Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গান্ধিজি ও চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ডরুজ

গান্ধিজি ও চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ডরুজ -- সৈয়দ কওসর জামাল

সৈয়দ কওসর জামাল

 


লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক। টেকনো ইন্ডিয়ার মিডিয়া স্টাডিজের আমন্ত্রিত অধ্যাপক

 

 

 

জন্মেছিলেন ১৮৭১ সালে উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের নিউকাসল-এ। পড়াশুনা বার্মিংহাম ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ১৮৯৭ সালে হয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মযাজক। অভিজ্ঞতা বলতে তাঁর ছিল বছর তিনেক লন্ডনে আর্বান মিশনারির কাজ ও চার বছর কেমব্রিজের পেমব্রুক কলেজে শিক্ষকতা। এরপর ১৯০৪ সালে তেত্রিশ বছর বয়সে খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে ভারতে এসে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেছিলেন চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ডরুজ। শুরুর দিনগুলোতে ভারতে তাঁর অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হয়নি।  সাদা চামড়ার ইংরেজ প্রভুরা এ দেশের কালো চামড়ার মানুষদের সামাজিকভাবে গ্রহণ করেনি, এই সত্য অ্যান্ডরুজের চোখ এড়ায়নি। এই ‘white racism’ তাঁকে হতাশ ও ব্যথিত করেছে। দৃষ্টিভঙ্গির এই ফারাকের জন্য অ্যান্ডরুজ স্বদেশীয় মানুষের চেয়ে ভারতীয়দের সঙ্গই বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছেন।

ভারতের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এক ধরনের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার জন্ম হতে দেখেছেন অ্যান্ডরুজ। গোপালকৃষ্ণ গোখেল প্রতিষ্ঠা করেছেন Servants of India Society, যার উচ্চ সামাজিক আদর্শ দেশের তরুণদের সঙ্কীর্ণ জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে সরব করেছে। অ্যান্ডরুজের ছাত্ররা ১৯০৫ সালে পাঞ্জাবের প্লেগশিবিরে হরিজনদের মধ্যে কাজ করেছে, ধর্মশালায় ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের দুর্গত মানুষদের জন্য রিলিফ ফান্ড সংগ্রহ করেছে। ভারতীয় খ্রিস্টানদের মধ্যেও এই জাতীয় সচেতনতা লক্ষ করা গেছে, তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন National Missionary Society। এমন এক পরিবেশ অ্যান্ডরুজের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল মিশনারি অধ্যাপকের কাছে কাজ করার খুবই উপযুক্ত সময় বলে মনে হয়েছে। তাঁর কখনও মনে হয়নি নিজের ব্রিটিশ উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে ভারতের জাতীয় আত্মজাগরণের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কোনও বিরোধ আছে। অ্যান্ডরুজ নিজেকে বলেছেন ‘an English friend of India’। ভারতের প্রতি ইংরেজদের ঔদ্ধত্য যত বেশি দেখেছেন, তত বেশি করে মিশেছেন ভারতীয়দের সঙ্গে। ১৯০৭ সালে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ হয়েছেন সুশীলকুমার রুদ্র। আর অ্যান্ডরুজ বন্ধু হয়েছেন গোখেল, লালা লাজপত রায়, সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, জাতীয়তাবাদী নেতা কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর রুদ্র প্রমুখ ভারতীয়ের।

১৯১২ সালের জুন মাসে অ্যান্ডরুজ লন্ডনে গেছেন Congress of the Universities of the Empire-এ যোগ দিতে। সেখানে শিল্পী রোটেনস্টাইনের বাড়িতে দেখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। দুজনের মধ্যে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। অ্যান্ডরুজ নভেম্বরে ফিরে এসেছেন দিল্লিতে। এবার তিনি যোগ দিয়েছেন ভাইস-প্রিন্সিপালের পদে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুতার যে সূচনা হয়েছে, তা আগামী দিনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করবে বলে আমরা জানি।

রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে অ্যান্ডরুজ শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। আশ্রমের পরিবেশ খুবই পছন্দ হয় তাঁর। কথাপ্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথকে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোহনদাস গান্ধি ভারতীয়দের প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। এই আন্দোলন সম্পর্কে এ দেশের মানুষের মধ্যেও ঔৎসুক্য ছিল। কংগ্রেস অধিবেশনেও এ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করা হয়। এদিকে গোখেল সারা ভারত ঘুরে এই সত্যাগ্রহের পক্ষে নৈতিক সমর্থন ও আর্থিক সহযোগিতার সন্ধান করেছেন। অ্যান্ডরুজ এই কাজে গোখেলের সঙ্গে দিনরাত কাজ করেছেন। এই কাজে তিনি তাঁর বন্ধু বিশপ লেফ্রয়কে পাশে পেয়েছেন। সবার উদার সহায়তায় একটা আর্থিক ফান্ড তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে অ্যান্ডরুজ শান্তিনিকেতনে এসেছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শের জন্য। ইতিমধ্যে কবির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবর এসে পৌঁছেছে। অ্যান্ডরুজ তাঁকে প্রণাম করতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। অ্যান্ডরুজ বুঝতে পারেন ঈশ্বরের যে আহ্বানের জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন তা যেন এই মুহূর্তে তিনি পেয়েছেন। দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন তিনি শান্তিনিকেতনের জন্য কাজ করতে চান। দিল্লি ফিরতেই গোখেল জানালেন এবার তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে হবে। যাত্রার প্রস্তুতি চলছে এমন সময় তাঁর কাছে এসেছেন উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ারসন। তিনিও দিল্লিতে থাকেন। “দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা উপহার এনেছি আমি আপনার জন্য,” ঘোষণা করেছেন তিনি, “উপহার আমি নিজেই।”

১৯১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন অ্যান্ডরুজ ও পিয়ারসন, এবং রবীন্দ্রনাথ জাহাজবন্দরে তাঁদের বিদায় জানালেন। তাঁরা ডারবান পৌঁছোন ১ জানুয়ারি, ১৯১৪। ডারবানের জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়েছিলেন হেনরি পোলক— তাঁর সঙ্গে অ্যান্ডরুজের দেখা হয়েছিল যখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের হয়ে কথা বলতে ভারতে এসেছিলেন। দিন বারো আগে গান্ধিজি ও হেরমান কালেনবাকের সঙ্গে তিনিও জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি অ্যান্ডরুজকে অভিবাদন জানালেন। “মিঃ গান্ধি কোথায়?”, অ্যান্ডরুজ জিজ্ঞেস করলেন। পোলক শ্রমিকের মতো মোটা কাপড়ের তৈরি সাদা ধুতি ও কুর্তাপরিহিত শীর্ণ ও সংযমী চেহারার এক ব্যক্তির দিকে তাকালেন। মুহূর্তে অ্যান্ডরুজ নিচু হয়ে তাঁর পা স্পর্শ করলেন। একজন ইউরোপীয় ভারতীয়ের পা স্পর্শ করে প্রণাম করছে, এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক আলোড়ন উঠেছে, কিন্তু অ্যান্ডরুজ সেসবকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।

পিয়ারসন দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে চিনিকলগুলোতে ভারতীয় শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেছেন। আর গান্ধিজি অ্যান্ডরুজকে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। আগের মাসেই জেনেরাল স্মাটস ভারতীয়দের জন্য গ্রিভান্স কমিশন গঠন করেছিলেন এবং গান্ধিজিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তিনি কমিশনে সাক্ষ্য দেবেন বলে। গান্ধিজির যুক্তি ছিল ভারতীয়দের আন্দোলন ছিল অহিংস তাই কমিশনে সাক্ষ্য দেওয়া ভারতীয়দের আত্মসম্মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতীয় পক্ষের যুক্তি খুবই দৃঢ়, তবু কমিশনে সাক্ষ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত মনে করেছেন কেউ কেউ। আলোচনার পথ বন্ধ হলে সত্যাগ্রহের পথ খোলা, কিন্তু নাটালের ইউরোপীয়রা অ্যান্ডরুজকে জানিয়েছেন যে এর অর্থ, গুলি খেয়ে মরতে হবে। ভারত থেকে গোখেলও সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছেন। ডারবানে ভারতীয় নেতারা আলোচনায় বসেছেন, তাঁদের সঙ্গে অ্যান্ডরুজ আছেন। দুএকটি কথার পর তিনি গান্ধিজির দিকে তাকালেন— “প্রশ্নটি কি শুধুমাত্র ভারতীয় সম্মানের নয়?” গান্ধিজির চোখে আলোর ঝিলিক খেলল। তিনি বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক তাই, ঠিক তাই। এটাই আসল কথা।” অ্যান্ডরুজ বললেন, “তাহলে আমি নিশ্চিত যে আপনিই ঠিক। সম্মান বিসর্জন দেওয়া যাবে না।” এই মুহূর্ত থেকেই গান্ধিজি ও অ্যান্ডরুজ যেন নিকতটতম বন্ধু হয়ে উঠলেন। দুতিনদিনের মধ্যে একে অপরের কাছে হয়ে উঠেছেন ‘মোহন’ ও ‘চার্লি’।

