বিভাবসু দে
রামচরণ পাগল হয়ে গেছে, অনেকদিন হল। রাতে ঘুমোয় না, দিনেও না— খোলা চোখে খোয়াব দেখে— হাসে, কাঁদে, মাঝেমাঝে চিৎকার করে গালমন্দও করে। কাকে করে, কেউ জানে না। শুধু জানে, রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল।
তবে পাগল হলেও একটা জিনিস কখনও ভুল হয় না রামচরণের— ঠিক সন্ধের মুখমুখ ও এসে দাঁড়ায় স্কুলের গেটটার সামনে। গেট তখন বন্ধ, স্কুল ছুটি হয়ে যায় অনেক আগেই। তবু রামচরণ আসে, রোজ আসে। আকাশে দিনের শেষ আলোটুকু তখন মিশে যায় অন্ধকারের নিরেট অবয়বে— রাস্তার বাতিগুলো ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দে দপদপ করে, কেউ একজন এসে বোতাম টিপলেই একসঙ্গে সবাই জ্বলে উঠবে বলে। ঠিক যেমনভাবে জ্বলে ওঠে শুকনো বারুদের স্তূপ, ছোট্ট একটা ফুলকির ছোঁয়ায়। রাস্তায় গাড়ি ছোটে, ধুলো ওড়ে আর বর্ষার দিনে কাদাগোলা জল। স্কুলের দারোয়ানটা বন্ধ গেটের বাইরে আপনমনে বিড়ি টানতে টানতে ঝিমোয় আর দেহাতি সুরে ভজন গায়। রামচরণ ঘোলাটে চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে চারপাশটা। স্কুল, স্কুলের ভারী লোহার গেট, পাশে সুপুরি গাছের মতো ঢ্যাংঢ্যাঙে লম্বা ল্যাম্পপোস্ট আর পেছনে রাস্তার ওপারে খানিকটা ঘাসের গালিচা পেরিয়ে অন্ধকার জঙ্গলের মতো সার সার পাকা বাড়ি। ছোট-বড় নয়, ঠিক একই ধাঁচে গড়া প্রতিটা দালান— বাবুদের কোয়ার্টার। দেখলে মনে হয় যেন কোনও এক বিশাল দৈত্যশিশু নিজের খেয়ালে একগাদা খেলনা বাড়ি সাজিয়ে রেখেছে সার দিয়ে।
রোজকার মতো রামচরণ আজও অবাক চোখে এই সবকিছু দেখল। তারপর কেমন যেন ঘোর-লাগা ভঙ্গিতে তাকাল স্কুল-গেটের ওপাশে রাখা সবুজ রঙের ঢাউসমার্কা সরকারি ডাস্টবিনটার দিকে— ঠিক রোজ যেমনভাবে তাকায়। আসলে দিনের এই সময়টায় বোধহয় রামচরণের খিদে পায়, তাই এখানে আসে। ওই ডাস্টবিন হল ওর একমাত্র খাবার খোঁজার জায়গা! কলোনিতে আরও অনেক ময়লা ফেলার বড় বড় আস্তাকুঁড় আছে, কিন্তু রামচরণ শুধু এখানেই খায়। অনেকটা ওই চাতক পাখির প্রবাদের মতো ব্যাপার আর কী— লোকে বলে চাতক পাখি নাকি তেষ্টায় ছাতি ফেটে মরে যাবে তবু বৃষ্টির জল ছাড়া খাবে না। এও সেই কেস! রামচরণও যে রোজ খাবার পায় তা নয়— কোনওদিন জোটে, কোনওদিন জোটে না। না জুটলে তেমন অসুবিধের কিছু নেই, সেদিনের খিদেটা পরদিনের খাতায় বকেয়া হিসেবে জমা হয়ে যায়, এই যা!
