Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাবাবিয়ানা

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

 

আমাদের বাংলা ছড়ায় রাজার সঙ্গে খাজার অন্ত্যমিল খুবই আকছার, তেমনি নবাবের সঙ্গে কাবাব। অনেকদিন ধরেই আমজনতার সঙ্গে কাবাবের একটা সামাজিক দূরত্ব ছিল। সাধারণ গেরস্তের ঘরে কাবাবিয়ানা ছিল না। মুসলমান সংসারেও তেমন নয়। গত কয়েক বছর যাবৎ দেখতে পাচ্ছি বাঙালির কাবাবির বাড়বাড়ন্ত। একবার, মাসছয়েক আগে দমদম জংশন থেকে আমার বাসস্থান মতিঝিলের কাছাকাছি হেঁটে আসতে আসতে গুণে দেখলাম রাস্তার উপরেই ৩৫টি দোকানের সামনে শালুমোড়া হাঁড়ি শোভাচ্ছে। মানে, ওখানে বিরিয়ানি পাওয়া যায়। চল্লিশটির মত দোকানে মাংসটুকরো-গাঁথা শলাকা ঝুলছে। এগুলোই কাবাব বলে জানে জনতা। এই শলাকাবিদ্ধ মাংসখণ্ডগুলি কখনও পরোটা জাতীয় খাদ্যে পেঁয়াজ, শসা, সস, লেবু মণ্ডন করে গুটিয়ে কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়, ওকে বলে রোল। কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়ায় চাউ আগে এসেছে না রোল আগে এ নিয়ে একটু মতভেদ আছে। ১৯৭৩ সালে আমি আমার এক আধুনিক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম চাউ খাই। আধুনিক বলছি এই কারণে, ও বাড়িতে প্রথম বনসাই এবং হাতকাটা ব্লাউজ পরা বৌদি দেখি। কিন্তু ৬৭-৬৮ সালেই আমিনিয়ায় রোল খেয়েছি। পরবর্তীকালে কলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্ত পাড়ায় বিউটি পার্লার, রোলকর্নার প্রায় একইসঙ্গে ঢুকতে থাকে এবং মেয়েদের ম্যাক্সি। প্রথমদিকে অবিবাহিতারাই পড়ত, পরের দিকে বিবাহিতারাও। রোলকর্নারগুলিতে সাধারণত চাউমিনও পাওয়া যায়। কিন্তু রোলই কাবাব সংস্কৃতিকে ডেকে আনে। কাবাবের একটা প্রকার শিককাবাব। এটা আলাদাভাবে সালাদসহ পরিবেশিত হতে পারে, আবার পরোটায় মুড়েও হতে পারে, যেটা আগেই বলেছি। আর এই কাবাবি ব্যাপকতার একটা বড় কারণ বেকারিত্ব। চাকরির সুযোগ কমে আসছিল, আর জমি খণ্ডিত হচ্ছিল বলে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে সারা দেশে পোলট্রি চর্চা শুরু হয়। সরকার সাহায্য করে। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা ক্রমশ কুক্কুট সিনড্রোম মুক্ত হতে থাকে। যে সব বাড়িতে ৬০-এর দশকেও মুরগি ঢুকত না, ৮০-র দশকে ঢুকে গেল। ৬০-এর দশকে মুরগি ও কাটাপোনা ছিল বড়লোকি খাদ্য। ৮০-র দশক থেকে পাঁঠা খাসির মাংসর তুলনায় মুরগি সস্তা হয়ে গেল, পুঁটি মৌরলার তুলনায় কাটাপোনা যেমন। মুরগি সস্তা হলেও কৌলীন্য ততটা হারাল না। লটে মাছ সস্তা অথচ কৌলীন্যহীন। মুরগির জাতরক্ষার কারণ এটা ছিল নবাবি খাদ্য, এবং সাহেবি খাদ্য। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ড ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানি মুরগির হরেক পদ তৈরি করে।

মুরগি ক্রমশ বাঙালি ননভেজ গেরস্তের নিত্যখাদ্য হয়ে উঠল। নব নব রূপে দেখার জন্য, নব আনন্দে জাগার জন্য মুরগি রান্নার বৈচিত্র এল। বাঙালি গেরস্ত চিলি চিকেন বানাতে লাগল বাড়িতে। পালক চিকেন, মেথি চিকেন ইত্যাদি পার হয়ে কাবাব।

