Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিক্ষোভ এবং বিজ্ঞান

পৌলমী সোমন্যা

 

অ্যামেরিকার মিনেয়াপলিস থেকে বিক্ষোভের ঢেউ পৌঁছে গেছে অ্যামস্টারডামে। গত বুধবার, ১০ই জুন, অ্যামস্টারডামের বাইল্মের এলাকায় একটি black lives matter বিক্ষোভে আমি অংশগ্রহণ করি। আমার সঙ্গে গেছিল আরেকটি মেয়ে। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রবাসী ভারতীয়দের বিক্ষোভে তার সাথে দেখা হয়। কোভিড লকডাউনের আগে। সেই বিক্ষোভের পর তিন মাস কেটে গেছে। বাড়িতে কাটানো তিনটে মাস। হাত গুঁটিয়ে বেড়ালের মতো নিজেকে নিয়ে থেকেছি।দিনে দিনে বুঝেছি আমার পরিস্থিতি কতটা সিকিউর। এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও গায়ে একটাও আঁচড় লাগে নি। এতো মৃত্যু দেখেও ঘুমোতে পারি। এটাই কী সবচেয়ে অস্বাভাবিক? সবচেয়ে অমানুষিক?

সেই বিক্ষোভের পর এই বিক্ষোভ। প্রথমবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে লোকের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ানো। হাত মুঠো করে উপর দিকে তোলা। পা ভাঁজ করে নতজানু হাজার হাজার মাস্ক পড়া মানুষের মধ্যে থাকা। বক্তৃতা। কবিতা। গান। রাগের বহুরূপী সুন্দর মুখ। বারবার প্রশ্ন করা, আগে কোথায় ছিল সবাই? কোথায় ছিল? পোস্টারে এখন যে শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিরা লিখেছেন, it is everyone vs. racists, তাঁরা এর আগে vs. কথাটির কোন দিকে ছিলেন? এর পর কি সব বদলে যাবে? এর পর কী বদলাবে? অথচ, সবকিছুর মধ্যেই হতাশা খোঁজা পাপ, তাই আমিও বলেছি হ্যাঁ বদলাবে, বদলে বদলে যাবে।

বিক্ষোভের দিন সকালবেলা বৈজ্ঞানিকদের প্রিপ্রিন্ট সার্ভার arxiv থেকে একটি ইমেইল পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছিল। যেই লাইনটা দেখে সব থেকে হোপফুল মনে হয়েছিল সেটা এখানে তুলে দিলাম —

“We acknowledge that in research, as in life, people often perpetuate bias and systemic racism, both consciously and unconsciously.”

এর আগেও এরকম কথা শুনেছি তবে এতোটা পরিষ্কার ভাবে নয়। বিশেষত বৈজ্ঞানিকদের কাছ থেকে নয়। বিদেশে এসে দেখেছি unconscious bias-এর উপর কোর্স দেওয়া হয়, বলা হয় বিজ্ঞান মহলে diversity নামক একটি বস্তুর খুব অভাব। এর একটি প্রাক্টিকেল ফল হচ্ছে যে, বৈজ্ঞানিক ইন্সিটিউটে গ্রুপফোটো তোলার আগে ফোটোগ্রাফার মেয়েদের, বিশেষত তারা শ্বেতাঙ্গ না হলে, আগে আসতে বলেন। কলেজ অথবা বিভাগের ওয়েবসাইটে উৎসাহী এবং হাসিখুশি “diverse” শিক্ষার্থীদের ছবি দেখা যায়। Unconscious bias কথাটা conscious bias-এর চেয়ে শুনতে অনেক বেশি ভালো। অনিচ্ছাকৃতভাবে যা করা হয় তাকে দোষ হিসেবে দেখা যায় না। তার নিজস্ব কোন বিশেষ ইতিহাস নেই। সে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ভুল। ভুল সংশোধনের জন্য চাই ট্রেনিং, মৃদুমন্দ আলোচনা। এর জন্য বিপ্লবের কোন প্রয়োজন নেই।

অপর দিকে systemic কথাটার অর্থ এই যে, যা করা হয়েছে বা যা করা হচ্ছে তা ব্যক্তিগত কাজকর্মের দিকে নজর রাখলে বোঝা যায় না। Systemic bias অথবা systemic racism বুঝতে গেলে আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবকে বুঝতে হবে। সেই ভুল সংশোধন করবার একমাত্র রাস্তা লড়াই এবং বিপ্লব। ঠুনকো ট্রেনিঙে বিশাল এই superstructure-কে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। Arxiv-এর ইমেইল দেখে মনে হল বৈজ্ঞানিক মহলেও বিক্ষোভের ঝড় ধীরে ধীরে হলেও উঠেছে। অথচ, আমার রিসার্চ গ্রুপ নীরব। আমার ইন্সিটিউট থেকে লম্বা এক ইমেইলে জানানো হল তাঁরা বৈষম্য দূর করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কীভাবে কাজ চালাবেন কিছুই বলা হল না। ডিরেক্টরকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন পরবর্তী এক ইমেইলে জানানো হবে। জানানোর দায়িত্ব পড়ল সেই diversity team-এর ঘাড়ে।

ইমেইলের আশা বহু দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বিজ্ঞান যে ক্ষমতার অধীন তাও মেনে নিয়েছি। অন্য সব ভাষার মতো বিজ্ঞানের ভাষাও যে ইতিহাসের হাতেই গড়া তাও বুঝি। কিন্তু কোথাও না কোথাও মনে হয় বিজ্ঞানের মধ্যে এখনো বিপ্লবের বীজ বেঁচে রয়েছে। বিজ্ঞান কেবল প্রযুক্তির কারখানা নয়, বাস্তবকে বোঝার এবং ব্যাখ্যা করবার উপযুক্ত হাতিয়ার। বিজ্ঞানকে decolonise এবং revolutionise করবার দায়িত্ব সকল বৈজ্ঞানিকের। না করতে পারলে আধুনিক বিজ্ঞান পরবর্তী কালে scientific racism এবং pseudoscience-এর পর্যায়ই রয়ে যাবে।


চিত্র: An example of scientific racism. “Types of mankind or ethnological researches, based upon the ancient monuments, paintings, sculptures, and crania of races, and upon their natural, geographical, philological, and biblical history” (Nott, Gliddon, 1854) (J.C. Nott and Geo. R. Gliddon/Google Books). License: Creative Commons Attribution 4.0