Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে

মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে -- ইশরাত তানিয়া

ইশরাত তানিয়া

 

এক টুকরো মেঘ কখন যেন ঢুকে পড়েছে তানিয়ার বারান্দায়।

রেলিং আর গ্রিল উধাও হয়ে সেখানে একটা শিউলিগাছ দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিধোয়া বিকেলে আকাশে হলুদ আলো লেগে আছে। এমন নরম আলোয় চারদিক ঘোলাটে হয়ে শুধু বারান্দাটা ফোকাসড হয়ে থাকে। সেখান থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ বিভ্রান্ত হলে দোষ দেওয়া যায় না।

ছুটির বিকেলগুলোয় তানিয়া কোথাও যায় না। ইদানিং চায়ের মাগ হাতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা দেখার নেশা পেয়েছে ওর। বিকেলটাকে দেখতে না পেলেই তীব্র অস্বস্তি চেপে ধরে। শুধু একটা মামুলি বিকেলমুহূর্ত যেন মহাকালে মিশে গেল না, প্রাণের কেউ অনন্তে হারিয়ে গেল। আর ফিরে পাওয়ার নয়।

স্কুলে বন্ধুরা ওকে ডাকত— ‘মেলো ইয়েলো’। এত দিন পর মনে পড়ে না এই নামে ডাকার কারণ কী ছিল? কোকাকোলা কোম্পানি নাকি মাউন্টেন ডিউর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক নরম পানীয় বানিয়েছিল। পৃথিবীর লেবুগুলোর স্বাদ আর গন্ধ নিয়ে এই পানীয় কোমল হলদে রঙের হয়ে উঠেছিল কেন তানিয়া জানে না। লেবুর সঙ্গে সবুজাভ কোনও নাম হলে মানিয়ে যেত। এতেও ‘মেলো ইয়েলো’ ডাকার কারণ শেষ পর্যন্ত বোঝা যায় না। এই পানীয়টি বাংলাদেশে পাওয়া যেত কি না সেটাও সে জানে না। বৃষ্টিভেজা শেষ বিকেল পাকা লেবুর মতো হলুদ আভা ছড়িয়ে এসব ভাবিয়ে তুলল।

তানিয়ার সেই মেলো ইয়েলো বয়সের মধ্যবিত্ত জীবনে বিশাল বারান্দা ছিল না। বাবা তখন সরকারি অফিসারদের জন্য বরাদ্দ কোয়ার্টার্স পেয়েছে। ই টাইপ বিল্ডিংগুলো ১৮শ স্কয়্যার ফিটের হলেও বারান্দাটা ছিল এক চিলতে। মৃদু হলুদ আর কালো বর্ডারের উজ্জ্বল বারান্দায় পা ফেলে চমকে উঠেছিল তানিয়া। বিশাল এক বটগাছ। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। বাবার মুখেই শুনল ওটা শিউলিফুলের গাছ। সে অবশ্য বটগাছও চেনে না। টিভিতে দেখেছে বটগাছ প্রকাণ্ড হয়ে থাকে। কেউ কি ভেবেছে তিনতলার বারান্দায় এমন উঁচু গাছ থাকতে পারে?

