Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সিক্ত স্মৃতির তোরণের সমুখে জলিদা

জলি মোহন কল | রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব

শঙ্কর রায়

 


লেখক প্রবীণ সাংবাদিক

 

 

 

 

History has many cunning passages, contrived corridors and issues.
T.S. ELIOT, Gerontion

জলি মোহন কল। আমাদের সবার প্রিয় অভিভাবকসম জলিদা, গত ২৯ জুন তাঁর জীবনের ইনিংস শেষ হল। আর ৮৩ দিন বাঁচলে তাঁর শততম জন্মদিনে আমরা প্রতি বছরের মত পার্ক সার্কাসে কড়েয়া হাউসিং স্টেট-এ তাঁর দু-কামরার ছিমছাম ফ্ল্যাটে গোলাপ ফুলের গুচ্ছ নিয়ে যেতাম। সেই স্বল্পতম ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেল। নচেৎ ৯৮ পেরুনো এক মানুষের মহাপ্রস্থান নিয়ে আফশোস থাকার কথা নয়, যদিও তাঁকে দেখে মনে হত বড় জোর ৮৫ বছর। মস্তিস্ক সচল ছিল। শেষ দিকে বলতেন স্মৃতিবিভ্রমের কথা, তাও তেমন কিছু নয়।

ঐ ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে দেখা ও বাতচিত হত আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ও বিরল মাপের লেখক সুনন্দ কিশোর দত্তরায়, ঋজু-দৃঢ় সাংবাদিক অদিতি রায় ঘটক, রাষ্ট্রসঙ্ঘ সংহতি-সচেতনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ সীতারাম শর্মা এবং তপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিত্যানন্দ ঘোষের মত মার্ক্স-পন্থী লিখিয়েদের সঙ্গে। যেতাম ১১ ডিসেম্বর, জলিদার স্ত্রী ও কমরেড কিংবদন্তিপ্রতিম কমিউনিস্ট নেত্রী ও গণআন্দোলনের প্রতিভাদীপ্ত সংগঠক মণিকুন্তলা সেনের জন্মদিনে। এ ছাড়াও বছরে গড়ে পাঁচ-ছ’র যাওয়া হত। তাতে অন্তরায় হল ২০১৬-র কলকাতা বইমেলায় আমার পড়ে গিয়ে ফিমার বোন (নেক) ফ্র্যাকচার। অপারেশন মোটামুটি ঠিক হলেও সেই পা-টা ছোট হয়ে গিয়ে আমাকে খোঁড়া করে দিয়েছে। শেষ চার বছরে বার দশেক যেতে পেরেছি। আমার তো আফশোস থেকেই গেল, জলিদাও বলেছিলেন, বেশ কিছু কথা বলার আছে, বলা হচ্ছে না।

শেষ কয়েক দশক তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন সুনন্দদা। তিনি অনেকটাই একলা হয়ে গেলেন। জলিদা-মণিদির ফ্ল্যাটেই সুনন্দদার সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈকট্য গড়ে উঠেছে। জলিদা-মণিদির জন্মদিনে সুনন্দদা সস্ত্রীক (সুমিতা দত্তরায়) আসতেন। জলিদার চেয়ে ১২/১৪ বছরের ছোট হলেও সুনন্দদা জলি বলে ডাকতেন। জলিদাকে দেখে এসে জানাতেন, জলি শারীরিকভাবে ঠিক আছে। জলিদার কাছে গিয়ে আমিও জানাতাম। সেসব ইমেলে রাখা আছে। তিনিই ২৯ তারিখে সন্ধেবেলায় ইমেলে জানালেন তাঁর বন্ধু আর নেই।

সেই প্রথম আর লিখতে পারলেন না, জলি শারীরিকভাবে ঠিক আছে।

জলিদার স্মৃতিভারে আমি ন্যুব্জ। আমার চেয়েও অদিতির স্মৃতিভার নিবিড়তর। মণিদির প্রয়াণের পরে অদিতি তাঁকে নিজের মেয়ের মত দেখভাল করেছে।

