Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটি মফঃস্বলি তদন্ত

একটি মফঃস্বলি তদন্ত -- কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

ঘটনার সময় আমরা কে কোথায় ছিলাম বলতে পারব না স্যার। তবে কোথায় আর থাকব, উত্তরে বন্ধ মিলের পাঁচিল, দক্ষিণে শম্ভু গরানের মাঠ, পুবে রেললাইন আর পশ্চিমে বারুজীবীর খালের মাঝখানেই ছিলাম নির্ঘাত। কে কী করছিলাম সেটাও এই মুহূর্তে মনে করা মুশকিল। তবে আন্দাজ করে বলে দিতে পারি। কটা হবে তখন, বিকেল পাঁচটা? হেমন্ত মাস ছিল যখন ধরে নেওয়া যায় বিকেল মরে এসেছিল। ভারি হয়ে কুয়াশা নামছিল চারদিক থেকে, ট্রেনগুলো বাঘের চোখের মতো হেডলাইট জ্বালিয়ে স্টেশনের কাছে এসে বোঁ বোঁ হর্ন দিচ্ছিল খুব। ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও কেউ ব্যবহার করে না তো; বারবার বারণ করার সত্ত্বেও সাইকেল, বাইক নিয়ে, গেট তুলে তুলে লাইন পেরোয়। যাদের অফিসকাছারি আছে, ওইসব ট্রেনে করেই তারা অফিস থেকে ফিরছিল, যাদের অফিসে যাওয়ার বয়স হয়নি তারা মাঠে বল পেটাচ্ছিল নয়তো সাইকেল নিয়ে ঝাঁক বেঁধে ঘুরছিল অলিগলি। যাদের অফিসকাছারির পাট চুকেছে, বল পেটানোর শক্তি নেই কিন্তু চলাফেরার ক্ষমতা আছে, শর্মার কাঠগোলার বেঞ্চিতে বসে রাজাউজির মারছিল। মুনমুনের মা আর সিকন্দরের বউ বিকেলের খেপ সেরে যে যার বাড়ি পৌঁছে গা ধুয়ে চুল বেঁধে দাওয়ায় পা মেলে জিরোচ্ছিল। নিষ্কর্মারা পুকুরধারে বসে জলে ঢিল ছুঁড়ছিল। কেউ মুদির দোকান যাচ্ছিল, কেউ লাইব্রেরি, কেউ রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছিল। লালনীল সোয়েটার পরা বাচ্চাদের গাল টিপছিল।

ধোঁয়াটা ঠিক সেই সময়েই উঠেছিল বলে যদ্দূর মনে পড়ছে। কালবৈশাখীর মেঘের মতো ধোঁয়া; কালচে নীল আকাশের গায়ে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছিল। যে যেখানে ছিল সবাই প্রথমে স্থির হয়ে দেখল। পাড়ার মাঠে কোমরে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলেরা দেখল। বুড়োগুলো কাঠগোলার বেঞ্চিতে বসে ঘন ভুরুতে হাতের তেলো ঠেকিয়ে দেখার চেষ্টা করল।

ওই সময় ধোঁয়া ওঠা কিন্তু অদ্ভুত কিছু নয়। মুনমুনের মা সিকন্দরের বউরা তো ওই সময়েই যে যার খুপরি ঘরের বারান্দায় উনুনে কাঠ গোঁজে, চোখে আসা জল অগ্রাহ্য করে উনুনের গুহায় জোরে জোরে ফুঁ দেয়। ওই সময়েই গোয়ালঘরে ধুনো দিতে ঢোকে কালাচাঁদ, আহ্লাদী গরুগুলোর বাড়িয়ে দেওয়া গলায় হাত বোলায়, গরুগুলো হাম্বা হাম্বা ডাকতে থাকে— এ ধোঁয়া সেই ধোঁয়া যে নয় কী করে বুঝব বলুন?

কিন্তু বুঝেছিলাম।

ওই ধোঁয়াটা অন্য ধোঁয়াগুলোর থেকে একেবারে আলাদা ছিল। দেখলে গা ছমছম করে। বোঝা যায় ধোঁয়াটা সুবিধের নয়, ওর গোড়ায় একটা গলদ আছে।

তাছাড়া ধোঁয়াটা লাইনবাড়ির মাথা থেকেও উঠছিল না, কালাচাঁদের গোয়ালের দিক থেকেও না। ধোঁয়াটা আসছিল পাড়ার উত্তরপশ্চিম প্রান্ত থেকে, শম্ভু গরানের ধানজমিতে যেখানে দু-একটা বাড়ি উঠতে শুরু করেছে,  সেদিক থেকে।

আগুন! চিৎকারটা আসতেই চটকা ভেঙে ছুটতে শুরু করল সবাই। মাঠ থেকে ছেলেরা দৌড়ল, পুকুরপাড় থেকে নিষ্কর্মারা দৌড়ল, বাচ্চাদের কারও কোলে গুঁজে দিয়ে বাচ্চার ভারপ্রাপ্ত লোকজন দৌড়োল, লাইব্রেরির দিক থেকে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে প্যাডেল করল পোঁ পাঁ, অলরেডি ছুটতে থাকা কেউ লাফিয়ে ক্যারিয়ারে উঠে বসল, সেকেন্দরের বউ, “ভাত পরে রাঁধবি এখন চল,” বলে মুনমুনের মাকে উনুনের সামনে থেকে টান মেরে তুলে দৌড়ল।

ব্যানার্জিবাড়ির মোড় ঘুরে ঘোষেদের বাড়ির পেছন ঘুরতেই শম্ভু গরানের মাঠ উন্মুক্ত হল। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একতলা বাড়িটার একটা দিক দাউ দাউ করে জ্বলছে।