বারান্দার ডান দিকের প্রায় পুরোটা জুড়ে মাটি। আগে যারা ছিল ওরাই মাটি ফেলে শিউলিগাছ লাগিয়েছিল। বারান্দার দরজাটা তালা দেওয়া থাকত। কোন সোনার চাবিকাঠিতে এ দরজা খোলা যায় সেটা জানলেও, স্টিলের আলমারির ওপর রাখা চাবির গোছায় হাত দেওয়ার সাহস তানিয়ার হত না। বারান্দায় শুধু রেলিং দেওয়া। গ্রিল নেই। সঙ্গে লাগোয়া প্যাঁচানো সিঁড়ি। যে কেউ সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে ঢুকে যেতে পারে। সেদিকে গ্রিল না দেওয়া পর্যন্ত তালা খোলার প্রশ্নই ওঠে না। বারান্দার দরজার দুপাশে সরু দুটো জানলা। সিটারের ওপর দাঁড়ালে জানলার নাগাল পাওয়া যায়। কাঠের ফ্রেমে কাঁচের জানলা খুলে দিলেই ওপাশে তানিয়ার ওয়ান্ডারল্যান্ড। যেদিন বারান্দা খুলে যায়, লাগোয়া ঘরটিতে আলোবাতাস আর ধরে না। ঘর পেরিয়ে উপচে পড়া সে আলোয় সারা বাড়ি ভরে যায়। বাবা ওজু করে ভেজা গামছা বারান্দায় মেলে দেয়। মুগ্ধ হয়ে বলে— কী সুন্দর বাতাস! বাবা জানে না, বাতাস শিউলিগাছের পাতাগুলো ছুঁয়ে আসে বলেই এত সুন্দর হয়ে যায়।

শেকড়সহ সেই শিউলিগাছ বারান্দা থেকে ধীরতম গতিতে পড়ছে তো পড়ছেই। কী অনিবার্য এই পতন। শিউলিগাছটা বাঁচবে না। বাবার মুখে এ কথা শুনেই দম বন্ধ হয়ে এসেছিল তানিয়ার। অকরুণ পৃথিবীর বাতাস কেটে কেটে শিউলিগাছ মাঠের সবুজের কাছাকাছি চলে যায়। আইডিয়াল স্কুলে সেদিন ঘণ্টা বাজে না। তামার পাতে হাতুড়ির বাড়ি ঢং ঢং শব্দ করে না। যেন শিউলিগাছের জন্যই এই শোকস্তব্ধতা। শাবল আর কোদালে মাটিগুলোও একদিন উধাও হয়ে যায়। ওই জায়গাটুকু জুড়ে শুধু গাঢ় খয়েরি চিহ্ন লেগে থাকে। কোনও কিছুতেই মোছে না। সেই কবে বিশ বছর আগে তানিয়ারা কোয়ার্টার্স ছেড়ে চলে এসেছে। শিউলিগাছের মায়া নিয়ে দাগটুকু আরও খয়েরি হয়েছে।

এরপর ভাড়াবাসার হাঁফধরা ঘর। ঘরের জানলাটা পর্যন্ত তানিয়ার খুলতে ইচ্ছে করত না। শুয়ে শুয়ে কতদিন সে একটা সবুজ বারান্দার কথা ভেবেছে। নিজের একটা বারান্দার খুব ইচ্ছে। ছোটমতো হলেও। জানলার ওপাশে ছিল আরেক বাড়ির শোবার ঘরের জানলা। প্রতিদিন সকাল, সন্ধ্যায় কিংবা রাতে এক লোক খালি গায়ে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। কী যে বিচ্ছিরি লাগত তানিয়ার। তখন পর্দা টানা থাকলেও পরনের কাপড় ছাড়তে অস্বস্তি। একদিন চুল থেকে তোয়ালে খুলে চেপে চেপে পানি মুছে নিচ্ছে সে, জানলা দিয়ে লোকটাকে দেখে চমকে উঠেছিল। পর্দা যে অনেকটুকু সরে গেছে লক্ষ্যই করেনি। কোনও মতে পর্দা টেনে, সাদা টেপ পরেই হতভম্ব হয়ে বসে ছিল আধঘণ্টা। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ধুকপুকানি থামেই না। সেদিন শাহ্‌ স্যারের মার্কেটিং রিসার্চ কোর্সের ক্লাস মিস হয়ে যায়। এরপর জানলাটাই সে আর কখনও খোলেনি।

 

