শতাব্দী দাশ
লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, পেশায় শিক্ষক
At the end of the day, it isn’t about how many women are on the bench, but about what perspectives and ideologies they bring to their decision-making processes.
ভারতীয় বিচারব্যবস্থার পিতৃতান্ত্রিক ঝোঁক সম্পর্কে বছরখানেক আগে এমনটাই বলেছিলেন বৃন্দা গ্রোভার, প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও আইনজীবী। তিনি এ কথা বলেছিলেন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক দুদিনের ওয়ার্কশপ চলাকালীন। ‘রাইটিং টুগেদার’ (Righting Together) নামক সেই ওয়ার্কশপটির আয়োজন করেছিল ‘ইন্ডিয়ান ফেমিনিস্ট জাজমেন্ট রাইটিং প্রজেক্ট’, যেখানে আলোচিত হচ্ছিল আদালতের পিতৃতান্ত্রিক হেজেমনি। বৃন্দা বলছিলেন, এমনকী মহিলা বিচারকরাও নারীবিদ্বেষী বা পিতৃতান্ত্রিক রায় দিতে পারেন, কারণ তাঁরা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ বহন করছেন। বুঝিয়েছিলেন, কীভাবে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় বৈবাহিক সম্পর্ক, যৌন অপরাধ বা ব্যক্তিগত মালিকানা সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনে (ও বিভিন্ন রায়ে) পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বর্তমান। গত মাসে এমনই দুটি রায় বেরিয়েছে দুটি রাজ্যের উচ্চ আদালত থেকে। তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে কিছু তোলপাড়ও হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে রায়দুটিকে বিচার না করে, রায়দানের ভাষা ও সমাজমানসে তার অভিঘাত পর্যালোচনা করাই বর্তমান লেখার লক্ষ্য।
*****
গত ২৩শে জুন তারিখে কর্নাটক হাইকোর্ট এক কেসে আগাম জামিনের সপক্ষে একটি রায় দেয়। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, প্রতারণার অভিযোগ। এক্ষেত্রে আবার বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। জামিনের জন্য অবশ্য ধার্য হয় এক লাখি বন্ড ও ছ দফা শর্ত। রায় দেওয়ার সময় বিচারক কৃষ্ণা এস দীক্ষিত এমন কিছু মন্তব্য করেন, যা উকিল ও আদালত মহলেও নিন্দিত হয়। রায়ের শেষ চার লাইন পরে তুলেও নেওয়া হয়। কী এমন ছিল সেই রায়ে? সেখানে বলা হয়েছিল:
“Nothing is mentioned by the complainant as to why she went to her office at night i.e. 11.00 pm; she has also not objected to consuming drinks with the petitioner and allowing him to stay with her till morning; the explanation offered by the complainant that after the perpetration of the act she was tired and fell asleep, is unbecoming of an Indian woman; that is not the way our women react when they are ravished,”
অর্থাৎ, বিচারক সন্দিহান হয়েছেন অপরাধ সম্পর্কে, প্রশ্ন তুলেছেন:
- মহিলা অপরধের দিনে রাত এগারোটায় কেন অফিসে গেছিলেন?
- কেন পুরুষটির সঙ্গে মদ খেয়েছিলেন?
- কেনই বা তার সঙ্গে গাড়িতে উঠেছিলেন?
- কেন চিৎকার-চেঁচামিচি করেননি?
- অভিযুক্তকে অভিযোগকারিণী দুবছর ধরে চেনেন৷ কেন তাঁর কোনও অসঙ্গত ব্যবহারের কথা আগে তিনি জানাননি?
