Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আয়াসোফিয়া— ধর্ম নয়, ইতিহাস

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


লেখক প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

 

ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে – অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, (রচনাকাল: বৈশাখ, ১৩৩৩)

কামাল আতাতুর্ক, জওহরলাল নেহরু। ১৯৩৪, ১৯৪৭। যদিও ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে বসানো হয়েছে অনেক পরে— ১৯৭৬-এর ৪২তম সংশোধনীটির মাধ্যমে— তবুও, নেহরু এবং আতাতুর্ক, নতুন একেকটি স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াতে প্রথমেই ধর্ম বিষয়টিকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে যতটা সম্ভব আলাদা করে রাখতে চেয়েছিলেন। পপ্যুলিস্ট মনোবৃত্তি অথবা রাজনীতির কারণে তাঁরা সে বিষয়ে কতটা সক্ষম হয়েছিলেন তার তুল্যমূল্য বিচার ইতিহাস করুক। কিন্তু এটুকু বলাই যায় যে অন্তত মুখে তাঁদের একটা প্রচেষ্টা, একটা দর্শনের কথা উঠে এসেছিল। এবারে, কোনও একটি রাষ্ট্রের নাগরিক বা সে দেশের পরবর্তী প্রশাসকদের ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে সেই দায়িত্ব থেকে যায় যে, জাতির প্রথম সূচনাতে যে আদর্শগুলিকে জাতির প্রথম নেতৃত্বেরা বিশ্বাস করেছিলেন, সেগুলিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে সেগুলিকে বুনে ফেলা। সেগুলির প্রচার করা। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও বারেবারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই পপ্যুলিজম, ভোটব্যাঙ্ক পলিটিক্স এবং ক্ষমতার লোভ, শঠতার মনোবৃত্তি। রাষ্ট্রপিতারা যে ভুল করেন না তা নয়, কিন্তু, তাঁদের সঠিক আদর্শগুলিকেও পপ্যুলিজমের নামে একেবারে বিস্মৃত হওয়াটাই যেন আজকের দিনে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধ্বংস হচ্ছে একের পর এক প্রতিষ্ঠান।

সম্প্রতি তুর্কির সর্বোচ্চ আদালত দীর্ঘদিনের একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে, সেদেশের আয়াসোফিয়া সংগ্রহশালাটিকে (যেটি আবার ইউনেস্কোর একটি অন্যতম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং বিপুল সংখ্যক পর্যটকের কাছে সবসময়ের আকর্ষণ) মসজিদে রূপান্তরিত করবার পক্ষে তাঁদের রায় জানিয়েছেন। এই রায়ের পরেপরেই সেদেশের রাষ্ট্রপতি একটি সরকারি আদেশনামার মাধ্যমে, সংগ্রহশালাটির সমস্ত দায়িত্বভার সেদেশের ডায়রেক্টরেট অব রিলিজিয়স অ্যাফেয়ার্সের অধীনে হস্তান্তরিত করেছেন। প্রাচীন এই সংগ্রহশালাটির মসজিদে রূপান্তরিত হওয়াটা এখন সময়ের অপেক্ষা কেবল।

