Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাঁচটি কবিতা

তৃষ্ণা বসাকের পাঁচটি কবিতা

তৃষ্ণা বসাক

 

হে রাম

অনেকক্ষণ ধরে পাম্প করলে
আধ বালতি জল,
জলস্তর এত নিচে নেমে গেছে,
এত দূরে সরে গেছে নদী,
সাতটি কলসিই ভরতে হল বালি দিয়ে…

সাতটি কলস, সাতটি নক্ষত্রের নিচে রেখেছি,
বালির ওপর জল পড়ে টপ টপ টপ,
ভিজে উঠে পরক্ষণেই খটখটে বালি, অহল্যার যোনির মতো,
রামের স্পর্শের অপেক্ষায় যেন পড়ে আছে রুক্ষ টাঁড়…

নতুন দুর্বার মতো রং যুবকটির,
সে এসে কর্ষণ করলে অহল্যা রসবতী হবে,
সে এসে কর্ষণ করলে
প্রতিটি আঘাতে উঠে আসে সীতা,
সে এসে কর্ষণ করলে নন্দীগ্রামে হাঁড়ি চড়ে ফের।

হে রাম, হায় রাম,
হাল ধরো, কৃষিকাজ করো,
তোমার প্রতীক্ষায় থেকে থেকে
শবরী ভারতবর্ষ কখন পতিতা হয়ে গেছে!

 

অপ্রকাশিত জীবনানন্দ

কখনও আমি এক ট্রাঙ্ক অপ্রকাশিত জীবনানন্দ,
উবু হয়ে বসে সুচেতনা দুহাতে আমাকে তুলে নিচ্ছে,
ওর উন্মুখ স্তনের ঘষা লেগে
মৃত অক্ষরগুলি মুছে যাচ্ছে
প্রজাপতির পাখার রঙের মতো,
আর আমি আবার জন্মাচ্ছি
নবীন কবির গোপন ডায়েরিতে,
জন্মানো ছাড়া অন্য কোনও অপশন নেই আমার…

কখনও আমি ভূমেন্দ্র গুহ,
সারা শরীরে শ্যাওলা,
বহুবার আমি নেমেছি ঐ সমুদ্র নীলে,
ভাঙা জাহাজের খোলে পেয়ে গিয়েছি ডাচ সুন্দরীর মুক্তোমালা,
সুরিনামি যুবকের পাজামার দড়ি
আর তৎপর পিরানহা—
জলের তলায় পড়ে থাকা স্থির সময়কে
খুবলে খেয়ে নিয়েছে এই মাছগুলো,
আমার দুহাত ভর্তি,
তুমি নেবে না সুচেতনা?
বলতে বলতে ভূমেন্দ্র গুহ
আবার ট্রাঙ্কের মধ্যে ঢুকে পড়লেন,
আর আমি,
অপরাধ নিও না বাংলা ভাষা,
ডালাটাকে বাইরে থেকে খুব ভালো করে এঁটে দিলাম!

 

লাইব্রেরি— মৃত প্রজাপতির ডানা

নিজেকে গুঁজে রাখি প্রিয় বইয়ের মতো ভেতর,
দুটি বারবার পড়া পাতার মাঝখানে,
মৃত প্রজাপতির ডানা,
পুরোটাও নয়, ছেঁড়া একটা অংশ,
কিন্তু ওইটুকুর মধ্যেই সূক্ষ্ম আর জটিল নকশা।
অকল্পনীয় সব রঙের পারমুটেশন আর কম্বিনেশন!
প্রজাপতিটা মৃত, কিন্তু তার ডানাটা,
মানে তার ছেঁড়া অংশটা
এখনও কাঁপছে,
আর তার গায়ের গুঁড়ো গুঁড়ো রং
মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে
আমার প্রিয় চরিত্রদের শরীরে,
তাদের মুখের সংলাপ
কিংবা উইংসের কাছে সরে এসে স্বগতোক্তি,
এমনকি একটা আস্ত কবিতার
ভেতরেও ছড়িয়ে যাচ্ছে রং,
ছড়িয়ে যাওয়া বলতে যে একটা বহুদূর রাস্তার কথা ভাবা হয়,
আমি ঠিক তাই বলতে চাইছি…

