শুভ্র মৈত্র
নাহ, তা বলে সারাদিন থাকা যায় না। তাপ একটু বাড়তে না বাড়তেই খেদিয়ে দেয় পুলিস। মকবুলের কাছ থেকে আর একটা বিড়ি চাইবার ফুরসতও মেলে না। –চল চল ভাগ— কুকুর বিড়ালের মতো তাড়িয়ে দেয়।
ওরা অবশ্য জড়ো হয়েছিল সেই অন্ধকার থাকতে থাকতে। এ জনপদের আনাচেকানাচে গুঁজে থাকা আর একটা শহর থেকে ওরা বেরিয়ে আসে, তখনও রোদে ঢালাই হয়নি আকাশ। সাইকেল নিয়ে, ভ্যান নিয়ে ঠেলাগাড়ি নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে ওরা। পৃথিবীর গভীর আলস্য তখন। মিইয়ে আসা হ্যালোজেনের নীচে অন্ধকারের চাদর গায়ে একে একে জড়ো হয় সবাই।
সালেকের কাছে নতুন এই রাতের ঝকঝকে আলোর বাজার। টাউনে এমন দেখেছে, অনেক রাতেও খোলা থাকে বাজার। আর এই হাট তো মনে হয় রাতেরই হাট। এখানে চ্যাঁচামেচি, দরদাম— সব আলোর নিচে। মুসাম্বি টিপে দেখে খদ্দের, কালচে তরমুজের গায়ে হাত বোলায়। হলুদ আলোতে উজ্জ্বল দেশি মানিক কলার গায়ে কালো দাগ দিনের বেলা দেখা যাবে কিনা— তা নিয়ে গভীর চর্চায় মগ্ন থাকে মুরুব্বি। আসলে বিক্রেতার সঙ্গে দরদাম করা ক্রেতা বেলা বাড়লে নিজেই বেচতে থাকে ফল। মুকুল ডিলারের কাছে ডেলি পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় নেওয়া ভ্যান রিক্সায় মাল সাজিয়ে সালেক ঢুঁ মারবে টাউনের পাড়ায় পাড়ায়— এই যে আপেল, মৌসুমি, আঙুর… লিবেন আঙুর…
হাঁকটা এখনও পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি সালেক, অন্যরা কত সুর করে ডাকে। অবশ্য শুধু কি ডাক? বেচছে ঠিকই, কিন্তু নিজেই তো ফল চেনে না। মকবুল ওকে বোঝায়, “ইটা নাসিক, ইটা কাশ্মির… আব্বে ইটা কি মালদার আম নাকি? ইটা মাদ্রাজি। দেখতেই ভালো, কিন্তু একবারে ফিকা!” এমন করে চেনায় ওকে মকবুল। খানিক সালেকের মাথায় ঢোকে, খানিক ব্রাশের গা থেকে সিমেন্টের ঘোলার মতো ছিটকে পরে এদিক সেদিক।
এখন টাউনের রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি নেই, কুকুরও না। কিন্তু এই বাজার দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ভালো লাগে সালেকের। ব্যস্ত লোকজন চলাফেরা করে, দর হাঁকে, কেউ সাড়াও দেয় সেই ডাকে। ধাক্কাধাক্কি করে, গালিগালাজ করে, ঝগড়া করে পাশের লোকটার সঙ্গে। বেশ একটা প্রাণ আছে, মনে হয়। নইলে টাউনে তো সব মরেই আছে কতদিন, রাস্তাঘাটে