সুব্রত রায়
লেখক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী
‘চিকিৎসা–সঙ্কট’
পরশুরামের নন্দকে মনে আছে? বেচারা নন্দ ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে কোঁচায় পা বেধে চিৎপাত। চোট লাগেনি কিছুই, কিন্তু ধনী ও বিপত্নীক নন্দর সান্ধ্যকালীন আড্ডার বন্ধুরা তা মানবে কেন! কাজেই, বন্ধুমহলের পরামর্শে একে একে চিকিৎসার হরেক রাস্তা পরখ করা শুরু হল তাঁর। চিকিৎসার অলিগলি বেয়ে বিস্তর ঘোরাঘুরি করে নন্দ শেষমেষ চার হাত এক করে বিপুলানন্দ হয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমান ‘সঙ্কট’ থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পাব তা নিয়ে এখনও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না! করোনা নিশ্চয়ই বিপদ, হাতুড়েপনার মহামারিটাও কি কম কিছু!
ভাইরাসটি ‘নভেল’; মাত্র তিন শতাংশ কি আরও কম মৃত্যুহার নিয়েও তা যে পরিমাণ আতঙ্ক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে আমাদের ঠেলে দিয়েছে, বছরের গোড়ায় তা আন্দাজ করা যায়নি। শত্রু অচেনা হলে লড়বার অস্ত্র নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতে পারে, সাময়িকভাবে হতচকিত হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। আবার, একই সঙ্গে, মজুত অস্ত্রের ধারভার খতিয়ে দেখা বা নতুন নতুন হাতিয়ার গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও তৈরি হয় শত্রুরই প্রচ্ছন্ন বদান্যতায়। অর্থাৎ মহামারি পরিস্থিতি আমাদের সামনে নতুন রোগ মোকাবিলায় পুরনো ওষুধপত্তরের কার্যকারিতা যাচাইয়ের সুযোগ যেমন এনে দিয়েছে, তেমনি নতুন নতুন গবেষণার রাস্তাও খুলে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগার থেকে করোনার টিকা নিয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষানিরীক্ষার খবর ভেসে আসছে। পুরনো ওষুধপত্তর নিয়ে গবেষণার খবরগুলিও মাঝেমধ্যে ঝিলিক দিচ্ছে। আশায় বুক বাঁধছে মানুষ। এরই মাঝে মুনাফাবাজরা তাদের ভুবনজোড়া ফাঁদ পেতে ফেলেছে, কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রীয় মদত পেয়ে তার বাড়বাড়ন্তের অন্ত নেই। উঠে আসছে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার নানান ‘অত্যাশ্চর্য’ দাবি। ভেসে আসছে শরীরকে ‘ভেতর থেকে প্রস্তুত’ রাখার রকমারি প্রলোভন। সর্বনাশেও কেউ কেউ পৌষমাসের গন্ধ পায়!
ওষুধ নেই, ইমিউনিটি আছে
মানবসভ্যতার ইতিহাসে কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারের বয়স খুব বেশি নয়, মেরেকেটে দেড়শো বছর। তার আগেও রোগভোগ ছিল, ছিল মড়কের কড়া নাড়া। গাঁয়ের পর গাঁ উজাড় হয়েছে। তবুও সভ্যতার নটেগাছটি মুড়োনো যায়নি। চিকিৎসায় এক-সময়ে মাথার খুলি কেটে অপদেবতাকে ছেঁটে ফেলার জাদু আর মন্ত্রতন্ত্রের দিন পেরিয়ে প্রকৃতিকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। রোগের বিরুদ্ধে মানুষের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল কিছু গাছগাছড়া ও খনিজের বিদ্যে। এইসব গাছগাছড়ার মধ্যে মাত্রই অতি অল্প কয়েকটি আজ আধুনিক চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ দিয়েছে, যদিও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অধিকাংশেরই জায়গা হয়েছে কেবলমাত্র ইতিহাসের পাতায়। তাহলে, আশ্চর্য হল এইটি যে, মানুষ কীভাবে টিকে ছিল অ্যাদ্দিন? একের পর এক মহামারি সামলে কীভাবে সম্ভব হল জীবনের ধ্বজাটিকে তুলে রাখা?