গাছগুলোতে আজ পানি দিতে হয়নি। জরিনা এসে আটা মাখাচ্ছে। মা বৃষ্টির আগেই বেরিয়ে গেছে। চাচাতো বোনের ছেলের বিয়ে। বাসায় থাকলে এখন রাগ করত— “ভরসন্ধ্যার বৃষ্টির বাতাস অনেক ঠান্ডা। ঠান্ডা লেগে যাবে।” মা ফোন করেছিল। বৃষ্টির মধ্যে দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে শেষমেশ বরযাত্রীরা সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছে। বউ ফারজানা শাকিল’স-এ আটকা পড়েছে। বিয়েবাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে নির্ঘাত মায়ের রাত হবে। পোলাও-রোস্ট খেয়ে মা কি আর রুটিসবজি খাবে? জরিনাকে শুধু দুটো রুটি বানাতে বলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তানিয়া।

দুপুর থেকেই গুমোট। চড়া রোদে দুপুরে খেতে বসে ফ্যানের তলে ঘামছিল মা আর মেয়ে। পুঁই-চিংড়ির চচ্চড়ি ভাতে মাখাতে মাখাতে মা বলে— আজকে ঝড় হবে।

-কীভাবে বুঝলে?
-একদম হাওয়া বাতাস নাই। কয়েকদিন ধরে কেমন ভ্যাপসা।

কই মাছের শক্ত কাঁটা দাঁতে চেপে টেনে বের করে তানিয়া। দুপুরে ঘামতে ঘামতেই কাঁচা আমের শরবত বানিয়েছে। হালকা সবুজ রঙের টক ঝাল মিষ্টি স্বাদ। এক মুঠো পুদিনাপাতা দিয়েছে, সামান্য বিটলবণ। গরমের দিনে এই শরবত খুব রিফ্রেশিং।

-যাওয়ার আগে আমের শরবত খেয়ে যেও।
-যা অ্যাসিডিটি! খেতে ইচ্ছা করে আবার ভয় লাগে! ফ্রিজে রেখে দিও।
-রেখেছি। কখন বের হবে?
-আগেই যাব। যদি ঝড় আসে? দেরি করা যাবে না। ভালো কথা, জিজ্ঞেস করতে মনেই থাকে না, এ মাসের বিল দিতে হবে না?
-বিল এখনও আসেনি। খোঁজ নিয়েছিলাম। দেরি হবে। নতুন করে হিসাব করছে। সার্ভিস চার্জ বাড়াবে।

ভাত খেয়ে মা-মেয়ে দুজনের ঘরে চলে যায়। মা ডান কাত হয়ে বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ওপাশ থেকে রোদের সবটুকু তাঁর চোখের পাতায় এসে ঝলসাচ্ছে। পর্দা টেনে দিলে শান্তি লাগত। মা বাঁ দিকে পাশ ফেরে। মেয়েটা তাঁর যেন কেমন। ভাসা ভাসা। থেকেও যেন কোথাও নেই। জীবনের বাস্তবতা, অসংলগ্নতা, গরমিলকে নিজের মতো করে বুঝে নেয়। দায়িত্ব-কর্তব্যটুকু ঠিকভাবেই পালন করে কিন্তু জগৎ শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, এই সত্য মেয়ের আধা উদাস-আধা বুদ্ধিবিবেচনার মাথায় ঢোকে না।

রোদের ঝাঁঝ কিছু কমেছে। বিশ্রামের আলস্য কাটিয়ে স্টিলের আলমারির সামনে দাঁড়ায় মা। হালকা গোলাপি সপুরা সিল্কের শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখে বেশ আরাম লাগে।

নিজের ঘরে গিয়ে কৌটা খুলে মৌরি মুখে দেয় তানিয়া। মৌরির মিষ্টি সুবাস অস্থি-রক্তে মিশে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এই ঘ্রাণটা ভালো লাগে ওর। উপন্যাস হাতে নিয়ে গা এলিয়ে দেয়। পেইজ মার্কার সরিয়ে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পড়ে। চাঁদনি রাতে কুসুম আর শশীডাক্তার কথা বলে। গভীর দুঃখের সঙ্গে শশীডাক্তারের মনে হয়, কুসুমের কথা সব বানানো। বলে। চারপাশ জোছনার আলোয় স্বপ্ন দেখছে। শশীডাক্তারের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না, এমন সময় কুসুমের কুটিলতার বিষে এত কষ্ট পাওয়া ওর ভাগ্যে ছিল। “…কিন্তু কেন সে দাঁড়াইয়া আছে, কেন সে চলিয়া যাইতে পারে না, কে জানে, হয়তো জীবনের বিতৃষ্ণা ও আত্মগ্লানি-ভরা মুহূর্তগুলির আকর্ষণ তার কাছেই এত তীব্র?” এই বাক্যটা পড়ে উপন্যাসের পাতা থেকে চোখ তোলে তানিয়া। সাদা দেওয়ালের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।