লোক নেই। কী বলছে লকডাউন! বাপের জন্মে এমন শব্দ শোনেনি সালেক। বোঝেও না। কেউ আর বাইরের লোক বাড়িতে ঢোকায় না। নিজেরাও বেরোয় না ঘর থেকে। সেই কারণেই এই বাজারটায় এসে একটু জান আসে ধরে। মাল নেওয়ার পরেও একটু থাকতে ইচ্ছে করে। খানিক ওম নিতে ইচ্ছে করে ভীড়ের। কিন্তু পুলিসের জ্বালায় সে উপায় আছে?— ভাগ ভাগ— এখন আবার মুখে কেন ঢাকা নেই তাই নিয়ে চিৎকার।
প্রথম দিকে সালেক তো কিছু বুঝতেই পারেনি। রোজকার মতোই ঢুকেছিল ফ্ল্যাটে। তিনতলার পূবদিকের বাবুর ঘরে কাজ করছিল কয়েকদিন ধরে। ঠিক ঘরে না, বাথরুমের কাজ। বাবু এমনিতে খুব ভালো। বৌদিও। ওদের দুজনকে— মানে ওস্তাদ আর সালেক যখন কাজ করে— দুজনের জন্যেই চায়ের সঙ্গে রুটি-সবজিও দেয়। এটা রোজের বাইরে। তা কাজ তো প্রায় শেষই হয়ে এসেছিল। টাইলসটা পছন্দ করতেই যা একটু দেরি করছিল বৌদি। সেদিন সাইকেল নিয়ে ফ্ল্যাটের গেটে দাঁড়াতেই দারোয়ান বলে, ‘এখন ঢুকা যাবে না।’ ফ্ল্যাটে নাকি কী নিয়ম হয়েছে। অবশ্য, সালেকদের ছায়াতেই দাঁড়াতে দিয়েছিল। তারপর দারোয়ান নিজেই ভিতরে গেল, ফিরল বাবুকে নিয়ে। বাবুই খোলসা করে, এখন ফ্ল্যাটে বাইরের লোক আসা বারণ, কাল রাতের মিটিঙে ঠিক হয়েছে। দিনের রোজ অবশ্য ধরে দিল। ওস্তাদ নিতে চাইছিল না, জোর করেই দিল।
তবে সেদিনও খুব ভালো বুঝতে পারে নি লকডাউন মানে কী। বুঝল পরদিন টাউনে পিঁয়াজি মোড়ে এসে। এখানেই সবাই দাঁড়ায় ওরা। কেউ ঝুড়ি কোদাল, কেউ খুরপি, ডালি, কেউ বা কিছুই না নিয়ে এসে শুধু হাতদুটোর ভরসাতেই দাঁড়ায়। ভোর থাকতে থাকতেই আসে। সাইকেল নিয়ে, বাসের মাথায় চড়ে ভিড় করে এই মোড়ে। আর ওদের জন্যেই চায়ের গুমটিও সেই ভোর থেকে খোলা। টাউনের দিন শুরু হয় এখান থেকেই, সালেক জানে। ওখানেই বাবুরা আসে, ঠিকাদার আসে, লোক নিতে। নতুন আসা চ্যাংড়াগুলো কেউ এলেই হামলে পড়ে, ‘লাগব্যে নাকি?’ সালেকের পোষায় না। অবশ্য ওস্তাদ রাজমিস্ত্রির কাজ পেলে সালেকের এমনিতেই কাজ পাকা। নামে লেবার, কিন্তু সালেক তো ওস্তাদের সঙ্গে কুর্নি, বাত্তাতেও হাত লাগায়। গাঁথনি তোলে, প্লাস্টার করে। আর ফাঁকে ফাঁকে ওস্তাদের কাজ দেখে মন দিয়ে। ওস্তাদ বলে, “শুন, ঘর তুলহা মানে নিজের জানের ভাগ দেওয়া। ওই সিমেন্ট-বালু-ইটকে জান দিচ্ছিস তুই। সিমেন্ট বালু মিশানোর হিসাব যেমন আছে তার চেহ্যাও বেশি লাগে বুকের কলজ্যা। ফাঁকা জমিনে জান ফুটাতে লাগে। ওইটা না থাকল্যে মিস্ত্রি হয়্যা কাম নাই।”