আমার প্রিয় বইয়ের
বারবার পড়া পাতাদুটির মধ্যে
চুপ করে থাকা ডানার অংশটা
এবার হয়তো উড়তে শুরু করবে,
কারণ কাঁপা আর ওড়ার মধ্যে
কতটুকুই বা পথ,
হয়তো কোনও চমৎকার সকালে
তোমরা দেখবে
তোমাদের এত বছরের স্থাণু লাইব্রেরি তার তাক টাক সুদ্ধু
উড়তে উড়তে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে,
আচ্ছা, ধরা যাক উড়ল না,
তাহলেও কি তোমরা, তুমি
এত বইয়ের মাঝখানে
খুঁজে নিতে পারবে
আমার প্রিয় বইটিকে,
তার বারবার পড়া দুটি পাতা,
যার ভেতরে আমি সফলভাবে গোপন রেখেছিলাম
নিজেকে—
মানে মৃত প্রজাপতির ডানা,
পুরোটাও নয়, তার ছেঁড়া একটু অংশ!

 

ছাড়িব না

আগুনের শব্দের মতো সকাল হল, এখন কথা শুরু করা দরকার,
দরকার দাবানল লাগা পাহাড় থেকে নেমে আসা,
আর তোমাকে প্রবলভাবে বুকে বেঁধে রাখা—
ছাড়িব না, ছাড়িব না, ছাড়িব না— মনে পড়ে?

মনে আছে
অতল চুলের স্নেহে ডুবে থাকা
কাজললতাটির কথা?
সেই কাজললতার কাজল
তোমার নাভি থেকে টানতে টানতে
নিচে নামছি,
আঙুলের টানে ছিঁড়ে যাচ্ছে এক একটা দশক,
তোমার পুরুষাঙ্গ শিউরে উঠছে
আমার নখের আঁচড়ে,
কান্নার মতো কোথায় যেন বাজছে
ছাড়িব না, ছাড়িব না, ছাড়িব না!

 

ফেরা

চোখের জলে আমার পা পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে দেশ,
আমি যে সেই কোথায় আটকে পড়েছিলাম,
সেখান থেকে ফেরার বাস নেই, ট্রেন নেই, এমনকি রাস্তা অব্দি নেই,
আমি আমার সমস্ত নষ্ট রাত্রি নিয়ে একটি বাসে উঠে পড়লাম,
আমি আমার সমস্ত খুচরো খিদে একজায়গায় করে
ড্রাইভারকে দিয়ে বললাম ‘আমাকে একটু পৌঁছে দেবে?’
ড্রাইভারের মুখ দেখতে পাচ্ছি না,
খালাসির মুখ দেখতে পাচ্ছি না,
শুধু সামনে নিঃসীম, নিকষ রাস্তা,
আর কাতারে কাতারে ছায়া হাঁটছে,
লঙ্কা খেতের ছায়া, হীরে কাটার ছায়া,
হোটেলের বাড়তি খাবারের ছায়া, সিমেন্ট, মার্বেল পাথরের ছায়া,
আমাদের লরি হর্নও দিচ্ছে না, স্রেফ ওদের পিষে দিয়ে চলে যাচ্ছে,

আমি ছাদে উঠে গেছি, খড়ের ওপর শুয়ে শুয়ে দেখছি তারাবৃষ্টি,
আকাশও আমার পাশে শুয়ে শুয়ে দেখছে সেই অবর্ণনীয় রাত্রি,
আর আমাদের পিঠ ফুঁড়ে বেজে উঠছে
‘চল ছাঁইয়া ছাঁইয়া ছাঁইয়া ছাঁইয়া’