খালিদা খানুম
ছোট ভৈরব
পানা আর কলমিশাকে মোড়া একটা নীচুমতো জমিন দেখিয়ে রূপাকে বলি, ওই দ্যাখো ওইটা ছোট ভৈরব। এখন মজে গেছে কিন্তু আগে জাহাজ চলত নাকি। নীলের বস্তাভর্তি জাহাজ।
রূপার চোখে সানগ্লাস। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাকে রুমাল চাপা দেয়। আমিও পাচ্ছি মনুষ্যবিষ্ঠার গন্ধ।
হা হা করে হাসি— আরে রুমাল চাপা দাও কেন? এটা ন্যাচারাল পারফিউম।
ভৈরবের বুকে ধানের বীজতলা। বর্ষার জল জমেছে কোথাও কোথাও। একটা মাছরাঙা বসে আছে সেই জলের দিকে চেয়ে। রূপার গাল লাল হচ্ছে রোদে। রোদে পুড়লে রূপাকে ভীষণ সেক্সি লাগে। চুমু খেতে ইচ্ছা করে ভীষণ।
–চলো আমবাগানটা দেখিয়ে আনি। দাদোর বাপের আমলের আমবাগান। কত পুরানো গাছ আছে জানো!
‘ডিসগাস্টিং!’ রূপা মনে মনে বললেও আমি শুনতে পাই। শুনেও ইগনোর করি। বিয়ের পর প্রথম এসেছি গ্রামের বাড়িতে। একবার অন্তত ঘুরে দেখুক শ্বশুরের ভিটা। আর হয়তো কখনওই আসা হবে না। গ্রামের সব বাগান ভিটা বেচার পরিকল্পনা চলছে। মোটামুটি সব ঠিক হয়ে গেছে। পরের মাসে রেজিষ্ট্রি। সেই টাকাই ভরসাতেই পার্কসার্কাসের নতুন থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাটের বুকিং। কী করার আছে! কত কষ্টে ছুটি জোগাড় হয় আমাদের। আমার হয় তো, রূপার হয় না। রূপার হয় তো, আমার হয় না। গ্রামের বাড়ি জমি থাকা না থাকা এক ব্যাপার। তার থেকে নতুবা ফ্ল্যাটে কাজে লাগুক।
মা শেষমেশ রাজী হয়েছেন কলকাতা গিয়ে থাকতে, এটাই ভাগ্যি।
–কিগো লিয়াকতের ব্যাটা লয়? ল্যাংড়া আমগাছের পেছন থেকে ভূতের মতো বেরিয়ে এল করিম শেখ।
কোমরটা টানটান করে দাঁড়িয়ে বলল— চোখে আর জ্যোতি নাই রে দাদো। কিন্তু ঠিক চিনছি লিয়াকতের ব্যাটা। ঠিক য্যানো লিয়াকত দাঁড়ায় আছে। আহারে! বুড়া চাচা পড়ি রইল, ব্যাটা চলি গেল আগুতে। সবই নসিব!
করিম শেখ সেই দাদোর আমল থেকে আমাদের আমবাগানের জোগালদার। আমেত বোল এলেই খড়ের ছাউনির মাচায় কাটায় দিনরাত। কোন গাছে কত আম হবে, আগে থেকে বুঝতে পারে সব। যেন গাছেদের ভাষা জানে।
–ক দিন থাকবা বাপ? সাদুল্লার আর কটি আম আছে। পরশু পাক ধরবে অল্প। ল্যাংড়াতে মিষ্টি বসতে আরও কদিন। তুমি তো গাছপাকা ল্যাংড়া ভালোবাসো।
বুকের মধ্যে একটা ছোট ভৈরব।
শুকিয়ে যায়। মজে আসে অল্প অল্প করে।
বুকের ভেতর একটা ছোট ভৈরব।
যে নদীতে আর নৌকা চলে না। সুর ওঠে না ভাটিয়ালি।
বুকের ভেতর একটা ছোট ভৈরব।
মরে যায় একটু একটু করে।
দিন বিকালের ট্রেন। বাতানুকূল কামরা। বাইরের বাতাস আসে না। রূপার গাল রোদে পোড়ে না, লালও হয় না। জানলার দিকে মুখ করে রূপা আমাকে বলে— করিমচাচা যতদিন আছে ততদিন না হয় জমিবাড়ি বিক্রিবাটা বন্ধ থাক। গাছপাকা ল্যাংড়া খাওয়া যাবে।
আমি রূপার দিকে তাকিয়ে থাকি। বুকের ভেতর ছোট ভৈরবে হঠাৎ কোথা থেকে জল থই থই করে। পালতোলা নৌকা বয়। সেই নৌকার পাল যেন রূপার আঁচল। বিকালের পড়ন্ত আলোয় রূপার গাল সূর্যের মতো লাল। আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি।
ভাঙন
বড় বৌয়ের নামে সবাই বলে তার নাকি হাত মুখ সমানে চলে। অবশ্য নিন্দুকরা কখনওসখনও সত্যি কথা বলে।
মোরগ ডাকতে না ডাকতেই বড়বৌ মেজবৌ সেজবৌ মিলে বড়ির ডাল কুমড়ো নিয়ে উঠে এসেছে ছাদে।
–রাতের কাপড় ছেড়েছিস? পরিষ্কার আছিস তো? হাত চালা। রোদ উঠলে বড়ি ফেটে যাবে। আচ্ছা তোরাই বল। কী আক্কেল ছোটবৌয়ের। মুখের উপর বলে দিল সকালে উঠতে পারব না। স্বামীসোহাগিনি। যেন স্বামীর ঘর আমরা করিনি। নতুন নতুন বলে এত পেরেম!