জলিদার সঙ্গে আলাপ ১৯৮২ সালে। আমি তখন ‘ক্যাপিটাল’ সাপ্তাহিক-এর অস্থায়ী সম্পাদক। আমি জলিদার কাছে সম্পাদনার ভার তুলে দিই। আমাকে সেই পত্রিকা কেন ছাড়তে হয়েছিল, জলিদা তাঁর স্মৃতিকথা In Search of A Better Life Memoirs-এ লিখেছেন। সে কথা নিয়ে বলার অবকাশ নেই এখানে। জলিদাকে প্রথম দেখি ১৯৫৪ সালে ভবানীপুরে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই)-এর আঞ্চলিক দপ্তরের কাছে। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। তখনই শুনেছিলাম তাঁর হিন্দি ও বাংলায় বাগ্মিতার কথা। তারপর থেকে সেই ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জলিদার সঙ্গে আর সামনাসামনি দেখা হয়নি।

জলিদা পূর্ণ পার্টি সদস্য ছিলেন প্রায় বিশ বছর। তাঁর মেধার সঙ্গে মিশেছিল শ্রমজীবী মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, তাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিলেমিশে থাকা। তার প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে বন্দর শ্রমিকদের (পোর্ট ও ডক শ্রমিক) ধর্মঘটে তাঁর নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা। তখন পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশ বছরে পা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট এমপ্লইয়িজ ইউনিয়নের সম্পাদক অর্থাৎ পয়লা নম্বর নেতা। সেই সময় ঐ ইউনিয়ন ছিল কলকাতা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ইউনিয়নগুলির মধ্যে অন্যতম। জলিদার প্রয়াণের পর একটি ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে শুরু ৮৭ দিনের ধর্মঘটে তিনি ছিলেন ‘অন্যতম সংগঠক’,  যেন তার চেয়ে প্রধানতর নেতা কেউ কেউ ছিলেন। এ নিয়ে ১৯৯৭-এর এপ্রিলে প্রখ্যাত সাংবাদিক, ইতিহাবিদ ও লেখ্যাগার বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড তাঁর সাক্ষাৎকার নেন, যার ভিডিও রেকর্ড লন্ডনের সোয়াস (স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) বিশ্ববিদ্যালয়ে সুরক্ষিত আছে (জলিদা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন, সুনন্দদা শেষবার লন্ডনে থাকার সময় সোয়াস থেকে একটা ভিডিওক্লিপ আনেন ও জলিদাকে তার প্রতিলিপি দেন)।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক হুকমতে জনপিছু বন্দর শ্রমিকদের মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১৫ টাকা। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শুরু হল ঐতিহাসিক অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। হোয়াইটহেডকে জলিদা যা বলেছিলেন তার সারমর্ম এইরকম—

শ্রমিকদের ৬০ শতাংশের বেশি ছিলেন মুসলিম, কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিভেদ বা বৈরিতা ছিল না, ছিল ভ্রাতৃত্ববন্ধন। স্ট্রাইক ফান্ড ছিল না। দুই সম্প্রদায়ের শ্রমিকেরা কালেকশন বক্স নিয়ে শহরের এলাকায় ঘুরতেন, দাড়িওয়ালা মুসলিম আর টিকিওয়ালা হিন্দুরা। মানুষ বিপুল সাড়া দিয়েছিলেন। পোর্ট ট্রাস্টের কর্তৃপক্ষ তথা ঔপনিবেশিক সরকার পে কমিশন বসায় ও শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য বেতনবৃদ্ধি হয়।

উপরিউক্ত ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ‘পোর্টের ৩০,০০০ শ্রমিকের মধ্যে ৮৫ শতাংশই তখন তাঁদের লাল ঝান্ডা ইউনিয়নে, তবু বহু চেষ্টায় একেবারেই সংখ্যালঘু আইএনটিইউসি ইউনিয়নকেও স্ট্রাইকে টেনে এনেছেন, শ্রমিক ঐক্য ভাঙতে দেবেন না বলে। আবার স্ট্রাইক চলাকালীন আইএনটিইউসি নেতৃত্ব যখন বার বার পিছুটান মেরেছে “এভাবে কিছু হবে না, ওরা কিছুতেই মানবে না” বলে, তখন শ্রমিকরাই তাদের গদ্দারি করতে দেয়নি।’

আদ্যন্ত ভিত্তিহীন। সেই ধর্মঘট শেষ হয় ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭। আর আইএনটিইউসি প্রতিষ্ঠিত হয় ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭।

