Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিজ্ঞাপনের ভাষা

বিজ্ঞাপনের ভাষা -- অরূপরতন বসু

অরূপরতন বসু

 

বাংলাভাষার এক ব্যতিক্রমী গদ্যকার অরূপরতন বসু (১৯৩৯-২০০৫) সম্বন্ধে রবিশংকর বল বলেছিলেন, “জীবনানন্দ দাশের পর অরূপরতন আমাদের নির্জ্ঞানের সেই ধারাভাষ্যকার...।” গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক অরূপরতন বসুর সৃষ্টিগুলো এখনও নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে পুনরাবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে। অরূপরতনের প্রয়াণের অব্যবহিত পরে ২০০৫-এর জুন মাসে তাঁরই এক সুহৃদ প্রদীপ ভট্টাচার্য উর্বী প্রকাশন থেকে প্রকাশ করেছিলেন স্মরণ, গদ্য, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের এক বাছাই-করা সঙ্কলন— ‘নির্বাচিত অরূপরতন’। বর্তমান গদ্যটি সেই সঙ্কলন থেকে নেওয়া৷ যদিও গদ্যটির প্রকাশকাল হিসেবে 'কলকাতা' পত্রিকার মার্চ ১৯৭৪ সংখ্যার উল্লেখ আছে৷ সেদিক থেকে বিচার করলে অরূপরতন বসুর এই টুকরো গদ্যে আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার-পাঁচ দশক আগের কলকাতার বিজ্ঞাপন জগতের সামান্য হদিশ পাওয়া যাবে।

নারী। মর্মস্পর্শিনী, বিহ্বলকারিণী উত্ত্যক্তকারিণী। নারী আর তার রকমারি মেজাজে অনুপ্রাণিত করেছে মেফ্রিন।

ওপরের বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন কোনো এক নামকরা বস্ত্র-ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গ্রুপ। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা মেফ্রিন শাড়ি কিনতে সত্যি-ই ব্যস্ত হয়েছিলেন কি? না, তা মনে হয় না। আমাদের এখানে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনই এরকম। বিজ্ঞাপন লেখকেরা ইংরেজি থেকে বাঙলায় দায়সারা অনুবাদ ক’রেই খালাশ। আর তা যে কতদূর উদ্ভট হ’তে পারে সে-বিষয়ে একেবারে কাণ্ডজ্ঞানহীন। ঐ একই বিজ্ঞাপনের পরের লাইনটি পড়ুন: ‘এখন মহিলাদিগকে সর্বত্রই মেফ্রিন শাড়িতে দেখবেন।’ এই ‘মহিলাদিগকে’ কিংবা নারী। মর্মস্পর্শিনী, বিহ্বলকারিণী কি কোনো বাঙালির তো দূরের কথা, এমনকি কোনো বাঙলা-জানা বিদেশীর— যেমন ফাদার দ্যতিয়েন কি কমল মজুমদারের— পক্ষেও লেখা সম্ভব?

কলকাতার প্রায় প্রতিটি রাস্তায় অজস্র বিজ্ঞাপন। এদের রেখা ও রঙের কায়দা হয়তো আধুনিক, আমি জানি না বিদেশে এসব কী রকম, কিন্তু এটা জানি যে এগুলির অধিকাংশের বাঙলায় না আছে বুদ্ধি, না ব্যকরণ। অবশ্য  এমন বিজ্ঞাপনও আছে যা বাঙলায় লেখা বলেই চেনা যায়। কিন্তু মনে ক’রে দেখুন সেই,

গড়তে দেশ নিতে ঋণ।
ইউ বি আই এর সাহায্য নিন।

অথবা একটা চারমিনার ধরিয়ে ‘একটু জিরিয়ে নিন’— এর সংখ্যা কত কম। ‘পুরুষের মতো কামানো কি তোমাকে মানায়, ডেপিল ব্যবহার করলেই তো হয়’— রসিকতাটা তেমন চালাক না-হোক, বিষয়টা এমন যে ছেলেরা একটু মুচকি না হেসে পারবে না, এবং মেয়েদের মনে বার্তাটা খচখচ করবে৷ কিন্তু ৯০% বিজ্ঞাপন লিখিয়ে কি একটা সহজ মিলও নিতে পারেন না? ‘গোল্ডস্পট খেতে কেমন, তিনটাকা সের ইলিশ যেমন।’