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেন তিনি যৌনকর্ম/যৌন-অপরাধটির পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? ‘এটা ভারতীয় নারীর কাছে অভিপ্রেত নয়।’
‘র্যাভিশড’ শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। বিচারক ধরেই নিয়েছেন যে একজন ধর্ষিত ‘ভারতীয় নারী’ নিজেকে ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত’ বলেই মনে করবে। তাই তার পক্ষে নেশাদ্রব্যের জেরে বা ধর্ষণ-পরবর্তী ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়া অসম্ভব।
অর্থাৎ এক অদৃশ্য ‘হাউ টু প্রুভ ইওরসেল্ফ আ পার্ফেক্ট রেপড উওম্যান’ ম্যানুয়ালের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে অভিযোগকারিণীকে। ধর্ষণের আগে, এবং বেঁচে থাকলে ধর্ষণের পরে, ধর্ষিতার কী কী করণীয়, তা নিয়ে এই অদৃশ্য ম্যানুয়াল। ভারতীয় নারী রেপের আগে মদ্যপান করতে পারে না। সিনেমা দেখতে পারে না। রাত করে ফিরতে পারে না। কাউকে নিজের গাড়িতে বা বাড়িতে প্রবেশাধিকার দিতে পারে না৷ এইসব আগেও আদালতে চর্চিত হয়েছে। নতুনভাবে জানা গেল, সে ধর্ষণের পর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেও পারে না। যদিও ধর্ষণের তাৎক্ষণিক ফলের মধ্যে অসাড়তা, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি, নড়াচড়ায় অনিচ্ছে ইত্যদি ঘটতে পারে বলেই জানা যায়।
সেই অদৃশ্য ম্যানুয়াল অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ‘অভিপ্রেত’ বোধহয় ভারতীয় ধর্ষিতার মৃত্যু। দিল্লি হোক বা হায়দ্রাবাদ, ধর্ষিতার মৃত্যু ঘটলেই ধর্ষণের ঘটনাকে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, অন্যথায় নয়।
অভিযোগকারিণীর উকিল বলেন, এরকম অপরাধ প্রকৃতিগতভাবে গুরুতর, তাই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই, ‘আগাম জামিন’ দেওয়া খারাপ নজির সৃষ্টি করতে পারে। বিচারক বলেন, অভিযোগের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর কোনও সন্দেহই নেই, কিন্তু তাতে বেইল আটকানোর কথা নয়। অথচ এদেশে প্রসূতি সফুরা জারগার বা অন্য সমাজকর্মীদের এত সহজে জামিন হয় না, গ্রেপ্তারের পরেও। আগাম জামিন তো দূরস্থান।
বিচারক আরও বলেন, অভিযোগকারিণীর বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। “The version of the complainant that she was subjected to rape on the false promise of marriage in the given circumstances of the case is bit difficult to believe at this stage”.
এখন এই বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিকভাবে বিতর্ক আছে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে একটি রায়ে বলেছিল, কোনও সময়ে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যৌন মিলন হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীকালে সম্পর্ক ভেঙে গেছে, এমন ক্ষেত্রে তা ধর্ষণ কিনা তা বিচারসাপেক্ষ। অর্থাৎ বলা হয়েছিল, কেস থেকে কেসান্তরে ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, তা নিয়ে আদালতের রায় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, জামিনের শুনানিতেই কি বলে দেওয়া যায় কোনও ঘটনা ‘ধর্ষণ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য’ কিনা? সে কথা ঘোষণা করা যায় কি প্রকাশ্যে?