ডারবান থেকে কিছু দূরে গান্ধিজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিনিক্স আশ্রম। অ্যান্ডরুজ সেখানে গেছেন গান্ধিজির সঙ্গে। খুব কাছে থেকে গান্ধিজিকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। দেখেছেন কীভাবে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্য কষ্ট পেয়েছেন তিনি। এখানে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে অ্যান্ডরুজেরও সাক্ষাৎ হয়েছে। এমনই এক তামিল কুলি পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে আশ্রমে। তার সারা শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন দেখে ব্যথিত গান্ধিজিকে দেখে অ্যান্ডরুজের চোখ সিক্ত হয়েছে। ফিনিক্স আশ্রমে অ্যান্ডরুজ বেশিদিন থাকার সুযোগ পাননি। জেনেরাল স্মাটস গান্ধিজিকে ডেকেছেন প্রিটোরিয়ায় আলোচনার জন্য, এবং অ্যান্ডরুজ তাঁর সঙ্গে যাবেন। সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকা শিল্পসঙ্কটের মুখোমুখি এবং দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। তার আগেই শেষ ট্রেন ধরে তাঁরা প্রিটোরিয়া পৌঁছেছেন। ‘প্রিটোরিয়া নিউজ’-এর সম্পাদকের প্রশ্নের উত্তরে গান্ধিজি জানিয়েছেন ভারতীয়রা এই ধর্মঘটে যোগ দেবে না, তাদের লড়াই খুবই স্পষ্ট, সত্যাগ্রহ এই অবস্থায় মুলতুবি থাকবে। দেশের সঙ্কটে স্মাটস-এর নজর সেই দিকে নিবদ্ধ হওয়ায় গান্ধিজির জন্য তিনি আর সময় দিতে পারছেন না। তাঁরা অপেক্ষা করছেন। শেষ পর্যন্ত জেনেরাল স্মাটস-এর সঙ্গে আলোচনা এবং গান্ধিজির সঙ্গে তাঁর চুক্তিও ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে; এখানেও বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন অ্যান্ডরুজ। কিন্তু ডারবানে আর থাকা হল নয়া। লন্ডনে মার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁকে সেখানে চলে যেতে হল।

কেপ টাউন বন্দর থেকে অ্যান্ডরুজ লন্ডনের জাহাজ ধরেছেন। তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন গান্ধিজি ও কস্তুরবা। গান্ধিজি থেকে তিনি ক্রমশ যত দূরবর্তী হয়েছেন, তাঁর মনে হয়েছে যিশু খ্রিস্টের উপস্থিতির অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। লন্ডনে পিতার সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে পুনরায় ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন অ্যান্ডরুজ। ১৭ এপ্রিল ভারতে এসে পৌঁছেছেন। ঘোষণা করেছেন আর এ দেশ ছেড়ে যাবেন না।

দক্ষিণ আফ্রিকা বা লন্ডনে থাকার সময় বেশ কয়েকটি চিঠির আদানপ্রদান হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও অ্যান্ডরুজের মধ্যে। একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “আপনি নিশ্চয় জানেন যে আপনি যখন গান্ধিজি ও অন্যান্যদের পাশে দাঁড়িয়ে আফ্রিকায় আমাদের মঙ্গলের জন্য সংগ্রাম করছিলেন তখন আমাদের গভীর শুভেচ্ছা আপনাকে ঘিরে রেখেছিল” (ফেব্রুয়ারি, ১৯১৪)। ডারবান থেকে লেখা অ্যান্ডরুজের একটি চিঠিতেই আমরা প্রথম লক্ষ করি গান্ধিজি সম্পর্কে ‘মহাত্মা’ শব্দটির ব্যবহার। তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখেন:

প্রথম থেকেই মিঃ গান্ধির অবস্থান লক্ষ করতে ও তা মেনে নিতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি; কারণ নীতিগতভাবে তা মূলত আপনার ও মহাত্মাজির— সত্যিকার স্বাধীনতা, আধ্যাত্মিক শক্তির ওপর নির্ভরতা, জাগতিক শক্তির সামনে নির্ভয় সাহস এবং এ সবের সঙ্গে সব মানুষের জন্য এক গভীর ও তীব্র বদান্যতা।

অনেকেরই ধারণা যে গান্ধিজিকে ‘মহাত্মা’ অভিধা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু অ্যান্ডরুজকেই আমরা প্রথম শব্দটি ব্যবহার করতে দেখছি এই চিঠিতে। মনে রাখা জরুরি যে তখন পর্যন্ত গান্ধিজির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সরাসরি কোনও যোগাযোগ ঘটেনি। আমাদের অনুমান, সম্ভবত স্থানীয় ভারতীয়দের মুখ থেকে তিনি অভিধাটি সংগ্রহ করেছিলেন। তবু, এদেশের মানুষের সামনে গান্ধিজিকে প্রথম ‘মহাত্মা’ অভিধায় সম্বোধন করার কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথেরই। কমবেশি অল্প সময়ের মধ্যে পিয়ারসন ও অ্যান্ডরুজ শান্তিনিকেতন আশ্রমে যোগ দিয়েছেন।

