Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মৃত পাখিদের গান — শেষ পর্ব

অবিন সেন

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

পর্ব – দুই

ছয়

মনে হয় কোনও এক গভীর অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা শব্দ প্রবালকে ডাকছে। সে প্রাণপণে দু-চোখ খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু দু-চোখের পাতায় ভীষণ ভার। কিছুতেই সে সেই ভার ঠেলতে পারছে না। তবু সে আপ্রাণ চেষ্টা করে। এমনি অনবরত চেষ্টার পরে সে চোখ দুটো খুলতে সক্ষম হয়। চোখের সামনে তার আধো আলো আধো অন্ধকার একটা পর্দা যেন দুলছে। ক্রমাগত দুলছে। মাথার ভিতরে তার যন্ত্রণা। বিসর্জনের বাজনার মতো ক্রমাগত বাজনা বেজে চলেছে তার মাথার ভিতরে।

তবু চোখ দুটো তার একটু সয়ে এলে সে দেখতে পায় সামনে একটা আলো। তেমন জোর নেই যেন আলোটার। সেই আলোয় সে চারদিক দেখার চেষ্টা করে। সে হাতদুটো নাড়াতে চেষ্টা করে। তখনই সে অনুভব করে সে একটা চেয়ারের উপরে বসে আছে। তার হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পা দুটোও গোড়ালির কাছে শক্ত করে বাঁধা। আর তার শরীরে নাম মাত্র পোশাক। শুধু কোমরের নীচে অন্তর্বাসের অনুভবটুকু সে টের পাচ্ছে।

সে চারপাশে একবার তাকায়। এবারে তার চোখ ঘরের আলোতে সয়ে এসেছে। একটা বড় ঘর। ঘরে নানারকমের যন্ত্র। তার ঠিক বাম পাশে একটা কাঠের লম্বা চৌকির মতো। তার উপরে কে যেন শুয়ে আছে। সে চোখ টান টান করে দেখার চেষ্টা করে। খাটের সঙ্গে হাত পা বাঁধা এক নারী শরীর। নারীদেহেও পোশাক নামমাত্র। সেই নারীদেহের কাছ থেকেই যেন একটা গোঙানির শব্দ ঘরের অন্ধকারে মাছির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মহিলার মুখটি সে দেখতে পাচ্ছে না।

প্রবালের ভীষণ জল তেষ্টা পায়। ঘরের ভিতরের অদ্ভুত একটা পচা পচা গন্ধে তার গা গুলিয়ে ওঠে। পেটের নাড়ি ভুঁড়ি পাক দিয়ে ওঠে। তখনি একটা ভরাট গলার স্বর সে শুনতে পায়।

গুড ইভনিং, মিঃ সেন।

সেই গলার স্বর অনুসরন করে সে তাকালে দেখতে পায় আবছা লম্বা এক মানুষের শরীর। সেই শরীরটা এগিয়ে এলে তার চেহারাটা স্পষ্ট হয়।

ঘরে আরো একটা আলো জ্বলে ওঠে। এই আলোটা বেশ জোরালো। সেই লম্বা মানুষটা একটা লম্বা টুল টানতে টানতে নিয়ে এসে প্রবালের সামনে রেখে বসে। প্রবাল এবারে যেন তাকে চিনতে পারে। হ্যামিলটন কি?

প্রবাল ভালো করে দ্যাখে আবার। লোকটির আদুল গা। শুধুমাত্র একটা শর্টস্ পরনে। এই অবস্থাতেও প্রবালের মুখে একটা মৃদু হাসি খেলে যায়। সে যতটা সম্ভব গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলে,

গুড ইভনিং। মিঃ দাশগুপ্ত।

দিগন্ত দাশগুপ্ত শিশুর মতো খুক খুক করে হেসে ওঠে। যেন খুব আমোদ পেয়েছে সে। সে হেসেই চলে। সারা গা দুলিয়ে সে হেসেই চলে। হাসি থামলে বলে,

জানি আপনি আমাকে চিনতে পারবেন। যখন জানতে পারলাম আপনি ডরোথির ওখানে গিয়েছেন, তখনই বুঝেছি আপনি আমাকে চিনে গিয়েছেন। এবার কথা হচ্ছে, এত কষ্ট করে এত মাথা ঘামিয়ে ময়দানের বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি বাঁধিয়ে আমার পিছনে ঘুরে আপনার কী লাভ?