সাপের চোখে চোখ ফেলেছেন কখনও? অবশ্য ফেলবেন কী করে, আপনি হয়তো সাপ দেখেননি। এখন তো অনেক কমে গেছে, এককালে এ সব দিকে আমরা সাপ দেখেছি অনেক। সাপের চোখে চোখ পড়ে গেলে নড়া যায় না। ভীষণ টান। বাঘের বেলাতেও নাকি অমন হয় শুনেছি। ভায়রাভাইয়ের সুন্দরবনে যাতায়াত ছিল, বলেছিল। সত্যিমিথ্যে জানি না, নিজের চোখে দেখিনি, দেখতেও চাই না, কিন্তু আগুনের কেসটাও যে এক সেদিন বুঝেছিলাম। লকলকে আগুন, লাল, কমলা, হলুদ, নীল ফুলকি ছুটিয়ে ফুটছে, নাচছে, ফাটছে, ভাঙছে, গিলছে।

বাড়ির সামনে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে বাড়ির মালিক। আগুনের তাতে মুখচোখ ঝলসে গেছে, সর্বাঙ্গে কালি, দৌড়ে গিয়ে কেউ টেনে সরিয়ে আনল নিরাপদ দূরত্বে। লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে তুতলে তুতলে উচ্চারণ করল, স্‌…সুতপা… তারপর আঙুল তুলে দেখাল জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে।

সবাই থম মেরে রইল। ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ চেঁচাল, “বউটা ভেতরে!”

ঘোর ছুটে গেল। জল কই, বালতি কই, পাইপ কই। দমকল কই। পাড়ার একমাত্র ফোন ছিল হোড়েদের প্রেসে, সাইকেল নিয়ে ছুটল একজন। বাকিরা বালতি বালতি জল ছুঁড়তে লাগল বাড়িটার গায়ে। ঘোষেদের বাগানে জল দেওয়ার পাইপটা টেনে এনে বন্দুকের মতো তাক করে ধরল। কিন্তু বাগানের পাইপের জলে কী আর ও আগুন বাগ মানে?

একটা কথা আপনাকে বলতে পারি, চেষ্টা করা হয়েছিল। বাচ্চারা পর্যন্ত মগে করে জল ছুঁড়েছিল। জানালার কাঠ ভেঙে ভেঙে পড়ছিল, আগুনের ঝাপটায় মুখচোখ ঝলসে গিয়েছিল, পিছিয়ে আসতে আসতেও আমরা লড়ে গেছিলাম।

প্রায় দেড়ঘণ্টাখানেক যুদ্ধের পর যখন আগুনের শিখা মরো মরো, দুয়েকজন দরজা ভেঙে ঢুকল। আগুন কলকবজা ঢিলে করে রেখেছিল আগে থেকেই, লাথি মারতেই খসে পড়ে গেল। কালো ধোঁয়া ভকভক করে বেরোল, সঙ্গে নিয়ে বিকট গন্ধ। নাক চাপা দিয়ে কাশি চাপতে চাপতে লোকজন ঢুকল বাড়ির ভেতর। মাগো! আর্তনাদ করে কেউ কেউ ছিটকে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল, উদ্গত ওয়াক চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে পোড়া দোপাটিচারার গোড়ায় উগরে দিল দুপুরের ভাত। পেছনের লোক “কী হল কী হল” বলে দৌড়ে ভেতরে গেল, গিয়ে দেখল একটা আধপোড়া, আধগলা একটা একসময়, হয়তো কয়েকঘণ্টা আগেই, সে মানুষ ছিল, এখন আর নেই। দোমড়ানো মোচড়ানো একটা অবয়ব, চোখের জায়গাদুটো, আর মুখের জায়গাটা হাঁ, একটা অট্টহাসি যেন হাওয়ায় জমে আছে।

*****

 

বউটার মুখ ছিল অনেকটা মীনা কুমারী প্যাটার্নের, ছোট নাক, ঝিমন্ত চোখ, ডিমের মতো মুখের দুপাশে চুল। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে ভাব। সকালবেলা দুধ আনতে যেত, বিকেলবেলা মাঝেমাঝে মুদির দোকান কিংবা গমকল থেকে আটার ভারি ব্যাগ নিয়ে হেঁটে হেঁটে আসত। রিকশা নিত না কোনওদিন। কাজের লোকও রাখেনি। মুনমুনের মায়ের সকালের স্লট খালি ছিল, জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল লোক লাগবে কি না। বউ দুদিকে ঘাড় নেড়েছিল। তারপর যাতায়াতের পথে দেখা হত, সকালবেলা বাগানের কলের জলে কাজ করত, কংক্রিটের স্ল্যাবে আছড়ে কাপড়জামা বিছানার চাদর ধুত, মেলত, বিকেলে দোপাটির গোড়ায় জল দিত। রান্নাঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঘর্মাক্ত মুখে খুন্তি নাড়ত।

বিকেলে গমকল কিংবা মুদির দোকান না থাকলে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। মুনমুনের মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই হেসে কথা বলত। মুনমুনের মা পাঁচ বাড়ি কাজ করে, হেব্বি তাড়ায় থাকে ওই সময়, গল্প করার টাইম নেই, তবু বউটাকে দেখে নাকি ওর মায়া হত, তাই থামত মাঝে মাঝে। বউটা চা করে দিত। নিজেদের ব্যবহারের কাপেই খেতে দিত। যত্ন করে বানানো, ভালো জাতের চা। আসামে বউয়ের মামার বাড়ি, সেখান থেকে আনা।

*****

 