আস্তে আস্তে মুখ-খোলা ডাস্টবিনটার দিকে এগিয়ে গেল রামচরণ। সন্ধে প্রায় হয়ে এসেছে— আরেকটু পরেই সরকারি বাতিগুলো জ্বলে উঠবে। তবে আপাতত চারপাশে শুধুই আবছা অন্ধকার। রামচরণ ডাস্টবিনের ভেতর কিছুটা ঝুঁকে দেখল— আজ ডাস্টবিনটা প্রায় খালি, নিচে তলানির দিকে শুধু কী যেন কিছু পড়ে আছে। আরও খানিকটা ঝুঁকল সে। কাগজের তেরঙ্গা পতাকা, মাঝখানে চাকতি আঁকা। গতকাল স্বাধীনতা দিবস ছিল কিনা, আস্ত স্কুল সাজানো হয়েছিল কাগজের ছোট ছোট পতাকায়। ওই যেমনটা হয় আরকী সবখানে। আজ সকালে আবার সেসব সাফ-টাফ করে এনে ফেলা হয়েছে এই আস্তাকুঁড়ে।
তবে রামচরণ এখনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি যে তলানিতে পড়ে থাকা জিনিসগুলো খাদ্য না অখাদ্য! যদিও পাগলের খাদ্যাখাদ্যের শ্রেণিবিন্যাসটা ঠিক কীভাবে হয়, আমার জানা নেই। তিনরঙা কাগজের টুকরোগুলো ধরবার জন্যে আরও বেশ অনেকটা ভেতরে ঝুঁকে পড়ল রামচরণ— তার অর্ধেক শরীর প্রায় ডাস্টবিনের ভেতরে; পেটের ওপর ভর দিয়ে পা-দুটো খানিকটা মাটি-ছাড়া, তবু কিছুতেই হাত পৌঁছচ্ছে না ওই গভীর অন্ধকারের তলানিতে। আস্তাকুঁড়ের একপাশের দেয়ালটা একহাতে ধরে আরেক হাতে নিচটা ছুঁতে চাইছে রামচরণ, একেবারে মরিয়া চেষ্টা— অনেকদিনের বকেয়া খিদে জমে আছে হয়তো!
সে ঝুঁকতে ঝুঁকতে প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছিল আস্তাকুঁড়ের নিচটা, কিন্তু এমনসময় হঠাৎ একটা অবাক কাণ্ড ঘটল। রামচরণের দেয়াল-ধরা হাতটা গেল ফসকে, আর অমনি ঝুপ করে আস্তাকুঁড়ের ভেতর পড়ে গেল সে। পড়ে তো গেল কিন্তু তলানিতে গিয়ে ঠেকল না রামচরণ! পড়ছে তো পড়ছেই— যেন একটা গভীর সুড়ঙ্গ। থামবার আর নাম নেই। যত নিচে নামছে ততই যেন আরও ঘনিয়ে উঠছে ভেতরের অন্ধকারটা— কুচকুচে আলকাতরা-কালো অন্ধকার। ভাগ্যিস রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল, নইলে এমন অবস্থায় কোনও সুস্থ মানুষ ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে প্রায় আধমরা হয়ে যেত… কিংবা পাগল। কিন্তু সে এসব কিছুই করল না— যেমন অবাক চোখে সে চারপাশে গজিয়ে ওঠা এই কলোনিটাকে দেখে ঠিক তেমনই অবাক চাউনি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হড়হড় করে আস্তাকুঁড়ের ভেতর আরও গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। এর শেষ কোথায়, খোদায় মালুম! হয়তো পৃথিবীর কেন্দ্রে!
নাহ, কেন্দ্র অবধি পৌঁছোবার ভাগ্য তার হল না, এর আগেই কোথায় একটা যেন জব্বর ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল রামচরণ। আস্তাকুঁড়ের তলায়? মাটিতে নাকি পাথরে? কীসে ধাক্কাটা খেল সে?
বিছানায়! হ্যাঁ। রামচরণ চোখ মেলে দেখল সে একটা বিছানার ওপর বাবু হয়ে বসে আছে। হাতে কাঁঠালের রস দিয়ে মাখা একবাটি মুড়ি। চারপাশে ঝলমল করছে সকালের রোদ্দুর। বিছানাটার ঠিক গা-ঘেঁষে একটা জানালা— পাল্লাদুটো হাট করে খোলা। বাইরে গাছগাছালিতে ঘেরা একচিলতে মেটে উঠোন। রামচরণ যে ঘরটায় বসে আছে, সেটাও মাটির— পালিশ করে নিকোনো। মাথার ওপর খড়ের চাল। রামচরণের কাপড়গুলোও সব কেমন যেন ভোজবাজির মতো বদলে গেছে— একটা প্রায় নতুন লুঙ্গি আর গায়ে একটা রং ঝলসে যাওয়া সাধারণ ফতুয়া। বয়সটাও যেন হুশ করে নেমে গেছে বছর বিশেক!