এবার প্রবাল হেসে ওঠে। হাসতে তার কষ্ট হচ্ছে তবু সে হেসে ওঠে। সে বুঝতে পারছে এখন তাকে নার্ভের খেলা খেলতে হবে। নার্ভ শক্ত রেখে তাকে বেঁচে থাকার অতিরিক্ত সময় জিতে নিতে হবে। এখন তন্ময় সামন্তর উপরেই ভরসা। সামন্তবাবুর মতো লোক কি পারবে? প্রবাল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তবু তাকে প্রাণপণে খেলাটা চালিয়ে যেতে হবে।

প্রবাল কিছু উত্তর দেবার আগেই দিগন্ত গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে,

আমি কি কিছু হাসির কথা বললাম মিঃ সেন?

প্রবাল তার হাসি থামায় না, মৃদু হাসিতে বলে,

এই প্রশ্নটা আমি আপনার কাছ থেকে আশা করিনি।

করেননি? তাই তো? কিন্তু এতে আপনার লাভ কতটা হল জানি না, তবে ক্ষতি তো অনেকটা হয়ে গেল। সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

প্রবাল আবার হেসে ওঠে একটু জোরে। বলে,

আমাকে খুন করলে আপনারও জিত হবে না মিঃ দাশগুপ্ত। আপনার হারই আমি দেখতে পাচ্ছি।

দিগন্ত কিছু বলে না। সে টুল থেকে উঠে পড়ে।

প্রবাল যেন তার কথাটা ফিরিয়ে নিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলে,

কিন্ত মিঃ দাশগুপ্ত, তবুও আমি আপনার ওপরে রাগ করতে পারছি না। আপনার কাছে জিতলেও আমার কোনও আনন্দ নেই।

সে তার গলাটা খাদের দিকে নামিয়ে এনে মেদুর করে তোলার চেষ্টা করে।

দিগন্ত তার পায়চারি থামিয়ে বলে,

কেন মিঃ সেন?

তার গলাটা হাহাকারের মতো শোনায়। তার পরেই সে চিৎকার করে ওঠে…

না। না। মিঃ সেন। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। না কাউকে বিশ্বাস করি না।

তার পরে সে আবার সেই টুলটাতে এসে বসে। প্রবালের দিকে ঝুঁকে গলা নামিয়ে বলে,

আপনি কখনও আপনার কোনও প্রিয়জনকে চোখের সামনে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখেছেন? জানি আপনি দ্যাখেননি। আমি দেখেছি। একবার নয়, দুবার।

সে আবার চিৎকার করে ওঠে…

হ্যাঁ। একবার নয়। দুবার। চোখের সামনে। আমার মাকে। আমার প্রাণের থেকে প্রিয় বোনকে। তারা কী দোষ করেছিল? আমি কী দোষ করেছিলাম? মিঃ সেন?

সে দু হাত ছুঁড়ে চিৎকার করে ওঠে।

বলুন মিঃ সেন? তখন পুলিশের, আপনাদের এই সব ফাকিং সত্য অনুসন্ধান কোথায় ছিল? এই সব ব্লাডি অনুসন্ধান কোথায় ছিল?

প্রবাল কোনও কথা বলে না। চুপ করে থাকে।

এবার দিগন্তর গলা যেন কান্নায় ভিতরে ডুবে যায় এমনভাবে বলে,

বিশাখাকে আমি কত বিশ্বাস করতাম। ভালোবাসতাম। সে কী করল? নিজের সুবিধার জন্য, নিজের অভিনয়ের কেরিয়ারের জন্য আমার বোনকে সে হায়নার মুখে ফেলে দিয়েছিল। আমার ছোট্ট ফুলের মত বোন। আমার ছোট্ট আদরের মতো বোন। কত কষ্ট। ওঃ কত কষ্ট পেয়েছিল সে।

সে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠে।

পরক্ষণেই সে হা হা করে বুক ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে,

বিশাখাকে কীভাবে মেরেছি জানেন? ওই দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওই লোহার মানুষটা দেখছেন?

