Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশোধস্পৃহাই ভারভারা রাও-কে কারারুদ্ধ রাখার কারণ হতে পারে

সন্দীপ পাণ্ড্যে ও সুরভি রাও

 

লেখকদ্বয় সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী, বিশ্লেষক

প্রখ্যাত তেলুগু কবি ও সমাজকর্মী ভারভারা রাও পুলিশ হেফাজতে আছেন ২০১৮ সালের ১৮ই নভেম্ভর থেকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, গদিচ্যুত করতে চেয়েছেন সরকারকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার ছক কষেছেন।

ভারভারা রাও ভারতের অগ্রণী বুদ্ধিজীবী, যিনি তিন প্রজন্ম ধরে সমাজকর্মী, লেখক ও ছাত্রদের অনুপ্রেরণা। তিনি ‘বিপ্লবা রচয়িতালা সংঘম’ (বিপ্লবী লেখক সংঘ)-এর ও ‘ভীরাসাম’ সংস্থা-র প্রতিষ্ঠাতা, যারা কিনা বিগত অর্ধশতক ধরে তেলুগু সাহিত্যের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তাঁর কবিতা রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক নির্যাতনের কথা বলে। সামাজিক ন্যায়ের লড়াই-এর প্রতি তিনি অবিচলভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতের সব কটি প্রধান ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত।

পোয়েট্রি ইন্টারন্যাশনাল আর্কাইভে তাঁর সম্পর্কে লেখা আছে, “there is evidence not only of commitment to a cause but commitment to craft. These are poems of anger, of outrage, biting indictment certainly. But there is also a palette of tonal variety. For Rao is also a lyric poet whose work is capable of combining elegy with hope.”

কবি হওয়ার পাশাপাশি, ভারভারা রাও সাহিত্যসমালোচক ও অনুবাদকও বটে। তাঁর গবেষণাপত্র ‘Telangana Liberation Struggle and the Telugu Novel: A Study Into Interconnections Between Society and Literature’ তেলুগু সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে এক উৎকৃষ্ট অধ্যায়। চল্লিশ বছর তিনি সাহিত্য-অধ্যাপনা করেছেন। সে সময়ে তিনি ‘স্রুজান’ নামক জনপ্রিয় পত্রিকাও প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা ১৯৯২ সাল পর্যন্ত, প্রায় পঁচিশ বছর যাবৎ, আধুনিক তেলুগু সাহিত্য চর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

মোদি জমানায় ভারভারা রাও-এর নিপীড়ন স্বাভাবিকই ছিল। স্বৈরাচারী সরকারের রাজনৈতিক বিরোধিতায় সর্বদাই কবি-সাহিত্যিকরা পুরোভাগে থাকেন৷ তাই তাঁদেরই কণ্ঠরোধের চেষ্টা হয় সর্বপ্রথম।

রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও বন্দিত্ব ভারভারা রাও-এর জীবনে এই প্রথমবার ঘটেনি। ১৯৭৩ সালে তাঁর বিপ্লবী কবিতা রাষ্ট্রের বিপজ্জনক লেগেছিল। তিনি বন্দি হয়েছিলেন। সেসময় অন্ধ্র প্রদেশ হাইকোর্ট তাঁকে মুক্তি দেয়। বলে, কবিকে শুধুমাত্র তাঁর কল্পনার বহিঃপ্রকাশের জন্য গ্রেপ্তার করা যায় না। ১৯৭৪ ও ১৯৮৫ সালেও তিনি গ্রেপ্তার হন, কিন্তু নির্দোষ প্রমাণিত হন।

১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময়, সেকেন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত হিসেবে জেল থেকে সদ্য জামিনে মুক্ত ভারভারাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ভীরাসাম-এর আরও ত্রিশ সদস্যকেও গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু নীরব হয়ে যাওয়ার বদলে তাঁরা জেলেও বন্দিদের জন্য হাতে-লেখা সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান।

রাও মোট আট বছর জেলে কাটিয়েছেন এ যাবৎ, কিন্তু গরাদ তাঁর শিল্পীসত্তাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। তিনি বন্দি অবস্থাতেও কবিতা লিখেছেন, তেলুগু ভাষায় অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন। সত্যি বলতে, তাঁর বেশিরভাগ রচনাই জেলে বসে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এলগার পরিষদ র‍্যালিতে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর এই সাম্প্রতিকতম গ্রেপ্তার। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ঘটনার সঙ্গে মাওবাদী যোগ ছিল। ভীমা-কোরেগাঁও-এর দলিত-বিরোধী হিংসার কারণ হিসেবেও এই র‍্যালিকেই দায়ী করা হয়।