গ্রামদেশে কোনও মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল চাষির ঘরে যা যা থাকতে হয় সেসবই আছে এই ঘরটায়। রামচরণ বারদুয়েক ঘোলাটে চোখে এপাশ-ওপাশ তাকাল বটে, তবে খুব একটা অবাক হল না। হয়তো ওর চোখে অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই এখানে! ভাগ্যিস রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল, তাই আর বেশি কিছু না ভেবে আবার আপনমনে বাটি থেকে কাঁঠাল রসে মাখানো মুড়ি খেতে লাগল। গাছ-পাকা কাঁঠাল কিনা, স্বাদই আলাদা।
“একটু নুন দিমু? হজম ভালো হইব।” ওপাশের একটা ঘর, সম্ভবত রান্নাঘর, সেখান থেকেই হাতে এক চিমটি নুন নিয়ে বেরিয়ে এল বছর তিরিশের মেয়েটি। গায়ে ঘরোয়া আটপৌরে শাড়ি, মাথায় খানিকটা ঘোমটা দেবার ব্যর্থ চেষ্টা, কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম, এলোমেলো চুল, সিঁথিতে সিঁদুরের লালচে আভা আর দু’চোখে একটা অকারণ হাসির ঝিলিক। স্রোত না থাকলেও নদীর বয়ে-চলা অস্তিত্বের সঙ্গেই যেমন মিশে থাকে একটা স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গীত, তেমনই কিছু কিছু মানুষের মুখেও কারণ ছাড়াই একটা হাসির ছোঁয়া সবসময় লেগেই থাকে। ঠিক যেন কানায় কানায় ভরা কলসি— থেকে থেকে আপনি ছলকে পড়তে চায়। এও তেমনই।
রামচরণ মুখ তুলে তাকাল মেয়েটির দিকে। তারপর বলল, “দেও একটু। স্বাদ বাড়ব বই তো কমব না।” রামচরণের মুখ দিয়ে যেন আপনি বেরিয়ে এল কথাগুলো। কেন, কীভাবে, সে নিজেও জানে না। জানতে চায়ও না— ভাগ্যিস রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল!
মেয়েটি ফিক করে হেসে এগিয়ে এল রামচরণের দিকে। রামচরণও বাটিটা এগিয়ে দিল। “হাসো কেনে বউ?” কথাটা জিগ্যেস করতে গিয়ে খানিকটা হাসি রামচরণের মুখেও ছড়িয়ে পড়ল। ওর ঘোলাটে চোখদুটো যেন আস্তে আস্তে কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
মেয়েটার চোখের পাতা আপনি নিচে নেমে গেল— হাসিতেও যেন একটু লজ্জার রং। সে জবাবে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু এমনসময় হঠাৎ, “রামচরণবাবু বাড়িতে আছেন?” কে যেন অপরিচিত গলায় এসে হাঁক পাড়ল উঠোনে দাঁড়িয়ে।
মেয়েটি আর দাঁড়াল না, ত্রস্ত হরিণীর মতো ঘোমটা টানার একটা অযথা চেষ্টা করতে করতে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
রামচরণও খানিকটা অবাক হয়ে গেল নিজের নামের পরে ওই বাবু সম্বোধন শুনে। তাড়াতাড়ি হাতের বাটিটা রেখে বাইরে দরজার সামনে যেতেই চোখে পড়ল স্যুট-বুট পরা বেশ শহুরে কেতাদুরস্ত একজন লোক— হাওয়ায় ভাসছে! কাঁধের কাছে দুটো তিনরঙা ডানা, ঠিক যেন একটা বিশাল বাজপাখি। লোকটার মুখে একচিলতে বিগলিত হাসি আর হাতে একটা কালো অফিস-ব্যাগ।
ভাগ্যিস রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল, তাই ডানাওয়ালা মানুষ দেখেও তাজ্জব হল না। তবে ডানাদুটোর দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ— রংগুলো ভারী সুন্দর, বড্ড মনে ধরেছিল ওর। লোকটা আগের মতোই বিনয়ী হাসি হেসে আবার জিগ্যেস করল, “নমস্কার। আপনিই শ্রীযুক্ত রামচরণ দাস?”