ওই ‘মারী নিয়ে ঘর’ করা সম্ভব হয়ে উঠল, কারণ মানুষের নিজের শরীরের মধ্যেই লুকোনো আছে এক দুর্দান্ত ‘অমৃতের টীকা’— বিভিন্ন বিভাগে ছড়িয়ে থাকা হরেক অস্ত্রে সজ্জিত অথচ এক নিটোল সমন্বয়ে পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকা নিষ্ঠাবান সেনাবাহিনী। মানবশরীরের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেই বলা হয় ‘ইমিউনিটি’, বাংলা প্রতিশব্দে যাকে বলে ‘অনাক্রম্যতা’। রোগজীবাণু শরীরে ঢুকলেই আমাদের অগোচরে সক্রিয় হয়ে ওঠে এই ব্যবস্থা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাইরে থেকে সাহায্যের দরকারই পড়ে না। কিন্তু কখনও কখনও এই প্রতিরক্ষাকে অতিক্রম করে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে। আমরা অসুস্থ হই। প্রয়োজন পড়ে বাইরে থেকে সাহায্যের। আর সেই আকাঙ্ক্ষিত সাহায্য যদি না পাওয়া যায়? যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগটা হয় নিতান্তই অচেনা? তাহলেও তো সেই আতঙ্কিত-ভাঙাচোরা শরীর দিয়েই যুঝতে হবে, এছাড়া উপায় কী!
আর এই আতঙ্কিত-উদ্বিগ্ন শরীরকে বাইরে থেকে বাড়তি সাহায্য করার ছদ্মবেশে হাজির হয় সংগঠিত মুনাফাবাজের দল। ‘ইমিউনিটি-বাণিজ্য’ বলতে পারি একে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নাগাদ, যখন ভারতে প্রথম দফার লকডাউনের মেয়াদ সদ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ‘immunity boosting’ শব্দবন্ধটি দিয়ে সার্চ করে দেখতে পাই ‘গুগল ক্রোম’ প্রায় ১ কোটি ৭৩ লক্ষ লিঙ্ক উগরে দিচ্ছে, যাদের বেশিরভাগটাই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এও এক অতিমারি বটে! অবশ্য করোনা-সঙ্কটে ‘ইমিউনিটি বাজার’-এর গুরুতর স্ফীতির তথ্য সামনে এলেও এর সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগে। ফ্রন্টিয়ার ইন মেডিসিন নামক জার্নালের জুলাই ২০১৯ সংখ্যায় এ বিষয়ে একটি চমৎকার গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘বুস্টিং দ্য ইমিউন সিস্টেম, ফ্রম সায়েন্স টু মিথ: অ্যানালিসিস দ্য ইনফোস্ফিয়ার উইথ গুগল’।[1] গবেষকরা ‘boost immunity’ শব্দবন্ধটির সাহায্যে গুগল-এ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রথম ২০০টি ইউআরএল-এ পাওয়া বিষয়বস্তু খুঁটিয়ে পড়েন ও প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো নোট করেন। প্রাপ্ত তথ্যগুলি বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। প্রথমেই শকিং তথ্যটি দিয়ে রাখা যাক। ওয়েবসাইটগুলোতে ইমিউনিটিকে ঠেলা মারার সর্বমোট ৩৭ রকমের উপায় পেয়েছেন গবেষকরা, এদের মধ্যে উল্লেখের প্রাবল্যের দিক থেকে সর্বমান্য টিকাদানের পদ্ধতিটি জায়গা পেয়েছে ২৭-তম স্থানে— মাত্র ১২ শতাংশ ওয়েবপেজে ইমিউনিটিকে সাহায্য করার জন্য টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তালিকার শীর্ষে থাকা দশটি বিষয় এরকম: ডায়েট (৭৭%), ফলমূল (৬৯%), ভিটামিন (৬৭%), অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট (৫২%), প্রোবায়োটিক (৫১%), খনিজ পদার্থ (৫০%), ভিটামিন সি (৪৯%), লাইফস্টাইল (৪৯%), হার্বাল মিশ্রণ (৪৫%) এবং ব্যায়াম (৪০%)। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, যেসব অসুখের মোকাবিলা করতে গিয়ে ইমিউনিটি বাড়ানোর দাওয়াই দেওয়া হচ্ছে, তার শীর্ষে আছে সংক্রামক ও শ্বাসযন্ত্রের অসুখ। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, প্রায় ৩০ শতাংশ ওয়েবসাইট ‘ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট’ বেচার জন্য সরাসরি বাণিজ্যিক ছলছুতোর আশ্রয় নিয়েছে। বিখ্যাত পদার্থবিদ লিনাস পাউলিং মনে করতেন, ভিটামিন সি খেলে সর্দি সেরে যায়। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীপ্রবরের এই ভিত্তিহীন বিশ্বাসটি কীভাবে যেন অন্যান্য সংক্রমণের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়ে ভিটামিন সি-কে অধিকাংশ ‘ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট’-এর আবশ্যিক উপাদান করে তুলেছে।