বন্দর শ্রমিক ধর্মঘটের ছ মাস আগে সারা ভারত মুসলিম লিগের সভাপতি মহম্মদ আলি জিন্নার ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র (১৬ অগাস্ট ১৯৪৬) ডাকে দেশ জুড়ে নারকীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়, যার জেরে ঘটে ইতিহাসে মহাকলঙ্ক ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। কিন্তু বন্দর শ্রমিকদের ঐতিহাসিক ৮৭ দিনের ধর্মঘটে তার কলুষ স্পর্শ করেনি। আজকের দিনে ভাবা যায় না, যে যখন পরাধীন ভারতের (একেবারে অন্তিম ক্ষণে) রাজনৈতিক চত্বর সাম্প্রদায়িক ‘হিংসায় উন্মত্ত’, তখন ধর্মগতভাবে মিশ্র শ্রমজীবী এলাকা সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে এককাট্টা। তাঁরা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র সময় একসঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়াসে ময়দানে গিয়েছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে হানাহানি শুরু হয়ে গেছে। তাঁরা ফিরে এসেছিলেন কিন্তু তাঁদের এলাকা ও চারপাশে দাঙ্গা রুখেছিলেন। জলিদা বলেছেন এ জন্য সিপিআই-এর নেতৃত্বের তারিফ করতে হবে। অথচ সেই এলাকায় সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট আমলের প্রথম দশকে দোলের দিন হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয়, কলকাতা পুলিশের উপ-নগরপাল বিনোদ মেহতা ও তাঁর দেহরক্ষী দাঙ্গা রুখতে গিয়ে নিহত হন।

জলিদা পার্টিতে যোগ দেওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যে কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য হন। সিপিআই-র প্রথম কংগ্রেসে (বম্বে) তিনি, প্রমোদ দাশগুপ্ত প্রভৃতি যোগ দিয়েছিলেন, তবে প্রতিনিধি নয়, দর্শক হয়ে। সেই কংগ্রেসে বাংলা থেকে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ও বিশ্বনাথ মুখার্জি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৩৩-এ গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে এই প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্দুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ি ও ডাঃ রণেন সেন। হালিম সাহেব বাদ পড়েন। আর বন্দর শ্রমিকদের সফল ধর্মঘটের পরে জলিদা পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে (কলকাতা ১৯৪৮) প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁকে অন্যত্র দরকার হয়েছিল। কংগ্রেসে ইংরাজি ভাষণের হিন্দি অনুবাদে ও হিন্দি থেকে ইংরাজিতে অনুবাদে। জলিদা দর্শক হলেন ও বন্দর এলাকার আরেক কমরেড প্রতিনিধি হলেন। সেই কংগ্রেসে পূরণ চাঁদ যোশীর জায়গায় সাধারণ সম্পাদক হলেন বালচন্দ্র ত্র্যম্বক রণদিভে। যোশীর কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ঠাঁই হল না। শুরু হল হঠকারী রণদিভে যুগ (সঙ্গে ছিলেন ভবানী সেন ও ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী)। সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেওয়া হল ৯ মার্চ ১৯৪৯। সারা ভারতে রেল ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল। জলিদা নিত্যানন্দ ঘোষকে তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সারা ভারতে তখন অধিকাংশ এলাকায় এআইটিইউসির কোনও ইউনিয়ন ছিল না। পার্টি পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেক রাজ্যে বেআইনি ঘোষিত হল। শুরু হল ব্যাপক ধরপাকড়। পার্টির খিদিরপুর কমিউন থেকে জলিদাও গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হলেন সিপিআই-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমদ, পার্টির বিধায়ক জ্যোতি বসু, মণিদি, রেণু চক্রবর্তী, নিরঞ্জন সেন, চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী প্রভৃতিও। মণিদি-রেণুদিরা অন্য জেলে ছিলেন। আর সবাই আলিপুর জেলে (দমদম জেলে নয়)। জলিদা হলেন জেল কমিটি সম্পাদক। তাঁদের কারাবাস শেষ হল ১৯৫১ সালের শেষে। এ নিয়ে অন্যত্র লেখার ইচ্ছে আছে।

রণদিভে আমল সব কিছু তছনছ করে দিল। সিপিআইতে এত বড় বিপর্যয় আগে ঘটেনি। জলিদা ১৯৫৩ সালে কুমুদ বিশ্বাসের জায়গায় কলকাতা জেলা সম্পাদক। সে বছরই মণিদির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। মণিদি তখন বিধায়ক ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সিপিআই গ্রুপের উপনেতা। পার্টি ছাড়া অবধি (জানুয়ারি ১৯৬৩) ঐ পদে ছিলেন। জলিদা ১৯৫৮ সালে সিপিআই-র পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে (অমৃতসর) পার্টির জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন।

