হিমাদ্রী মন্ডল
শেষবার মার মৃতদেহটা যখন ঘরটা থেকে বের করে উঠোনে রাখা হল, তখন ঠিক এরকমই পড়ন্ত বিকেল। গোধূলি-আলোয় মার মুখখানা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। চোখে জল ছিল না, বরং এক গভীর বিষণ্ণ মুগ্ধতা অবশ করে ফেলছিল অপর্ণাকে। আড়াই বছরের ছোট্ট পিউকে কোলে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়েছিল সে।
–শেষ কটা দিনও মাকে ওই সিঁড়ির নিচে ছোট ঘরটায় রাখলি?
–বিয়ে করার পর আমি আর নূপুর তো এই ঘরেই উঠেছিলাম। তাছাড়া মারও তো বয়স হয়েছিল। এই বয়সে উপর নিচ করাটা…
–আমাদের ছোটবেলাও তো এই ঘরেই কেটেছিল দাদা। জানালা আর খোলা বারান্দা দিয়ে হু হু করে হাওয়া খেলত, মা চুল শুকাত, মনে আছে তোর?
–সেসব তো বহুদিনকার কথা। তখন এই একটাই বড় ঘর। নিচের ঘরে ঠাকুমা থাকত।
ঠাকুরমার মুখে অনেক অল্প বয়সে সে শুনেছিল বাড়ির ছেলের বিয়ে হলে, নতুন বৌয়ের জন্য নাকি বরাদ্দ হত দোতলার ওই ঘরটা। মাকে জিজ্ঞেস করায় হেসেছিল শুধু, বড় বিবর্ণ সে হাসি।
–একদিন কেউই আর নতুন থাকে না অপু। বাচ্চা-কাচ্চা হয়, তারা বড় হয়, তারই মাঝে কখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, পুরনো হয়ে যায় সবাই। আবার কোনও ‘নতুন বউ’ আসে। প্রয়োজন ফুরালে, তারও ভবিতব্য ওই সিঁড়ির নিচের ঘরটাই।
বিল্টু হওয়ার পর তার জন্য বড়বৌদির আলোবাতাস খেলা ঘরের দাবীতে জানালার পাশের মায়ের প্রাণপ্রিয় কদমগাছটা কাটা পড়েছিল সেদিন। মারা সব মেনে নিতে জানে। জানালার সামনেটা খালি হওয়ার আনন্দে বিহ্বল বড়বৌদির দিকে তাকিয়ে বড় করুণা হয়েছিল তার।
–তুই অযথা ভাবছিস রে অপু। মা কিন্তু শেষদিকটা আনন্দেই কাটিয়েছে।
–হ্যাঁ রে, তোর দুই বৌদি মায়ের সর্বক্ষণ খেয়াল রেখেছে। আর ওই ঘরটার এক কোণেই তো ঠাকুরঘরটাও ছিল…
–হ্যাঁ, শেষ বয়সে একটু ধর্মকর্মের দিকে সবাই একটু মন দেয়৷ পরকাল বলে একটা ব্যাপার তো আছে নাকি।
অপুর শূন্য দৃষ্টি সিলিঙের কোণা ভেদ করে কোথায় যেন হারিয়ে যায়— তার চোখে ভাসে ক্লাস টুয়েলভের সেই দিনটা। মার কাছে ধরা পড়ে ভয়ে লজ্জায় আসন্ন বলিপ্রদত্ত পশুর মতো কাঁপছিল সে।
–আনিসুরকে তুই পছন্দ করিস? কী হল জবাব দে। আমি কিন্তু তোর বইয়ের ফাঁকে চিঠিটা দেখেছি অপু।
হঠাৎ মাকে জড়িয়ে বুকে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল অপু। শাসনের ভয়ের চেয়েও সেদিন একটু আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা বেশি হয়ে উঠেছিল। কঠিন গৃহকর্ত্রীর বুকে একান্ত মায়ের ছোঁয়া খোঁজা মেয়েটির দাবি মেনে তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল মা।
