্বাদ আর ঠিক স্বাদ বলব না— পেঁয়াজ-আদা-রসুন মেলানো একটা কড়া গন্ধ৷ ওঃ! উপাদেয়৷
নাক-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরছে আর আমি সাবড়ে যাচ্ছি সিদল চাটনি৷ এর পর বহুকাল সমীরণদা কলকাতায় এলেই বাঁধা ছিল প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের সাপ গলিতে ত্রিপুরা ভবনে ঢুঁ মেরে সিদল আর ভাত সাবড়াতে যাওয়া৷ সে সিদল আসত সুদূর আগরতলা থেকে, প্লেনে! আর এই করে করেই সিদলের ঝাল-ঝটকাটাকে সামলানোর একটা তরিকা বার করে ফেলেছি আমি— আগে বড় এক দলা ভাত মুখে পুরে দাও, তার পর একটু খানি সিদল৷ হয়তো খাস হিদল খাইয়েরা হাসবেন— আরে, এ তো তবলার সঙ্গে সেতারের সঙ্গৎ হয়ে গেল৷ হোক গে, তবু সিদল মিস্ হতে দেওয়া যাবে না৷
চুমুকে চুমুকে চনমনে চমক — নেওয়ারি গুনদ্রুক
সাড়ে তিনশো বাজ এক সঙ্গে ভেঙে পড়ল তাঁর মাথায়৷ তাঁর নামটা অবিশ্যি জানাননি কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷ কিন্তু কুমারবাবুর লেখা ‘কুদরৎ রঙ্গিবিরঙ্গি’-তে গপ্পোটা রয়েছে এ রকম (আমি স্মৃতি থেকে বলছি)— তিনি হলেন দিল্লির এক প্রসিদ্ধ মাহিলা৷ সেই ধরনের মহিলা যাদের ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘socialite’৷ তাঁর বাড়িতে হবে জলসা৷ সেই জলসায় গাইবেন স্বয়ং উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাহাব৷ তিনি এ বাড়িতেই এসে উঠেছেন৷ শুনতে আসবেন স্বয়ং ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি৷ তোড়জোড় চলছে বাড়ির বৈঠকখানায়৷ ম্যাডাম ছোটাছুটি করছেন৷ তারই মাঝে অন্দরমহলে এসে উস্তাদ খান সাহাবকে নিজে সামনে বসে ষোড়শ ব্যঞ্জনে শুদ্ধ শাকাহারী ভোজন করিয়ে গিয়েছেন৷ এ বাড়িতে মাছ মাংস ঢোকে না৷ তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন জলসার তদারকিতে৷ খবর এল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী আসছেন৷ মহিলা হন্তদন্ত হয়ে উস্তাদজির খাস চাকরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘উস্তাদজি কোথায়? রেডি তো?’
চাকর, ‘উস্তাদজি তো ঘুমিয়ে পড়েছেন৷’ মহিলার মাথায় তিন কোটি ভোল্টের বজ্রাঘাত৷ কেন? কী ব্যাপার? কী হয়েছে উস্তাদজি? দিশেহারা হয়ে উস্তাদজিকে ঘুম থেকে তুলে জানতে চান মহিলা৷ উস্তাদজির সহজ উত্তর— তুমি সত্যিই ভেবেছিলে আমি ওই সব ঘাসপুস খেয়ে গান গাইব!?