‘মিটু’ আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, তখন তার মূলে ছিল ‘ডিউ প্রসেস’ নিয়ে অসন্তুষ্টি৷ কারণ যুগ যুগ ধরে এমন ধরনেরই প্রশ্ন করা হয়েছে অভিযোগকারিণীকে যার মাধ্যমে তার ধর্ষণের জন্য প্রকারান্তরে তাকেই দায়ী করা হয়েছে। কর্নাটক হাইকোর্টের মতোই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এরকমই রায় এসেছে। ধর্ষিতার জামার ঝুল, তার চরিত্র, তার পানাসক্তি, তার বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদির ভিত্তিতে আদালত স্থির করেছে, ঘটনাটিকে ‘রিয়াল রেপ’ বলা হবে কিনা৷
ভারতে প্রতি পনেরো মিনিটে একটি ধর্ষণ নথিভুক্ত হয় এবং এর মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হয়। তার চেয়েও বড় কথা, ৯৯.১ শতাংশ যৌন অপরাধ নথিভুক্ত হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি ‘অ্যাকোয়েন্টেনস রেপ’। অর্থাৎ পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষণ। এই ‘অ্যাকোয়েন্টেন্স রেপ’ অধুনা পৃথিবীতে এক অতি পরিচিত শব্দবন্ধ। ধর্ষক হতে পারেন আত্মীয়, বন্ধু, এমনকি বর বা প্রেমিকও। যৌনতায় অভিযোগকারিণীর সম্মতি ছিল কি না, তা-ই নির্ধারণ করবে যৌনকর্মটি ধর্ষণ কিনা। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (National Family Health Survey, NFHS) বলছে, একজন সাধারণ ভারতীয় নারীর নিজের পরিচিত পুরুষের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা অপরিচিত পুরুষের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে সতেরো গুণ বেশি৷ অথচ বৈবাহিক ধর্ষণ আজও এদেশের আইন স্বীকার করে না৷
উপরন্তু অভিযুক্তকে একটা সামান্য জামিন মঞ্জুর করতে গিয়ে বিচারক অভিযোগকারিনীর প্রতি অবিশ্বাস ও অসম্মানের ভাষা ব্যবহার করে ফেলেন। এ হল সেরকম রায়, যে ধরনের রায়ের ভাষা শুনে দেশের অসংখ্য ধর্ষিতার ‘ট্রিগার’ হয়। যে ধরনের রায় পড়ে তাঁরা ভাবেন, ‘ঠিক এজন্যই আমি আইনের দ্বারস্থ হইনি।’ টুইটারে এই ঘটনার পরে এমন বিবৃতি কিন্তু সত্যি দেখা গেছে। কেউ একজন লিখেছেন ‘আমি ভারতীয় নারী। আমি বন্ধুর দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলাম ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে। ভারতীয় নারী হওয়া সত্ত্বেও ফিরে আসিনি, ছুটি কাটিয়েছিলাম আপাত ভালোভাবে। কিন্তু ঠিক এই কারণেই আমি আদালতের দ্বারস্থ হইনি।’
মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, হার্ভে উইন্সটেইনের কেসের সময়ে ‘আটলান্টিক’ কাগজে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখা হয়েছিল: ‘Police tend to pursue only cases involving a “righteous victim”—for example, a woman raped by a stranger with a gun, in an alley, who fought back, who had a clean record, and who had no alcohol in her system. That is a “real rape,” worthy of investigation. But 80 percent of the time, the victim knows her assailant. Prosecutors avoid those cases, even if they believe the woman, anticipating that a jury will not.’
অর্থাৎ যে নারীকে বন্দুকের নলে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে, যে বাধা দান করতে পেরেছে, যার চরিত্র লোকমতে ‘ভালো’, যে মদ খায়নি, সেই নারীর ধর্ষণ নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামায়। অন্যথায়, তারা খুব একটা পাত্তা দেয় না কেসটিকে। আবার কখনও পুলিসের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হলেও জুরির কাছে হয় না। অথচ ৮০ শতাংশ মহিলা ধর্ষিত হন পরিচিতরই দ্বারা।