প্রবাল ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। দ্যাখে, ঘরের এক কোণে একটা ধাতুর মানুষের মতো আকৃতির পূর্ণ দেহের স্ট্যাচু দাঁড় করানো আছে। নগ্ন। কী বিশাল লিঙ্গ তার। প্রবাল ঘাড় ফেরালে সে বলে,

ওই গরম লোহার মানুষটার সঙ্গে বিশাখাকে সঙ্গম করিয়েছি। তার পরে জীবন্ত তার চোখ কান জিভ উপড়ে নিয়েছি। হাতের আঙুলগুলো কেটে নিয়েছি। ওই দূরে কাচের বয়াম দেখছেন ওর ভিতরে সেই কাটা অঙ্গগুলো আছে।

প্রবাল ঘাড় ফেরায়। একটা কাঠের টেবিলের উপরে সারি দিয়ে কাচের বয়াম রাখা আছে।

সে মনে মনে ভাবে “কী বীভৎস। উন্মাদ হয়ে গিয়েছে দিগন্ত”। তার একটু ভয় ভয় করে। তারও কি এই হাল হবে?

দিগন্ত আবার বলে,

কী ভাবছেন মিঃ সেন? শুনুন, ও ভাবে এগারো দিন বিশাখা বেঁচে ছিল। সবাইকে, যারা আমার বোনের মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত, সামান্যভাবে যুক্ত ছিল সবাইকে আমি শাস্তি দিয়েছি।

সে যেন প্রেতের মতো খল খল করে হেসে ওঠে।

পরক্ষণেই আবার তার গলা ধরে আসে।

আমি তো তাকে ভালোবাসতাম। বলুন। আমি তো ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পেলাম না!

তার গলা গভীর বিষাদে যেন কাঁপতে থাকে।

এবার প্রবাল কথা বলে। মোক্ষম কথাটা সে বলে।

ভালোবাসা তো আপনি পেয়েছিলেন মিঃ দাশগুপ্ত। ডরোথি আপনাকে সত্যি ভালোবাসে। আপনি যে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিলেন!

ভীষণ ত্বরায় যেন দিগন্ত ঝুঁকে পড়ে প্রবালের দিকে।

সত্যি বলছেন? সত্যি বলছেন? মিঃ সেন? ডরোথি আমাকে ভালোবাসে? আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না আজকাল কাউকে। ছোটবেলা থেকে তো ভালোবাসা দেখিনি! শুধু প্রতারণা দেখেছি। মার প্রতি বাবার অনবরত প্রতারণা।

আর বনানীর প্রতি আপনার আর আপনার বাবার?

কথাটা যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়।

দিগন্ত মাথা নাড়ে।

এটা ঠিক বললেন না মিঃ সেন।

তার গলা উদাস হয়ে যায়।

ওই যে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের বুকের উপরে আমি কতদিন শুয়ে থাকতে চেয়েছি। কতদিন এমনি শান্ত হয়ে বাঁচতে চেয়েছি। তা আপনি কী করে জানবেন!

তার পরে সে হেসে ওঠে।

আপনি কখনও সরু আলপথ ধরে হাঁটেননি! তাই না! ধানক্ষেতের মাথায় দুলতে থাকা এলোচুলের মতো মেঘ দ্যাখেননি! তাই না!

সে আবার হো হো করে হেসে ওঠে।

বনানীর দেওয়া জল আপনার কেমন লেগেছিল মিঃ সেন?

সে আবার হো হো করে হেসে ওঠে।

প্রবালের মাথার ভিতরটা যেন ভন্ডুল হয়ে যাচ্ছে। তবে কী? তবে কি বনানী? বনানী এ সবের পিছনে?

দিগন্ত হাসতে হাসতে বলে,

আপনি হেরে গেছেন মিঃ সেন। আর এই হারের পুরস্কার মৃত্যু। আপনার লাইফ লাইন শেষ হয়ে গিয়েছে।

প্রবাল তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল,

আর একটা প্রশ্ন। রেখা দাশকে কেন মারলেন? ও তো আপনার বোনের ব্যাপারে যুক্ত ছিল না!