থানাপুলিস হয়েছিল বৈকি। সব যখন থেমে গেছে জিপে চড়ে পুলিস এল, বরটাকে থানায় নিয়ে গেল। সে তখন কান্নাকাটির পর শোকে পাথর।

বরটা সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানতাম না। বাড়ি তৈরি চলাকালীন শনিরবিবার আসত। বেলা দশটা এগারোটা নাগাদ। বুড়োরা হলে হয়তো সোজা গিয়ে জিজ্ঞাসা করত, আপনি কে কোথা থেকে আসছেন কী বৃত্তান্ত; আমরা তখন ধীরে ধীরে সভ্যভদ্র হওয়ার চেষ্টা করছি, মোড়ের মাথার জটলা থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। রিকশা থেকে নেমে, ‘এই নে’ বলে ভাড়া গুনে হেঁটে হেঁটে মাঠের দিকে চলে যেত। হাইট কত হবে, পাঁচ ছয় কি পাঁচ সাত, সামনের চুল ফাঁপানো হলেও পেছনে ফাঁকা হতে শুরু করেছে, নাক চোখ মুখ আলাদা করে বর্ণনা দেওয়ার মতো কিছু না। চকচকে জামা প্যান্ট। দু হাত মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছটা আংটি। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি বানানোর তদারক করত।

পোস্ট মর্টেম হয়ে বডি পুড়ে গেল। শ্রাদ্ধশান্তিও হল। লোকটা বলেছিল অনেককেই, কিন্তু এ সব কেসে কারওই যাওয়ার, খাওয়ার ইচ্ছে থাকে না, ভদ্রতাবশত সবাই একবার করে উঁকি দিয়ে এল।

এসে বলাবলি করল, বাপের বাড়ির কাউকে তো দেখলাম না? মুনমুনের মা বলল, থাকলে তো দেখবে। বাপমা মরেছে ছোটবেলাতেই। মামারা ঘাড় থেকে ফেলে বেঁচেছে। ও মেয়ে ওদের কাছে মরেছে যেদিন বিয়ে হয়েছে সেদিন।

*****

 

বাড়ির বারান্দায়, কাঠগোলার বেঞ্চিতে, লাইব্রেরির “কিপ সাইলেন্স” নোটিশের নিচে গুজগুজ ফুসফুস চলতে লাগল। পুলিশ যে কী ছাতার মাথা তদন্ত করল, আদৌ করল কি না, করে কী পেল, কোনও খবর আমাদের কানে এল না।

জ্ঞানের স্পৃহা একবার যদি জাগে, নিবৃত্ত করা শক্ত। আসামবউ পুড়ে মরার মাসছয়েক আগে আমাদের থানার ওসি বদল হয়েছিল। আগের ওসি ছিলেন ঘোষদারোগা, নর্থবেঙ্গলের লোক। তেমন দাপুটে ছিলেন না, তবে ছিঁচকে চুরিডাকাতি সামলানোর জন্য বেশি দাপটের দরকারও ছিল না। বাজারে দেখা হলে হেসে কথা বলতেন, রবীন্দ্র-সুকান্ত-নজরুলসন্ধ্যায় এসে, ছবিতে মাল্যদান করে, বিপত্তারিণী মিষ্টান্নের বাক্স খুল ন্যাতানো নিমকি খেতে খেতে ঋতুরঙ্গ দেখতেন। ঘোষদারোগা থাকলে খবরাখবর বার করে ফেলা কোনও ব্যাপারই হত না, কিন্তু ততদিনে আমরা বিপত্তারিণীর বাক্স সহকারে দারোগার গলায় রজনীগন্ধার মালা আর কবিতা লেখা মানপত্র ধরিয়ে ফেয়ারওয়েল দিয়েছি।

নতুন ওসি-র কাছ থেকে খবর বার করার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। সে তরুণ তুর্কি, ফোন ধরে বলছি-র বদলে স্পিকিং বলে। রসুনজয়ন্তীর নেমন্তন্ন পুরোটা শোনার আগেই নাকচ করেছিল। ঘোষদারোগার কেমন ঢিলেঢালা ভুঁড়ি ছিল; এর ছ ফুট চেহারা, বেল্ট পেটের ওপর পেতে বসা, বুটের আওয়াজে কাকচিল উড়ে যায়।

তবে উপায়ের সুবিধে হচ্ছে, ইচ্ছে থাকলেই এসে হাজির হয়। আর মফঃস্বলের লোকদের খবর বের করার ইচ্ছের তীব্রতা আপনার জানা নেই। খেয়াল হল উপায় আছে আমাদের হাতের সামনেই। সাইকেলের হ্যান্ডেলে চার থাক টিফিনবাক্স ঝুলিয়ে সকালসন্ধে দিলীপদার চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছে আর আসছে, আসছে আর যাচ্ছে।

দেবু ঘোষ, থানার টাইপিস্ট। এই আপনার থেকে ইঞ্চিখানেক বেঁটে, সরু গোঁফ, নাকের ওপর আঁচিল। একদিন বিকেলবেলা দোকানের সামনের জটলা থেকে আমরা হাঁক পাড়লাম, দেবুদা!

কী ব্যাপার আজকাল তো আর পাত্তাই দাও না, একসঙ্গে কত ফুটবল খেলেছি, হ্যাঁ ভাই, তোমার সরকারি চাকরি ভাই আমরা এদিকে বেকার ঘুরছি, এইসব আগডুমবাগডুমের পর বিটনুন ছড়ানো লেবু চা আর প্রজাপতি বিস্কুট, যার দাম ক্লাবের জনহিত খাতে যোগ হবে, দেবু ঘোষের হাতে ধরিয়ে জানতে চাওয়া হল,

তারপর, আসামবাড়ির বউয়ের কেসটা কী জানো নাকি?