সমগ্র পৃথিবী জুড়েই আইনব্যবস্থা আজও ‘রাইটিয়াস ভিক্টিম’ (অর্থাৎ ‘ন্যায়পরায়ণ ভুক্তভোগী’) আর ‘রিয়াল রেপ’ (‘প্রকৃত ধর্ষণ’)-এর সংজ্ঞাকে সঙ্কুচিত করে রেখেছে পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্য মেনেই।
ধর্ষণ-সংস্কৃতির অবাধ রাজ্য ভারতবর্ষে ধর্ষিতাদের প্রতি পুলিশ-প্রশাসনের মনোভাব যে আরওই খারাপ, তা বলাই বাহুল্য। তাত্ত্বিকভাবে ধর্ষণ সংস্কৃতি হল সেই সংস্কৃতি যেখানে ধর্ষণ নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি জলভাত, অথচ বাস্তব ধর্ষণের ঘটনাকে প্রায়শই অবিশ্বাস করা হয়।
সমাজমাধ্যমে প্রবল সমালোচনার পর ও কিছু আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস বোবডেকে চিঠি লেখার পর অবশ্য বিচারপতি দীক্ষিত তাঁর রায়ের শেষ চারটি লাইন বাদ দিয়েছেন। বলেছেন, জামিনের রায় ও জামিনের শুনানি চলাকালীন তাঁর ভাষা ভবিষ্যতে কোনওভাবে প্রভাবিত করবে না ধর্ষণের মামলাটিকে। এটুকুই আশার কথা, কিন্তু সেটুকু প্রাপ্তিও এসেছে অনেক প্রতিবাদের পর।
*****
আলোচ্য দ্বিতীয় রায়টি গৌহাটি হাইকোর্টের।
গৌহাটি হাইকোর্টে জাস্টিস অজয় লাম্বা (যিনি সেই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও বটে) ও জাস্টিস সৌমিত্র শইকিয়ার ডিভিশন বেঞ্চ যে ডিভোর্সের রায় দেন ১৯শে জুন তারিখে, তাকে অনেক সংবাদপত্রই খানিক ভুল পাঠ করেছে। সেই রায়ে সমস্যা ছিল। কিন্তু সমস্যাকে ঠিকমতো অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়ত হয়নি।
তিনসুকিয়া জেলার ডিগবয়ের ভাস্কর দাসের সঙ্গে রেণু দাসের বিয়ে হয় ২০১২ সালে, হিন্দু নিয়ম মেনে। বিয়ের পর থেকেই তিনি স্বামীকে নিয়ে আলাদা সংসারের দাবি জানাতে থাকেন। বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায়, রেণু বাপের বাড়ি চলে যান। স্বামী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ৪৯৮(এ) ধারায় মামলা করেন। রেণুর দাবি অনুযায়ী, ভাস্কর বলেন, সেই মামলা তুলে নিলে তিনি বাড়িভাড়া করে রেণুকে নিয়ে আলাদা থাকবেন। কিন্তু যখন কেস তুলে নেওয়া হয়, তখন ভাস্কর চুক্তিও ভুলে যান, রেণুকেও আর ফেরত নেন না। রেণু মোট তিনবার গৃহহিংসার মামলা করেছেন, জানা যায়।
এখানে বলে রাখি, গৃহহিংসা কর্মী হিসেবে দেখেছি, এই ৪৯৮এ কেস ফাইল করে আবার তুলে নেওয়ার নজির মোটেও দুর্লভ নয়। এমনকি উকিল বা পুলিশও এরকমই পরামর্শ দেয়। যুক্তি হল, এই মামলা চলতে থাকলে তো আর সংসার করা যায় না! সংসারকেই সার মানেন আমাদের ভারতবর্ষের অধিকাংশ বিবাহিতা। তাঁরা কেস তুলে নেন, কিন্তু কেস তুলে নেওয়ার পরে অপরাধ আবার শুরু হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে অবশ্য দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে ভাস্কর উলটে ডিভোর্স চান। রেণু কনটেস্ট করেন। বলেন, হয় বরকে বাড়ি ছেড়ে এসে তাঁর সঙ্গে থাকতে হবে, নয় উপযুক্ত খোরপোষ সহ তিনি ডিভোর্স দিন। এই খোরপোষের বিষয়েও কিছু অমূলক ধারণা সমাজে আছে। খোরপোষ কোনও দাক্ষিণ্য নয়। তা অধিকার। বৈবাহিক জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর যা যৌথ সম্পত্তি, তাকে ডিভোর্সের সময় ন্যায়সঙ্গতভাবেই সমান দুই ভাগে ভাগ করে দেয় পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ। স্ত্রীর যদি কোনও আয় নাও থাকে, তাহলেও ধরে নেওয়া হয়, বিয়ে ও সংসারের জন্য তিনি যে সময় ও শক্তি ব্যয় করছেন, তার ফলে বরের সম্পত্তিতেও তাঁর অর্ধেক অধিকার জন্মেছে। আমাদের দেশের আইনব্যবস্থা অবশ্য এই নীতি কোনওকালেই মেনে চলে না৷ এমন কী ‘চাইল্ড কেয়ার’-এর টাকা বের করতেও মেয়েদের দম বেরিয়ে যায়। তদুপরি, ‘যাকে বিচ্ছেদ দেওয়া হচ্ছে তার কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়া’ নৈতিকভাবে বেশ নিন্দনীয় বলেই ধরে নেন মানুষ।