প্রথমে এই ‘সংগ্রহশালা’টির ইতিহাসটিকে কিঞ্চিৎ ফিরে দেখি চলুন। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের কনস্ট্যানটিনোপল, যা বর্তমানের ইস্তানবুল— সেই কনস্ট্যানটিনোপলে প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসনকালে ৫৩২ থেকে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি হয় আয়াসোফিয়া গির্জা। এর আগে অন্তত আরও দুটি পুরনো গির্জার স্থাপত্য এখানে থাকলেও বিভিন্ন সময়ে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৫৩৭-এ প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসনকালে এটি বর্তমান রূপে প্রকাশিত হয়। সেই থেকে প্রায় এক হাজার বছর, ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসিয়াতে সেভিল ক্যাথেড্রালটি না তৈরি হওয়া পর্যন্ত, এই আয়াসোফিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম গির্জা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। শুরু থেকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাকালীন গির্জাটি গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ দ্বারা পরিচালিত হত। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে, চতুর্থ ক্রুসেডের কারণে— স্বল্পসময়ের জন্য এটি রোমান ক্যাথলিকদের হাতে চলে যায়। পরে ১২৬১-তে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পুনরার্বিভাবে এটির কর্তৃত্ব আবার গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের হাতে ফিরে আসে। ১৪৫৩-তে অটোমানদের হাতে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সুলতান মামুদের আদেশে আয়াসোফিয়া গির্জাটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। এই কারণে সুলতানের তরফে গির্জাটিকে ঘিরে চারপাশে চারটি মিনার তৈরির আদেশ দেওয়া হয়। যার ফলে আয়াসোফিয়া তার বর্তমান রূপটিকে পরিগ্রহ করে। এরও প্রায় পাঁচশো বছর পর, আধুনিক তুর্কির রূপকার কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪-৩৫-এ বিশেষ আইন বলে এই আয়াসোফিয়া ক্ষেত্রটিকে সংগ্রহশালা হিসেবে ঘোষণা করেন। ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কিকে গড়ে তোলবার বাসনা থেকেই তাঁর এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। আর আজ, সেই সময়ের প্রায় পঁচাশি বছর পার হয়ে গিয়েছে— ইতিহাসকে নতুন করে লেখা হল। সংগ্রহশালা নয়, আয়াসোফিয়াকে আজ ফিরে যেতে হবে তার সেই মসজিদ পরিচয়ে। ধর্ম দূরে থাক, ইতিহাস এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও অভ্যাসকেই মান্যতা দেওয়ার ভদ্রতাটুকুও দেখালেন তুর্কির নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধিরা। যদিও, প্রতিনিধিত্ব যতই থাক, সবদেশেই বোধহয় এখন কুড়িয়ে বাড়িয়ে একজন বা দুজনের সরকার চলে। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম-র প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয়, প্রত্যেকটি প্রাচীন স্থাপত্যের বিচার হওয়া উচিত তার প্রাচীনত্বে, তার রূপশৈলীতে— তার ইতিহাসে। যে কারণে, বাবরি আমার কাছে যত না মসজিদ— তার চেয়ে অনেক বেশি করে একটি মুঘল স্থাপত্য। যার কোনও রেস্টোরেশন অসম্ভব। একশোটা কেন হাজারটা মসজিদ তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু মীর বাঁকির স্থাপত্যটিকে আর কখনওই ফিরিয়ে আনা যাবে না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগ কতখানি হওয়া উচিত সেই নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক চলেছে। ‘ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিং’ শীর্ষক বিখ্যাত উদ্ধৃতিটিকে মনে পড়ছে। তাই তার বিশদ ব্যাখ্যাতে না গিয়েও গত কয়েক বছরে যে বিশ্বাস এবং ধর্মের নামে সারা পৃথিবী জুড়ে পপ্যুলিস্ট রাজনীতিকে সম্পূর্ণ একটি আলাদা স্তরে, একটি আলাদা মাত্রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই বিষয়টিতে বোধ করি সকলেই একমত হবেন। আজ যদি, স্পেনের বিখ্যাত কর্ডোবা গির্জাটিকে ভেঙে ফেলে আবার তার মসজিদ রূপটিকে বা মসজিদ পরিচয়টিকে ফিরিয়ে আনতে গণ্ডগোল শুরু হয়, সেটা কি আমাদের তরফে খুব আধুনিকতার পরিচায়ক হবে? নাকি পরিপক্কতার লক্ষণ বলে মনে হবে? এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আয়াসোফিয়াকে তো ভেঙে ফেলা হবে এমনটা বলা হয়নি। কেবল খাতায় কলমে সংগ্রহশালার পরিবর্তে তাকে মসজিদ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বলব হে পাঠক, এই কাজের পিছনকার উদ্দেশ্যটিকে, পিছনকার রাজনীতিটিকে অনুধাবন করতে আজ্ঞা হোক। দেওয়াল লিখন কি যথেষ্টই সুস্পষ্ট নয় আজ?