গান্ধিজি লন্ডনে থাকায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। শারীরিক শ্রম এবং ধর্ম ও নীতিশিক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হত ছাত্রদের পাঠক্রম। কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু আজ্ঞানুবর্তিতাকেই বড় গুণ হিসেবে মানা হত। দুজন শিক্ষকসহ এই ছাত্রদের ভারতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা দূরে থেকেই করলেন গান্ধিজি। তাঁদের আশ্রয় হল হরিদ্বারের গুরুকুল আশ্রমে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা হওয়ায় অ্যান্ডরুজের মধ্যস্থতায় সবাইকে হরিদ্বার থেকে শান্তিনিকেতনে আনা হয়। এখানকার আশ্রম বিদ্যালয় ও ফিনিক্স বিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তাদের শান্তিনিকেতনে থাকার ব্যবস্থা করতে অসুবিধে হয়নি। বরং রবীন্দ্রনাথ গান্ধিজিকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন— “আপনি যে আপনার ছাত্রদের আমার ছাত্র বলে গ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ জানাতেই আপনাকে এই চিঠি লিখছি।”

গান্ধিজির শান্তিনিকেতনে আসার পর গান্ধি-অ্যান্ডরুজ সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। গান্ধিজি গোখেলকে কথা দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরার পর এক বছর তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবেন না। এই কারণে এ সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার টলস্টয় ফার্ম ও ফিনিক্স বিদ্যালয়ের মতো করে সবরমতী আশ্রম নির্মাণের কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। বছরের শেষদিকে অ্যান্ডরুজ নিজে সবরমতী আশ্রমে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ করেন আশ্রম কীভাবে দরিদ্রতম, দীনতম ও নিঃস্বতম মানুষদের সেবা করছে। আবার তিনিই গান্ধিজির রবীন্দ্র-কথিত ‘নৈতিক অত্যাচার’-এর বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে তর্ক করেছেন। তিনি একবার বলেছিলেন— “মিঃ গান্ধির সঙ্গে ভিন্নমত  হতে আমার আপত্তি নেই, ভিন্নমতের জন্যই আমরা পরস্পরকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে পারি।”

১৯১৮ সালের মে মাসে লর্ড চেমসফোর্ড গান্ধিজিকে আহ্বান করেন দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য ইম্পিরিয়াল ওয়ার কনফারেন্সে যোগ দিতে, গান্ধিজি চেয়েছেন অ্যান্ডরুজ তাঁর সঙ্গে থাকুন। তাঁর অনুরোধমতো অ্যান্ডরুজ দিল্লি যাত্রা করেন এবং ট্রেনে সংবাদপত্রে পড়েন যে রাশিয়ার বিদেশ অফিস থেকে এক ‘গোপন চুক্তি’র নথি ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে যে চুক্তিতে গ্রেট ব্রিটেনও স্বাক্ষর করেছে। অ্যান্ডরুজ ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকাটি গান্ধিজিকে দেখান এবং এই দ্বিমুখী নীতির অনুসরণকারী ব্রিটেনের ডাকে গান্ধিজির কনফারেন্সে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।  অভিযোগ ‘অপ্রমাণিত’ বলে গান্ধিজি সংবাদটিকে গুরুত্ব দিতে চাননি; তাঁর মত ব্রিটেনকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দেওয়ার পক্ষে। অ্যান্ডরুজ এই ধারণার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন শুধু নয়, তিনি বিতর্কটির সঙ্গে শান্তিবাদ ও অহিংসার প্রশ্ন যুক্ত করে চিঠিতে লেখেন:

আপনার চিঠিতে বোবা মানুষের তুলনা ঠিক মনে হয় না। মনে হচ্ছে এই তুলনা বিপজ্জনকভাবে সেই যুক্তির কাছাকাছি চলে যাচ্ছে যে, যে ভারতীয় রক্তলোলুপতার কথা ভুলে গেছে তাকে তা আবার জানতে উৎসাহিত করা হবে এবং তারপর তার নিন্দা করা হবে।… একই সঙ্গে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে ভারত স্বাধীনভাবে তার নিজের পথ ঠিক করবে যা পৃথিবীকে অহিংসার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ দেবে, বর্তমানের অধীনস্থ ভারত নয়। কিন্তু তখনও কি আপনি দখলকারী সেনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য স্থায়ী সেনার সৃষ্টি না করে শুধু মাত্র নৈতিক শক্তির দ্বারা সেই স্বাধীনতা অর্জনের চিন্তা করবেন না? (২৩ জুন, ১৯১৮)