‘ইমিউনিটি বুস্টিং’
মোটরগাড়ির ক্ষেত্রে ‘ইঞ্জিন বুস্টিং’ কথাটির অর্থ হল ইঞ্জিনে বেশি করে বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা, যাতে আরও বেশি জ্বালানির আরও বেশি করে দহন ঘটানো যায়, ফলে ইঞ্জিন আগের চেয়ে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। গাড়ির ইঞ্জিনে বাড়তি ব্যবস্থা যোগ করে সহজেই ইঞ্জিনে এই ‘ঠেলা’-টা দেওয়া যায় এবং এভাবে কতটা দক্ষতা বাড়ল তা মাপা সম্ভব। কিন্তু শরীরের ‘ইমিউনিটি বুস্টিং’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? এটা বুঝতে হলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ-ক্ষমতা বা ‘ইমিউনিটি’ নামক একটি অত্যন্ত জটিল ব্যবস্থা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা থাকা দরকার। ইমিউনিটি প্রধানত দু-রকমের: অবিশেষ ও বিশেষ। অবিশেষ বা সহজাত ব্যবস্থা রোগজীবাণুনির্বিশেষে কোষকলায় ঢুকতে বাধা দেয় কিংবা ঢুকে পড়লেও নানাভাবে তাদের বের করে দেবার চেষ্টা করে। রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে অনু্প্রবেশকারীকে ধ্বংস করে, আগ্রাসী কোষের মাধ্যমে শত্রুকে গিলে নিয়ে, পরিপূরক প্রোটিন তৈরি করে কিংবা আক্রান্ত স্থানে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে এই ব্যবস্থায় রোগকে প্রতিহত করা হয়। আর বিশেষ বা অর্জিত ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট জীবাণুর জন্য নির্দিষ্ট ব্যবস্থা। শরীর এক্ষেত্রে দু-ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে: কোষনির্ভর ও অ্যান্টিবডি-নির্ভর ইমিউনিটি। টিকাকরণের সুফল হল, তা এই অ্যান্টিবডি-নির্ভর ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে জীবাণুটির স্মৃতি ধরে রাখে, যাতে বিপদের সময় বিশেষ জীবাণুটি মেরে ফেলতে সক্ষম অ্যান্টিবডি শরীরে তৈরি হতে পারে। তবে কোনও ব্যবস্থাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না, বরং অন্যান্য ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে বহুমুখী সমন্বয়ের মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারুভাবে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। অস্থিমজ্জা, রক্ত ও লসিকাতন্ত্র, কোষকলা, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন অংশের তৎপরতা ও নিটোল সমন্বয়েই মানবশরীরে ইমিউনিটি গড়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হল, ইমিউনিটিতে এই ‘ঠেলা’-টা লাগবে কীভাবে? ইমিউনিটি নামক জটিল ব্যবস্থার কোন অংশের ওপর সেটা কাজ করবে? তা ওই অংশের কী রকম পরিবর্তন ঘটাবে? ওই অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত অংশগুলি বা গোটা ব্যবস্থাটির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের ফল কেমন হবে? এ রকম অজস্র প্রশ্ন আছে। ‘বুস্টিং’-এর দাবিদারদের কিন্তু এ সব প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর জানা নেই। তবে একটা কথা বোধহয় বলাই যায় যে, ‘ইমিউনিটি বুস্টিং’ বলতে নিশ্চয়ই অপুষ্টি থেকে মুক্তি বোঝায় না, বরং বাড়তি কিছু বোঝায়। স্বাভাবিক অবস্থায় যা ইমিউনিটি থাকার কথা তার থেকে বেশি না হলে তাকে ‘বুস্টিং’ বলা হবে কেন? তাই কোনও বিশেষ জিনিসের উল্লেখ ছাড়া সাধারণভাবে সুষম খাবারদাবার গ্রহণের পরামর্শ, আর যাই হোক, নিশ্চয়ই ‘বুস্টিং’ নয়। সত্যি কথা বলতে, উনিশ শতকের শেষপাদ থেকে বিভিন্ন টিকার আবিষ্কার ছাড়া ইমিউনিটির বিভিন্ন অংশের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত গবেষণা সেরকমভাবে হয়নি বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। অর্থাৎ কীভাবে ইমিউনিটি বাড়ে, বা, আরও অর্থপূর্ণভাবে বললে, তা ‘বাড়াবার’ তাৎপর্যই বা কী, তাও আমাদের জানা নেই। ইমিউনিটি বাড়লেই কি শরীরের লাভ? বাড়তি ইমিউনিটি কি সংক্রমণ এড়াতে সাহায্য করে? এখনও পর্যন্ত এ প্রশ্নেরও নিশ্চিত উত্তর আমাদের অজানা। কতকগুলি চেনা দৃষ্টান্ত কিন্তু দেখায় যে, ইমিউনিটি বাড়িয়ে তুললে সুফলের চেয়ে কুফলের পাল্লা ভারী হয়ে উঠতে পারে। আমরা জানি যে, কারুর ইমিউনিটি যদি খুব দুর্বল হয়ে যায়, যেমনটি এইচআইভি বা ম্যালেরিয়া সংক্রমণের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে, তা সত্যিই ভয়ঙ্কর। সাধারণ অসুখেও শরীর যুঝবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আবার এর উলটো দিকটিও কিন্তু আদৌ সুখকর নয়। ইমিউনিটি অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠলে তা আমাদের শরীরের নিজস্ব কোষগুলিকেই নিশানা করতে শুরু করবে। বাড়তি ইমিউনিটি প্রদাহ তৈরির সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তোলে, যা কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী অসুখে পরিণত হয়। মৃদু অ্যালার্জিজনিত সমস্যা তো আছেই, এতে শরীরের রক্তবাহী ধমনীগুলিও ফুলে উঠতে পারে। দেখা গেছে যে, নিউমোনিয়ার জোরালো সংক্রমণ হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে, এক্ষেত্রে শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে ওঠা ইমিউনিটি রক্তবাহী নালীগুলিকে সঙ্কুচিত করে দেয়। কোভিড-১৯এর ক্ষেত্রেও আমাদের ইমিউনিটি ব্যবস্থার অতিসক্রিয়তার তথ্য জানা গেছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। ‘সাইটোকাইন ঝড়’ অর্থাৎ রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী কোষগুলির মধ্যে সমন্বয়রক্ষাকারী ও বার্তাবহ হিসেবে সাইটোকাইন অণুর অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে উদ্ভূত বাড়তি প্রদাহ আচমকা ফুসফুস ও অন্য একাধিক অঙ্গকে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সামনে দাঁড় করাচ্ছে, যা কখনও কখনও মৃত্যুকে ডেকে আনছে।[2] সুতরাং, ইমিউনিটিকে ঠেলাঠেলি করা আদৌ যদি বা সম্ভব হয়, তার পরিণাম কিন্তু খুব একটা কাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে।
আয়ুষ অপেরা
ইমিউনিটির বিশ্ব-বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে ভারতীয় তৎপরতা গোটা বিশ্বে অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে। সঙ্কটকালে সরকারিভাবে হাতুড়েপনাকে প্রোমোট করে বিপদ বাড়িয়ে তোলার এমন দৃষ্টান্ত আর কোনও দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০০২ সালে দেশের সরকার ভারতীয় সনাতন চিকিৎসার সঙ্গে আরও কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিয়ে একযোগে গঠন করে ‘আয়ুষ’ (AYUSH; A=Ayurveda, Y=Yoga-Naturopathy, U=Unani, S=Siddha, H=Homeopathy; কয়েক বছর আগে এতে Sowa-Rigpa নামক একটি বৌদ্ধ ঘরানার চিকিৎসাপদ্ধতিও যুক্ত হয়েছে)। ২০১৪ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অধীনে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি অবৈজ্ঞানিক ও বাতিলযোগ্য চিকিৎসাগুলির জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রক গঠিত হয়। পরে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় এগুলি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতেও জাঁকিয়ে বসে। উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত মহৎ সন্দেহ নেই— আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত এ দেশের সাধারণ মানুষকে আদৌ এইটা বুঝতে না দেওয়া যে, তারা বঞ্চিত হচ্ছে— এবং তাও আবার এদেশের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের নাম করেই!