বড়বৌয়ের হাতের সঙ্গে মুখও চলে।
সেজবৌ বলে— বুবু ছাড়ো না। কলেজে পড়া মেয়ে, অত জানে না। আমরা আছি তো।
–ছেড়ে দিলে হয় বল? তোদেরকে আমি নিজের বুনের চোকে দেখি, দেখি না বল? কিন্তু সংসারটা ভেঙে দিলে হবে বল? কলেজে পড়া বলে সংসার করবে না? তোদের অসুখ হলে আমি দেখি না? নিজের মা বুন কি থাকে সঙ্গে? জা থাকে।
মেজবৌ কথা বলে খুব কম। নিন্দুকরা এও বলে মেজবৌ বড়বৌয়ের কথার চাপে কথা বলতে পারে না। মেজ আর সেজ হাই তোলে আর ডাল মাখে।
তারপর একদিন বড়বৌ, মেজবৌ আর ছোটবৌ ডাল মাখে।
তারপর বড়বৌ আর ছোটবৌ।
তারপর ছোটবৌরাও ঘর তোলে আলাদা করে। একটু মফস্বল, কিন্তু নিজের বাড়ি।
তারপর আর বড়বৌ ডাল মাখে না। মাখবে কী করে? ছাদটাই নেই আর! তার সামনে একটা কেবল জানলা আছে। তার ভাগে দক্ষিণের ফ্ল্যাটখানি পড়েছে অবশ্য।
রফা
ঝাঁকা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে ঢ্যাঁড়স বরবটি কুমড়ো। সিটছেঁড়া সাইকেল পড়ে আছে একদিকে। চাকা ঘুরছে এখনও।
–দ্যাখো দ্যাখো মিনসের কাম দ্যাখো। কালকে কি ব্যাবসায় বেরোবে না গা আর? সবকিছু লাথ মারি ফ্যালি দিল গো। গোঁসা পোঁদে লাগেই থাকে।
উপুড় হয়ে সবজিগুলো জড়ো করছিল সখিনা।
বাপি গাঁক করে এক লাথি মারল তার কোমরে। সোজা করে এক লাথি মারল পেটে।
–উঃ মাগো! বলে কঁকিয়ে উঠল সখিনা, তারপরই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
–তোর কি শালী? আমি যা খুশি করব। বলে আরেকটা লাথি মারল সখিনার উপর।
বাপের জন্য পানি এনেছিল টুম্পা। বদনা হাত থেকে পড়ে গেল ভয়ে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে।
বাড়িটা থম মেরে পড়ে আছে। যেন ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে কিন্তু কিছু অজানা আশঙ্কায় ঘুম আসছে না, মটকা মেরে পড়ে আছে। বাড়ি বলতে ইটের পাঁচ ইঞ্চির কাদার গাঁথনির চার দেওয়াল আর উপরে শ্যাওলাধরা টালি। একখান দাওয়াও জোটেনি তাতে। ঘরের পরেই উঠান তারপরে সফিকুলদের ঘরের দেওয়াল। তার পাশে পুঁইগাছের মাচার নীচে বসে আছে বাপি। মাথাটা ঠান্ডা হচ্ছে না কিছুতেই। হবে কী করে! কিছুদিন বামুনপাড়া, কুলতলি, স্কুলপাড়া, সব কটা পাড়াতে গিয়ে দেখে কেউ না কেউ আগেই সবজি বিক্রি করে গিয়েছে। আজ ধরেছে হাতেনাতে। নতুন বাসস্ট্যান্ডে টোটো চালায় পিন্টু সে এসেছে সবজি নিয়ে। দিয়েছে শালাকে এক ঘুঁষি। সিভিলগুলো শালা মালখাওয়া পার্টি। তাকেই দিল উল্টে কয়েক ঘা। ঠোঁটের পাশ কেটে গেছে অল্প। দৃশ্যটা আবার সামনে আসতেই থুক করে থুথু ফেলল একদলা।
পিন্টু এল বিকেলবেলা। সঙ্গে আরও কিছু পার্টি অফিসের লোক। রফা হল। বামুনপাড়া আর কুলতলি তার। স্কুলপাড়া আর নতুন বস্তি বাপির।
এরপর থেকে পিন্টু প্রায় আসে বাপিদের বাড়ি। বাপি বেরিয়ে যায়। যদিও রফাতে এর কোনও উল্লেখ ছিল না।