শান্তি সম্মেলনের ইতিহাস শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করেছে যে ব্রিটিশ সরকারের দুরকম নীতির (double-dealing) যে অভিযোগ অ্যান্ডরুজ করছিলেন তা ছিল বাস্তব। গান্ধিজির কাজের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা অ্যান্ডরুজের ছিল। তাই তিনি বলতে পারেন, যে-যে বিষয়গুলোকে গান্ধিজি কম গুরুত্ব দিয়েছেন, সেগুলোর ক্ষেত্রেই তিনি অসফল হয়েছেন।

অ্যান্ডরুজ ও গান্ধিজির এই বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা, কখনও বিতর্কও, চিঠিপত্র থেকে ব্যক্তিগত সাক্ষাতেও প্রসারিত হয়েছে। ১৯২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বিশেষ কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পর গান্ধিজি শান্তিনিকেতনে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বিদেশে। অ্যান্ডরুজ ও গান্ধিজি একান্তে কথা বলেছেন। গান্ধিজি কংগ্রেস অধিবেশনে তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন এবং তাঁর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। এ বছরই বিশ্বভারতীতে পুজোর ছুটি শুরু হলে অ্যান্ডরুজ গুজরাতে গিয়ে গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের মধ্যেকার আলোচনা পুনরায় চিঠিপত্রে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। গান্ধিজি এই সময় জাতীয় পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে তাঁর পাঁচটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন— ১) তথাকথিত অন্ত্যজদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ২) হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্ব ৩) নারীর সম্মান ৪) মদ্যপান ও ড্রাগের নেশা থেকে মুক্তি ও ৫) ‘স্বদেশি’ আচরণ। অ্যান্ডরুজ এই লক্ষ্যের সঙ্গে ঐকমত্য দেখান এবং আন্তরিকভাবে কর্মসূচি রূপায়ণে গান্ধিজির পাশে দাঁড়ান, তবে রাজনীতিক হিসেবে নয়, একজন ধর্মীয় মানুষ হিসেবে। তাঁর যুক্তি ছিল— গান্ধিজির এই নীতি ধর্মেরই নীতি। নিজে খ্রিস্টান বলেই তিনি জানেন যে স্বাধীনতা ধর্মীয় নীতির অন্তর্গত। আর ভারত কখনওই তথাকথিত অস্পৃশ্যদের উচ্চশ্রেণির মানুষদের অধীনস্থ রেখে স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারবে না।

গান্ধিজি, রবীন্দ্রনাথ ও অ্যান্ডরুজ একসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ এসেছিল ১৯১৯এর এপ্রিলে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর। সংবাদ প্রচারে নিষেধ থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের খবর লোকমুখে দেরিতে এসে পৌঁছোয়। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন যে গান্ধিজি রাজি হলে তাঁরা একসঙ্গে দিল্লিতে মিলিত হবেন এবং সেখান থেকে দুজনে একসঙ্গে পাঞ্জাবে প্রবেশ করার চেষ্টা করবেন। পাঞ্জাবের বাইরে থেকে সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে তাঁদের নিশ্চয় গ্রেফতার করা হবে এবং এভাবেই তাঁরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাবেন। এই প্রস্তাব নিয়ে অ্যান্ডরুজ গান্ধিজির কাছে গেলেন। কিন্তু গান্ধিজি পাঞ্জাব যেতে রাজি হননি– “I do not want to embarrass the Government now”– শুনে রবীন্দ্রনাথ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এর পরের ঘটনা হিসেবে আমরা দেখি ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকে চিঠি লিখে তিনি তাঁর নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করছেন।

দেশের স্বায়ত্তশাসন বা স্বরাজের দাবিতে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন পরের বছর, ১৯২০ সালে। এই আন্দোলনই তাঁর দিক থেকে প্রথম ও পূর্ব-পরিকল্পিত বৃহৎ গণ-আন্দোলন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যার ক্রোধ এই আন্দোলনকে তীব্র করতে সাহায্য করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন ইউরোপে। প্রথমে তিনি এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু অ্যান্ডরুজের চিঠিতে যখন জানেন যে খিলাফতের দাবিকেও তিনি এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন, তখন তিনি বিমুখ হন। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে খিলাফতের দাবিকে যুক্ত করায় অ্যান্ডরুজ নিজেই গান্ধিজির কাছে তাঁর ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনিও গান্ধিজির অসহযোগ ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয় পরিত্যাগের নীতি সমর্থন করেছিলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও অ্যান্ডরুজের মতের অমিল লক্ষ করা যায়।  এই আন্দোলন সারা দেশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারিতে চৌরিচৌরার ঘটনার প্রেক্ষিতে গান্ধিজি অ্কস্মাৎ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। আন্দোলন প্রত্যাহৃত হলেও গান্ধিজিকে গ্রেফতার করা হয় ১৯২২-এর মার্চ মাসে। কারামুক্তির জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় দুবছর—  ১৯২৪ এর জানুয়ারি পর্যন্ত।

