সুকান্ত চক্রবর্তী
লেখক পেশায় চিকিৎসক
সারা পৃথিবীকে এলোমেলো করে দিল যে অতিমারি, তার সম্পর্কে কিছু তথ্য, কিছু ভাবনা পাঠকের কাছে তুলে ধরার অনুরোধে, এই লেখার অবতারণা।
করোনা কী?
এতদিনে আমরা জেনে ফেলেছি, করোনা একধরনের RNA ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা গ্রুপের অন্তর্গত। সাধারণ সর্দিকাশি হয় আলফা গ্রুপের থেকে। আর কোভিড-১৯, সার্স, মার্স ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত গুরুতর রোগ-সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলো বিটা সাবটাইপ। করোনা ভাইরাসের মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে স্পাইক প্রোটিন, যেটি ভাইরাসের ছবিতে আমরা সবাই দেখে নিয়েছি। এই স্পাইক প্রোটিন মানুষের শরীরে ঢুকে কোষের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে।
মানবশরীরে করোনা ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া কী ধরনের হয়?
ভাইরাস শরীরে ঢুকে যুক্ত হয় ACE2 রিসেপটরের সঙ্গে। এই রিসেপটর শরীরের যে অংশে বেশি থাকে, যেমন ফুসফুস, সেটিই প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত হয়। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এই ভাইরাস সরাসরি আমাদের শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে না। ভাইরাসের প্রভাবে আমাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধকারী কোষগুলি (যেমন T লিম্ফোসাইট) সক্রিয় হয়ে ওঠে। একটা ক্ষুদ্র অংশের রোগীর মধ্যে এই ‘ইনফ্ল্যামাটরি রেসপন্স’ দেখা দেয় যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তখনই তৈরি হয় সাইটোকাইন স্টর্ম। জীবাণু মারার জন্য তৈরি রাসায়নিকগুলি (ইন্টারলিউকিল-৬, টি. এন. এফ. আলফা ইত্যাদি) রোগীর নিজের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকেই আক্রমণ করতে শুরু করে।
রোগের লক্ষণ কী?
অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তি সামান্য জ্বর, গলাব্যথা, সর্দিকাশি, পেটে ব্যথা বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হচ্ছে নাকে গন্ধ না পাওয়া এবং জিভে স্বাদ না পাওয়া। অনেকেই অবশ্য কোনও লক্ষণ বুঝতে পারেন না। অল্প সংখ্যক মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। তার মধ্যে অতি সামান্য অংশের জীবনসংশয় হয়। অ্যাকিউট রেসপিটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম (ARDS) হয়, বা মাল্টি সিস্টেম অরগ্যান ফেলিওর (MSOF) হয়। কিন্তু কোন রোগীর ক্ষেত্রে এগুলি হবে তা আগে থেকে বোঝা যায় না। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা (SPO2) ৯০ শতাংশের নিচে নামা হল এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপদসঙ্কেত।
করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা কী?
খুব সংক্ষেপে বলতে হয়, রোগটি নির্ণয় করা হয় PCR (পলিমারেস চেইন রিঅ্যাকশন) পদ্ধতিতে, ভাইরাসের RNA-কে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করে। শরীরে রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা বোঝা যায় IgG পরীক্ষার মাধ্যমে৷ তাছাড়া এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান থেকেও রোগের প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে।
সাধারণ মানুষের কী করণীয়?