জানুয়ারি মাসের শেষে, যখন করোনা সংক্রমণ চিনে ভালোমতন ছড়িয়ে পড়েছে, আয়ুষ দপ্তর একটি বিজ্ঞপ্তি[3] দিয়ে জানায় যে, হোমিওপ্যাথিক আর্সেনিকাম অ্যালবাম 30C হল করোনার প্রতিষেধক। এছাড়াও জানানো হয় যে, য়ুনানি পদ্ধতিতে হেকিমি দাওয়াই ব্যবহার করে করোনার লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ভারতে পৌঁছালে আয়ুষ স্পষ্টত অস্বস্তিতে পড়ে। মার্চ মাসের শেষদিকে দেশজোড়া লকডাউন পরিস্থিতিতে দেখা যায় যে, অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আয়ুষ দপ্তরটাই লকডাউনে চলে গেছে! ইতিমধ্যে কানাঘুষো শোনা যায় যে, চিন নাকি করোনার চিকিৎসায় আধুনিক ওষুধের পাশাপাশি সনাতন চৈনিক গাছগাছড়ার বিদ্যেও কাজে লাগিয়েছে। যদিও সে সবের কার্যকারিতা নিয়ে কোনও বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু এতে আয়ুষের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করে। আবার নড়েচড়ে বসে আয়ুষ মন্ত্রক (হাত গুটিয়ে বসে থাকা তাদের মর্যাদার পক্ষে নিঃসন্দেহে হানিকর ছিল); এবং, একই সঙ্গে, পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো যায় কিনা তা নিয়েও চিন্তাভাবনার অবকাশ তৈরি হয়। আয়ুষ দপ্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীপাদ নায়েক, যিনি অতীতে গোমূত্রের গুণগান করে যথেষ্ট ‘সুনাম’ অর্জন করেছিলেন, সারা দেশের আয়ুষ পদ্ধতির চিকিৎসকদের থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ আহ্বান করেন।[4] কয়েক দিনের মধ্যেই হোমিওপ্যাথ, কোবরেজ আর হেকিমদের নানান আজগুবি দাবিতে উপচে পড়ে পরামর্শের ডালি। এমনকি কেউ কেউ এমনও দাবি করে বসেন যে, ব্রিটেনের রাজকুমার আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি ব্যবহার করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন! ক-দিনের মধ্যেই অবশ্য ব্রিটেনের রাজপরিবারের মুখপাত্র এই খবরের সত্যতা অস্বীকার করেন। মন্ত্রীমশাই বেগতিক দেখে এর রাশ টেনে ধরতে বাধ্য হন।[5]
মার্চের শেষদিকে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক সেরে, যাতে আয়ুষ চিকিৎসকদের পাশাপাশি বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী পীযুষ গোয়েলও উপস্থিত ছিলেন, আয়ুষ দপ্তর করোনা চিকিৎসার এক ‘প্রোটোকল’ নির্মাণ করে, শিরোনাম ‘আয়ুর্বেদ’স ইমিউনিটি বুস্টিং মেজারস ফর সেল্ফ কেয়ার ডিউরিং কোভিড ১৯ ক্রাইসিস’।[6] কী আছে এতে? এতে আছে চ্যবনপ্রাশের মতো আয়ু্র্বেদিক ‘টনিক’, হার্বাল টি আর হলুদ গুঁড়ো মেশানো দুধ পান করার পরামর্শ। আছে নাকের ফুটোয় তৈলমর্দনের আর নারকেল-তিল তেলের সাহায্যে কুলকুচো করার নিদান। আছে গলাব্যথা হলে মধু বা পুদিনা ব্যবহারের কথা। এসব করলেই নাকি ‘বুস্ট’ হবে আমজনতার ইমিউনিটি। ৩১ মার্চ জারি হওয়া এই বিজ্ঞপ্তিটির শেষে অবশ্য খুব যত্ন করে দেওয়া আছে কথা ক-টি: ‘ডিসক্লেইমার: দ্য এবভ অ্যাডভাইসরি ডাজ নট ক্লেইম টু বি ট্রিটমেন্ট ফর কোভিড ১৯’! এইভাবে আয়ুষ ওষুধপত্তর দিয়ে করোনা সংক্রমণের চিকিৎসা করার জায়গা থেকে এক অনির্বচনীয় ডিগবাজি দিয়ে আমজনতার শরীরের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়েছে, ‘ইমিউনিটি বুস্টিং’ করতে বলছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে ছাত্রছাত্রীরা এইসব নিয়ম মেনে চলে। ধীরে ধীরে ‘ইমিউনিটি বুস্টিং’ হয়ে উঠেছে দেশবাসীর রোজনামচা, এক ‘জাতীয় কর্তব্য’। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গোটা বিষয়টি নিয়ে গোড়া থেকেই অত্যুৎসাহীর ভূমিকা পালন করেছেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে একাধিকবার দেশবাসীকে এই পবিত্র কর্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