সেদিন চায়ের টেবিলে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে হঠাৎ-ই মনে পড়লো জবাকুসুমের সেই স্নিগ্ধ লাবণ্যময়ী মেয়েটাকে অনেক দিন দেখিনি। তার জায়গায় প্রায়ই শুয়ে থাকে অন্তর্বাস পরিহিতা, মুক্তনাভি এক আধুনিকা। ফিনলের সেই আলুলায়িত ধুতিপরা লম্বা স্বাস্থ্যবান যুবকটিই বা গেলো কোথায়? তার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে জাঁকালো জুলপিওয়ালা, ঝাঁকড়া যুবক চুলো ঢলঢলো প্যারালালে ও ঝোলা গোঁফে তাকে প্রায় মার্কিন ছবির উদাসীন সর্বশক্তিমান শ্বেতাঙ্গ দস্যু-নায়কের মতো দেখায়। আসলে এখনকার প্রায় সমস্ত বিজ্ঞাপন লক্ষ করলেই বোঝা যায়, এই অসম্ভব নিম্নক্রয়ক্ষমতার গরিব দেশে স্বচ্ছল ক্রেতা কারা। তাদের বেশভূষা কী রকম। মুখমণ্ডলের চেহারাই বা তাদের কতখানি নির্বিকার। মনে হয় তারা যেন বিদেশ থেকে কদিনের কন্ডাক্টেড টুরের বাসে চেপে বেড়াতে এসেছে এদেশে। একদিকে ইয়োরোপীয় প্রাচুর্যের ছায়ায় দৌড়ুতে থাকা এদেশের বিত্তবান ক্রেতাদের প্রাণপণ মনোরঞ্জনের চেষ্টা, অন্যদিকে ব্যাপক গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্তদের এক অলীক বিজ্ঞাপনের গাধার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অবিশ্বাস্য আলিবাবার স্বপ্ন-গুহার দিকে— এই দুয়ের টানাপোড়েনের ধাক্কায় আমাদের এখনকার বিজ্ঞাপন হ’য়ে উঠেছে ক্রমশ স্থূল, অবাস্তব ও হাস্যকর।

মনোমোহন ব্যানার্জি কলকাতার এক খ্যাতনামা ও সমৃদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান ক্ল্যারিয়ন ম্যাককানের অন্যতম পরিচালক আমাকে বেশ জোরের সঙ্গেই বারবার মনে করিয়ে দিলেন: ‘দেখুন ক্রেতাদের মধ্যে যাঁরা একটু খোলা মনের, মানে যাঁরা চটপট আন্তর্জাতিক রুচি রপ্ত করতে পারেন, তাঁদের টানার দিকেই আমাদের নজর বেশি।’ এবং বিজ্ঞাপনব্যবসায়ীদের আদর্শ এই জুলপিশোভিত মহামানবেরা সকলেই ইংরিজি বলেন।

আমি বললাম, ‘কেন?’

মি. ব্যানার্জি বললেন, ‘কেননা ক্রেতাদের মধ্যেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছেন। সংখ্যায় অল্প হ’লেও শেষকালে তাঁদেরই নকল করেন বেশির ভাগ লোক, যাঁরা সংস্কার কিংবা অভ্যাসবশত সবসময়ই পেছিয়ে থাকেন।’