যাইহোক, ডিব্রুগড়ের পারিবারিক কোর্ট ডিভোর্সের আবেদন একাধিকবার খারিজ করে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভাস্কর খোরপোষ দিতে নারাজ ছিলেন। অথচ ডিসট্রিক্ট কোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘The respondent has no source of income and she is dependent on her brother. On the other hand the petitioner is serving at Oil, Digboi with a monthly income of Rs. 50,000/- and additional income and other benefits including land.’ অর্থাৎ ব্যক্তি স্ত্রীর থেকে ডিভোর্স চান, অথচ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও খোরপোষ দিতে রাজি নন।
ভাস্কর এবার হাইকোর্টে মামলা করেন। গত ১৯শে জুন গৌহাটি হাইকোর্ট ডিভোর্সের রায় দেন। রেণুর অ্যালিমনির ব্যবস্থাও করেন। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। বেঞ্চের যুক্তি অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে একসঙ্গে না-থাকা দম্পতির মধ্যে দাম্পত্যের কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এই পরিস্থিতিতে জোর করে বিয়ে টিকিয়ে রেখে কোনও পক্ষেরই বিশেষ লাভ নেই। এ একরকম যুক্তিযুক্ত কথাই।
কিন্তু গোল বাধাল রায়ের কিছু অংশের ভাষা। যেখানে শাঁখা সিঁদুর নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়েছে আর যেখানে রেণুর ‘নিষ্ঠুরতা’-র উল্লেখ আছে। দেখা যাক, ডিভিশন বেঞ্চ ঠিক কী বলেছিল।
‘Under the custom of Hindu Marriage, a lady who has entered into marriage according to Hindu rituals and customs, and which has not been denied by the respondent in her evidence, her refusal to wear ‘sakha and sindoor’ will project her to be unmarried and/or signify her refusal to accept the marriage with the appellant.’
এই রায়ের পরেই শোরগোল পড়ে যায়, গৌহাটি হাইকোর্টের রায় অনুসারে এয়োতি হিন্দু নারী মানেই এবার থেকে শাঁখা-সিঁদুর।
বাস্তবে বিষয়টি আরেকটু জটিল। প্রথমত, এয়োতি-চিহ্ন হিসেবে ভারতীয় হিন্দু সমাজই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন চিহ্ন ধারণ করার বিধান দেয়। যেমন পূর্ব ভারতের বাইরে শাঁখার তেমন চল নেই। এমনকি উজানি অসম অঞ্চলেও শাঁখা পরা হয় না। তাই শাঁখা-সিঁদুর হিন্দু সধবাকে পরতেই হবে, এমন কোনও রায় দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, রায়টিকে বিচার করতে হয় ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট’ নামক আইনের বাস্তবতার ভিত্তিতে। ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’-এর বাইরেও এদেশে যে হিন্দু বা মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্ট আলাদা আলাদাভাবে আছে, তা অবিদিত নয়। ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ‘হিন্দু কাস্টমস’ মেনে বিয়ে করলে সেই বিয়ে মান্য। বিয়ের পরে সেই বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়া যায় হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টেই, তাতে অফিশিয়াল কাজকর্মে সুবিধে হয়। এই বিয়েতে বিবাহচিহ্নগুলির তথা সপ্তপদীর গুরুত্ব স্বীকৃত, এটা নতুন কিছু নয়। এখানে বলা আছে:
‘(1) A Hindu marriage may be solemnized in accordance with the customary rites and ceremonies of either party thereto. (2) Where such rites and ceremonies include the saptapadi (that is, the taking of seven steps by the bridegroom and the bride jointly before the sacred fire), the marriage becomes complete and binding when the seventh step is taken.’