এই সময় অ্যান্ডরুজ প্রধানত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর কাজে নিয়োজিত থাকলেও একাধিকবার দেশের বিভিন্ন স্থানে মানবসেবার কাজে যোগ দিয়েছেন। ১৯২৩-এ তিনি ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন; ১৯১৪ সালে তিন সপ্তাহ কাটানোর পর আর তিনি ইংল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ পাননি। ১৯২৪এ গান্ধিজির বন্দিদশা ঘুচলে দুমাস তিনি গান্ধিজির সঙ্গে কাটান। এই সময় অনেক দেশীয় নেতার সঙ্গে তাঁর সরাসরি কথা বলার সুযোগ ঘটে। জেলে কয়েকবার অনশনের জন্য গান্ধিজির বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। অ্যান্ডরুজ দায়িত্ব নিয়ে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স-এ অগস্ট মাসে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে; গান্ধিজি তখন দিল্লিতে; তিনি সংঘর্ষ প্রশমনের জন্য ১৭ সেপ্টেম্ব থেকে একুশ দিনের অনশনে বসেন। অ্যান্ডরুজ এখানেও গান্ধিজির পাশে থেকেছেন। অনশনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফলে ধর্ম-সম্প্রদায়-প্রদেশ নির্বিশেষে চারশো প্রতিনিধি এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন দূর করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। অনশনের শেষ দিন পার হলে অনশন ভাঙার সময় গান্ধিজি অ্যান্ডরুজকে তাঁর প্রিয় একটি খ্রিস্টান স্তব (hymn)— When I survey the wondrous Cross— গেয়ে শোনাতে বলেন। অ্যান্ডরুজের কণ্ঠে এই স্তবগান সবার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে; আর তাঁর মনে হয়েছে মানুষের দুর্দশার মর্ম গান্ধিজি বুঝতেন বলেই যিশু খ্রিস্টের যন্ত্রনা উপলব্ধি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত। অ্যান্ডরুজ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না এবং সারা ভারতে, ও বিদেশেও, তাঁর কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে থাকার জন্য শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে ওঠেন। বর্মা ঘুরে আসার পর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় তাঁর রিপোর্ট পড়ে গান্ধিজি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন– “কাজ হল প্রার্থনা, কিন্তু তা পাগলামিও হতে পারে।” গান্ধিজির কি মনে হচ্ছিল অ্যান্ডরুজ তাঁর সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন? অ্যান্ডরুজের বন্ধুত্বকে উচ্চ মূল্য দিতেন এবং তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই তাঁদের বিদায়বেলার মুহূর্ত গান্ধিজির কাছে বেদনার মতো বেজেছে। এ বছরই, ২০ অক্টোবরের চিঠিতে তিনি লিখেছেন— “আমি আজ প্রতিটি মুহূর্তেই আপনার অভাব বোধ করেছি। ওহ, আপনার ভালোবাসা!”

১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ যাওয়ার কথা। অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেবেন। অ্যান্ডরুজও ওই সময় যাবেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ইউরোপ যাওয়া সম্ভব হল না। অ্যান্ডরুজ তাঁর নিজের ভ্রমণ বাতিল করলেন না; তাঁর মনে হয়েছিল এই সময় ভারতের পক্ষ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোকে কিছু জানানো দরকার। আগের বছর ক্যাথারিন মেয়ো-র গ্রন্থ ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ভারত সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। অ্যান্ডরুজ স্বেচ্ছায় ভারতের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা জাতীয় সত্তায় জাগরিত ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং গান্ধিজির জীবন ও চিন্তা পশ্চিমের সামনে তুলে ধরবেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্র জগতে অ্যান্ডরুজের যোগাযোগ ছিল, তাদের মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করলেন যা কিছু তাঁর বলার ছিল। কথা বলেছেন বিশ্বশান্তি বিষয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর সঙ্গে। এই সময় অ্যান্ডরুজ রবীন্দ্রনাথের রচনার ইংরেজি সঙ্কলন, যেমন Letters to a friend, Fireflies, The Tagore Birthday Book, Thoughts from Tagore– সম্পাদনার কাজ করছিলেন তা সমাপ্ত করেছেন এবং পাশাপাশি লিখছেন গান্ধিজিকে নিয়ে গ্রন্থ ‘Mahatma Gandhi’s Ideas’।