অবশ্য ওস্তাদ বলেছে, এবার সালেক নিজেই রাজমিস্ত্রির কাজ নিতে পারে, শিখে গেছে ভালোই। ঠিকাদারকে বলে দেবে। আর সালেক জানে মিস্ত্রি ওকে হতেই হবে। পুরোপুরি রাজমিস্ত্রি। টাকা অনেক বেশি। আর গ্রামেও সবাই সালেক মিস্ত্রি বলে ডাকবে। আফসানার বাপ রাজমিস্ত্রি ছিল। আমজাদ মিস্ত্রির নাম ছিল এলাকায়। অবশ্য বিবি ওকে কোনও খোঁটা দেয় না এ নিয়ে। ঘরের মানুষটাও যে রাজমিস্ত্রি হবে এই বিশ্বাসটাই রং-চটা শাড়ির মতো জড়িয়ে রাখে ওকে।
এই কয়দিনে কাজ পাওয়ার তাগিদ ছিল না, পৌঁছানোর তাড়া ছিল, আসা হয়নি। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের দরজা থেকে ঘুরে আসার পরদিন সকালে তো আসতেই হল। আর বড় রাস্তায় সাইকেল বাঁক নিতেই ধক করে উঠল বুকটা। একদম ফাঁকা। চায়ের গুমটিও খোলেনি। এদিক সেদিক দু একটা মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু কাজ পাবার আশা কারও আছে বলে মনে হল না। –‘কহ্যেছে কী নাকি অসুখ হইচ্ছে সবার, পুলিস থেকে লকডাউন করেছ্যে। দোকানপাট কাজকাম সব বন্ধ’— আরমান কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। হাতে ঝুড়ি আর কোদাল। হ্যাঁ, অসুখ একটা শুনেছিল বটে সালেক, কিন্তু সে তো নাকি কলকাতা, দিল্লি বিদেশে হচ্ছে। ওর গ্রামের তো সরিফুল, রাইসুরা দিল্লি গেছে। তাই বলে এখানেও সব বন্ধ!
সালেকের মাথায় কিছু ঢুকছিল না। সাইকেল থেকে নামতেও পারছিল না। ‘বাড়ি যাও সালেক ভাই, এখানে ভীড় করলে পুলিস এসে হাঁকাবে।’ চা দোকানের দীনেশ। আজ দোকান খোলেনি। কাল রাতেই নাকি মাইক নিয়ে এসে বলে গেছে পুলিস।
আবার সাইকেল উজিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে অন্য দিন বাজারে একবার ঢুঁ মারে, কিন্তু আজ নাকি বাজারও বসেনি। ধ্যুস। খালি হাতেই ফিরতে হবে। গাঁয়ের রাস্তার মুখে যথারীতি জটলা। রবিউল, মকবুল, সাদিক মাস্টার— সবাই আছে। হয়তো এর মধ্যেই অনেকে ওর মতো ফিরেও এসেছে টাউন থেকে। সবার মুখে একটাই বুলি, ‘লকডাউন’। টিভিতে কে কী দেখেছে, পুলিসের জিপ গাঁয়েও ঢুকবে কিনা সেসব নিয়ে চর্চা চলছে। সালেক কিছু বলতে পারে না, তবে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এত সকালে ঘরে ঢুকেই বা কী করবে?