কাবাব শুধু মুরগি দিয়েই হয় তাই নয়। নানারকম মাংসেরই হতে পারে। গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগির কাবাবই বিশ্বজুড়ে চলে। তবে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দোকানগুলিতে যেসব সাদা, লালচে এবং সবুজ মাংসমালা ঝোলে, ওগুলো মুরগি জাত। এবং এইসব মশলা মাখানো মাংস সমাহার উনুনে সেঁকা হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকে। এগুলো শিক কাবাব আগেই বলেছি (যদিও নীলাঞ্জন সিখ কাবাব বলেছেন)। কিন্তু কাবাব যে আরও বহু রূপে আবির্ভূত হয়, এ কথা অনেক বেকাবাবির জানা নেই। কিছু কিছু রান্নার বইতে টিক্কা কাবাব, সুতলি কাবাব এসব থাকে। কিন্তু আরও কত রকম কাবাব আছে জানবেন নীলাঞ্জন হাজরার ‘কাবাব কিসসা’ বইটি পড়ে। এটি রান্নার বই বা রেসিপি বুক নয়। নিছক ‘রেসিপি বুক’ হলে এত বুক বাজিয়ে প্রশংসা করতাম না। রান্নার বই পেটুকের পেটের খিদে বাড়ায়, এইধরনের বই মনের খিদে বাড়ায়। খাদ্য নির্বাচন, পাকপ্রণালী এবং বিশেষ খাদ্যের প্রতি অনুরাগ মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে সমন্বিত। বিশেষ গোষ্ঠীর খাওয়াদাওয়াটাও তাদের সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে। এবং খাদ্যগুলির নামকরণের কেন্দ্রেও জলভরা তালশাঁস সন্দেশের কেন্দ্ররসের মতই লুকনো থাকে ইতিহাস। নীলাঞ্জনের এই কেতাবটি কাবাব-কেতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ যেহেতু, তিনি মূলত কাবাবের কথাই বলেছেন, বলেছেন বিভিন্ন কাবাবের অন্তর্গত ইতিহাস। সমাদৃত বা অসমাদৃত হওয়ার কাহিনি এবং রেসিপিও। রেসিপি বর্ণনার ভঙ্গিটি গতানুগতিক নয়। কেমিস্ট্রির প্র্যাকটিকালের মতো। কী করবেন কী মেশাবেন-এর সঙ্গে সঙ্গে বলা হচ্ছে কেন করবেন, কেন মেশাবেন।

লেখক নানা কারণে নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। এবং জানা কথা, আর ভ্রমণ গড়পড়তা বাঙালিদের মতো নয় যারা লেবাননে লেবু মেখে ডাল-আলুপোস্ত বা লে-তে গিয়ে লুচি খোঁজেন। ভ্রমণের কোনও মানে নেই যদি সেদেশের কাঁচা বাজার না দেখা হয় এবং স্থানীয় খাদ্য না খাওয়া হয়। নীলাঞ্জন যেটা করেছেন। নানারকম খাবার পরখ করেছেন এবং সুলুকসন্ধান করেছেন। নানারকম খাবারের কথা বলতে গিয়ে হয়তো সাত তরকারির লাফড়া হয়ে যেতে পারত, তাই কেবলমাত্র কাবাবেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। যেসব কাবাবের নামই শুনিনি কখনও সেসব আলোচনা করেছেন। কাবাব তালিকায় আছে— রামায়ণী, মিনোয়ানি, মাহি, খৈয়ামি, তন্দুরি, ইরানি, নিজামি, অটোমানি, সিরিয়ান, দড়কা, আকবরি, শাহজাহানি, আওরঙ্গজেবি, লখনওয়ি, আসফিয়া এবং বাঙালি কাবাব।

প্রথম কিসসা রামায়ণী কাবাব পড়েই আমার ভালোলাগা শুরু। শুরুতেই একটি রাজস্থানী রামায়ণের ছবির পুনর্মুদ্রণ উপহার দিয়েছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঘরের ভিতরে সীতা সম্ভবত রান্না করছেন, বাইরে লক্ষণ কাঠিতে মাংস গেঁথে আগুনে ঝলসে নিচ্ছেন। ১৬৪০ সালে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। লেখক দেখিয়েছেন মাংস ঝলসানোর এই প্রাচীন পদ্ধতি যর্জুবেদ-সহ প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থেও ছিল। এটাকে শূলপক্ক মাংস বলা হত। কিন্তু পারস্যে এর উচ্চারণ সিখ। উনি ‘শিক’ না লিখে ‘সিখ’ লিখেছেন। রামায়ণের কালে অনেক মশলাই ছিল না। এখন যেসব মশলাপাতি ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই এসেছে পরবর্তীকালে। সেসময় ডালিম রসে ম্যারিনেট করা হত। দধি লবণেও। রামায়ণী কাবাবের প্রস্তুতপ্রণালীতে তাই জাফরান নেই, দারুচিনি এলাচ নেই। আদা, গোলমরিচ, ঘি, ডালিম রস, দই, ধনে ও পুদিনা পাতা, সৈন্ধব লবণ।