এবার যেন হুঁশ ফিরল রামচরণের। ডানা থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমিই।”
“যদি অনুমতি করেন তাহলে একটু ভেতরে আসতে পারি?”
রামচরণ ব্যস্ত হয়ে বলল, “আসেন আসেন।” দরজা ছেড়ে দাঁড়াল, কিন্তু ওই তেরঙ্গা ডানাদুটো থেকে চোখ সরল না তার। আগন্তুক এসে ঘরে ঢুকল— হাওয়ায় ভেসে ভেসেই ঢুকল। চারপাশটায় বেশ করে একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নিল রামচরণের ঘরটা; রান্নাঘর থেকে বেগুনভাজার গন্ধ আসছে। লোকটা আস্তে আস্তে গিয়ে বসল রামচরণের বিছানাটায়— রামচরণও বসল মুখোমুখি। ডানাগুলো কী সুন্দরভাবে গুটিয়ে পিঠের সঙ্গে সেঁটে যাচ্ছে।
লোকটা কোনও ভনিতা না করেই কথা শুরু করল, “আচ্ছা রামচরণবাবু, আপনি দেশকে ভালোবাসেন না?”
রামচরণ তখনও ওই ডানার কথাই ভাবছিল। হঠাৎ থতমত খেয়ে বলল, “দেশ!”
লোকটার সুরে যেন আবেগের মাত্রা খানিকটা বেড়ে গেল হঠাৎ– “হ্যাঁ, দেশ। আপনাদের গ্রাম, এমন আরও অনেক অনেক গ্রাম, শহর, জেলা, রাজ্য মিলিয়ে যে বিশাল একটা দেশ, আমাদের মাতৃভূমি, তাকে ভালোবাসেন না আপনি?”
রামচরণ কী বুঝল কে জানে, তবে সম্মতির ঢঙে ঘাড় নাড়ল বটে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকটার গলা যেন আনন্দে কেঁপে উঠল, “তবে আর দেরি কেন, আসুন দেশের বিকাশে দশের কল্যাণে আমাদের রাষ্ট্রবাদী কোম্পানির এই সুমহান কর্মযজ্ঞে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। আমাদের প্রতিটি কাজ দেশের কাজ, মানুষের কাজ। এই দেখুন…”, বলতে বলতে ব্যাগের চেন খুলল লোকটা। রামচরণ দেখল সেখান থেকেও তেরঙ্গা আলো বেরোচ্ছে, যেন রামধনুর শুধু তিনটে রং কেউ আলাদা করে পুরে রেখেছে ওই ব্যাগের ভেতর। লোকটা ব্যাগ থেকে একদলা আলো বের করে আনল— কেমন যেন চোখ-ধাঁধানো আলো। তারপর সেই আলোর দলাটা রামচরণের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতেই রামচরণ অবাক হয়ে দেখল সেটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে ওর সারা ঘরে। কেউ যেন স্বাধীনতা দিবসের ওই তেরঙ্গা পতাকায় মুড়ে দিয়েছে ওর গোটা ঘরটা। ঠিক যেন একটা ঘোর-লাগানো স্বপ্নের মতো সেই আলো একটু একটু করে ঘনিয়ে উঠতে লাগল রামচরণের চোখের ওপর— নদীর বাঁধ, তার ওপারে একটা বিশাল বাড়ি। ঘটাং-ঘটাং করে কতসব মেশিন চলছে সেখানে, হাজার হাজার ডানাওয়ালা লোক উড়ে উড়ে কাজ করে চলেছে, যন্ত্রের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে তেরঙ্গায় মোড়া সার সার বাক্স। নেপথ্যে কোথায় যেন একটা স্বাধীনতা দিবসে বাজানো গানের সুর বাজছে। শিরশির করছে রামচরণের শরীরটা।