দুদিন চা-বিড়ি আর শুয়ে বসেই কাটার পরেও তেমন কিছু বোঝেনি। ডরটা লাগল সেদিন মকবুলের কথা শুনে, ‘এই শালার লকডাউন এখন উঠব্যেক না। টিভিতে কহ্যেছে। কাজকাম আর পাওয়া লাগবে না, টাউনে কারও বাড়ি ঢুকতেই দিছে না!’ তাহলে? ডরের একটা স্বভাব আছে, একা আসতে পারে না। সঙ্গে করে ডেকে নিয়ে আসে আর পাঁচটাকে। লকডাউন না উঠলে কয়দিন পরে খাবে কী? আর ওর রাজমিস্ত্রি হওয়া? নাহ, সালেকের মাথায় সব জট পাকিয়ে যায়।
বুদ্ধিটা মকবুলই দিয়েছিল। ভ্যানে করে ফল বেচবে। পাইকার বাজার থেকে ফল কিনে রাস্তায় রাস্তায় ভ্যান নিয়ে হাঁকবে। মকবুল পাইকারের সঙ্গে কথাও বলে এসেছে। টাউনে নাকি সবাই খুব ফল খায়। দেখেছে সালেক নিজেও। ওই ফ্ল্যাটবাড়িতে সবাই টেবিলে ভাত খায়। সেখানেই সাজিয়ে রাখে আপেল, কলা, আঙুর। “অরা ফের চাকু দিয়্যা কেট্যা কেট্যা খেছ্যে”— খ্যাকখ্যাক করে হাসছিল মকবুল।
ও তো শুরুও করে দিল। বিমার বউটার খুব মুখ। মনে হয় মকবুলের ঘরে মন টেঁকে না। রাত থাকতে বেরিয়ে যায়, আর গ্রামে ফিরতে ফিরতে বিকেলের রং লাগে পাকুড়গাছে। দেখা হলে সালেককে খোঁচা মারে।
ঘরে অবশ্য সালেকের তেমন অশান্তি নেই। আফসানা এখনও খোঁজ নেয়নি, কবে আবার কাজে যাবে সালেক। নিয়ম করে রোজ কড়াই, কুর্নি ধুয়ে মুছে রাখে। ও জানে ওর মরদ মিস্ত্রি হবে। টাউনের বড় বড় বাড়ির ডিজাইন করবে। সাত বছরের ওয়াহাব ইস্কুলে যায়, এখন বন্ধ। ইংরাজি শিখেছে, বাপকে বলে, ইংরাজিতে মিস্ত্রিকে বলে ‘ম্যাসন’। সালেক জানত না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মুকুল ডিলারের দাওয়ায় গিয়ে যখন ভ্যানগাড়িটা চাইল, মকবুলই দরদাম করছিল, সালেক বাড়ির বাইরে। অন্ধকারে। ডিলারের বেটি দেখে ফেলেছিল, “আরে সালেকমিয়া, আন্ধারে খাড়ায় আছ ক্যানে? আব্বুর সাথ্যে কথা কহিব্যা না?” ঠিক সেই মুহূর্তে সালেকের মনে হয়েছিল, অন্ধকারটাও যেন তেমন গভীর হয় না এখন।
এখন অবশ্য কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। মকবুলের সঙ্গেই রাত থাকতে বেরিয়ে যায়। ভ্যান চালিয়ে দুই বিড়িতে টাউন। তারপর এই বাজার। এই ভীড়টাই ওকে টানে। গ্রামে ফিরে আর কোথাও বের হয় না। আগে যে সন্ধ্যায় কার্তিকের চায়ের দোকানে গিয়ে বসত, এখন আর মন টানে না। টাউনে কোনও দোকান খোলে না, তবে এখানে চা-বিড়ির দোকানে কোনও বারণ নেই।
ধীরে ধীরে ভ্যান নিয়ে বাইরে আসে সালেক। কুর্নি, বাত্তা, কড়াই ধরা হাতটায় এখন ভ্যানের হ্যান্ডেল। এখন চালাতে হবে না। ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাবে পাড়ার, গলির ভিতর… এই যে আপেল, মৌসুমি, আঙুর…। রোদের তাপ এই সকাল থেকেই বেশ। টাউনের লোক বাড়ি থেকে বেশি বের হয় না। ঘরেই থাকে। ব্যাটাছেলেরা হাফ প্যান্ট পরে আড্ডা মারে বাড়ির নিচে। মুখে সবার মুখোশ। সালেককেও মুখ ঢাকতে হয়। তবে ওই মুখোশ পরে দেখেছে, কেমন দম বন্ধ লাগে। তাই গামছা পেঁচিয়ে নেয়। সেটা অবশ্য লোক দেখলে, আর কেউ না, সিভিকগুলো খুব ঝামেলা করে।
টাউনে তো কম দিন ধরে আসছে না, অনেক পাড়াই চেনা। কিন্তু সেগুলোতে যায় না। অচেনা পাড়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য যেন। মকবুল একদিন বলেওছিল, “ডাক্তারপাড়া তো তোর চিনা। যাস, ওঠি ভাল বিককিরি আছে”— শোনেনি সালেক। মকবুল বোঝে না। ওস্তাদের সঙ্গে কত বাড়িতে কাজ করেছে ওখানে। ওই পাড়ায় সালেক ফল নিয়ে যেতে পারে? রংচঙে দেওয়ালগুলো মুখ টিপে হাসবে না?