পড়তে পড়তে পাঠককে অবাক করবে কাবাবকেন্দ্রিক অনুসন্ধিৎসার কামাল। কোথায় কোন প্রাচীনকালের গ্রিসের মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা শিক কাবাবের উনুনের ছবি দিয়েছেন, যেটা খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৬০০ সালের। আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের তলায় চাপা ছিল। পার্কসার্কাস রাজাবাজার অঞ্চলের লম্বাটে উনুনের মতোই দেখতে। পড়তে পড়তে দেখি নানারকম বইয়ের উল্লেখ, যা উনি পড়েছেন। মধ্যযুগের ইসলামের ইতিহাস না পড়লে ওদের ক্যুজিন জানা যায় না। বিভিন্ন সাহিত্যে রয়েছে রন্ধন প্রণালীর উল্লেখ। আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্যে তো অনেক রান্না-বর্ণনা আছে। বইয়ের শেষে সূত্রগুলি উল্লেখ করেছেন। সেখানে চোখ বোলালেই বোঝা যায় কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে, এবং এই পরিশ্রমটুকু ভালোবেসেই করেছেন।

আমাদের ধারণা মাংসেরই কাবাব হয় শুধু। মাছেরও হয়। মাহি কাবাব। ইরানে জাফরান দিয়ে মাছের কাবাব হয়। ওরা ক্যাবব বলে। তুর্কিরা বলে কেবাপ বা কেপাপ। মাহি কাবাবের একটা রকমফের খৈয়ামি কাবাব। ভিন্নস্বাদের এই কাবাবের নাম হয়ত লেখকেরই দেওয়া। ওমর খৈয়ামের একটা রুবাইকে অবলম্বন করে এই নাম দিয়েছেন। খৈয়াম পারস্যের কবি। ঝলসানো মাংস কীভাবে সুগন্ধী নরম কাবাব হয়ে উঠল এটা সবচেয়ে ভালো জানে পারস্য। একটি চ্যাপ্টার আছে ‘কাবাব কারে কয়’। এখানে রোস্টের সঙ্গে কাবাবের পার্থক্য, কাবাবের অনন্যতা ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছেন। পরবর্তী অধ্যায়ে কাবাবের জাতি কুল গোত্র খুঁজেছেন। একটা অধ্যায় আছে ‘কেবাপের রাজনীতি’। এখানে কাবাব না লিখে তুর্কি উচ্চারণ কেবাপ লিখেছেন এই কারণে— তুর্কি জনগোষ্ঠীকে বশ করার জন্য ওদের দোনার কেবাপকে নিয়ে যে লোকদেখানো আহ্লাদীপনা সেটাই তুলে ধরেছেন। যদি আমাদের মোদিজি হঠাৎ সর্ষে ইলিশ বা আলুপোস্তর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন, কিছু বাঙালি প্রভাবিত হতেই পারেন। জার্মানিতে নানা কারণে বেশ কিছু তুর্কি জনগোষ্ঠী আছেন। ওদের বেশ কিছু কেবাপের দোকান আছে। সেই দোকানগুলিতে গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানরা ছবিটবি তোলেন। প্রশংসা করেন। বছরে ৩৫০ কোটি ইউরোর ব্যবসা করে কেবাপ। তুর্কিরা মনে করে এটা খ্রিস্টান দুনিয়ায় ইসলামের মাথা তুলে দাঁড়ানো। আমাদের বাঙালিদের যেমন সব গেছে, শেষে রসগোল্লা নিয়ে আমাদের গর্ব খুঁজতে হয়। ওডিশার সঙ্গে রসগোল্লা নিয়ে ঝগড়া করি।

দোনার কেবাপ অন্য কাবাবের মতো নয়। ঘুরন্ত দণ্ডে মাংসচাকার উপর লম্বালম্বি তাপ পড়ে। এতে খাদ্যবস্তুর স্বাদ, গন্ধ এবং নমনীয়তা বজায় থাকে।

খাদ্য নিয়ে তো নানা ধরনের রাজনীতি হয়। ট্রাম্পের নিমন্ত্রণে ভারতীয় নেতারা গেলে যদি ধোঁকলা-গাঁঠিয়া পান মোদিজি সন্তুষ্ট হবেন। মিষ্টি দই পেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা যদি ইমরান খাঁকে নিমন্ত্রণ করি নিশ্চয়ই কাবাব রাখব মেনুতে। বিরিয়ানিও।

বইটি পড়ে বোঝা যায় খাদ্যরসিক নীলাঞ্জন ইতিহাস থেকেও রস বের করতে জানেন। তবে খাদ্যের ইতিহাস একটা আলাদা বিষয় হিসেবে এখন চর্চিত। খাদ্যের মধ্যে দার্শনিকতা এবং পুরাকাহিনি কিংবদন্তীও মিশে থাকে। সংস্কার কুসংস্কারও।

নীলাঞ্জন হাজরার কলম ও মননের কাছে আমাদের অনেক আশা। উনি খাদ্যসংস্কৃতি বিষয়টিকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারবেন।

কাবাব কিসসা। নীলাঞ্জন হাজরা। ধানসিড়ি। ৪৫০ টাকা।