দুপুরের রোদ বেশ থিতিয়ে এসেছে। ঠান্ডা হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে। তানিয়ার ত্বক একই সঙ্গে গরম আর ঠান্ডা হাওয়াকে স্থির হয়ে গ্রহণ করে। এই হাওয়াতেই শশীডাক্তারের গভীর অনুভূতি ওর মনে ঘুরপাক খায়।

চারতলার বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। দুচাকা, তিনচাকা, চারচাকা সবই চলে। বৃষ্টি ধরে এলেও রাস্তা বেশ ফাঁকা। ভাবেনি এত জলদি সিটি কলেজের লেকচারার পোস্টে চাকরি হয়ে যাবে। কলেজের কাছাকাছি তাই এই বাসা নেওয়া। বাড়তি পাওয়া শোবার ঘরের সঙ্গে এই বারান্দা। এখান থেকে অবশ্য বহুদূরে হারিয়ে যাওয়া দিগন্ত দেখা যায় না। ফুটপাথ ঘেঁষে লিকপিকে দুটো সোনালু, একটা জারুল আর ওপরে অনেকটা আকাশ। আকাশী রঙের বাড়ির ছাদ বরাবর আকাশে চোখ মেললে সেখানে মেঘের স্তূপ। ক্ষয়িষ্ণু সূর্যের বিপরীতে সেখান থেকে সন্ধ্যা নেমে আসছে।

ইলশেগুঁড়িতেও টঙের দোকানে যুবক আর বয়স্কদের ভিড়। সেদিকে তাকিয়ে চায়ের তৃষ্ণা জাগে তানিয়ার। সে নিজের হাতে চা বানিয়ে খেতে ভালোবাসে। ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি। অন্যের হাতে এ চায়ের সুবাস আর স্বাদ হারিয়ে যায়। চায়ের কাপে গরম পানি ঢেলে আগে কাপ গরম করে নিতে হয়। হাল্কা গরম পানিতে চা পাতা ছেড়ে দিলে কড়া গন্ধে অপূর্ব স্বচ্ছ সোনালি বর্ণের তেতো মিঠে স্বাদ। সত্যি ‘এ কাপ অফ ওয়েলনেস’। কিন্তু এখন ওর রান্নাঘরে যেতে ইচ্ছে করে না। একটু নড়লেই যেন আসন্ন সন্ধ্যাদৃশ্যের সবটুকু বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।

অবিরাম প্যাঁপু, ক্রিংক্রিং শহরের নৈঃশব্দ্য মুছে দিয়েছে। কল বেল বাজায় পেপারওয়ালা, লন্ড্রিওয়ালা। টিভিতে  উচ্চস্বরে ভাঁড়ামো চলে দিনরাত। ঘরে বাইরে ভিড়ভাট্টায় এই বারান্দাই তানিয়ার আশ্রয়। এখানে এসে দাঁড়ালে শেষ বিকেলের হাওয়া রোমকূপে ঢুকে যায়। এখন যেমন হলদে আলো ওর গালে টুক করে চুমু খেয়ে, রাস্তার ওপাশে সেই উঁচু পান্থ স্কয়্যারের ছাদ পেরিয়ে আকাশে মিশে গেল। বেলির ঝাড় আর অর্কিডগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে সম্মোহিত হয়ে সে গুনগুন করে— চাতক বাঁচে ক্যামনে মেঘের বরিষন বিনে… তানিয়ার মনে হয় ওর কাছে আর মাত্র ১০,৯৫০টা বিকেল আছে। ১০,৯৪৯তম বিকেলে সূর্যাস্ত দেখে ওর ভীষণ মন খারাপ হবে। পৃথিবীতে সৌন্দর্যের রহস্যময় উদ্ভাস আর বিস্তৃতি থেকে যাবে, শুধু সে থাকব না। এই মন খারাপ অর্থহীন নয়। ব্যাখ্যাতীতও না।