বড়ে গুলাম আলি খান যেখানে যেতেন সঙ্গে যেত নাকি পাতিয়ালার ১৩টি টিন ভর্তি খাঁটি গব্য ঘৃত৷ তাতে ভাজা লুচি এবং সের খানেক রেওয়াজি পাঁঠার ঝোল না-হলে উস্তাদজির গলা নাকি ঠিক খেলত না৷
মিথ্যে বলব না৷ খাদ্যের পছন্দের নিরিখে, আমি ঠিক হুবহু ওই কোঠায় না-হলেও, ঘাসপুস— থুড়ি ভেজিটেরিয়ান খানা— খেয়ে আঙুল চুষছি, এটা আমার কল্পনারও বাইরে৷ তা যে খানাই হোক না কেন৷ লাউ-পোস্ত কিংবা মোচার ঘণ্ট নিয়ে যাঁরা আদিখ্যেতা করেন… হুঁহ্… কী আর বলব? থাক৷ এ হেন আমার বাদশাহি রুচি যে সে দিন এভাবে ল্যাজেগোবরে হতে হবে তা আমি কল্পনাও করিনি৷
বৈশাখের প্রখর দাবদাহ৷ পিচ গলছে৷ হাজির হয়েছি জয়াদির কলকাতার ডেরায়৷ জয়াদি— জয়া মিত্র৷ যাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের৷ আর যাঁর সঙ্গে সময় কাটালেই আমি নতুন নতুন করে চিনতে পারি এই দেশটাকে৷ তা, যাই হোক৷ ঢুকতেই জয়াদির প্রশ্ন— কিছু খেয়েছ দুপুরে? খাইনি বেশ খিদে খিদেই পাচ্ছিল৷ দাঁড়াও, তোমায় একটা পাহাড়ি স্যুপ খাওয়াই৷
গুনদ্রুক — শুকনো
গুনদ্রুক — স্যুপ
একটা বিশাল বাটিতে যে বস্তুটা এল তার রং কালচে। আর দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা সিমপ্লি একটা শাক সিদ্ধ৷ মনটা একটু দমেই গেল৷ খিদে খানিকক্ষণ সহ্য করাই যায়৷ কিন্তু শাক সিদ্ধ? মনের সব শক্তি একত্র করে মুখ হাসি হাসি রেখে এক চামচ তুলে মুখে দিই৷ স্পষ্ট মনে আছে, ৩০ সেকেন্ড চোয়াল নাড়াতে ভুলে গিয়েছিলাম৷ অনির্বচনীয় তার স্বাদ৷ এবং গন্ধ৷ বেশ কড়া গন্ধ৷ আর আমি পরে একাধিকবার লক্ষ করে দেখেছি, এ খানা খাওয়ার পর অনেকটা ভাল কোনিয়াক ব্র্যান্ডির মতো সারা শরীর-মনে আশ্চর্য একটা চনমনে ভাব ছড়িয়ে পড়ে৷ এমন তারিয়ে তারিয়ে আর কখনও জীবনে শাক সিদ্ধ খেয়েছি বলে মনে পড়ে না৷
কী এই বস্তু? খাস নেওয়ারি খানা৷ কাঠমান্ডু সংলগ্ন উপত্যকার মানুষেরা হলেন নেওয়ার৷ নেপালি-গোর্খালি নাম গুনদ্রুক৷ আর এ কোনও একটি শাক নয়৷ গুনদ্রুক খাদ্যটির নাম৷ সবজিটির নয়৷ ব্যাপারটা খুব সোজা নয়৷ রাই সরষের গাছে যখন প্রথম পাতা বড় হবে, চাই সেই পাতা— রাইয়ো কো সাগ৷ চাই মুলো শাক— মুলা কো সাগ৷ আর ফুলকপির পাতা— কউলি কো পাত! ভালো করে সেগুলি ধুয়ে একটা মাটির হাঁড়িতে সব এক সঙ্গে পুরো ডুবুডুবু জলে হালকা গরম করে নাও৷ হাঁড়ির মুখ মাটির সরা আর আটা দিয়ে একদম সিল্ করে দাও৷ ঘরের কোণে এক হপ্তা রেখে দাও৷ হালকা ফার্মেন্টেশন হয়ে যে বস্তুটি বেরোবে, সেটি জল ছেঁকে সূর্যের তাপে একেবারে শুকিয়ে নিলে তবে তৈরি হবে গুনদ্রুক৷ মাসের পর মাস তা রেখে রেখে খাওয়া যেতে পারে৷ জয়াদির স্টাইলে স্রেফ আদা-কুচি, পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কা কুচি দিয়ে স্যুপ করে৷ কিংবা কাঠমান্ডু গেলে খাস নেওয়ারি খানার রেস্তোরাঁয় খোঁজ করুন সয়াবিন, টোমাটো কুচি দেওয়া ‘গুনদ্রুক কো ঝোল’! প্রত্যেক চুমুকে চমক!