–তোর দিদা কিন্তু বর্ডার পেরিয়ে আসা বাঙাল। মায়ের মুখে শুনেছি খান সেনাদের অত্যাচারের কথা। আমার এক মাসিকেই নাকি দু পা চিরে মেরে ফেলেছিল। বহু কষ্টে তোর দিদা এর-তার সঙ্গে পালাতে পালাতে এপারে এসে ওঠে।
অপু বিহ্বল হয়ে শুনছিল। মা বলে চলে—
–আমি যে আমার বাপেরই মেয়ে তার কি কোনও ঠিক আছে! কে বলতে পারে ওই খানসেনাদেরই কেউ একজন আমার বাপ নয়! বাপের ধর্মই যদি ছেলেমেয়েরও ধর্ম হয়, তাহলে এত বছর হিন্দু হয়ে কাটিয়ে দিলাম কী করে? শোন অপু, মানুষ যা কিছু মেনে চলে সেটাই তার ধর্ম।
–কিন্তু আনিসুররা যে মুসলমান, নামাজ পড়ে। ওদের মেয়েরা বোর্খা পরে।
–বাপের বাড়ি থেকে লক্ষ্মীর পাঁচালি, ব্রতকথা, নারায়ণ পুজো, উলবোনা, সেলাই করা এসব শিখে এসেছিলাম। এ বাড়িতে এসে এখানের দেশাচার, পুজো আচ্চা শিখেছি। তুইও নাহয় ও বাড়িতে একটু কষ্ট করে নামাজ পড়াটা শিখে নিস। যা করলে মেয়েমানুষে বেঁচে থাকতে পারে সেটাই তার ধর্ম!
আনন্দে অপুর চোখে জল এসেছিল সেদিন। যদিও সে যাত্রা তার আর নামাজ পড়া শেখা হয়নি। মেয়েমানুষের ধর্ম থাক বা না থাক, তার উপর ধর্মের, সমাজের বা পুরুষ-পরিবারের অধিকার তার নিজের চেয়েও বহুগুণ বেশি।
এর একমাসের মাথায় অপর্ণার বিয়ে হয়ে যায় শ্রীধরের সঙ্গে। এ পোড়া দেশে সামাজিকতা ব্যতিরেকে যেসব মা-মেয়ে মিলে খুঁজে নিতে পারে জন্ম, বঞ্চনা, লড়াই সম্বলিত সম্পর্কের গভীরতম অধ্যায়, তাদের নাড়ির টান বড় অমোঘ। অপর্ণার তাও ছিঁড়ল একসময়।
রান্নাঘর থেকে ফিসফিসিয়ে শব্দ আসে—
–আরে দুশ্চরিত্র মেয়েছেলে একটা। আগে তো কোন এক কাটার বাচ্চার সঙ্গে মজেছিল… নেহাত ভালোমানুষ দাদারা ছিল বলে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল।
–আস্তে বলো দিদি শুনতে পাবে। আগে তো কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটুক।
–শুনেছি এখন নাকি নিজের শ্বশুরের সঙ্গেও…
চাপা হাসির রোল ওঠে।
–এই আস্তে আস্তে!
–বুড়ির ওই বাক্সটা কই রে?
–ওই তো নিচের ঘরেই আছে…
–নিয়ে আয় তো ওটা…
–শ্রীধরের ব্যবসাটা কেমন চলছে এখন?
আচমকা প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে অপর্ণার।
–ওর ব্যবসার ব্যাপারে আমি মাথা টাথা ঘামাই না।
–পিউটা বড় হচ্ছে, এবার তো একটা প্লেস্কুল-টুলে দিতে হবে। কিছু ভেবেছিস?