লোকটা বলল, “রামচরণবাবু, এই যে দেখছেন, এটা আমাদের নতুন কারখানা। নদীর বাঁধের ওপারে তৈরি হচ্ছে। বহুলোক কাজ করছে সেখানে। যখন এই কারখানা তৈরি হয়ে যাবে, এই অঞ্চল শিক্ষায় স্বাস্থ্যে উন্নয়নে শহরকেও ছাপিয়ে যাবে। আপনাদের এই গ্রামের চেহারা পাল্টে যাবে।”
রামচরণ আচ্ছন্নের মতো শুনছিল লোকটার কথাগুলি। লোকটা একটু থেমে আস্তে আস্তে রামচরণের হাতদুটো নিজের হাতে তুলে নিল; গভীর অনুরোধের সুরে বলল, “রামচরণবাবু আমাদের এই কাজে আপনার সাহায্য চাই। আপনি আমাদের সঙ্গে কারখানার কাজে যোগ দিন, কারখানা গড়তে সাহায্য করুন আমাদের। চাষ করে যত পান তার চেয়ে ঢের বেশি পাবেন, হাতে হাতে নগদে পাবেন। তাছাড়া স্বাস্থ্যবীমা, জীবনবীমা, ছেলেমেয়ের পড়াশুনোর বন্দোবস্ত সব করে দেবে আমাদের রাষ্ট্রবাদী কোম্পানি। আমরা ব্যবসা করতে আসিনি রামচরণবাবু— দেশের কল্যাণ, আপনাদের কল্যাণই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। দয়া করে না বলবেন না, মনে রাখবেন এ-কাজ দেশের কাজ। এই দেশের জন্যে কত লোক নিজের বুকের রক্ত দিয়েছে, সেনারা সীমান্তে প্রাণ দিচ্ছে রোজ, আর আপনি এটুকু করতে পারবেন না?”
রামচরণ কিছুক্ষণ চুপ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে জিগ্যেস করল, “আমারও তিনরঙা ডানা হইব আপনের মতন?”
“একশোবার। দেশের কাজে আপনি নিজেকে যত উজাড় করে দেবেন, তত বড় আর রঙিন হয়ে উঠবে আপনার ডানা— ঠিক দেশের পতাকার মতো। আপনি হাওয়ায় ভেসে বেড়াবেন। কোনও চিন্তা থাকবে না আপনার।” আগন্তুকের গলায় যেন জাতীয়সঙ্গীতের মূর্ছনা শুনতে পাচ্ছিল রামচরণ। থিরথির করে কাঁপছিল ওর ভেতরটা। চোখের সামনে থেকে এই ঘর, এই গ্রাম, ওই গাছগাছালি ঘেরা উঠোন মিলিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে উঠছিল একটা দেশ— তার চোখে দেখা, চেনা এই গ্রামের চেয়ে অনেক অনেক বড় একটা অচেনা দেশ। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল রামচরণের। দেশের জন্যে দশের জন্যে কাজ করবে সে— টাকা পাবে, পিঠে দেশের রংমাখা ডানা গজাবে, লোকে জয়জয়কার করবে!