জলিদা ও মণিদি পার্টি ছাড়লেন কেন? কারা যেন লিখেছেন, জলিদা বলেছেন পার্টি ছেড়েছিলেন “কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা আর মার্ক্সিস্ট পার্টি নেই, একটা স্ট্যালিনিস্ট পার্টি হয়ে গেছে।” এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেই সাক্ষাৎকার জলিদার জীবদ্দশায় (গত দেড়-দু বছর আগে হয়ত নেওয়া হয়েছে) ছাপা হলে জলিদা প্রতিবাদ করতেন।

পূর্বোদ্ধৃত ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে ‘১৯৬১ সালেই তিনি ভবানী সেনকে চিঠি লিখে পার্টি ছাড়তে চান, এবং তার পরের বছরেই ছেড়ে দেন’— এটাও ঠিক নয়। এক, আগেই বলেছি, জলিদা ও মণিদি ১৯৬৩তে (২১ জানুয়ারি ১৯৬৩) পার্টি ছেড়েছিলেন। পদত্যাগপত্রে জলিদা লিখেছিলেন:

প্রতিবেশী কমিউনিস্ট দেশের কিছু আচরণের কারণে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং প্রতিক্রিয়াবাদী যন্ত্রগুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে, তাতে আমি ভাবতে চেষ্টা করেছি, এই অবস্থা যতদিন চলবে ততদিন এখানে কমিউনিস্ট পার্টি আদৌ কোনও প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা। এটা অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক যে উক্ত বিষয়সহ আরও নানাবিধ আন্তর্জাতিক প্রশ্নে বিশ্বের বেশিরভাগ কমিউনিস্ট পার্টিই চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐকমত্য নয়, এবং তার চিন্তাকে তাঁরা ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর মনে করেন। কিন্তু চিনা পার্টির তরফে এমন কোনও ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যাচ্ছে না যে, এই ভুলগুলো তাঁরা বুঝতে পেরেছেন এবং তা সংশোধনের প্রয়াস নিয়েছেন। এর ফলস্বরূপ, আমার মনে একাধিক মৌলিক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। কিন্তু সমস্ত প্রশ্ন ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও আমি পার্টিতে আমার কাজ করে যাচ্ছিলাম এই আশা নিয়ে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে চলতে থাকা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমি আমার মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর পাব। কিন্তু এই মুহূর্তে, পার্টির ভেতরে যা অবস্থা, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়, তাতে আমি আমার পদত্যাগপত্র দাখিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বর্তমানে, প্রকৃত প্রস্তাবে, পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, এবং এও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, উদ্ভুত পরিস্থিতির সামনে তা ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। আগামীতে, প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির ফলে, একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য তা সম্পূর্ণভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়বে। পার্টির এহেন ভবিষ্যৎ-দশা আমাকে মানসিকভাবে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এবং একে যে এড়ানো সম্ভব হবে, বা গোটা বিষয়টা স্বল্প সময়ের মধ্যে মিটে যাবে, আমি এমন আশার আলোও দেখতে পাচ্ছি না।

যে লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি, সেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং শান্তির প্রতি আমি আজও আগ্রহী। কিন্তু বর্তমানে আমি এই আত্মবিশ্বাস অর্জনে অসমর্থ যে পার্টিতে অবস্থান করে আমি এই লক্ষ্যগুলোকে পূরণ করতে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হব।

(অনুবাদ— বাসু আচার্য, দ্রষ্টব্য ফেসবুক পোস্ট)

কিন্তু জলিদার পার্টির ওপর আস্থা আগেই (১৯৫৭ সালের পর থেকে) কমতে শুরু করে। আত্মস্মৃতিতেই আছে। তার বাইরেও কথা আছে। তিনি লিখেছেন, ১৯৫২ সালে পার্টি যখন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন নেতৃস্থানীয়দের অনেকেই প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি, তাঁদের গণসংগঠনের কাজ ব্যাহত হবে, এবম্বিধ যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৭ সালে লাইন পড়ে গেল। জলিদার ভাষায়:

পার্টির মধ্যে সুবিধাবাদ বাসা বাঁধছে, বুঝতে পারছিলাম। এ পার্টিতে থাকা মুশকিল। সেই সময় পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ আমাকে বললেন তাঁরা আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য করতে চান। আমি রাজি হইনি এ কারণেই। আমি বললাম আমার জায়গায় হরেকৃষ্ণ কোঙারকে নিতে। আমার পরামর্শ গৃহীত হল।