দেবু ঘোষ প্রজাপতি বিস্কুট চিবোতে চিবোতে বলল, কেস আবার কী? গায়ে আগুন।

সুইসাইড?

সে রকমই তো রিপোর্ট লেখা হয়েছে। বরটা তো চরকি ঘোরা ঘুরছে নতুন ওসির কাছে। বাড়িতেও যায়ফায়। বোতল নিয়ে বসেফসে। হেবি খাতির। আগের মাসে একটা গলায় দড়ির ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়তে পার্টিকে সাড়ে পাঁচ মাস ঘুরিয়েছে, এখানে পনেরো দিনের মধ্যে সব ফিনিশ।

চোঁ করে তলানি চাটুকু শেষ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কালো নেড়িটাকে তাক করে ভাঁড়টা ছুঁড়ে, ‘আসি রে’ বলে সাইকেলে প্যাডেল করে চলে গেল দেবু ঘোষ।

*****

 

আমাদের জীবনে আর কিছু রইল না। বছরে গোটা তিনেক বিয়ে, গোটা দুয়েক শ্রাদ্ধ, মুখেভাত, বছরতিনেক অন্তর অন্তর একটা করে গলায় দড়ি, কারও ছেলের জয়েন্ট ক্লিয়ার, এ সব বাদ দিয়ে বলার মতো কিছু ঘটত না তো, তার মধ্যে হঠাৎ ওই কাঠপোড়া দেহ, জমে যাওয়া চিৎকার, পাড়াটার ঘেঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল। ক্রিকেট, রাজনীতি, বাতের টোটকা সব হাওয়া হয়ে গেল। শর্মার গোলায়, পুকুরঘাটে, বিকেলবেলার চাইনিজ চেকারের চ্যাম্পিয়নশিপ ছেয়ে রইল আসামবউ আর আসামবউয়ের সুইসাইড।

বউটার খুব দুঃখ ছিল বোধহয়, কেউ কখনও হাসতে দেখেনি।

হাঁদার মতো কথা বলিস না। হাসা না হাসার সঙ্গে মরার কী সম্পর্ক। ও পাড়ার কেষ্ট শিকদারকে কেউ কখনও হাসতে দেখেনি, রোজ সকালে চিরতার জল খায় আর জোরে জোরে হাঁটে আয়ু বাড়ানোর জন্য, জানিস?

সেদিন সকালেও তো দেখলাম দোকান থেকে ফিরতে। কিচ্ছু বোঝা যায়নি, তাই না?

বোঝা যায়ও না। ওটা একটা তাৎক্ষণিক অসুখ। আগের মুহূর্ত পর্যন্ত হয়তো দেখ হেসেছে, আড্ডা মেরেছে, ভাত খেয়েছে, তারপর হাত ধুয়ে এসে মৌরির বদলে হাফ বোতল অ্যাসিড ঢকঢক করে খেয়ে ফেলেছে।

আত্মহত্যা করলে একটা নোট রেখে যেত অন্তত।

কই গত বছর যে শিবুর বড়দা সুইসাইড করেছিল, নোট রেখে গিয়েছিল নাকি?

পাশের ঘরে কেউ গায়ে আগুন দিল, আর লোকটা বুঝল না?

ওফ্‌, ছাড় না। যা হয়েছে হয়েই তো গেছে, লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর তোদের এই বিশ্রী গ্রাম্য স্বভাবটা যে কবে যাবে…

*****

 

লোকটা কিন্তু ঝটপট সামলে উঠল। কালিঝুলি তো চান করলেই মুছে যায়, কাঁদতে কাঁদতে চিরে যাওয়া গলার স্বরও তিনবেলা গার্গল করলেই জোড়া লাগে, কিন্তু শূন্য দৃষ্টি আর না কাটা দাড়িও চোখে পড়ার মতো দ্রুততায় অদৃশ্য হল। পাড়ার লোকেরা যার যার মতো করে সহমর্মিতা দেখানোর চেষ্টা করেছিল। কাকিমা জেঠিমারা ভালোমন্দ রাঁধলে বাটিতে করে দিয়ে আসত, কাকুজেঠুরা সাইকেল চড়ে যাতায়াতের পথে ব্রেক চেপে এক পা মাটিতে ঠেকিয়ে হাঁক পাড়ত,

“সব ঠিক তো? কিছু লাগলে জানাবেন কিন্তু।”

বাড়িটায় দরজাজানালা নতুন করে লাগাল লোকটা, রংটং করায়নি। আমাদের পাড়ার জলুদা, জিপিও-তে বড় পোস্টে চাকরি করত, ফটফটে ফরসা মুখের বাঁ পাশ জুড়ে বোতল উল্টোনো কালির মতো জন্মদাগ। বাড়িটা জলুদার গালের মতো পোড়া ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