ও বোধহয় আমাকে সন্দেহ করেছিল।

কিন্তু ওর লাশটা ওভাবে জলে ফেলে দিলেন?

আরে ওটা বদ্রির মিস্টেক। আমি লাশটা গঙ্গায় ডিসপোজ করতে বলেছিলাম। ব্যাটা এমনি ফেলে এসেছিল। এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। পিছনে যে মেয়েটি শুয়ে গোঙাচ্ছে ওটা কে বলুন তো? এটার উত্তর দিতে পারলে আপনি কিছুটা কম কষ্ট পেয়ে মরতে পারবেন।

প্রবাল ভাবে এ যেন একটা খেলা চলছে। সে ঘাড় ফেরায়। কতকটা আন্দাজেই যেন বলে,

রুচিরা।

দিগন্ত আবার গলা ফাটিয়ে হেসে ওঠে।

আপনার বন্ধুর প্রেমিকা।

প্রবাল এবার যেন অনুনয়ের মতো করে বলে,

ওকে কেন মারবেন? ও তো কোনও ক্ষতি করেনি আপনাদের।

এটা ওর প্রেমিক-পুলিশকে আমাদের উপহার।

তার বলা “আমাদের” কথাটা লক্ষ করে প্রবাল।

দিগন্ত হাঁটতে হাটতে রুচিরার কাছে যায়। চোখের পলকে সেই চৌকির উপরে রাখা একটা ছুরি দিয়ে রুচিরার ডান হাতের কব্জির কাছটা কেটে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে এসে দিগন্তর গায়ে পড়ে।

প্রবাল চিৎকার করে ওঠে।

মিঃ দাশগুপ্ত, প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন। প্লিজ মিঃ দাশগুপ্ত।

দিগন্ত হেসে ওঠে।

আরও চিৎকার করুন। যত জোরে পারুন চিৎকার করুন।

তখনই দরজার কাছে একটা প্রবল ধাক্কার শব্দ। কে যেন বীর বিক্রমে দরজায় লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলেছে। কিন্তু তখনই ঘরের সমস্ত আলো নিভে যায়।

***

 

সাধুচরণ আজকাল ঘর থেকে বের হতে পারে না। বড় বেদনা তার। মাঝে মাঝে বদু তাকে দরজার বাইরে একটা টুলের উপরে বসিয়ে দিয়ে যায়। সে সেটার উপরে বসে বসে ঝিমায়। বিকেলে বৃষ্টি থামতে বদু তাকে মেন দরজার বাইরে টুলটার উপরে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কেন কে জানে বদু দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।

সাধু চোখ তুলে ভালো করে তাকাতে পারছিল না। তার সামনে একটা ছায়া এসে দাঁড়ায়। সেই ছায়ার পাশে আর একটা ছায়া। ছায়া দুটো তার পাশে বসল। বসে তার সঙ্গে গল্প জুড়ল। সাধুচরণের ভালো লাগছিল না তাদের গল্প। তবু সে যেন বাধ্য হয়ে তাদের গল্প শুনছিল।

সে শুনতে পেল কোথায় যেন একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির শব্দ শুনে যে দুজন গল্প করছিল তারা সচকিত হল। তাদের সামনে আবার একটা গাড়ি এসে থামল। সামন্তবাবু আর তাদের দলবল এসে নামল গাড়ি থেকে।

একজন বলল,

স্যার, পিছনে মনে হচ্ছে একটা দরজা আছে।

সাধুকে সে জিজ্ঞাসা করল,

এই, পিছনে একটা দরজা আছে নাকি?

সাধু ঘাড় নাড়ল।

তারা সবাই পিছন দিকে দৌড়ায়।

পিছনের দরজা আগলে বদু বসেছিল। বিপদ বুঝে সে পালাতে চাইল কিন্তু সামন্ত তাকে ধরে ফ্যালে। তার পরে দু চারটে চড় থাপ্পড়েই কাজ হয়। সে বেসমেন্টে নামার দরজা দেখিয়ে দেয়। তন্ময় সামন্ত প্রবল বিক্রমে দরজায় লাথি মারে পর পর। পুরানো কাঠের দরজার ভিতরের কড়ি ভেঙে পড়ে।

ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। কটু পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। দু জন পুলিশ কর্মীর হাতে টর্চ জ্বলে ওঠে। সামন্তর হাতে সার্ভিস রিভলভার। আধো অন্ধকারে তারা দেখল, কাঠের বড় বেঞ্চের উপর একটা মহিলার দেহ পড়ে আছে। তার হাত পা বাঁধা। তারা আরও এগিয়ে যায়। সেই মেয়েটির একটা হাত বেঞ্চের এক পাশে ঝুলে আছে। সেটা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। আর একজন চেয়ারে বসে আছে। সামন্ত চিৎকার করে বলে,

প্রবাল স্যার, ঠিক আছেন?

প্রবাল সাড়া দেয়।

সামন্ত এগিয়ে এসে তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। প্রবাল নিচু হয়ে পায়ের বাঁধন খোলে।

সবার হাতেই রিভলবার, পিস্তল।

প্রবাল বলে,

ওই দিকে একটা ছোট ঘর আছে।

সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

সামন্তবাবু সাবধান। ভয়ঙ্কর লোক। আপনি আগে রুচিরাকে দেখুন।

সামন্ত দ্রুত সেই রুচিরার কাছে এগিয়ে যায়। চিৎকার কারে বলে

স্যার, রুচিরা-দেবীর এখনো শ্বাস পড়ছে। তবে অজ্ঞান হয়ে আছে। তাদের সঙ্গের দুজন রুচিরার বাঁধন খুলে তাকে উপরে নিয়ে যায় হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে।

প্রবাল ঘরের মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে চারপাশ ভালো করে দেখতে থাকে। খুনি পালাল কোথায়? তখনই কোণের দিকে দরজাটা যেন সে দেখতে পায়। সে দরজাটার দিকে এগিয়ে যেতে যায়, আর তখনই ঘরের ভিতরে একটা গুলির শব্দ।

বদ্ধ ঘরের ভিতরে বীভৎস শোনায় সে শব্দ।

তবু তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।

প্রবাল আর সামন্তবাবু পায়ে পায়ে সেই দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

তার পরে প্রবাল আলতো করে সেই দরজাটায় ধাক্কা দেয়। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না। দরজাটা খুলে গেলে তারা দেখে ঘরের ভিতরে একটা চেয়ারে বসে আছে দিগন্ত দাশগুপ্ত। তার ঘাড়টা একদিকে এলিয়ে পড়েছে। রগের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা নেমে এসে সারা গা ভাসিয়ে দিয়েছে।

সেই ঘরে সারি দিয়ে কয়েকটা পিচবোর্ডের বাক্স রাখা ছিল। সামন্ত একটা বাক্সের কভারটা খুলে দ্যাখে তার ভিতরে কয়েকটা পিস্তল।

প্রবাল বলল,

চিনতে পারছেন?

সামন্ত ঘাড় নাড়ল। সেটা হ্যাঁও হতে পারে আবার নাও হতে পারে।

প্রবাল বলল,

দিগন্ত দাশগুপ্ত ওরফে হ্যামিলটন। নিজেই হ্যামিলটন সেজে নারী পাচারের দলে ঢুকে গিয়েছিল সেই সঙ্গে অস্ত্র চোরাচালানের ব্যাবসায় নেমেছিল। তার অনেক টাকার দরকার ছিল এই হত্যালীলা চালাবার জন্য।

প্রবাল এক হাত দিয়ে সামন্তবাবুর কাঁধটা জড়িয়ে ধরে। তার গলা আবেগে ভরে আসে। সেই ভরা গলায় সে বলে,

সামন্তবাবু আপনি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করব না। আপনি না থাকলে কী হত ভাবতেই পারছি না।

সামন্তবাবু চট করে কোনও উত্তর দেয় না।

সে বাকি অফিসারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। বলে,

চলুন স্যার।

সেই ছোট ঘরটাতেই প্রবালের পোশাক আশাক রাখা ছিল। সেগুলো সে পরে নিয়েছে।

পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সামন্ত আগের কাথার উত্তর দেয়,

স্যার, আপনার নির্দেশ মতো দিগন্ত দাশগুপ্তর গাড়ি ফলো করে তবেই না এখানে আসতে পারলাম। আপনি না থাকলে এই কেস কোনওভাবেই সলভ করা যেত না।