‘আপনারা কি ক্রেতাদের রুচি পালটানোর চেষ্টা করেন?’
‘তা করি বইকি, আগে কটা লোক টেরিলিনের শার্ট পরতো— এখন দেখুন সামান্য কেরানির ছেলেরও টেরিলিন পরা চাই। টেরিলিনের দাম আগের চেয়ে শস্তা হয়েছে? মোটেই নয়।’
‘তাহলে আপনারাই এদের রুচি পাল্টে দিয়েছেন?’
‘নিশ্চয়ই। বেশভূষায় কিংবা রুচিতে আন্তর্জাতিক কায়দাটা আমরাই চালু ক’রে দিই।’
‘কিন্তু সুস্থ রুচিবোধ তৈরি করা অথবা কোনো বদরুচিকে ভাঙার কাজ আপনারা করেন?’
‘না সেটা আমাদের কাজ নয়,’ মি. ব্যানার্জি আমার দিকে অসন্তুষ্ট ভাবে তাকান, ‘ওটা পোলিটিশিয়ানদের কাজ।’
‘আর সেইজন্যই কি ইংরেজি বিজ্ঞাপনের দিকে আপনাদের ঝোঁক বেশি?’
‘তা কিছুটা বলতে পারেন। প্রথমত সমস্ত ভারতবর্ষের বাজারের কথা আমাদের ভাবতে হয়, দ্বিতীয়ত ঐ যে আগেই বললাম, ক্রেতাদের মধ্যে যাঁরা “আধুনিক রুচিসম্পন্ন” তাঁরা ইংরেজিরই পক্ষপাতী।’
‘বিজ্ঞাপনের মূল কপিটি সেই জন্যই বাঙলায় না লিখে আপনারা ইংরেজিতে লেখেন?’
‘হ্যাঁ’, মনোমোহনবাবু বলেন, ‘তাছাড়া বাঙলায় অনুবাদ করার সময় আমরা তো একেবারে হুবহু অনুবাদ করতে বলি না, মোটামুটি আইডিয়াটা রেখে একটা ফ্রি ট্রান্সলেশন।’
‘কিন্তু তাহ’লেও আপনার কি মনে হয় না, গোড়াতে বাঙলায় না-ভাবার জন্য বিজ্ঞাপন লেখক মানসিক দিক থেকে কিছুটা ইংরেজিনবিশ হ’য়ে থাকেন।’
‘তা হওয়া উচিত নয়। কেননা, বাঙলায় অনুবাদ করার সময় তাঁকে তো আমরা পুরো ব্যাপারটাই বুঝিয়ে দিচ্ছি- কেবল ইংরেজি কপিটা তাঁর সামনে তাঁকে সাহায্য করার জন্য থাকছে।  তাছাড়া বাঙলাতে বোধহয় সারা কলকাতায় দু-একজনই মূল বিজ্ঞাপন লিখতে পারেন। কাজেই—’ ব’লে আশ্চর্য উনি কিনা নাম করলেন একজন কবির?
‘ঠিক আছে’, আমি এবারে ওঠার আগে তাঁকে প্রশ্ন করি, ‘কিন্তু বাঙলা ক্রেতাদের জন্য দেশী ঐতিহ্য কিংবা লোকাচার, পুজো-পার্বণ ইত্যাদির কোনো ইঙ্গিত বিজ্ঞাপনে কি রাখা সম্ভব নয়?’
‘দেখুন আমাদের সমস্ত ভারতবর্ষের কথা ভাবতে হয়’, বললেন যে কোনো পোলিটিশিয়ানের মতোই৷ ‘তাছাড়া বললাম তো ক্রেতাদের মধ্যে যাঁরা আধুনিক, তাঁরা দেশী ঐতিহ্য-টৈতিহ্যের চেয়ে আন্তর্জাতিক ফ্যাশনই বেশি পছন্দ করেন।’

এরপর অন্য একটি বিজ্ঞাপন আপিসে যাই৷ তাঁরা মোটামুটি দ্বিতীয় ঝোঁকটিরই পক্ষপাতী৷ যেমন ইউ-বি-আই, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্থাপি’ শীর্ষক শিয়ালদ’-র ব্যানার বা ‘গড়তে দেশ নিতে ঋণ’ যা সর্বত্র৷ কিন্তু সেকথা পরে।


বানান অপরিবর্তিত