ভারভারা রাও-এর বিরুদ্ধে প্রমাণ বলতে আছে কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ থেকে প্রাপ্ত কিছু চিঠি, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীর বাড়ি তল্লাশির সময় যা পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। এই রেইড বা হার্ড-ড্রাইভ থেকে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশ যথাবিহিত নিয়মাবলি মানেনি। ক্যারাভান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি তদন্তমূলক নিবন্ধ বলেছিল, হার্ডড্রাইভগুলিতে স্পাইওয়্যার লাগানো ছিল, যা দিয়ে তাদের কার্যকলাপে নজর রাখা যেত। এমনকি, অজানা ফাইলও হার্ডড্রাইভে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় সেই স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে৷ এরপর থেকে আরও কিছু সমাজকর্মীর উপর এই স্পাইওয়্যার আক্রমণ হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, প্রমাণাদি নির্মিত ও নকল হওয়ারও সম্ভাবনা যথেষ্ট।

এই চিঠিগুলির ভিত্তিতে ভারভারা রাও ছাড়াও আরও দশজনের জেল হয়— সুরেন্দ্র গাডলিঙ, সুধীর ধাওয়ালে, মহেশ রাউত, সুধা ভরদ্বাজ, রোনা উইলসন, সোমা সেন, গৌতম নওলাখা, অরুণ ফেরেরা, ভার্নন গঞ্জালভেজ ও আনন্দ তেলতুম্বড়ে— যাঁরা প্রত্যেকেই স্বনামধন্য সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মী ও প্রত্যেকেই মোদি সরকারের প্রকাশ্য সমালোচক।

সম্প্রতি, প্রাক্তন ইনফরমেশন কমিশনার শৈলেশ গান্ধি ও এম শ্রীধরাচার্যালু মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছেন, ভারভারা রাও-এর বিরুদ্ধে কোনও শক্তিশালী প্রমাণ নেই। তাঁরা বলেছেন, পুনে পুলিশ ও রাজ্য তদন্ত দল ষোলো সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করেও কোনও প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি৷

সদ্য অভিষিক্ত মহারাষ্ট্র সরকার ঘোষণা করেছিল, এই কেসের ফাইল শীঘ্রই বন্ধ করা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তখন তড়িঘড়ি কেসটিকে ন্যাশনাল ইনভেসটিগেশন এজেন্সির আওতায় নিয়ে আসে, যাতে ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোনও সম্ভাবনাই না থাকে।

ভারভারা রাও-এর বয়স আশি। তাঁর স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটেছে সম্প্রতি। এমতাবস্থায়, তাঁর বন্দিদশাকে এই কোভিড পরিস্থিতিতেও দীর্ঘায়িত করা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। তাঁকে শীঘ্র মুক্তি দেওয়া হোক।

এ বড়ই লজ্জার বিষয় যে ভয়ঙ্কর সব অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পায় এই দেশে, তাদের বিরুদ্ধে অনেক কেস ঝুললেও তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ভারভারা রাও-এর মতো বুদ্ধিজীবীরা জেলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকেন। বিদেশনীতি, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, করোনা-পরিস্থতি, পরিযায়ী-শ্রমিক সমস্যা, বিশৃঙ্খল অর্থনীতি— সব বিষয়েই বর্তমান সরকার ব্যর্থ। তার কারণ, ভারতীয় জনতা দল আসলে আরএসএস-এর রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণেই বেশি ব্যস্ত। তারা ব্যস্ত আরএসএস-বিজেপির আদর্শের বিরোধী যেকোনও নাগরিকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে। তা না হলে, যখন জনসমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হয়েছে, মানুষকে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তখন সমাজকর্মীদের জেলেই রেখে দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? করোনাভাইরাস ও লকডাউনে ক্লিষ্ট এই সময়েও, এনআরসি ও সিএএ বিরোধীদের প্রতি সরকারের এই প্রতিহিংসা বুঝিয়ে দেয়, সরকার আসলে কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।