ঘরের ভেতর তিনরঙা আলো যেন আরও ঘনিয়ে উঠছিল একটু একটু করে— নেশার মতো রামচরণের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল একঝাঁক স্বপ্ন! সে মাথা নেড়ে বলল, “আমি রাজি।”
লোকটার মুখে হাসির ঝলকানি খেলে গেল, পিঠে সেঁটে থাকা ডানাদুটো ফরফর করে ছড়িয়ে পড়ল দু’পাশে। ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করতে করতে সে বলল, “তবে এখানে একটা সই করুন।”
রামচরণ সই করল— ঘন আলোয় ছেয়ে গেল সবকিছু, চারদিক থেকে রাষ্ট্রগান বেজে উঠল, পুরোটা ঘর ঢেকে গেল তেরঙ্গা পতাকায়। একটু একটু করে চোখের সামনে থেকে ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে যেতে লাগল তার বাড়ি, উঠোন, কাঁঠাল-রস মাখা মুড়ির বাটি আর সেই ডানাওয়ালা লোকটা— রামচরণ এখন হাওয়ায় ভাসছে! তার পিঠেও দুটো তেরঙ্গা ডানা; ভেসে ভেসে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু একা নয়— ওই তো ওরই গাঁয়ের ওসমান শেখ, মোড়ল খুড়ো, মদন তাঁতি, দুর্গা… ওরাও উড়ছে। ওদের পিঠেও ডানা। রামচরণ নিচে তাকিয়ে দেখল— চাষের জমিগুলো ফুটিফাটা হয়ে খালি পড়ে আছে। বাঁধের জল এখন আর এদিকে আসে না, যা আসে তা শুধুই কারখানার ময়লা ঘোলা জল।
রামচরণ উড়তে উড়তে কখন যে বাঁধ পেরিয়ে ঢুকে পড়ল সেই কারখানায়, নিজেও টের পেল না। ওড়া-পথে সময় বড় তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায়। তার সঙ্গে আরও শয়ে শয়ে লোকও এসে ঢুকেছে। সেই গেরুয়া, সাদা আর সবুজে সাজানো কারখানায় সবাই উড়ছে আর কাজ করছে— দেশের কাজ, দশের কাজ। বিশাল বিশাল মেশিনে স্বদেশী স্বপ্ন গড়ার কাজ। দৈত্যের মতো বিরাট বিরাট যন্ত্র বসানো হচ্ছে, ঘটর-ঘটর শব্দ উঠছে; তবু যেন তাতে কেমন একটা স্বদেশী গানের সুর— নেশা ধরায়। শরীরে হঠাৎ যেন সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগুন জ্বলে ওঠে। দেশের কাজ, দশের কাজ। রামচরণও হাত লাগাল কারখানা গড়ার কাজে, ডানা ঝাপ্টে ঝাপ্টে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খাটতে লাগল। সারা শরীর বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল রঙিন ঘাম! রামচরণ আরও মেতে উঠল।
কিন্তু এসবের মাঝে হঠাৎ একবার ওপরে তাকাতেই তার চোখে পড়ল একটা আজব ব্যাপার— চারপাশ থেকে বৃষ্টির ছাঁটের মতো টাকা উড়ে উড়ে পড়ছে, কিন্তু মাটিতে নামছে ছিটেফোঁটা মাত্র। সেগুলোই কাড়াকাড়ি করে কুড়িয়ে নিচ্ছে ওর মতো আরও অনেক ডানাওয়ালা মানুষেরা; রামচরণও পেল কিছু। কিন্তু সিংহভাগটাই কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে কারখানার তিনরঙা আলোয়— এমনভাবে উবে যাচ্ছে যেন কখনও ছিলই না! কোথায় যায় এত টাকা? কে পায়? দেশ? নাকি…!
প্রশ্নগুলো যখন সবে মেঘের মতো জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল ওর মনে, তখনই কে যেন ফিসফিস করে কানের কাছে বলে উঠল, “দেশের কাজে দশের কাজে টাকার হিসেব করতে নেই রামচরণবাবু। দেশের চেয়ে বড় কেউ নেই, কিছু নেই। ভুলবেন না, কত বীর সৈন্য রোজ শহিদ হচ্ছে এ-দেশের জন্যে।”
রামচরণ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল; এ-গলা তো সেই লোকটার। কিন্তু কোথায় সে? চোখে পড়ল না। শুধু মাথার ভেতর কে যেন মন্ত্রের মতো অনবরত আউড়ে যেতে লাগল, “দেশের চেয়ে বড় কেউ নেই, কিছু নেই।” রামচরণ আবার সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল কারখানা তৈরির কাজে— দেশের কাজে। ওর ডানাদুটো আরও বড়, আরও রঙিন হয়ে উঠতে লাগল, ঠিক কারখানার ভেতর ঘনিয়ে ওঠা ওই তেরঙ্গা আলোর মতোই। পকেটের টাকাগুলো যে কখন কীভাবে হাওয়া হয়ে গেল, সে নিজেও বুঝতে পারল না।