২০০২ সাল থেকে, বর্তমান টার্কিশ প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোগান, ক্ষমতায় বসে ইস্তক কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামোটিকে অল্পেতে অল্পেতে ধ্বংস করতেই সচেষ্ট থেকেছেন। জনমানসের ধর্মীয় উত্তেজনা, ধর্মীয় আবেগটিকে অস্ত্র করে, সেটিকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে উদগ্রীব হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে পরে, গ্যারি কাসপারভের মন্তব্যটিকে মনে করাতে চাইব। গ্যারি বলেছিলেন, “সংখ্যাগুরুকে যদি বিশ্বাস করাতে পারো যে, তারা সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে বিপদগ্রস্ত— এবং একমাত্র তুমিই তাদেরকে সেই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে, ভোটে জেতার কাজটা তোমার পক্ষে অনেকটা সহজ হয়ে যায়…।” কী আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ— ২০১৪-তে নয়া ভারত, ২০১৭-তে মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন, ২০২০-তে আয়াসোফিয়া। এমন একটা সময়, যখন তুর্কির অর্থনীতি তলানিতে। কোভিড-বিপর্যয় চরমে। আইন হচ্ছে কিসের— না সংগ্রহশালা থেকে মসজিদে রূপান্তরের। কোনও এক দেশে বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। প্রধান বিচার্য বিষয় কী? ৩৭০ বিলোপ, জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জীকরণ প্রকল্প, অয্যোধ্যা বিতর্ক, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ইত্যাদি! মানুষকে ব্যস্ত রাখো, বিতর্কে রাখো! পরিযায়ী শ্রমিকেরা হাঁটছে— ধর্মাবতার, পুরীতে রথযাত্রার কী হবে, মানুষের ভাবাবেগ যে টলমল করছে। মানুষ বড় কাঁদছে, ভগবানের আশায়!

যেমনটা সৈয়দ মুজতবা আলীকে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঠিক উদ্ধৃতিটিকে মনে পড়ছে না— কেবল স্মৃতি থেকে যেটুকু পাচ্ছি তার সারবত্তা দাঁড়ায়, “অবতার আসবেন, হাতে কাঁচি নিয়ে— টিকি দাড়ি ছাঁটতে ছাঁটতেই নতুন যুগের সূচনা ঘটাবেন।” যতদিন না এই টিকি-দাড়ি-সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি; যতদিন না পর্যন্ত প্রশাসন এবং ধর্মকে আলাদা করে না দেখতে পারছি; যতদিন না অবধি ধর্মকে, মানুষের অন্তরের স্পর্শকাতর একেকটি বিশ্বাসকে নির্লজ্জ ভাবে ভোটবাক্সে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পারছি— ততদিন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কেবল ওই আফিংখোর কমলাকান্তের খোয়াব হয়েই থেকে যাবে। আমরা পড়ব কেবল, বাস্তবে তার কোনও কিছুকেই উপলব্ধি করব না।

আজ, বামিয়ান ভেঙে গেছে, বাবরিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, আয়াসোফিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও অন্ধকার ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই না। সে হয়তো অমূলক, এখনও। কিন্তু, আইসিস জঙ্গিদের হাতে পালমাইরার স্থাপত্যগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে পরে যতখানি জোরে পৃথিবী জুড়ে চিৎকার শোনা যায়— সব দেশের সব স্থাপত্যের ক্ষেত্রেই কি তেমনটা হয়? ইতিহাসকে ইতিহাসের চোখে দেখুন, স্থাপত্যকে স্থাপত্যের, আর মানুষকে দেখুন ধর্মের নয় মানবতার চোখ দিয়ে। তাহলেই দেখবেন পৃথিবীটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। আয়াসোফিয়া কোনও ধর্মের নয়, শিল্পের, স্থাপত্যের, ইতিহাসের— এবং সর্বোপরি সকল মানুষের উৎকর্ষের প্রতীক।