মফঃস্বলের একটা অসুবিধের ব্যাপারে আপনারা শহরের লোকেরা হয়তো জানবেন না, ফাঁকা জায়গা অনেক থাকলেও প্রেম করার জায়গার মারাত্মক অভাব। কেউ না কেউ দেখে ফেলবেই। দেখলেই বাড়িতে বলবে, বা নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নীতিশিক্ষা দিতে আসবে। সে জায়গায় শহরে লোকে এমন ঘেঁষাঘেঁষি বসে প্রেম করে যে কে কার জোড়া গুলিয়ে যায়, অথচ কেউ তাকিয়েও দেখে না। আমাদের বাপি— ফরসা মুখ রোদে খেলতে নামলেই লাল হয়ে যেত বলে যার নামই হয়ে গেল লাল বাপি— তার নেশা ছিল প্রেম করা। কারও তাস দাবা পাশার নেশা থাকে, কারও থিয়েটারের নেশা, লাল বাপির ছিল প্রেমের নেশা। ক্লাস সেভেন থেকে সেই যে বাপি প্রেমে পড়তে শুরু করল, একমাসের বেশি টানা কখনও প্রেমহীন থাকেনি। কাজেই বাপির প্রেম করার প্রচুর জায়গার দরকার ছিল। আপনাদের নন্দন, ভিক্টোরিয়া, মিলেনিয়াম পার্ক ছিল বাপির চারণক্ষেত্র। সেই বাপি একদিন ক্লাবে এসে বলে কী, আসামবাড়ির লোকটাকে দেখলাম মিলেনিয়াম পার্কে, প্রেম করছে।

হ্যাঃ। এখনই? তিনমাসও তো হয়নি?

তাতে কী? কা তব কান্তা কস্তে পুত্র, শুনিসনি? বেঁচে থাকতেই কান্তা কেউ নয়, মরে গেলে তো হয়েই গেল।

তবু। ওইরকম আকাশবাতাস ফাটিয়ে কাঁদল… তুই ঠিক দেখেছিস?

হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। ওই টেরি, ওই আংটি, ওই চ্যাটচেটে হাসি। খুব ঘন হয়ে বসে সাধাসাধি করছিল এক মহিলার সঙ্গে। লালহলুদ চকরাবকরা সালওয়ারকামিজ পরে মহিলা বসেছিলেন ঝোপের আড়ালে, মুখটা দেখতে পাইনি, কিন্তু লোকটা যে আসামবউয়ের বর তাতে নো ডাউট।

*****

 

বরই যখন তিনমাস যেতে না যেতে ভুলে মেরে দেয়, পাড়ার লোক আর কতদিন মনে রাখতে পারে বলুন? সেই ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ, আমাদের স্মৃতিতে তখন ফিকে হতে শুরু করেছে। তার মধ্যে আবার এক রোমহর্ষক ঘটনা, দত্তদের ছোটমেয়ে অ্যাসিডের বোতল উপুড় করেছে গলায়। রাত এগারোটার সময় সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এল, পাড়ার লোক জড়ো হতে না হতে লেপমুড়ি দিয়ে কাকে যেন স্ট্রেচারে শুইয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে রওনাও দিল, বলা হল দত্তবুড়োর হার্নিয়ার ব্যথা উঠেছে, এখন তখন অবস্থা। কেউ বিশ্বাস করেনি। সেদিন সন্ধেবেলা মেয়ে আর মা-বাবাতে কুরুক্ষেত্র বেধেছিল, সবাই শুনেছে। তার আগে মাসকয়েক মেয়েকে ওপাড়ার বাবাইয়ের সঙ্গে এদিকসেদিক দেখাও গেছে। বাবাই যাকে বলে একটি তৈরি ছেলে, মাধ্যমিকের পর স্কুল ছেড়েছে, কালভার্টে বসে ফুলটাইম গাঁজা টানে। কালে কালে যে হেরোইন ধরবে তাতে ওর নিজের বাবামায়েরও সন্দেহ নেই। যাই হোক, ছ মাস ঘুরতে না ঘুরতে মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেটে একবছর বয়স বাড়িয়ে আঠেরো করে, প্যান্ডেল বেঁধে বাবাইয়ের সঙ্গে চার হাত এক করে দেওয়া হল। তবে বিয়ের পর বাবাইয়ের মতি ঘুরে গেছে। প্রথমে জেনারেটরের ব্যবসা ধরেছিল, এখন প্রোমোটারি করে। জোড়াপুকুর বুজিয়ে যে ফ্ল্যাটবাড়িগুলো উঠেছে, ওরই কোম্পানির।

তবে আমরা আরও বেশি উত্তেজিত ছিলাম টুটুলের এরোপ্লেনে চড়া নিয়ে।

টুটুল যাকে বলে ছিল ফুটবলে আমাদের পাড়ার, পাড়ার কেন, গোটা মহকুমার, গোটা জেলার স্টার। এবড়োখেবড়ো মাঠে খালি পায়ে যা খেলত, যা বলের ওপর কন্ট্রোল, যা গোল চিনত, বলে বিশ্বাস করাতে পারব না। আমাদের এদিকেও অনেক প্রতিভা থাকে, স্যাডলি, সেই প্রতিভা দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। প্রপার ডায়েট লাগে, ভালো জুতো লাগে, ঠিকঠাক কানেকশন লাগে। টুটুলও যায়নি বেশিদূর, খেপ খেলে খেলে ফুরিয়ে গেছে। যাই হোক, ফুরিয়ে যাওয়ার আগে রেলে একটা চাকরি পেয়ে গেছিল কী ভাগ্যি। যাই হোক, খেপ খেলার নেমন্তন্ন পেয়ে টুটুল গিয়েছিল আসাম। শিবসাগর না কী, জায়গাটা অত মনে নেই। শাঁসালো ক্লাব, গৌহাটি পর্যন্ত প্লেনে নিয়ে যাবে, তারপর গাড়ি। সেই প্রথম আমাদের পাড়ার কেউ প্লেনে চড়েছিল। যাত্রার আগে দিন পাড়ার তরফ থেকে শনিমন্দিরে পুজো দেওয়া হয়েছিল, পাড়ার কাকিমারা লুচি সুজি ভেজে, এমনকি বিপত্তারিণীর মালিক পর্যন্ত দুটো বাসি দানাদার ঠোঙায় করে টুটুলের মাকে দিয়ে গেছিলেন, “ছেলেকে এরোপ্লেনে টিফিনে দিয়ে দেবেন” বলে।