আজকের আপেলগুলো ভালো পেয়েছে। কালচে লাল। প্রত্যেকটার গায়ে আবার কাগজ সাঁটা। বাড়ির বউরাই বেরিয়ে আসে— মিষ্টি হবে তো?— ‘কহ্যতে লাগবে না, একবারে গ্রান্টিক। লিয়্যে যান, খেয়ে পয়সা দিয়েন।’ এসব বলতে হয়। অবশ্য এখনও সালেক ভালো পারে না, জিভের আড় ভাঙেনি। রোদটা বড্ড চড়া আজ। মুখে জড়ানো গামছাটাই মাথায় দেয়।
সকালের আপেল-কলাগুলো যেন শুকনো মুখে তাকিয়ে থাকে সালেকের দিকে। হলুদ হয়ে যাওয়া মুসাম্বির বিক্রি এ অঞ্চলে হবে না জানে। বেলা আরও গড়ালে ঢুকবে বটতলি, মহেশমাটি। ঐ পাড়ায় ওর নিজের মতোই মানুষ সবাই। ফল ওদের ডায়েটে নেই। শুধু বাবুদের মতো হওয়ার জন্য কেনে হলুদ মুসাম্বি, শুকনো আঙুর। ঘর মোছার ফাঁকে দেখেছে টেবিলের উপরে সাজানো থাকে কলা, আঙুর। এখানে সালেকের বলা দাম চলে না, ওদের জেদের কাছে হার মানতে হয়। তার সঙ্গে ওই পাড়ার বাচ্চাগুলো। ওয়াহাবের বয়সিই হবে। একসঙ্গে দল বেঁধে রাস্তায় ঘোরে, কুকুর তাড়া করে, সাইকেলের টায়ার নিয়ে দৌড়ায়। আর সুযোগ খোঁজে, সালেকের ভ্যান থেকে ছোঁ করে ফল নিয়ে পালায়। চিৎকার করা বা পিছনে ধাওয়া করা পোষায় না সালেকের। এই পাড়ায় এলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি, তবু সালেক না এসে পারে না। আসলে লোকগুলিকে নিজের মতো লাগে। আর ঐ যে, এখানে রাস্তায় মানুষ থাকে, মুখোশ ছাড়াই।
ভ্যান খালি হলে দিনের শেষে দুই-তিনশো টাকা থাকে, সালেক দেখেছে হিসেব করে। কিন্তু সব বিক্রি হলে তো? সেদিন যেমন হঠাৎ বৃষ্টি এসে সব ভণ্ডুল করে দিল। প্রায় কিছুই বিক্রি হয়নি তখনও। ভ্যানের সব মাল বাধ্য হয়েই গরু-ছাগলকে খাইয়ে আসতে হয়। অবশ্য মাল বিক্রি না হলে মকবুল যেমন আফশোস করে সালেকের তেমন পোষায় না। এই নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় কথাও হয়। “তুই শালা এখনও মিস্ত্রিগিরি ছাড়ত্যে পারলি না,” মকবুল খোঁচা দেয়। সালেক চুপ করেই থাকে। মিস্ত্রি হতে পারেনি এখনও, কিন্তু হবে তো! মকবুল শালা কী বুঝবে? অন্যের কাছে থেকে মাল নিয়ে বেচা আর নিজে কুর্নিতে সিমেন্টের গোলা নিয়ে ডিজাইন ফোটানো এক হল? নিজেই ডিজাইন তুলতে পারে সালেক, কুর্নি আর সালসুতা দিয়ে দেওয়ালের গায়ে পদ্ম ফোটাবে, চায়ের কাপের মতো জলের ট্যাঙ্ক বানাবে। হওয়ার পরে ওস্তাদকে ডেকে দেখাবে, নিজের জানের কতটা দিয়ে দিয়েছে, দেখাবে। খুশি হলে ওস্তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে, ‘শালা আটিস’! লজ্জা পাবে সালেক।