টেবিলে দুটো রুটি আর সব্জি রেখে দেয় জরিনা। কাঁচের প্লেটের ওপর দু ফালি লেবু আর ঝকঝকে গ্লাস-বোতল খাবার টেবিলের সৌন্দর্য বাড়ায়। টেবিলের চারপাশে ছয়টা চেয়ার। একটাই ব্যবহার হয়। বড়জোর দুটা। বাকি চারটায় ওপর ধুলার মিহি প্রলেপ পুরু হয়ে ওঠার আগেই মুছে ফেলে তানিয়া। বন্ধের দিনগুলো কেটে যায় আলমারির কাপড় ভাঁজ করে, ন্যাপথালিন দিয়ে। আসবাবপত্রের ধুলো ঝেড়ে। বুকশেলফের বই গুছিয়ে আর গাছের গোড়ায় একটু নিড়ানি দিয়ে।

জরিনা বারান্দায় উঁকি দেয়। ঝাড়ু ফেলে নিজের কোমরে দু হাত রেখে বলে— ও আপু! কয়বার ডাকলাম আমনেরে। খাইতে যান।

-হু। যাই।
-রুটি ঠান্ডা হইয়া যাইব।
-হু।
-বইমেলা আইতাছে। এইবার বই বানাইবেন না?
-অ্যাঁ। বই বানায় নাকি?
-হ বানায় তো! বানাইয়া ব্যাচে। মাইনষে কিন্যা পড়ে।
-তাই?
-হ। ত্যাল আর ভিম বার শ্যাষ।
-আচ্ছা। টাকা নিয়ে যেও। কালকে আসার সময় কিনে আনবে।
-কালকে আসতে পারুম না। সুমনরে নিয়া যামু ডাক্তারের কাছে।
-ঠিক আছে। আমিই নিয়ে আসব। তোমার বোনের ছেলে?
-হ। ছোড বোইনের। বিউটির পোলা।

‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিট্যুড’-এর ওপর সেলফোন। কল লিস্টে পরাগ আর জেরিনের নাম। সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখার কথা। ও কনফার্ম করলে পরাগ টিকেট কাটবে। পরাগ এসেছিল স্বপ্নের ঘোরে। লজ্জিত, বিচলিত স্বপ্নের ঘোর পেরোলে তানিয়ার ফুটফুটে শরীরটুকুই শুধু পরাগের ধর্তব্য। তবু তানিয়ার শরীরভরা শূন্যতা। মন এত একা। সে মনের গতিপ্রকৃতি সব সময়ই পরাগের নাগালের বাইরে থেকে যাবে। এই অনুভব আজকাল তানিয়াকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। জেরিনকে টেক্সট করে দেয়— তোরা যা, আমার শরীর ভালো না।

ফোনে অনলাইনে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চেক করে সে। অন্যান্য বিল ডেবিট করার পরও ইএমআইয়ের জন্য ব্যালেন্স থাকবে। নতুন ফ্রিজের জন্য আর চার মাস ইএমআইয়ের টাকা কাটবে। ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্টের টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট করার অটো ইন্সট্রাকশান দেওয়া আছে।