–না। এখনও সেরকম কিছু ভাবিনি।
–আরে দাদা, শ্রীধর নিশ্চই কিছু ভেবে রেখেছে। একটিমাত্র মেয়ে, তাকে তো চোখে হারায়।
–এরা তিন ভাইবোন মিলে আড্ডা জমিয়ে আমাদের ভুলেই গেছে রে।
–আমরা বাবা শুধু চা জলখাবার দিতে এসেছি। তোমাদের আড্ডা ভাঙতে চাই না।
–তবে দিদি তোমার সম্পত্তি জমা রয়েছে আমাদের কাছে, তোমার হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হব।
অপর্ণার সামনে একটা ফটো অ্যালবাম, আরেকটা টিনের ছোট বাক্স। বাক্সটা হাতে নিয়ে খানিক বিহ্বল হয়ে পড়ে অপর্ণা, চোখে জল আসে।
–শেষ কটা দিন এগুলো আঁকড়েই বেঁচেছিল দিদি। একটিবারও হাতছাড়া করত না।
–দেখ আশা, আমাদের পিউকে কিন্তু একদম ছোটবেলার দিদিভাইয়ের মতো দেখতে।
পিউ এতক্ষণ নিজের মতো খেলা করছিল, এখন সবকটা চোখ ওর দিকে। অপর্ণা পিউকে কোলে তুলে নেয়। নরম গালে গাল ঘষে। পিউয়ের ছোট্ট নরম গালের উষ্ণতা বড় প্রিয় আপর্ণার। পিউ খিলখিল করে হেসে ওঠে তারপর কী মনে হতে ট্রেতে রাখা বিস্কুটের দিকে একগাল হেসে হাত বাড়ায়।
–ও মা! পিউ সোনা, তুমি বিক্কুট খাবে! বিক্কুট খাবে তুমি! এসো এসো এসো।
নুপুর হাত বাড়িয়ে পিউকে আবার অপর্ণার কোল থেকে নিয়ে নেয়।
সেদিনের দুপুরটা এখন আর বাকি পাঁচটা দিনের চেয়ে আলাদা কিছু মনে হয় না অপর্ণার। শ্রীধর দোকানে, রান্নাঘরে ও একা। পেছন থেকে অতর্কিতে আবারও ওকে সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরে। প্রতিনিয়ত আক্রমণে আর চমকে ওঠে না অপর্ণা, অভ্যাসবশত বঁটি তুলে ফেলে। বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে চরম ঘৃণা নিয়ে চোখ রাখে ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের চোখে। চোখ-নাক-মুখ-জিভ-হাত-পা থেকে লিঙ্গ অবধি শুধু স্খলনের সুযোগসন্ধান। ধর্ষণোন্মুখ স্ফীত লালসা নারীর অনিচ্ছা চেনে না, ঘৃণা চেনে না, বিরক্তি চেনে না, শরীরি ভাষ্য চেনে না, শুধু শরীর চেনে। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে অপর্ণার, প্রতিদিন কতবারই বা ঠেকাতে পারে! মুহূর্তে হতাশা গ্রাস করে, হাত থেকে খসে পড়ে বঁটি— ক্লান্ত আত্মসমর্পণ। পুতুলের মতো নির্জীব পড়ে থাকা শরীরে তখন ক্ষুধার্ত পৌরুষের বিজয়োল্লাস। প্রবল ঘৃণায় বমি করে ফেলে অপর্ণা।
–শালি খানকি, সেই দিবি, তাও নখড়া মারাবি। রেন্ডি মাগি… ঢেম্নি শালি…
কিছুক্ষণ পর উল্লাস থেমে যায়, রান্নাঘরে পড়ে থাকে থুতু-শ্লেষ্মা-বীর্য-কালশিটে সমন্বিত অপর্ণার জ্যান্ত লাশ।
দিনরাত… দুই ভিন্ন পুরুষশরীর… মারের দাগ… সঙ্গমে উন্মত্ত উদগ্র খিস্তি, এমনকি শীৎকারগুলোও— সবই এক লাগে অপর্ণার। হিসেব রাখা হয় না আর… পিউ কার সন্তান… কী বা এসে যায়! পিউ শুধু তারই মেয়ে।
টিনের বাক্স খুলতেই মার গায়ের গন্ধ, গলার স্বর।
–তোর মেয়ের জন্য একটা সোয়েটার বুনছি অপু। কি কি রঙের উল নিই বল তো।
–আর সোয়েটার, বছর ঘুরে আবার শীত আসতে চলল। মেয়ে তো আমার বড়ও হয়ে গেল।
–বললে বিশ্বাস করবি না অপু। সারাদিন ধরে বুনি। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যতটুকু বুনেছিলাম সবটা খুলে গেছে। আবার বুনতে বসি।
–তোমার বয়স হয়ে গেছে মা। তাই পারছ না। দাদাকে বলব চশমা বানিয়ে দিতে।
–বয়স হলে মানুষ এমনিই অনেককিছু দেখতে পায়, আবার অনেক কিছু দেখেও না।
–আপাতত আমি আমার ছোটবেলার সোয়েটারটা নিয়ে যাচ্ছি, ওটাই আমার মেয়েকে পরাব।
–কতদিন আর হাতের মুঠোয় করে রাখবি অপু? দেখবি প্রয়োজন ফুরালে সব ফস্কে যাচ্ছে, বাঁধন খুলে যাচ্ছে ওই সোয়েটারের মতো। তোর দাদা তোর ভাইপোর জন্য কীসব ইংরিজি কোম্পানির সোয়েটার কিনে এনেছে।
–আনুক গে। এখানে আমি সবাইকে বলেছি তোমার হাতের কাজ কত ভালো। আর আমার মেয়েটা তোমার বানানো একটা সোয়েটারও পাবে না!