খেপ খেলার টাকা দিয়ে টুটুল সিগারেট এনেছিল সবার জন্য। খেলাধুলো করলে মনটা বড় হয়ে যায়, খেয়াল করে দেখবেন। খাওয়াদাওয়া সেরে রাতে মাঠে বসে ছিলাম। ল্যাম্পপোস্ট, হাইরাইজের আলো না থাকলে তারাগুলো কী স্পষ্ট দেখা যায়, দেখেছেন কখনও? পুকুরের দিক থেকে হাওয়া আসছিল। টুটুল সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, জানিস আসামবাড়ির বউয়ের পাড়ার একজনের সঙ্গে দেখা হল। বলল, ইস, ভোম্বলদার কপালটাই খারাপ, পর পর দুটো বউই অপঘাতে গেল।

দুটো? বেশি ধোঁয়া টেনে ফেলে বিষম খেল কেউ কেউ।

সে রকমই তো বলল।

আমরা টানটান হয়ে বসলাম। টুটুল ভালো করে শুনে এসেছে। আসামবাড়ির লোকটা আদতে কলকাতার। টেলিকমে চাকরি করে। এখানে থাকতে থাকতে লোকটার একটা বিয়ে হয়েছিল, কয়েকবছর পর সে বউ গলায় দড়ি দিয়েছিল নাকি জলে ডুবেছিল। মোদ্দা কথা, অপঘাত মৃত্যু। তারপর লোকটা আসামে চলে যায়। সেখানে আমাদের আসামবউয়ের সঙ্গে লোকটার আলাপ হয়। মাসছয়েকের প্রেম, তারপর বিয়ে। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই হাওড়ার কোনও একটা এক্সচেঞ্জে ট্রান্সফার হয়ে লোকটা বউকে নিয়ে আবার এদিকে চলে আসে।।

সেও গেল, আগুনে পুড়ে।

আমরা চুপ করে বসে রইলাম। হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছিল। মেঘ এসেছিল সম্ভবত, তারাগুলো নিভে গেল। ভ্যাপসা গুমোটে, মশা তাড়াতে তাড়াতে আমরা অন্ধকার মাঠে বসে রইলাম, সিগারেটের জ্বলন্ত সিগারেটের লাল বিন্দু আমাদের অবস্থান নির্দেশ করতে লাগল।

*****

 

বোমাটা ফাটল তার মাসখানেক বাদে। মুনমুনের মা জ্বলজ্বলে মুখে খবর দিল, মুনমুনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। জেঠিমাকাকিমারা অবাক হলেন, এখনই? এই তো সবে কলেজে ঢুকল। মুনমুনের মা বলল, ভালো পাত্র পেয়ে গেলাম। বলে রহস্য ফাঁস করল। পাত্র আসামবউয়ের বর।

ওইটুকু মেয়েকে দোজবরে দিচ্ছ? জেঠিমাকাকিমারা শিউরে উঠলেন।

মুনমুনের মা বলল, আমার দেওয়ার কিছু নেই। মেয়েই পছন্দ করেছে। ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবেই না।

খবরটা পেয়ে আমরা বুঝভম্বুল হয়ে রইলাম। আর ঠিক তখনই রোজকার মতো লাল রঙের হিরো সাইকেল সাঁইসাঁই চালিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল। পরনে লালহলুদ চকরাবকরা সালওয়ারকামিজ। লাল বাপি মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আর কিছু বলার দরকার পড়ল না।

কী করব বুঝে না পেয়ে দিনদুয়েক পর এক সন্ধেয় জলুদার বাড়ি যাওয়া গেলাম। টুটুল আসাম থেকে থেকে যা শুনে এসেছে সব বলল। প্রথম বউ, গলায় দড়ি, দ্বিতীয় বউ, আগুনে পোড়া। তৃতীয় এবং হবু বউ মুনমুন। মিলেনিয়াম পার্ক।

জলুদা আঁতকে উঠলেন। মুনমুন মানে আমাদের মুনমুন? মুনমুনের মায়ের মুনমুন?

সেম টু সেম।

আসামবাড়ির লোকটা মুনমুনের সঙ্গে প্রেম করছে? ওর মেয়ের বয়সী তো!

প্রেমপর্ব শেষ। বিয়ে লাগল বলে। মুনমুনের পয়লা নম্বর, লোকটার তিন নম্বর।

মুনমুনের মা জানে?

জানতেও পারে। লোকটা প্রায়ই সন্ধেবেলা চপ তেলেভাজা নিয়ে ওদের বাড়িতে যায়। সিকন্দরের বউ বলেছে।

জলুদা টাকে জোরে জোরে হাত বোলাতে লাগলেন।

এই যে কলকাতার স্ত্রীর কেসটা, গুজবও তো হতে পারে?