আঙুল অজান্তে কিপ্যাডে সে লেখে ‘মেলো ইয়েলো’। গুগল করে। স্কটিশ গায়ক ডোনোভ্যান এই শিরোনামে একটা গান গেয়েছিল। গানটা ডোনোভ্যানেরই লেখা। গত শতকের ৬০ দশকের মানুষেরা ইউএস টপচার্টের শীর্ষে থাকা এই গান হয়তো শুনে থাকবে। সবাই ভেবেছিল ‘মেলো ইয়েলো’ কলার খোসা পুড়িয়ে ধোঁয়ায় নেশা করার মতোই কিছু একটা বোঝায়। “হোয়াট ইজ মেলো ইয়েলো?” এই বহু পুরনো প্রশ্নের উত্তরে ডোনোভ্যান জানায়— মোটেও তা না! একদিন খবরের কাগজ পড়ছিলাম। শেষ পাতায় হলুদরঙা ডিলডোর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। নাম ছিল মেলো ইয়েলো। এখন ‘ইলেকট্রিক ব্যানানা’র দাপট চলছে, জানেন তো? এই যে প্রতিস্থাপন, এটাই মেলো ইয়েলোর সারকথা। ভারি আশ্চর্য হয় তানিয়া। জীবিত মানুষের দেহে মাথা কিংবা মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপন করা গেলে ভালো হত। ধাপে ধাপে তানিয়া কোনও সন্ন্যাসীর, আদিবাসীর মাথা গ্রহণ করত। কখনওই আর আগের মানুষটি থাকত না। পুরনো মাথা আর মস্তিষ্ক সরে গেলে নতুন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় চেনা পৃথিবীটা আর জীবনটা বদলে যেত। সে হয়তো আমিত্ব থেকে বেরিয়ে নিজেকে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারত।

কলা চাষের কথা মনে পড়ে তানিয়ার। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিট্যুড’-এর পাতা উল্টায়। বুকের নিচে বালিশ চেপে ধরে পড়ে মাকন্দো গ্রামটি কেমন করে ধীরে ধীরে শহর হয়ে ওঠে। বহুজাতিক কোম্পানি সেখানে ঢুকে যায় কলা চাষের অজুহাতে। বুয়েন্দিয়া পরিবার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি-তে চুমুক দেয় তানিয়া। মাকন্দো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ। অবশেষে ঝড়ে বন্যায় মাকন্দো এক ধ্বংসস্তূপ। শুধু নিঃসঙ্গতা থেকে যায়। চিৎ হয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ফলাফল সেই কত আগে দেখে ফেলেছে কলম্বিয়ান মার্কেজ। এত ভাবার কিছু নেই অবশ্য। মা ফোন করেছে আজ ফিরবে না। জরিনার হাতে কিছু টাকা সে দিয়ে দেয় সুমনের জন্য।

তানিয়ার আছে একটা পড়ার টেবিল। যা ইচ্ছে লেখার জন্য একটা কলম। ভাবনা লেখার একটা নোট খাতা। ল্যাপটপও আছে অবশ্য। একটাই। প্রয়োজনীয় লেখাগুলো কম্পিউটারে লেখে সে। একই সঙ্গে কম্পোজ আর এডিটের কাজ হয়ে যায়। দুদিন আগে আইডিবি ভবনে ল্যাপটপ দিয়ে এসেছে সার্ভিসিং আর রিপেয়ারের জন্য। আজই নিয়ে আসার কথা। সাপ্তাহিক ছুটিতে সে আর বেরোয়নি। পরাগকে বললে দিয়ে যেত। কেন যেন ওর অনুরোধ করতে ইচ্ছে হল না। কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে নিজেই নিয়ে আসবে।

বেডসাইড টেবিল থেকে চন্দন কাঠের কলম তুলে নেয় তানিয়া। সুবাস ছড়ানো কলমের গায়ে ময়ূর খোদাই করা। সামনে ধাতব নিব। নোটখাতা খুলে তাকিয়ে থাকে। কী লিখবে ভেবে পায় না। কল্পনার অতলে ডুবে প্রবালে মুখ গুঁজে থাকা ভাবনার গেঁড়ি-গুগলি-শামুক থেকে ঝিনুক সেঁচে আনে। ভেতরে যদি উজ্জ্বল মুক্তো মেলে, সেটা হতে পারে কবিতা কিংবা কবিতার মতো কিছু।