১ এপ্রিল ২০২০ তারিখে প্রকাশিত এক নির্দেশিকায় আয়ুষ করোনা নিয়ে আয়ুর্বেদ, হোমিয়োপ্যাথি, য়ুনানি ইত্যাদির অবৈজ্ঞানিক দাবিগুলিকে নিয়ন্ত্রণের কথা ঘোষণা করে। এতে ওষুধ ও প্রসাধনী আইন, ১৯৪০-এর ৩৩পি ধারার উল্লেখ করে খবরকাগজ, টেলিভিশন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ‘বিকল্প’ পদ্ধতিতে করোনা সারানোর অপ্রমাণিত দাবি প্রকাশ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশিকার উপর ভিত্তি করে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া সব ধরনের মিডিয়ার উদ্দেশে জারি করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একই পরামর্শ দেয়।[7] কিন্তু এ ছিল করোনাপীড়িত দেশবাসীর প্রতি আয়ুষের নির্মম এপ্রিল ফুল! হোমিওপ্যাথ, কোবরেজ ও হেকিমদের তরফে অপ্রমাণিত দাবি করা চলতেই থাকে। দেশবিদেশের বিজ্ঞানীমহলের তীব্র আপত্তিতে আয়ুষ জানুয়ারি মাসের বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছিল। মার্চের গোড়ায় এ ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের চিফ সেক্রেটারিদের উদ্দেশে আয়ুষ মন্ত্রকের সেক্রেটারি রাজেশ কোটেচা লিখিত একটি নির্দেশিকা[8] নজরে আসে। এতে কার্যত পুরনো বিজ্ঞপ্তিটির সামান্য রদবদল করে দুটি সংযোজনীর আকারে একই বক্তব্য তুলে ধরা হয়। লক্ষ্য, দেশের আয়ুষ পদ্ধতি অনুশীলনকারীদের অস্বস্তিকর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা। প্রমাণিত ওষুধের অনুপস্থিতিতে সাময়িকভাবে অপ্রমাণিত যে কোনও ওষুধ ব্যবহারের নৈতিকতা প্রমাণের জন্য ২০১৪ সালে ইবোলা সংক্রমণের সময়কালীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি মতামত প্রথম সংযোজনীতে তুলে ধরা হয়, এবং, আগের মতোই আয়ুষের তরফে প্রতিষেধক ও লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় কয়েকটি ওষুধের নামের তালিকা পেশ করা হয়। এ থেকে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারি আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি, য়ুনানি, সিদ্ধা— সবেতেই নাকি করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসার একাধিক রাস্তা আছে! এই সংযোজনীটিতে পরিবেশিত বক্তব্যের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত তথ্যসূত্রগুলি দ্বিতীয় সংযোজনীতে দেওয়া হয় (আমরা এবার থেকে এ দুটি সংযোজনীকে যথাক্রমে সংযোজনী–১ ও সংযোজনী–২ বলে উল্লেখ করব)। এই দ্বিতীয় সংযোজনীটি বাস্তবিকই একটি ধাঁধা, কোন বই বা কোন গবেষণাপত্রের কোন অংশটির সাহায্যে কী দাবি করা হচ্ছে, তার কিছুই স্পষ্ট নয়। অবশ্য এই ঘোলাটেপনা আয়ুষ-এর কর্মকাণ্ডে নতুন কিছু নয়! বুঝ লোক যে জান সন্ধান…