ক্যালে-প্যাচে — ইয়্যাজ়্দ্
তেহরান৷ ইরানের রাজধানী৷ পৌঁছেছি ভোরবেলা৷ এখন আমার বন্ধু সৈয়দ বোরেরি ও তার স্ত্রী তহমিনেহ্-র বাড়িতে বসে আড্ডা চলছে৷ বড় কাচের জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ঝলমলে রোদ উঠেছে৷ ঘড়িতে সাড়ে নটা৷ আমার মন আর ঘরে রইছে না৷ সৈয়দ ছুটি নিয়েছে৷ যে কটা দিন আমি থাকব সে আপিস যাবে না৷ উঠি উঠি ভাবটা তহমিনেহ্-র চোখে পড়ে৷ সে দেখি তড়াক করে লাফ কেটে উঠে পাশের ঘর থেকে একটা মার্কার কলম নিয়ে হাজির৷ ড্রয়িং রুমের একপাশের দেওয়ালে একটা লম্বা আয়না লাগান৷ তার উপরেই সে তৈরি করে ফেলে তেহরানের পরিচিত দ্রষ্টব্যের একটা তালিকা৷ আর তার একদম উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখে— বাজ়ার-ই-বোজ়োর্গ৷ গ্র্যান্ড বাজার৷
‘বাজ়ার’ খাস ফারসি শব্দ৷ শব্দটা আমরা সুন্দর আত্মসাৎ করে দিব্যি হাটের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি বটে, কিন্তু বক্সিগঞ্জের পদ্মাপারের খোলা মাঠে সারি সারি দাওয়ায় শুক্কুরবারে জড়ো করা উচ্ছে-বেগুন-পটল-মুলো, বেতের ঝুড়ি, মাটির কলসি, শীতের র্যাপার-ধুতি-শাড়ি-গামছার গোছা, কী নৌকো বোঝাই পাটের হাটের থেকে ‘বাজ়ার’ ব্যাপারটা এক্কেবারে আলাদা৷ এতটাই আলাদা যে ইরানের বাজার না বলে বলা যেতেই পারে বাজারের ইরান৷ সে অনেক দিনের বিপুল তোড়জোড়৷ সেই মধ্যযুগ থেকে তৈরি হয়েছে ইরানের এক একটা ডাকসাইটে বাজার৷ ত্যাবরিজ়, ইসফাহান, ইয়্যাজ়্দ্— বিভিন্ন শহরে৷
তেহরানের বাজার-ই-বোজোর্গ, গ্র্যান্ড বাজারের সামনে পৌঁছে আমার যে অবস্থাটা হল তাকে সোজা বাংলায় বলে হকচকিয়ে যাওয়া৷ এখন চোখ বন্ধ করলে মাথার ভিতরে গমগম করতে থাকে অফুরন্ত রঙের হৈ চৈয়ের মধ্যে ছড়ানো ছিটোনো কালো৷ তাকে কোনও সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে সাজিয়ে বর্ণনা করার সাধ্যি আমার নেই৷ শুধু মনে আছে সব কিছুই কেমন বিশাল বিশাল আর সব কিছুই কেমন নতুন নতুন৷ এক বিশাল ছাদের তলায় গলির পরে গলি৷ পরে ইরান রিভিউ-এ পড়েছিলাম সব মিলিয়ে ১০ কিলোমিটার! মেন গেট ছাড়াও বাজারে ঢোকার অজস্র গেট৷ কিন্তু তা দিয়ে ঢোকার আগেই পুরোদস্তুর বাজার শুরু হয়ে যায়৷
সারি সারি শুখা ফল আর বাদামের দোকান৷ বিশাল বিশাল স্তূপে চূড় করে রাখা আখরোট, কাঠবাদাম, আঞ্জির, কাজু আরও অজস্র রকমের বাদাম যা আগে কখনও দেখিনি৷ পেস্তা আর অলিভের আচার জয়তুনের স্তূপ দেখে তাক লেগে যায়৷ তার পাশেই পরপর পরপর প্যানিরের দোকান— সাদা, ঘিয়ে, হলদেটে রঙের চূড়৷ তার পাশেই ফল৷ বড়সড় গোলার সাইজের ডালিমের পাহাড়— অ্যানর৷ আর ওইগুলো দেখতে হুবহু বড়সড় টোমাটোর মতো, কিন্তু টোমাটো নয়৷ ওর ভিতরটা শাঁস ভর্তি৷ চিনির মতো মিষ্টি৷ খোরমালু৷ খাওয়া তো দূরের কথা আমি আগে কখনও দেখিইনি৷ যদিও পরে খোঁজ খবর করে জেনেছি আমাদের