বাইরে বেরিয়ে তারা দেখল আকাশে মেঘ কেটে গিয়েছে। প্রবাল মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। পশ্চিম আকাশটা লাল আবিরে যেন মাখামাখি হয়ে আছে। সে পকেট হাতড়ায়। তার প্রাণ যেন একটা সিগারেট চাইছিল। সামন্ত যেন সেটা টের পায়। সে তার পকেট থেকে প্যাকেট বার করে একটা দেয় প্রবালের হাতে। প্রবাল সেটা ধরিয়ে প্রাণ ভরে একটা টান দেয়। তারা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে চলে গিয়েছে।

প্রবাল বলে,

আমাদের আরেকটু কাজ বাকি আছে সামন্তবাবু। একবার বকুলবাগানের সেই ঠিকানায় কাউকে পাঠতে পারেন? সেখানে এখনও কেউ আছে কি না!

সামন্ত তার মোবাইল বার করে বলে,

এখুনি দেখছি স্যার।

সে একটু সরে গিয়ে ফোনে কথা বলে।

প্রবাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে।

সামন্ত ফিরে এসে বলে,

স্যার, ওই বাড়িটায় কিছুক্ষণ আগে আগুন লেগেছিল। দুটো মানুষের শরীর সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে।

প্রবাল সামন্তর দিকে ফিরে বলল,

এই ভালো হল।

কেন স্যার?

এই সমস্ত কিছুর পিছনে খুনির মোটিভেশন ছিলেন বনানী। সেটা কি প্রমাণ করতে পারবেন কোনওভাবে?

সামন্তবাবু ঘাড় নাড়লেন।

প্রবাল বলল,

তার থেকে এই বেশ ভালো হল। খুনি সবার বিচার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। শেষে সে নিজেকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তেমনই বনানীরও আর বেঁচে থাকার কোনও মানে ছিল না। সামন্তবাবু, এই কেস নিয়ে আমার আর কিছু জানারও নেই। বলারও নেই। আপনাদেরও থাকার কথা না। কারণ খুনিকে তো আর বিচার করার দরকার নেই। তার বিচার বিধাতাই করে দিয়েছেন। সুতরাং আপনাদের ছুটি।

সামন্ত বলল,

স্যার আপনি কখন দিগন্তকে সন্দেহ করলেন?

পাসোয়ানের খুনের পরে। তার ঘরে একটা খবরের কাগজ পড়েছিল। সেই কাগজের উপরে পেন দিয়ে অদ্ভুত ডিফিক্যাল্ট একটা নকশা আঁকা ছিল। আবার দিগন্তর অফিসে যেদিন গেলাম সেদিন দেখলাম তেমনি ডিফিক্যাল্ট আর সেম একটা নকশা আঁকা ছিল সেদিনের খবরের কাগজের পাতায়। তার পরে বিশাখার সঙ্গে দিগন্তর বোন দিগঙ্গনার ছবি। আমি মনে মনে গল্পটা সাজালাম তখন।

সে একটু হাসল। বিকেলের পড়ন্ত আলোতে সে হাসি তেমন ফুটল না।

সাধুচরণও তেমনি বসে ছিল। এত কিছু হয়ে গেল সে কিছুই জানল না। সে এটাও জানল না যে এই বাড়িটা বহু বছর আগে দিগন্তর বাবা কিনে ফেলে রেখেছিল। এটা ছিল তার লাম্পট্যের লীলাকানন। সবার চোখের আড়ালে। একটা ভূতুড়ে বাড়ির মোড়কে।

***

 

হাসপাতালে আরও কয়েক ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফেরে রুচিরার। অনেক রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে তার। শরীর খুব দুর্বল। খুব কষ্ট করে সে চোখ মেলে।

আবছা আবছা একটা পুলিশের পোশাক পরা চেহারা তার চোখের সামনে ফুটে ওঠে।

পুলিশের মুখে লজ্জা দুশ্চিন্তা একাকার হয়ে আছে।

রোগা মুখে রুচিরা তার ভুবন ভোলানো হাসিটা হাসল।

 

(সমাপ্ত)