 

তানিয়ার নাম যখন মেলো ইয়েলো, বিটিভির ছোটদের অনুষ্ঠান ‘অঙ্কুর’-এর রেকর্ডিং থাকত প্রায়ই। অঙ্কুরের গ্র্যান্ড শো-র জন্য ড্রেস কোড ছিল ফুলস্লিভ হলুদ টপ আর নি-লেংথ কালো স্কার্ট। মা কাপড় কিনে সেলাই মেশিন চালিয়ে টপ-স্কার্ট বানিয়ে দিয়েছিল। হতে পারে প্রিয় সেই টপ বার বার পরত বলেই এমন নামে ডাকত বন্ধুরা। হলুদ রঙের একটা শেডের নাম ‘মেলো’। বান্ধবীদের নাম ছিল পেপ্স জেল, সুন্দরী প্রিন্ট। আরও কী সব নাম! মুক্তোঝরা মধুময় হাসি আর রূপে অপরূপ বলেই ওদের এসব নামকরণ। স্কুলেরই নায়কভাবওয়ালা এক সিনিয়ার ছেলের নাম ওল্ড স্পাইস। মর্নিং শিফটে মেয়েদের ক্লাস। ছেলেদের জন্য ডে শিফট। ক্লাস শেষ আর শুরুর সময়টা ছাত্র আর ছাত্রীদের আশ্চর্য অলৌকিক সম্মিলনের। ঠিক সম্মিলন নয়। আসা-যাওয়ার পথে একটু দেখা, সামান্য কথা, কখনও চিঠি ইত্যাদির সংযোগ। মর্নিং আর ডে শিফটের মায়েরা পরস্পরের কাছ থেকে জেনে নেয় কী কী পড়ানো হয়েছে। টিচারদের কেউ স্কুলে ঢোকে কেউ বেরিয়ে যায়।

এ সময় বাউন্ডারি দেওয়ালের লোহার গেটের একটু দূরে ওল্ড স্পাইস বন্ধুদের নিয়ে গান গায়— এ মন করেছে চুরি, প্রিয় প্রিয় সুন্দরী…

গান শুনে সুন্দরী প্রিন্টের ফর্সা মুখ রক্তিমাভায় ছেয়ে যায়। পেপ্স জেল বলে— তোকে শোনাচ্ছে। শুনছিস? সুন্দরী প্রিন্ট শাড়ির গান।

সুন্দরী প্রিন্ট নিচুস্বরে বলে— অ্যাই, চুপ চুপ…

মেলো ইয়েলো চোখ মেলে একবার তাকিয়েছিল ওল্ড স্পাইসের দিকে। কাঁধে ব্যাগ। শাদা শার্ট আর নেভি ব্লু প্যান্ট পরা। কী সাহস! ইউনিফর্ম পরে গান গাইছে। স্কুলে কমপ্লেইন গেলে কী হবে, এসবের থোড়াই কেয়ার করে ওল্ড স্পাইস! এই বেপরোয়াভাবটা ভালো লাগত তানিয়ার। ভালো লাগা পর্যন্তই। ওল্ড স্পাইসের গলায় শাড়ির বিজ্ঞাপনের গান শুনে সে মিষ্টি এক চেহারায় আবিষ্ট হয়ে যায়। নায়িকা মৌসুমীর চুল আর আঁচলে হাওয়ার দোলা লাগে। সে হাওয়ায় তানিয়ার চশমার কাচও দুলে ওঠে। মৌসুমী সুন্দর। এটা বুঝে ফেললেও তখনও সে মেলো ইয়েলো নামের মাহাত্ম্য বোঝে না। মায়ের হাতে চালানো বাটারফ্লাই সেলাই মেশিনের শব্দটা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে আসে।

 