সকলেই জানেন, তবে কী করবেন, কী করবেন না— তা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়ায় ক্ষতি নেই কোনও।
- বাড়ির বাইরে বেরোতে হলে নাক মুখ ঢেকে মাস্ক পরবেন। মাস্কের মাঝখানে বা ভেতরে হাত দেবেন না। ২-৪ স্তরের কাপড়ের মাস্ক, অথবা সার্জিকাল, অথবা N95 মাস্ক পরবেন। ভালভ দেওয়া মাস্ক পরবেন না। ৪ দিনে ৪টি মাস্ক পরে পঞ্চম দিনে আবার প্রথম দিনের মাস্কটি পরবেন। ধোওয়ার প্রয়োজন নেই।
- বাইরে থেকে এসে, অফিসে এসে অথবা সকলের হাত লাগে এমন জায়গায় হাত লাগলে (যেমন ইলেকট্রিক সুইচ, দরজার হাতল ইত্যাদি) সাবান জল দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। সেই মুহূর্তে হাত ধোওয়ার উপায় না থাকলে ৭০% অ্যালকোহল-যুক্ত স্যানিটাইজার হাতে লাগান।
- চোখে মুখে হাত দেবেন না। হাঁচি, কাশি এলে কনুইয়ের ভাঁজের মধ্যে মুখ ঢাকুন।
- জ্বর বা কাশি হলে বাড়িতেও মাস্ক পরে আলাদা ঘরে থাকার চেষ্টা করুন। বারেবারে সাবান দিয়ে হাত ধোন। শ্বাসকষ্ট হলে বা খুব দুর্বল বোধ করলে নিকটবর্তী হাসপাতালে যান।
- অন্য ব্যক্তির থেকে ন্যূনতম ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করুন। আশেপাশের সকলকে নাক মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে অনুরোধ করুন। কথা বলার সময় মাস্ক নামাবেন না। সামনের জনকেও নামাতে দেবেন না।
- পাড়ার করোনা-আক্রান্ত পরিবারের প্রয়োজনে সাহায্য করুন।
মিডিয়ার ভূমিকা
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মেনস্ট্রিম সংবাদমাধ্যম আমাদের দেশে করোনা সচেতনতা ছড়ানোর চেয়ে বেশি ছড়িয়েছে আতঙ্ক, ভুয়ো খবর। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে শুধুমাত্র চিত্তাকর্ষক অংশগুলি তুলে এনে পরিবেশন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে দিনের পর দিন৷ তাই, পাঠককে অনুরোধ, শুধুমাত্র সরকারি অথবা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ওয়েবসাইটের তথ্যই শুধুমাত্র বিশ্বাস করবেন।
সরকার কী করল?
যখন আমাদের দেশে কেসের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়, তখন বিদেশ থেকে আগত মানুষকে কোয়ারান্টাইন না করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পাল্লা দিয়ে লকডাউন ঘোষণা করল এবং পর্যায়ক্রমে লকডাউনের দিন বাড়ানো শুরু করল। একদিকে কাঁসরঘণ্টা, মোমবাতি, আরেক দিকে হরেকরকম বিশেষজ্ঞ কমিটির ঢক্কানিনাদে ঢাকা পড়ে গেল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য— লকডাউন শুধু অল্প দিনের জন্য পরিকাঠামো তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা যায়। লকডাউন করে অতিমারিকে হারানো যায় না। অভিবাসী শ্রমিক ও খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে ফেলেছে দুই সরকার।
কী হওয়া উচিত?
- যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সাধারণ করোনা রোগীর জন্য কোয়ারান্টাইন সেন্টার, জেনারেল বেড বাড়ানো। অন্যদিকে, গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর জন্য ICU বেড বাড়ানো।
- সরকারি, বেসরকারি ও গবেষণাসংস্থাগুলির সমস্ত RT. PCR যন্ত্রকে করোনা পরীক্ষার কাজে লাগানো।
- প্রতিটি পাড়ায় বা গ্রামে স্কুল, কমিউনিটি হল, ক্লাব, অনুষ্ঠানবাড়ি অধিগ্রহণ করে সেফ হোম তৈরি করা। সেখানে সাধারণ ওষুধপত্র, পরীক্ষার ব্যবস্থা, অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা। প্রয়োজন হলে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
- অল্প উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে থাকা রোগীর জন্য হেল্পলাইনে পরামর্শ৷
- উপরের সমস্ত পরিষেবা দেওয়ার জন্য হয় বেসরকারি ল্যাবরেটরি বা হাসপাতাল অধিগ্রহণ করা, অথবা সরকারি খরচে গরিব মানুষের বেসরকারি জায়গায় পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
- মেডিকাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে আলাদা আলাদা বিল্ডিং-এ কোভিড ও নন-কোভিড উভয় চিকিৎসা চালু রাখা।
- কোভিড-আক্রান্ত পরিবারগুলিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার জন্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবগুলিকে কাজে লাগানো।
- ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ইত্যাদি জনগণের সেবায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের IgG অ্যান্টিবডি নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে কোভিড ইমিউনিটি পরীক্ষা। তাদের জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা।
- মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিয়ে পৃথক হেল্পলাইন। কারণ এই অতিমারি জন্ম দিচ্ছে মনখারাপের মহামারির।
শেষকথা
অগোছালোভাবে হলেও বেশ কিছু কথা ভাগ করে নেওয়া গেল যাঁরা এ লেখা পড়ছেন তাঁদের সঙ্গে। আসলে এই সময়ে দাঁড়িয়ে নানা কাজেকর্মে যাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আমরা— আমরা কেউ-ই চাপমুক্ত নই এখন। তবু এসময় মানসিক একতার বড় প্রয়োজন। শারীরিক দূরত্ব দরকার, সামাজিক দূরত্ব নয়। আসুন, আমরা সকলে মিলেমিশে বাঁচি।