রাজুর মামা পোর্ট ট্রাস্টের হেডঅফিসে বসে। নাম করায় চিনতে পেরেছে। শুনেই বলেছে, ভেরি আনফরচুনেট। ওঁর বোধহয় ওয়াইফ সুইসাইড করেছিলেন তাই না? তারপরই তো উনি আসামে না কোথায় ট্রান্সফার হয়ে যান। এখন তোমাদের পাড়ায় থাকেন বুঝি, কেমন আছেন হ্যানাত্যানা।

কৌশিকদার বাবা হাইকোর্টের নামজাদা উকিলের অফিসে স্টেনোগ্রাফার; বললেন, দেখো কিছু প্রমাণ যখন হয়নি তখন আমাদের ধরে নিতে হবে যে প্রথম বউটার গলায় দড়ি আর আসামবউয়ের পুড়ে মরা, দুটোই লোকটার মন্দভাগ্যের ফল। এর বেসিসে লোকটাকে তিন নম্বর বিয়ে করা থেকে আটকানো যাবে না। একমাত্র রাস্তা মুনমুনকে বুঝিয়ে বলা।

অন্য কেউ হলে তবু চেষ্টা করা যেত, মুনমুনের সঙ্গে আমরা খেলেছি, দৌড়েছি, নাগরদোলা চড়েছি, ও মেয়ের জেদ আমরা জানতাম। ডুবসাঁতারের কম্পিটিশনে জিততে গিয়ে নীল হয়ে যাচ্ছে তবু উঠে আসছে না, ও শুনবে কথা?

খোঁজখবর চালিয়ে গেলাম। কায়দা করে রাজুর মামার অফিস থেকে লোকটার পুরনো ঠিকানা বার করে একদিন যাওয়া হল। বেলগাছিয়ার গলির ভেতর তস্য গলি। গলায় দড়ির কেসটা মনে ছিল পাড়ার কারও কারও, তারাই বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিল। বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন মালিকরা কিছু জানেটানে না। ফিরে আসছি, উল্টোদিকের বাড়ির দোতলার আধময়লা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা একটা বুড়ো বসে ছিল। হাতপাখা নাড়তে নাড়তে দেখছিল আমাদের। শেষ চেষ্টা হিসেবে বুড়োটাকে ধরলাম। এ বাড়ির আগের মালিককে চেনেন কি না।

বুড়োর ঘোড়েল চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নিমপাতা চেবানো মুখের ভাব। বলল, চিনি বৈকি। কিন্তু আপনারা কেন চিনতে চান সেটা তো আগে জানতে হবে। বললাম, পাড়ার একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ায় খবরাখবর নিতে এসেছি। বুড়ো বলল, অ। পাত্র হিসেবে কেমন সে বলতে পারব না, তবে ভাগ্যবান পুরুষ। এ বাড়ি ছিল ওর বউয়ের। লাঠালাঠিতে কাকচিল বসতে পারত না। বউ গলায় দড়ি দেওয়ার পর উইল বেরোল— বউ বাড়িশুদ্ধু সমস্ত সম্পত্তি লোকটার নামে লিখে দিয়ে গেছে।

চোখ তাকাতাকি করে উঠে পড়তে যাব, বুড়ো বলল, আরেকটু শুনে যান। লোকটার পৈতৃক বাড়ি ছিল বাগবাজারে। বুড়োর ভায়রাভাই নাকি সে পাড়ারই লোক। লোকটার এক অকৃতদার কাকা ছিল, মহাজনী কারবারে বিস্তর পয়সা করেছিল, সেই কাকাও মরার আগে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গিয়েছিল এই ভাইপোকেই। কাকা ভাইপোর তেমন হৃদ্যতা চোখে পড়েনি কারও কাজেই এর ভাগ্যে যে শিকে ছিঁড়বে ভাবেনি কেউ। কিন্তু অমন ডাম্বেল পেটানো, মুগুর ভাঁজা কাকা, মোটে ষাট বছরে যে রাতের অন্ধকারে ভুল করে ওষুধের বদলে ইঁদুরের বিষের বোতল গলায় উপুড় করে মরে যাবে, সেও তো কেউ ভাবেনি।

*****

 

সেদিন রাতে মোড়ের মাথায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম। লোকটা রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। আমরা এগিয়ে গেলাম। কয়েকটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে। এক সেকেন্ড থেমে আমাদের আলতো ধাক্কা মেরে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল লোকটা। অল্প অল্প টলছে।

পেছন থেকে চাপা গলায় বলে উঠলাম, আমরা জানি। সব জানি। বেলগাছিয়ার বাড়িতে কে গলায় দড়ি দিয়েছিল, বাগবাজারের বাড়িতে ওষুধের ভুল ডোজ খেয়ে কে মরে গিয়ে সব সম্পত্তি কার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিল, সব। সব জানি আমরা।

ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের খারাপ টিউবলাইটটার আলো দপদপ করছিল লোকটার মুখের ওপর। সেই প্রথম ভালো করে লোকটার চোখ দেখলাম, আর কী বলব আপনাকে, হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। চোখ তো নয়, ঠান্ডা গহ্বর। লোকটা কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমাদের চোখে চোখ ফেলে। তারপর মুচকি হেসে পেছন ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল। একটা চেনা হিন্দি গানের গুনগুনানি বাতাসে ভেসে রইল শুধু।

*****

 

মুনমুন বাড়িতে জানান দিল, রেজিস্ট্রারকে নোটিস দেওয়া হয়ে গেছে, আর মাসকয়েকের মামলা। আধপোড়া বাড়ির খদ্দেরও জুটে গেছে। কাগজপত্র রেডি হচ্ছে, বাড়ি বিক্রি হলেই রেজিস্ট্রি করে ওরা চলে যাবে হাওড়ায়। অফিসের কোয়ার্টারে উঠবে।

শান্ত গলায় খবর দিল মুনমুনের মা। আর কেউ না জানুক তোমরা তো জান। হাড়পাঁজরা দিয়ে একা ওই মেয়েকে বড় করেছি। ও ছাড়া তো আমার আর…

মুনমুনের মা চুপ করে গেল। আমরা মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