নোটখাতা রেখে তানিয়া পানির ঝাপটা দেয় চোখে মুখে। বেসিনের আয়নায় মুখ দ্যাখে। কপাল আর গাল ঢেকে গেছে গোছা গোছা কেশচূর্ণে। কোনও রকম হেয়ার ট্রিটমেন্ট ছাড়াই টুইস্টেড ব্যাংস। সেখানে পানির ফোঁটা জ্বলছে হীরার কুচি হয়ে। ঢেউ খেলানো চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়ে গেছে। চোখে কাজলের হালকা আভাস। উঁচু করে পনিটেল করে তানিয়া। লোশান লাগায় ধীর ধীরে।

বাসাটা ফাঁকা হয়ে গেলেও বড় হয়ে যায়নি। তবু মনে হয় দুই বেডরুম, দরজা, জানলা, কিচেন, বারান্দা সব মিলিয়ে কত বড়! লিভিং রুমের দেওয়ালে শকুন্তলার ব্রাসওয়ার্ক ডান দিকে হেলে গেছে। সেটা ঠিক করে তানিয়া। একটু দূরে গিয়ে দ্যাখে। কাছে এসে আরেকটু বাঁয়ে ঠেলে দেয়। বসার ঘরের জানলা লাগিয়ে মানি প্ল্যান্ট থেকে দুটো বাদামি পাতা তুলে বিনে ফেলে দেয়। মায়ের বিছানার চাদর আরেকটু টান টান করে। ভাঁজ করা কাঁথা আলমারিতে তুলে রাখে।

বাড়ি জুড়ে শব্দ নেই, দৃশ্য আছে। নিঃশব্দ হাসি যেমন শোনার নয় দেখার। তেমনি বাড়িটাকে পুরাতত্ত্বের মতো খুঁড়ে খুঁড়ে দ্যাখে তানিয়া। এ যেন প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। কতকিছু বাকি রয়ে গেছে জানার, বোঝার। মাঝে মাঝে পুরাকীর্তির এক আধলা ভাঙা মাটির চারা খুঁজে পায়। সেদিন পাতা আলগা হয়ে আসা শরৎ রচনাবলির ভেতর পেল মা-বাবার বিয়ের ছবি। অ্যালবাম থেকে খুলে পড়ে গিয়েছিল কখনও। মা তুলে রেখেছে। সময়ের সঙ্গে কত কিছু যে হারিয়ে যায়। আমরা টের পাই না। এই ছবিটাও হারিয়ে যেতে পারত। আসলে হারিয়েই গিয়েছিল, ফিরে এসেছে। তানিয়ার এই নিজেকে যেমন নিজের একলা করে দেওয়া, সে কি আর ফিরে আসার? প্রতিটি মানুষের জীবন অন্যের জীবন থেকে আলাদা। সেই আলাদা জীবনও তো বদলে যায়। ওর কলেজ, স্টাডি সার্কেল আর লেখালেখিতে মা কি একলা হয়ে যায়নি? বাবাও নেই। কত কথা হয়তো জমিয়ে রাখে, ভুলে যায়। প্রয়োজনীয় কথাগুলোও ক্রমশ ধুসর হয়ে মুছে যায়।

রুটি-সব্জি টেবিলে পড়ে থাকে। ফ্রিজ করতে মনে থাকে না। মধ্যরাতে আলো নিভে যাওয়া শহরের বারান্দায় কিছু হচ্ছে। তানিয়ার ঘুমলাগা চোখ দ্যাখে একটা বারান্দাই হচ্ছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ওল্ড স্পাইস, পরাগ, শশীডাক্তার আর মার্কেজ নিজেরদের ভাষায় কী যেন বলছে। ওদের হাতে লেমন ফ্লেভার্ড মেলো ইয়েলো। একশো বছরের নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে পড়ছে টুকরো টুকরো হয়ে।

নাগরিক বারান্দার উথালপাথাল জোছনায় ভিজতে থাকে তানিয়া। সেখানে একটা শিউলিগাছ সাদা ফুল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আবহে হলুদ টপ উড়ছে।