এই ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে’ সিঁদুরদানের গুরুত্ব থাকলেও আজীবন সিঁদুর-টিদুর পরেই থাকতে হবে, এমন কিছু লেখা নেই। পরবর্তীতে বিচারপতি শইকিয়ার কাছে এই রায়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হলে, তিনি কোনও ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিঁদুর-শাঁখা ধারণ ও বিবাহে থাকার ইচ্ছের যে সমানুপাতিক সম্পর্ক বিচারকগণ দেখিয়েছেন, তা বড়জোর একটি কেস-নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ (অবজার্ভেশন) মাত্র। তা কোনও নির্দেশ (ডাইরেকশন) নয়। অর্থাৎ হাইকোর্ট এমনটা বলতে চায়নি যে, এরপর থেকে সব হিন্দু বিবাহিতাকে, বা ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে’ বিবাহিতাকে, শাঁখা-সিঁদুর পরতেই হবে।
তৃতীয়ত, তাহলে এই নির্দিষ্ট কেসের ক্ষেত্রেই বা শাঁখা-সিঁদুর না পরাকে একটি নির্দিষ্ট বিবাহে এক মহিলার অরুচি হিসেবে ডিভিশন বেঞ্চ দেখেছেন কেন? তার উত্তরে বলা যেতে পারে, মহিলা নিজে এর আগে বলেছিলেন, বা বলে ফেলেছিলেন যে, তিনি আর শাঁখা সিঁদুর পরেন না, কারণ তিনি ভাস্করকে স্বামী হিসেবে মানেন না। অর্থাৎ, তিনি নিজেই শাঁখা-সিঁদুর ধারণ করাকে বিবাহিত জীবনের অংশ বলে ভাবেন। বিবাহিত হয়েও বিবাহচিহ্ন ধারণ না করার আন্দোলনে তিনি কখনও ছিলেন না। যখন তিনি নিজেকে স্বামীপরিত্যক্তা মনে করেছেন, তখনই তিনি রাগে-অভিমানে বিবাহচিহ্ন খুলেছেন।
তবু কেন রায়ের ভাষা সমস্যাজনক? কারণ এই সিঁদুর নামক চিহ্নটিকে আদালত, দেখা যাচ্ছে, ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে বিপরীতধর্মী রায় দিতে। হিন্দু বিবাহ মতে সিঁদুরহীনতা যদি বিবাহের সম্পর্কে থাকার অনিচ্ছের প্রকৃষ্ট প্রমাণই হয়, তবে সিঁদুর পরলেই নিশ্চয় বিবাহিতা বোঝায়? অথচ সিঁদুর পরিয়ে মন্দিরে বিয়ে করা হয়েছে যাঁদের, তেমন স্ত্রী যদি আদালতে পরবর্তীকালে যান স্ত্রীর মর্যাদা পেতে, বা বর ছেড়ে যাওয়ার পর খোরপোষ পেতে, তাহলে প্রতিপক্ষের উকিল বলেন, ‘শুধু’ সিঁদুর পরলেই বিয়ে হয় না। অন্যান্য আচারও মানতে হয়। অথচ এক্ষেত্রে যেমন সিঁদুর না পরাটাকেই বিয়ে ভাঙার ইচ্ছের দ্যোতক হিসেবে চটজলদি মেনে নেওয়া হল, তেমন চটজলদি আদালত মানতে চান না সিঁদুর-পরা কিন্তু ‘রেজিস্ট্রি না হওয়া’ বউদের।
তা সত্ত্বেও সমাজে এয়োতি-চিহ্নের হেজেমনি আজও বিদ্যমান। প্রথম মহিলা ঈশান স্কলার শান্তিসুধা ঘোষ ‘শাঁখা-সিঁদুর-ঘোম্টা’ নামের একটি প্রবন্ধে সকৌতুকে লিখেছিলেন, সেই ১৯৩৮ সালে,
স্বীকার করি, এগুলি দেখিতে সুন্দর লাগে… যদি বা তর্কের খাতিরে স্বীকার করিয়া লই, তবে সে সৌন্দর্য্যবৃদ্ধি কুমারীকালে করিলেই বা দোষ কী?…. বধূবেশে এগুলিকে আমরা যে অনির্বচনীয় শ্রী বলিয়া মনে করি, ইহা আমাদের মনের সংস্কার।
‘দেখতে ভালো লাগে তাই পরি’-র এর চেয়ে মোক্ষম জবাব আর হয় না।