এই গ্রন্থগুলো ছাড়াও প্রকাশকের অনুরোধে অ্যান্ডরুজ নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ What I Owe to Christ রচনার কাজে হাত দিয়েছেন। Mahatma Gandhi’s Ideas প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৯ সালে আর Mahatma Gandhi : His Own Story বেরিয়েছে ১৯৩০এ। এর পরই অ্যান্ডরুজ তৃতীয় গ্রন্থ— Mahatma Gandhi At Work রচনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতি গান্ধিজির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ইংল্যান্ডে নানা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। গান্ধিজির উদ্দেশ্য ও তার সততা সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল অনেকেই। অ্যান্ডরুজ তাঁর বইদুটোতে গান্ধিজি সম্পর্কে এই বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে ব্যক্তিগত আলোচনায় ও পত্রপত্রিকার সাক্ষাতে সব ধরনের অস্বচ্ছতা দূর করতে সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছেন। তিনি বলেছেন—

আমি শুধু বলতে পারি যে বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় আমি তাঁর চেয়ে বেশি সত্যবাদী মানুষ আমি কখনও দেখিনি। আপনারা যদি সত্যিই তাঁর সঙ্গে আলোচনা চান তবে আমার সঙ্গে এই বিশ্বাস ভাগ করে নেওয়া জরুরি।… মিঃ গান্ধির সততা ও আন্তরিকতায় বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনও ভিত্তিতেই ভারতের পরিস্থিতি সঠিক মীমাংসায় পৌঁছোবে না।

১৯৩১এর গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য গান্ধিজি লন্ডনে গেছেন। অ্যান্ডরুজ মার্সাইয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং কনফারেন্সের বাইরে গান্ধিজির জন্য ব্যবস্থাপনার সমস্ত দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছেন। গান্ধিজির অসংখ্য সাক্ষাৎপ্রার্থীদের দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। হেনরি পোলকের সাহায্যে সপ্তাহান্তিক ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছেন বিভিন্ন প্রদেশে। লাঙ্কাশায়ারে গিয়ে কথা বলেছেন সেখানকার শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে। একটি সপ্তাহের শেষদিন কাটিয়েছেন ‘ম্যানচেস্টার গার্ডেন’-এর সম্পাদক সি-পি স্কটের সঙ্গে। দেখা হয়েছে বার্মিংহামে ‘কোয়েকার ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া’র সদস্যদের সঙ্গে। আর যে জন্য লন্ডনে যাওয়া সেই গোলটেবিল বৈঠক সম্পর্কে অ্যান্ডরুজ জানিয়েছেন তাঁর অনুভবের কথা এইভাবে— ‘আ ম্যাগনিফিসেন্ট ফেলিওর’। বৈঠক ব্যর্থ হলেও অ্যান্ডরুজের সাফল্য এই যে তিনি খুব ভালোভাবে ভারতের পরিস্থিতি ও ভারতীয় বক্তব্য উল্লেখযোগ্য ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। কিন্তু রাজনীতি যে ভিন্ন আবর্তে চলে তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি গান্ধিজি ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করে ১৯৩২ সালের মাঝামাঝি ভারতে ফিরে এলে। ইতিমধ্যে লর্ড আরউইনের স্থলে ভাইসরয় হিসেবে এসেছেন লর্ড উইলিংডন। তাঁর নীতি সব আন্দোলনকে শক্ত হাতে দমন করা। গান্ধিজি দেশে ফেরার পর আরো অনেক নেতাসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। অ্যান্ডরুজ ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা কনফারেন্সে যোগ দিতে। গান্ধিজির গ্রেফতারের খবর পেয়ে তিনি সব পরিকল্পনা বাতিল করে দ্রুত ফিরে আসেন ভারতে।

একই ব্যাপার ঘটেছে গান্ধিজি ‘কমিউন্যাল অ্যওয়ার্ড’ প্রত্যাহারের দাবিতে পুনা জেলে অনশন শুরু করলে অ্যান্ডরুজ ম্যানচেস্টার থেকে উদবিগ্ন হয়ে তারবার্তা পাঠান তাঁর দেশে ফেরা দরকার কিনা জানতে। গান্ধিজি পরবর্তী তারবার্তায় জানান যে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই তাঁর এই অনশন, চার্লি যেন ইংল্যান্ডেই থাকেন। সরকারের সঙ্গে পুনা-চুক্তি অনুষ্ঠিত হওয়ায় গান্ধিজি অনশন ত্যাগ করেন। এই চুক্তির পেছনে অ্যান্ডরুজের পরোক্ষ প্রভাবের কথা জনিয়েছেন অ্যান্ডরুজের জীবনীকার। তাঁর ধারণা লন্ডনে অ্যান্ডরুজের পরিকল্পিত ও অবিরাম প্রচেষ্টা ছাড়া গান্ধিজির প্রাণরক্ষা সম্ভব হত না। দূরে থেকেও প্রতিনিয়ত খোঁজ রেখেছেন গান্ধিজির অনশনের প্রতিটি মুহূর্তের এবং উদ্বেগের সঙ্গে কাটিয়েছেন। গান্ধিজির অনশন শেষ হলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। রম্যাঁ রলাঁকে তারবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছেন— ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ওঁকে বাঁচানো গেছে।