সন্ধে হল, আস্তে আস্তে সব শব্দ থেমে গেল। কারখানার শেষ যন্ত্রে শেষ নাট-বল্টুখানাও কষে দেওয়া হয়েছে— কারখানা তৈরি। দেশ গড়ার এই চরম মুহূর্তে শরীরের স্নায়ুতে স্নায়ুতে কেমন একটা আনন্দ যেন তিরতির করে বয়ে যেতে লাগল রামচরণের। এখন এই কারখানায় কত জিনিস তৈরি হবে, সেসব জিনিস দেশে বিদেশে বিক্রি হবে— দেশের দশের আয় হবে তাতে। ঘরে টাকা আসবে, রঙে রঙে ভরে উঠবে ওদের জীবন।
কিন্তু তখনই হঠাৎ কে যেন আবার ফিসফিস করে তার কানে কানে বলে উঠল, “রামচরণবাবু, দেশের কাজে এই মহৎ অবদানের জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কারখানা গড়ার কাজ শেষ, সব যন্ত্র তৈরি; বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়াররা, যারা যন্ত্র চালাবেন তাঁরাও শহর থেকে এসে পড়েছেন… এবার আপনি আসতে পারেন।”
ভাগ্যিস রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল, তাই সে বাকিদের মতো চিৎকার রাগারাগি কিছুই না করে চুপচাপ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কারখানাটা আপনা-আপনি আবছা হয়ে আসছিল ওর চোখের সামনে থেকে। ক্রমশ ধূসর হয়ে আসা দৃশ্যপটে সে দেখতে পাচ্ছিল ওসমান শেখ, মোড়ল খুড়ো, মদন, দুর্গা আরও কত লোক জটলা করে লাঠিসোটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে কারখানার বাইরে— চিৎকার করছে, কেউ কেউ কাঁদছেও। ওই যে গাড়ি ভরে ভরে পুলিশ আসছে ওদিক থেকে— কাঁদানি গ্যাস, লাঠি… হঠাৎ দুটো গুলির শব্দ উঠল আকাশ কাঁপিয়ে। রামচরণের মনে পড়ে গেল, সীমান্তে রোজ কোনও না কোনও জওয়ান শহীদ হচ্ছে… মাত্র দুটো গুলি, বেশি তো নয়।
আস্তে আস্তে সব মিলিয়ে গেল… নিভে গেল সেই তেরঙ্গা আলোও, থেমে গেল রক্ত গরম করা দেশাত্মবোধক গানের ঘোর। শুধু ডানাদুটো রয়ে গেল এখনও। রামচরণ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল, সে তার গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটা সত্যিই ওর গ্রাম তো? বছর কয়েকের অনাবাদিতে আর কারখানার ঘোলা জলে চাষের জমিগুলো এমনভাবে হেজেমজে শুকিয়ে গেছে যে দেখলে এখন বোঝাই যায় না কোনওকালে এখানে চাষ হতো। রামচরণ কেমন যেন নেশার ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ের আরও ভেতরে এগিয়ে গেল— চারপাশে কেউ নেই, শুধুই শ্মশানের মতো নিস্তব্ধতা। অকারণেই যেন তার আবার মনে পড়ে গেল কারখানার সামনে শোনা সেই গুলির শব্দ।
হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করল রামচরণ, সে যত এগোচ্ছে ততই যেন চারপাশের পট পাল্টে যাচ্ছে— মেটে বাড়িগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে তাদের জায়গায় হুশ-হুশ করে গজিয়ে উঠছে পাকা দালানকোঠা। কাঁচা মেঠো রাস্তা, ক্ষেতের আলপথ সব বদলে যাচ্ছে পাকা সড়কে। সেগুলোর দু’পাশে সুপুরিগাছের মতো মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সার সার সরকারি ল্যাম্পপোস্ট। সত্যিই গ্রামের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে! আর তখনই সেই অদৃশ্য কণ্ঠ আবার ফিসফিস করে উঠল— “অবাক হবেন না রামচরণবাবু, এই গ্রামকে আমরা কলোনি বানিয়ে দিয়েছি। কারখানার বাবুরা, কর্মচারীরা থাকবেন; হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ সব হবে। আপনারাও সুবিধে পাবেন।”
রামচরণ নিজের মনেই জিগ্যেস করল, “তাইলে চাষ?”