গাব ফলের ভায়রাভাই৷ আমি অবিশ্যি গাবও খাইনি কখনও৷ ইরানের সর্বত্রই দেখেছি সাংঘাতিক জনপ্রিয়৷ কেজিতে নয়, লোকজন ক্রেট ক্রেট কিনছে৷ বাজারের ঠিক সামনেই বিশাল চওড়া শান বাঁধানো রাস্তা৷ দুধারে চিনার গাছের সারি৷ মোটর গাড়ি চলাচলের জন্য নয় সে রাস্তা৷ এক পাশে চলছে শখের ঘোড়ার গাড়ি৷ বাকিটা হকারদের দখলে৷ মোজা থেকে কফি, পুতুল থেকে সোয়েটার সব কিছুই তারস্বরে চেঁচিয়ে বিক্রি হচ্ছে ঝুড়িতে, টেবিল পেতে, কাঁধে ফেলে৷
চোখ আটকে যায় একজন হকারের টেবিলে৷ থরে থরে ভেড়ার আস্ত মাথা আর খুর সহ পা— ইরানের বিখ্যাত ‘ক্যালে প্যাচে’৷ ‘ক্যালে’ মাথা৷ ‘প্যাচে’ পা৷ জনপ্রিয় প্রাতঃরাশ৷ কাঁচা কিনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রাঁধেন না সকলে৷ রান্না করা ক্যালে-প্যাচের নির্দিষ্ট দোকান আছে৷ ভোর হওয়া মাত্র সেখানে ভিড় জমে৷ যত শীত তত ভিড়৷ ইয়্যাজ্দ্ শহরে ঢুকে পড়েছিলাম এমনি এক ভিড়ে৷ বন্ধু শাহ্রাম জানে শহরের উৎকৃষ্টতম ক্যালে-প্যাচের হদিশ৷ ছোট্ট দশ ফুট বাই দশ ফুট দোকান৷ ঢুকেই ডান পাশে মোজায়িক টালিতে বাঁধানো এক চৌবাচ্চার মধ্যে একটা বিরাট হাঁড়ি সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা৷ সেই হাঁড়িতে ক্যালে আর প্যাচের চর্বি চবচবে স্যুপ৷ তার পিছনে দোকানি৷ তাকে ঘিরে ক্রেতাদের ভিড়৷ প্রায় সকলেই পার্সেল নিচ্ছেন৷ দোকানির কানে মোবাইল ফোন ঘাড় বেঁকিয়ে ধরা— বুঝতে পারি ফোনেই অর্ডার আসছে একের পর এক৷
আমি আর শাহ্রাম দোকানের দুটো ছোট্ট টেবিলের একটা দখল করি৷ ল্যাভশ রুটি আর মাখন চলে আসে৷ একজন ওয়েটার-কাম-সহকারীও আছেন৷ কোন অংশটা দেব? বিষয়টা নিয়ে আমি আগেই মৃদু খোঁজখবর নিয়ে রেখেছিলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে জানাই— ‘ম্যাঘ্জ়্ ওয়্যা জ়্যাবন৷’ মগজ আর জিভ৷ হাঁড়ি থেকে ডাব্বু হাতায় উঠে আসে ধুমায়িত কড়া গন্ধের স্যুপ৷ পাশে রাখা একটা ক্যালে থেকে খুঁচিয়ে জিভটা আর ঘিলুর খানিকটা বার করে নিয়ে প্লেটের উপর চামচ দিয়ে থেঁতলে হাল্কা লেবু ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সঙ্গে সেই ধোঁয়া ওঠা স্যুপের বাটি৷ অপূর্ব৷ পাটনার হাড্ডি-কংকড়নেওয়ালি শীতের সকালে গান্ধি ময়দানের পিছনের মুসলমান পট্টিতে ঘুপচি শান-এ-হিলাল রেস্তোরাঁর উপাদেয় গোশ্ত নেহারির কথা মনে পড়ে৷ কিন্তু সে স্যুপ লাল৷ এ স্যুপ ঘিয়ে রঙের৷ সে স্যুপ অনেক বেশি মশলাদার, এ স্যুপ তুলনায় ফিকে৷ কিন্তু একটা আশ্চর্য গন্ধ আছে, যেটাকে বলা যায় প্রগাঢ়৷ আর সঙ্গের মাংসটা মাখনের মতো নরম৷ মনে মনে ভাবি, বাংলায় এভাবে ভেড়ার জিভের স্যুপ খাওয়া মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত বাড়িতে কল্পনাই করা যায় না৷ অথচ কী উপাদেয় খেতে৷ মনের কী সাংঘাতিক দেওয়াল, আমরা যাকে রুচি বলে চালাই!
(ক্রমশ)