জলিদা-মণিদির ফ্ল্যাটটা ছিল পার্টির কমিউন। একটি ঘরে থাকতেন জলিদা-মণিদি, অন্যটিতে দীনেশ রায়। (তাঁর সম্পর্কে পরে লিখব)। অজয় ঘোষ বা ভূপেশ গুপ্ত কলকাতা এলে সেখানে থাকতেন। তখন দীনেশবাবু অন্যত্র থাকতেন। এই কথাগুলি বললাম এজন্যে যে পার্টি ছাড়ার ভাবনা জানালে তিনি অজয় ঘোষ বা ভূপেশ গুপ্তকে জানাতেন, ভবানীদাকে নয়। তার থেকেও একটা বড় কারণ ছিল ভবানীদাকে না জানানোর। পালঘাট কংগ্রেসের (চতুর্থ, ১৯৫৬) আগে থেকেই আন্তঃপার্টি সংগ্রামের দুটি ধারা ছিল— নরমপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট, যার নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, যোশী, ড. অধিকারী, রাজেশ্বর রাও, সোমনাথ লাহিড়ি, ভবানী সেন প্রভৃতি। আর অন্যটি গরমপন্থী ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট যার নেতৃত্বে ছিলেন অজয় ঘোষ, এর্নাকুলাম মানাক্কাল শঙ্করন নাম্বুদিরিপাদ, মাক্কিনেনি বাসবপুন্নাইয়া, ভূপেশ গুপ্ত, পঞ্চপাকেশন রামমূর্তি, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরকিষাণ সিং সুরজিত ইত্যাদি। জলিদা ও রণেনদাও এই লাইনে ছিলেন। তবে জ্যোতিবাবু, জলিদা, রণেনদারা বাসবপুন্নাইয়া-প্রমোদবাবুর কোন্দলবাজি থেকে দূরে থাকতেন। কাজেই জলিদা পার্টি ছাড়ার কথা ভবানী সেনকে চিঠি লিখে জানাবেন, তা অবিশ্বাস্য, লিখলে ভবানীদা বা তার কাছের লোকেরা পার্টিভাগের পর প্রকাশ করে দিতেন।

পশ্চিমবঙ্গের পার্টি নেতৃত্ব যে অধঃপতনমুখী, তা নিয়ে জলিদা এক চাঞ্চল্যকর কথা জানিয়েছিলেন। ‘রাজ্যের পার্টি নেতারা ১৯৫৭ সালে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা আসনটি বীরেন রায়কে বেচে দিয়েছিল।’ তখন নেতৃত্বে ছিলেন জ্যোতি বসু, প্রমোদবাবুরা। রণেনদা  আমাকে বলেছিলেন, ‘আমিও পার্টির নির্দেশে বীরেন রায়ের পক্ষে প্রচার করেছিলাম।’ নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করার দায়ে ভোটে জিতলেও সভ্যপদ নাকচ হয়। সেই উপ-নির্বাচনে ১৯৬০ সালে সিপিআই প্রার্থী হিসেবে জেতেন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।

জলিদার মতো দীর্ঘ ও মহাজীবনের যথার্থ স্মৃতিচারণ, বিশেষত এই ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তে, আমার পক্ষে করা অসম্ভব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালর থেকে ইংরাজি সাহিত্যে বিএ অনার্সে  প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে যাঁর ইংল্যান্ডে গিয়ে আইসিএস পরীক্ষায় বসার কথা, সেই সদ্য যুবা মত পরিবর্তন করে ঠিক করলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। লিখে ফেললেন ‘মজদুর, মজদুর, মজদুর হ্যায় হাম’ গীতিকবিতা, যাতে সুর সংযোজিত করলেন নিখিল সেন। তার পর থেকে শ্রমজীবী স্বার্থরক্ষায় অবিচল রইলেন বিশ বছর। তার পরে কিছুদিন সাংবাদিকতা, জনসংযোগ পেশায় দেড় দশক লিপ্ত থাকা, আবার সাংবাদিকতা (‘ক্যাপিটাল’ সাপ্তাহিক সম্পাদনা)। আশিতে পৌঁছে গান্ধি লেবার ফাউন্ডেশনে শ্রমজীবীদের শিক্ষাদান অর্থাৎ শ্রমজীবীদের মধ্যে ফিরে আসা। তাঁর জীবনে এভাবেই প্রস্ফূটিত হয়েছিল মার্ক্সের প্রিয় বাক্য (যা তিনি শিখেছিলেন প্রাক-খৃস্ট লাতিন নাট্যকার টেরেন্স থেকে)—

I am human and nothing human is alien to me.