১৯৩৯ সালে গান্ধিজি পুনরায় তাঁর সত্যাগ্রহ শুরু করেন ভারতের রাজ্যগুলোর সমস্য নিয়ে। এই বিষয়ে অ্যান্ডরুজ গান্ধিজির পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি নিজেও ওডিশায় লক্ষ করেছেন অনেক সমস্যা। সেখানে কয়েকবার বন্যার সময় দুর্গত মানুষের পাশে থেকেছেন। ওডিশার ভিতরে অনেকগুলো এমন ছোট ছোট রাজন্যশাসিত অংশ দেখেছেন, যাদের অবস্থা সুখকর ছিল না। গান্ধিজি রাজকোটের সমস্যার সমাধানে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে নতুন সংবিধান রচিত হলে এই রাজ্যগুলোর স্বায়ত্বশাসন স্বীকৃত হয়েছে।

আমরা জানি অ্যান্ডরুজ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। দিল্লিতে থাকার সময় উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য শরীরের অবস্থার অবনতি হলে তিনি সিমলায় গিয়ে থাকতেন। আবহাওয়ার কারণে ছাড়াও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যেমন ১৯১৫ সালে তিনি যখন শান্তিনিকেতনে, অসুস্থ হয়ে কলকাতার নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়। ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অ্যান্ডরুজ। তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেনেরাল (পিজি) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গান্ধিজি কলকাতা চলে আসেন এবং দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটান। ডাক্তাররা অ্যান্ডরুজের দুটি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। গান্ধিজি টেলিগ্রাম করে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন যে টেলিগ্রাম পড়ে অ্যান্ডরুজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “আমার আর কোনও উদ্বেগ নেই। বাপু যখন অনশন করছিলেন আমি তাঁকে ডাক্তার দেখাবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘চার্লি, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না?’ আমি এখন সেই মহান ডাক্তারের কথা চিন্তা করছি। তিনি যা করবেন তাতে আমার জন্যে যেমন তেমনি ভারত ও পৃথিবীর জন্যেও মঙ্গল হবে।” অপারেশন করেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। ৫ এপ্রিল, ১৯৪০ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় লোয়ার সার্কুলার রোডের সেমিটারিতে।

অ্যান্ডরুজের মৃত্যুতে গান্ধিজি ‘হরিজন’ পত্রিকায় লেখেন— “সি-এফ অ্যান্ডরুজের মৃত্যুতে শুধু ইংল্যান্ড নয়, শুধু ভারত নয়, মানবতা হারাল এক সত্যনিষ্ঠ সন্তান ও সেবককে।” মানুষের জন্য তাঁর সেবাব্রত ও ভালোবাসা লক্ষ করেই গান্ধিজি তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরিসর বৃদ্ধি করে তাঁকে ভারতের জাতীয় জীবনের সঙ্গী করেছেন; তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন একে অপরের ঘনিষ্ঠ ভ্রাতা ও বন্ধু। এই বন্ধুত্ব একজন ভারতীয় ও ইংরেজের বন্ধুত্ব ছিল না, বন্ধুত্ব দুই সত্যসন্ধানীর। গান্ধিজি অ্যান্ডরুজ সম্পর্কে বলেছিলেন— “তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের সুসন্তান এবং তিনি ভারতেরও সন্তান হয়ে উঠেছিলেন; আমি তাঁর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানুষ বা উৎকৃষ্ট খ্রিস্টান আর দেখিনি।” আত্মজীবনীমূলক ‘What I Owe to Christ’ (১৯৩২) গ্রন্থে অ্যান্ডরুজ গান্ধিজি সম্পর্কে লিখেছেন–

দেখা হওয়ামাত্র আমাদের দুই হৃদয়ের মিলন ঘটেছিল; আর তারা তখন থেকেই ভালোবাসার অতি দৃঢ় বন্ধনে এক হয়ে থেকেছে। তাঁর সংস্পর্শে থাকার অর্থই হল এক অনুপ্রেরণা যা তাঁর ভিতরের সব ভালোকে জাগ্রত করেছে, এবং আমাকে দিয়েছে তাঁর প্রোজ্জ্বলিত ও আলোকিত এক উচ্চ সাহস। ব্যথাক্লিষ্ট যে কোনও সামান্য জিনিসের প্রতিও তাঁর ছিল কোমলতা, আর এ ছিল তাঁর সত্যের নিরন্তর সন্ধান, যার অন্য নাম ছিল ঈশ্বর।”