আজকে ফল বেচতে পারেনি সবটা। ফেরত নেয় না মহাজন, এটাই চুক্তি। বিক্রি না হলে ফেলে দিতে হয়, গরুকে খাওয়াতে হয়, দিয়ে দিতে হয় ফুটপাথে শুয়ে থাকা মানুষগুলিকে। আজকে অবশ্য দেয়নি। ওই কাগজের স্টিকার লাগানো দুটো আপেল ঢুকিয়েছে বাড়ির ব্যাগে, যেখানে আফসানা রুটি ঠেসে দিয়েছিল।
ঘরে ফিরতে ফিরতে রোজের মতোই বিকালের রোদ শুকনো তরমুজটার মতো পানসে হয়ে গেছে। ডিলারের ভ্যান এখন বাড়িতেই থাকে। টিউকলের পানিতে মুখ হাত ধুয়ে এসে দাওয়ায় বসে। আপেল দুটো আগেই তুলে দিয়েছে ওয়াহাবের হাতে। কালচে লাল, ওই চকচকে কাগজগুলি উঠতে দেয়নি আপেলের গা থেকে।
ভিজে গায়ে দাওয়ায় বসলে এই সময় মুড়ির বাটি নিয়ে আসে আফসানা। এখন খিদা পাবার সময়। এই সময়টাকে ডর লাগে সালেকের। সেই ছোটবেলা থেকে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ডর লাগে এই খিদাকে। সালসুতা দিয়ে মাপার চেষ্টা করেছে, সালেরমাথা কিছুতেই পৌঁছায় না। নিজের জান দিয়ে ডিজাইন তোলার সময়, রুশা দিয়ে সিমেন্টের ঘোলা ছোঁড়ার সময়, কুর্নি দিয়ে মসৃণ, আরও মিহি করে মেঝের ঢালাই করার সময় আসলে ওই ডরটাকেই সিমেন্টের গোলা দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় সালেক। এই যে কী অসুখ বলছে, ওর ডরটা কি খিদার ডরের চেয়েও বেশি? জানে না সালেক। শুধু যে ডরটা বুকের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকে, সেটাই ফিরে ফিরে আসে। শুধু ভাবে কিছুতেই যেন ওই ডরটা ওয়াহাবকে ছুঁতে না পারে।
–আব্বু, হামি জানি এখন তুই কী আছিস, আপেলটায় কামড় দিয়েছে ওই কচি দাঁত নিয়ে।
–মানে? কী আছি?
–তুই এখন আর ম্যাসন নাই, মাস্টার কহ্যেছে। তুই এখন ভেন্ডর। ঠেলায় কর্যে অন্যের মাল বেচিস! লিজ্যে কিছু বানায় না…।
অন্ধকারটা আজ খুব ঘন, বাল্বের ফিকে আলোয় আরও যেন বেশি জমাট লাগে সালেকের…।