গভীর বিনয়ী সুরে জবাব এল, “চাষ আর কোথায় রামচরণবাবু? এখানের জমি তো আপনারা আগেই আমাদের সইসাবুদ করে দিয়েছেন, সরকার অধিগ্রহণ করেছে… আর রইল বাকি আবাদি জমির কথা? দেশের স্বার্থে কত লোক প্রাণের আহুতি দিচ্ছে, আর আমরা খানিকটা ফসলী জমিকে কাগজেপত্রে পতিতজমি করে নিতে পারব না! আপনিও আর অমত করবেন না রামচরণবাবু, এতেই দেশের মঙ্গল।”
রামচরণ হাসল। কেন হাসল সে নিজেও জানে না।
পিঠে ডানাদুটো এখনও আছে, গাঢ় তেরঙ্গা পতাকার মতো জড়িয়ে আছে তার পিঠে, চাইলে উড়তে পারে, তবু আর ইচ্ছে করছিল না ওর। হাঁটতেই ভালো লাগছিল। আরও খানিকটা হেঁটে এসে সে দাঁড়াল তার সেই একচিলতে উঠোন-ঘেরা বাড়িটার সামনে। বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে— সেই মেয়েটা যার ঠোঁটে সবসময় হাসি লেগে থাকত, তার আধপোড়া নিথর শরীরটায় এখনও ধিকিধিকি আগুনের শিখা। রামচরণ পাগল, তবু কেন কে জানে, হঠাৎ স্বাভাবিক মানুষের মতো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। নিজের ডানায় মুড়ে ওর গায়ের আগুন নেভাতে চাইল, কিন্তু পারল না। ডানাদুটো রঙিন ধোঁয়া হয়ে স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
এই প্রথমবার বুকফাটা চিৎকারে ভেঙে পড়ল রামচরণ— দেশের প্রান্তে শহীদ সৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আর ওই আকাশ-ছোঁয়া তেরঙ্গা পতাকা, কিছুতেই চোখের জল বাঁধ মানল না ওর। রামচরণ ছাতি চাপড়ে কাঁদল, পাগলের মতো কাঁদল। কিংবা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে গেল!
ভোরের আলোর মতো আস্তে আস্তে স্ট্রিটলাইটের আলোগুলো জ্বলে উঠছে। পেছনের রাস্তায় গাড়ির শব্দ, কলোনির বাড়িগুলোর জেগে ওঠার শব্দ, আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা কারখানার শব্দ— ঠিক যেন জাতীয়সঙ্গীতের সুর! “এয় সালা পাগল, নিকল বে বাহার উহা সে। মুর্দা কে মাফিক পড়া হুয়া হ্যা সালা!” কে যেন অচেনা গলায় ধমকে উঠল পেছন থেকে, সঙ্গে কাঁধের ওপর জোরালো হাতের টান। রামচরণ আস্তে আস্তে উঠে এল সেই ডাস্টবিনের ভেতর থেকে। পাশে স্কুলের সেই দারোয়ান— কড়া দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে।
রামচরণ ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে দেখল সেই খড়ের ছাউনি দেওয়া মেটে বাড়িটা এখন স্কুল হয়ে গেছে, উঠোনটা স্কুলের মাঠ আর যেখানে সেই মেয়েটার আধপোড়া লাশ পড়েছিল, সেখানে এখন সরকারি আস্তাকুঁড়। রামচরণের হাতে একদলা কাগজের তেরঙ্গা— ঠিক ওই ডানাদুটোর মতো।
“ভাগ সালা পাগল, ভাগ ইহা সে।” হাতের লাঠি উঁচিয়ে আবার খেঁকরে উঠল সেই দারোয়ান। সবার মতো সেও জানে রামচরণ পাগল হয়ে গেছিল— ভাগ্যিস পাগল হয়ে গেছিল! তাই চুপ করে কিছুক্ষণ দূরের অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইল রামচরণ, তারপর রোজকার মতো আজও আস্তে আস্তে টলতে টলতে চলে গেল হাতের দলা পাকানো তেরঙ্গাগুলো চিবোতে চিবোতে।