নারীবাদী ভাবনায় জেনেছি, শাঁখাপলাসিঁদুরলোহা বা যেকোনও বিবাহচিহ্ন নারীকে তার ‘স্বামী’-র সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে, তাই তা বর্জনীয়। কিন্তু অন্যদের শাঁখা-পলা পরাকে তাদের সামাজিক অবস্থায় উদ্ভূত বাস্তবতা হিসেবেই দেখি। যেমন, ভীষণ সংগ্রাম করে বিবাহবিচ্ছিন একা মা মেয়েকে মানুষ করছেন, অথচ শাঁখাপলা ছাড়তে পারেননি, এমন মহিলাদের চিনি। তিনি নাকি ‘নিরাপদ বোধ করেন’। নাকি ‘কুৎসা কম হয়’। তাঁর সত্যকে তাঁর সমাজবাস্তবতায় নেমে বোঝাই উচিত মনে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এভাবেই আজও ‘বিবাহিতা’-র এই স্ট্যাম্পকে নিজেদের প্রাথমিক সুরক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন মেয়েরা। আর মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে পরিসরে শাঁখা-পলা উঠে গেলেও রয়ে গেছে চুলের আড়ালে এক ফোঁটা লাল আভা বা সোনায় বাঁধানো হাতের লোহা, যা একরকম ভাবের ঘরে চুরি। সেটুকু সচরাচর বাদ দেওয়া হয় না পারিবারিক অশান্তির ভয়ে। সেও আর এক সমাজবাস্তবতা। আছে ভীষণ ফোটোজেনিক একরকম শহুরে সিঁদুর খেলার উৎসব, যেখানে অংশগ্রহণের আগ্রহে এখনও ভাঁটা পড়েনি, যা প্রায় দ্বিতীয় দোল হয়ে উঠেছে। অথচ ‘বাপের-বাড়ি’ থেকে বিদায় দেওয়ার কালে এমনকি দেবীকেও বিবাহচিহ্ন ধারণে বাধ্য করলে হয়ত দশভূজার শৌর্যেরই অবমাননা হয়। সিঁদুরখেলার অতীতও বেশ অসাম্যের। বিধবাদের বা অবিবাহিতাদের এ খেলায় ঠাঁই ছিল না এককালে। এখন অবশ্য, তৃতীয় লিঙ্গ, বিধবা, অবিবাহিত এমনকী পুরুষদেরও সিঁদুর খেলতে দেখা যায়। তাৎপর্যকে চিহ্ন থেকে ছিঁড়ে নিয়ে, যদি চিহ্নটিকে অন্যভাবে ব্যবহার করা যায়, তাতে ক্ষতি নেই। তবে সে কাজ খুব একটা সহজও নয়।
কিন্তু শাঁখা-সিঁদুরের ডামাডোলে রায়ের দ্বিতীয় অংশটি যে বিশেষ পাত্তা পায়নি সমালোচকদের কাছে, তা বেশ দুর্ভাগ্যজনক। এখানে দেখা যাচ্ছে রেণুকেই ‘নিষ্ঠুর’ বলা হচ্ছে এবং সেই ‘নিষ্ঠুরতা’-ও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে এক নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। ‘শ্বশুরবাড়ির প্রতি দুর্ব্যবহার, মিথ্যে মামলা করা, ছেলেকে জোর করে নির্ভরশীল মায়ের থেকে পৃথক রাখা, বৃদ্ধদের যত্ন না-করা’-র অভিযোগ রয়েছে রেণুর প্রতি। এই যে ধরেই নেওয়া হচ্ছে, বাড়ির বধূরই অবশ্যকর্তব্য বাড়ির বৃদ্ধদের পরিচর্যা করা— লিঙ্গভিত্তিক গৃহশ্রমের বিভাজনের এই ধারণা পিতৃতান্ত্রিক নয়? আবার ‘শ্বশুরবাড়ির প্রতি দুর্ব্যবহার’-এর কথা বলা হয়েছে, অথচ শ্বশুরবাড়ির প্রতিই ছিল রেণুর অত্যাচারের অভিযোগ। সেই ৪৯৮(এ) মামলাকে হাইকোর্ট ভুয়ো বলছে। অথচ দেখা যাচ্ছে তুলে নেওয়া মামলাটির সম্পর্কে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট বলেছিল, ‘After careful assessment of the evidence and on the basis of preponderance of probabilities, it is held that the respondent (রেণু) was subjected to cruelty by the petitioner (ভাস্কর). She did not desert her husband.’