অদ্ভুত ব্যাপার, সবসময় না হলেও, কখনও কখনও কিছু কিছু সমস্যার সমাধান আপসে হয়ে যায়। মাস ফুরোতে না ফুরোতেই আবার আগুন লাগল পাড়ায়। ওই আসামবাড়িতেই। ভাবতে পারেন? সকাল থেকে বৃষ্টি নেমেছিল সেদিন। দুপুর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার পর যতক্ষণে ধরেছিল, ততক্ষণে সবাই যে যার বাড়িতে ঢুকে দরজা দিয়েছে। সে জন্যই তো আগুনটা লাগার বেশ খানিকক্ষণ পর্যন্ত কেউ বুঝতেই পারেনি। মাঠের ভেতর বাড়িটা দাউ দাউ করে জ্বলেছে, কে জানে কতক্ষণ। তারপর জানালার পাল্লার ফুটো দিয়ে কে যেন আগুনের লাল দেখে সবাইকে খবর দেয়। লোক জড়ো হতে হতে গোটা বাড়িকে আগুন গিলে ফেলেছিল। চেষ্টা করলেও কিছু করা যেত না। কাজেই আমরা বৃথা চেষ্টা করিনি।

পুলিশ? হ্যাঁ, এসেছিল তো। গলা মোটা করে ওসি জানতে চাইলেন কী করে আগুন লাগল। কী বলব বলুন। রান্না করতে গিয়ে স্টোভ ফাটল, নাকি শর্ট সার্কিট, কে জানে। বাড়িতে বসে ড্রিঙ্ক করার অভ্যেস ছিল, হয়তো সিগারেট ধরিয়ে নেভাতে ভুলে গেছে। না, কেউ কিচ্ছু দেখেনি। ওই দুর্যোগের রাত, চাঁদ ঢেকে গেছে লালচে মেঘে, ওর মধ্যে কি কারও কিছু দেখা সম্ভব?

নিয়মরক্ষা জনাপাঁচেককে জিপে পুরে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্থা করে ছেড়েও দেওয়া হল।

মুনমুন আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদল। মুনমুনের মা, সিকন্দরের বউ, মা কাকিমা জেঠিমারা জাপটে ধরে রইল। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কয়েকদিন ভয়ে ভয়ে ছিলাম সবাই, চোখে চোখে রাখতাম। একা একা কোথাও যাচ্ছে দেখলেই, যে যত ব্যস্তই থাকি না কেন, দাঁড়িয়ে কথা বলতাম। ওর বয়সী মেয়েরা রোজ বিকেলে দল বেঁধে আসত, জোর করে ঘুরতে নিয়ে যেত এদিকসেদিক। জলুদা বলে দিলেন, কলেজ না থাকলে ছেলেটার অঙ্ক দেখিয়ে যাস তো মুনমুন, হাফইয়ার্লিতে সাঁইত্রিশ পেয়েছে। দেখাদেখি পাড়ার আরও বাড়ির বাচ্চাকাচ্চার টিউশানির দায়িত্ব মুনমুনকে দেওয়া হল। তারপর রেললাইনের ওপারের একটা বাচ্চাদের স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল মুনমুন। এখনও মনে আছে, ঘটনার পর বছর ঘুরে রসুনজয়ন্তী এল, মুনমুন বাচ্চাগুলোর মাথায় মালা পেঁচিয়ে দিচ্ছিল, লাস্ট মোমেন্টে নাচ প্র্যাকটিস করিয়ে দিচ্ছিল। বাচ্চাগুলো স্টেজে ঘুরে ঘুরে নাচছিল, স্টেজের আলো এসে পড়ছিল মুনমুনের নার্ভাস মুখে। নাচ শেষ হওয়ার পর জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে মুনমুন, মুখ জুড়ে ঘাম আর গর্ব লেপালেপি— আমাদের অনেকেরই সুখস্মৃতির অ্যালবামে ওই দৃশ্যটা চিরকালের মতো সাঁটা আছে।

মিথ্যে বলব না, পাড়ায় একটা টানটান আবহাওয়া বজায় ছিল ঘটনার বেশ কিছুদিন পরেও। চলতে চলতে পেছন ফিরে চট করে চারদিক দেখে নিত কেউ কেউ। দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় অচেনা লোককে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলে ছাদের তারে কাপড় মেলতে মেলতে কাকিমাজেঠিমার হাত থেমে যেত। কিছুদিনের মধ্যেই সে সব থিতিয়ে গেছিল। থানা থেকেও আর বেশি ঝামেলা করেনি। পরে বুঝেছিলাম ওসির মাথা জুড়ে তখন অন্য চিন্তা ছিল। মাসকয়েক বাদেই তিনি বদলি হয়ে গিয়েছিলেন সালকিয়ার দিকের একটা থানায়। সেখানে প্রকাণ্ড সব গুদামঘর আর ন্যাশনাল পারমিটের লরিদের দাপাদাপি। ওই থানায় বদলির জন্য শুনেছি ডিপার্টমেন্টে ধরাধরি মারামারি লেগেই থাকে, দরখাস্তর পাহাড় জমে যায়।

তারপর? তারপর আবার যেই কে সেই। উত্তরে বন্ধ কারখানার পাঁচিল, দক্ষিণে গরানের মাঠ, পুবে রেললাইন আর পশ্চিমে বারুজীবীর খালের মধ্যে জীবন বয়ে চলল। গরানের মাঠ এখন নামেই মাঠ, আসলে কংক্রিটের জঙ্গল। পোড়ারমুখ আসামবাড়িটা ফাঁকা দাঁড়িয়েছিল অনেকদিন, সম্প্রতি ওটা আর ওটার আশেপাশের প্লট কিনে নিয়েছে বাপি, দত্তবাড়ির জামাই। একুশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি তুলেছে। নাম রেখেছে উইন্ডসর রেসিডেন্সি।