–বুনোট খুলে যাচ্ছে রে মা। আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
–অতশত জানি না। পরের বার এসে মেয়ের সোয়েটার নিয়ে যাব ব্যস।
–একটা কথা ভাবছিলাম বুঝলি।
একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বড়দা শুরু করে। চিন্তার তাল কাটে অপর্ণার।
–এই বাড়িটা আমাদের পক্ষে দেখভাল করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিল্টুটাও বড় হচ্ছে, পরের বছরই তো হাইস্কুলে ভর্তি করতে হবে। ওর জন্যও তো কিছু রেখে টেখে যেতে হবে।
–তোর ছোটবৌদিরও কিন্তু এই সেপ্টেম্বরেই ডেট। এই একটা ছোট এককামরার ঘরে… বুঝিসই তো।
–তাই ভাবছিলাম এই ঘরটা আর সামনের জায়গাটুকু বেচে, আর জমানো কিছু টাকা পয়সা দিয়ে আমরা দুজন দুটো টুবিএইচকে ফ্ল্যাট নিয়ে নেব।
–এই ডানকুনিতেই, স্টেশনের একদম গায়ে। লোকেশানটা খুব ভালো বুঝলি।
–লাখোটিয়ার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। ভালো দামও দিচ্ছে গোটা প্রপার্টিটার।
–দেখ তোর তো একটা বাড়ি আছেই। শাশুড়ি নেই, শ্বশুর চোখ বুজলেই গোটাটা তোর। শ্রীধরকে না হয় খানিকটা টাকা দিয়ে দেব আমরা। ও ব্যবসাটা আরও একটু বড় করে দাঁড় করাক।
–ফোন করেছিলাম ওকে, ও রাজি। আসছে, রাস্তায়। লাখোটিয়াও এসে পড়বে।
–এখন তুই যদি আর অমত না করে সইটা করে দিস।
অপর্ণা ছলছল চোখে সবার মুখের দিকে তাকায়। যে সিদ্ধান্ত সবাই তাকে ব্যতিরেকে নিয়েই ফেলেছে, তার মতো একলা মেয়ের সাধ্য কি একটা সইয়ের জোরে তা আটকায়! মেয়ের শরীর ভাগ হয়ে যায়, স্থাবর-অস্থাবর সবই বাঁটোয়ারা হয়ে যায়। মৃতবৎ সমর্পণই বারংবার তার জীবনের কঠিনতম সত্যি।
সফল ভাগবাঁটোয়ারা শেষে আনন্দ উদযাপনের মাঝে এক শূন্যগর্ভ কণ্ঠস্বরে সবাই ফিরে তাকায়। বাক্সটা বুকে জড়িয়ে একটা আর্তি বেরিয়ে আসে অপর্ণার ভেতর থেকে…
–আমাকে মায়ের এই বাক্সটা শুধু দিস দাদা।
–ওতে দুটো উলকাঁটা, উলের গোলা আর একটা সোয়েটার তাও অর্ধেক বানানো হয়ে পড়ে আছে। আর কিছুই নেই রে। কী করবি ওটা দিয়ে?
–রেখে দেব। আমার মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে। যদি কোনওদিন ও ওর উত্তরাধিকারের শেকড় খোঁজে…
পিউকে কোলে তুলে নিয়ে বাক্সটা বুকে চেপে অপর্ণা নিঃশব্দে বের হয়ে যায়।