আগেই বলেছি, চাপের মুখে এরকম অনেক মামলা তুলে নেওয়া হয়। সেগুলি সবই ভুয়ো নয়। কোন আর্থ-সামাজিক চাপে মেয়েরা এদেশে ৪৯৮(এ) করেও তুলে নেন তা বোধের অগম্য হওয়া উচিত নয়।
অতঃপর বলা হচ্ছে, বরকে আলাদা বাড়িতে থাকতে বলাটা ‘নিষ্ঠুরতা’। আমাদের দেশে বৃদ্ধ বাবা-মা-শ্বশুর-শাশুড়ির বঞ্চনা হয়। কিন্তু পারিবারিকভাবে বধূ-নির্যাতন হয় আরও বেশি। বধূনির্যাতনে শ্বশুরবাড়ির ভূমিকা থাকা কিছুমাত্র নতুন নয়, ব্যতিক্রমী নয়। সেই অবস্থায়, শুধুমাত্র আলাদা থাকতে চাওয়া কি ‘নিষ্ঠুরতা’? অথচ মেয়েরা বিবাহের পর নিজের পরিবার থেকে আলাদা থাকবে, এটি প্রচলিত নিয়ম মাত্র, ‘নিষ্ঠুরতা’ নয়। উচ্চ আদালত যে ভাষায় ‘নিষ্ঠুরতা’-র বর্ণনা দিলেন, তা সমস্যাজনকই বটে।
*****
প্রশ্ন হল, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ভারতের দুটি উচ্চ আদালতের দুটি ভিন্ন রায় পিতৃতান্ত্রিক ভাষার দোষে দুষ্ট হলে, তা কি কাকতালীয়? লক্ষ্যনীয় , দুটি রায়ই পরোক্ষভাবে, অর্থাৎ ‘ডাইরেকশন’ হিসেবে না হলেও ‘অবজার্ভেশন’ হিসেবে, যথাক্রমে ‘ভারতীয়’ ও ‘হিন্দু’ নারীর কাঙ্ক্ষিত স্বভাব বা আচার-ব্যবহার নিয়ে কিছু বক্তব্য রেখেছে। এইরকম বক্তব্য রোয়াকের বা চায়ের দোকানের পুরুষসর্বস্ব জমায়েতে প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু তা আদালতের কাছে অভিপ্রেত ছিল না। লক্ষ করলে আরও দেখা যাবে, দুটি রায়ের ভাষাই একরকমভাবে নারীর নিজস্ব ‘এজেন্সি’-কে অস্বীকার করেছে। একটিতে বলা হয়েছে, ধর্ষিতার শরীর ধর্ষিত হয়েছে, এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ যিনি নিজের ইচ্ছায় মদ খান, রাতে অফিসে যান ও ধর্ষণের পর ঘুমিয়ে পড়েন (পরে বিচারক বাধ্য হন শেষ চার লাইন মুছে দিতে), তাঁর কি আবার ধর্ষণ হয়? অন্যটিতে বলা হয়েছে, বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে আলাদা থাকার এজেন্সি নারীর নেই। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হলেও নেই। এমনকি এমন ইচ্ছা পোষণ করাও ‘নিষ্ঠুরতা’।
বলা বাহুল্য, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা সমাজমানসেরই পরিচায়ক। তাই সেখানে নারীবিদ্বেষী যুক্তিজাল বোনা থাকে, নারীবিদ্বেষী রূপক থাকে ঘাপটি মেরে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশের আদালতের ভাষার কি সাবধানী হওয়ার দায় নেই?