এপ্রিলের গোড়াতে বিভিন্ন ‘বিকল্প’ পদ্ধতির কার্যকারিতা খতিয়ে দেখার জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়, যাতে আয়ুষ প্রতিনিধিদের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর), কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর), ডিপার্টমেন্ট অব বায়োটেকনোলজি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা যুক্ত হন। এই টাস্ক ফোর্সের সক্রিয়তায় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় বিভিন্ন ‘বিকল্প’ পদ্ধতির গবেষণা ও চিকিৎসার প্রোটোকল নির্মিত হয়। আয়ুর্বেদ প্রসঙ্গে আমরা এই টাস্ক ফোর্সের কথায় আবারও ফিরে আসব। এর পরই আমরা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আর্সেনিকাম অ্যালবাম 30C নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৎপরতা লক্ষ করতে থাকি। বিভিন্ন রাজ্যে মূলত রাজনৈতিক উদ্যোগে এই হোমিওপ্যাথিক সামগ্রীটি জনগণের মধ্যে গণহারে বিলিবাঁটোয়ারা শুরু হয়। সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিয়োপ্যাথি (সিসিআরএইচ) এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। আয়ুষ দপ্তরগুলি থেকে সরাসরি এবং তাদের অনুরোধে বিভিন্ন সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতে হোমিওপ্যাথি, য়ুনানি ইত্যাদি পদ্ধতি অনুশীলনকারীরা করোনা সংক্রমণে চিকিৎসা করার অনুমতি প্রার্থনা করে আবেদন করতে থাকেন। প্রথমে আদালত এতে আপত্তি জানালেও রাজনৈতিক সক্রিয়তায় বাধাগুলি ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে, বিশেষত বিকল্প চিকিৎসার প্রোটোকল নির্মাণ কাজটিকে সুগম করে তোলে। অন্যদিকে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনের ঘোষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে, আয়ুষ-এর অন্তর্গত বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে দেশে গবেষণা শুরু হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, সাধারণভাবে যে কোনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য একটি গবেষণা প্রকল্পকে যেভাবে বাধ্যতামূলকভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (সিটিআরআই)-য় নথিভুক্ত করতে হয়, আয়ুষ পদ্ধতিগুলির ক্ষেত্রে সেই নিয়মে ছাড় দেওয়া হয়েছে।[9] কিন্তু, কেন এই লুকোছাপা? কেন নিয়মের এই সচেতন ব্যত্যয় ঘটানো? কারণ একটাই, কোনও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাপদ্ধতিকে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক আতসকাচের নিচে ফেলে তার হাড়মজ্জাকে স্পষ্ট করে তুললে স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে তার অপসারণের ভবিতব্য এড়ানো যাবে না, বর্তমান রাজনৈতিক ইচ্ছার কাছে যা একেবারেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা এই প্রসঙ্গে আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি নিয়ে কিছু আলোচনা করব। ভারতে মহামারি মোকাবিলা ও ইমিউনিটি প্রসঙ্গে এই পদ্ধতি দুটির কথা বারেবারেই উঠে আসছে, এ ব্যাপারে সত্যিই কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা তা বুঝে নেওয়া দরকার।
আয়ুর্বেদই আয়ুষ্কর?
একথা সত্যি যে, আয়ুর্বেদের সময়ে তা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের চিকিৎসার চেয়ে অনেকখানিই এগিয়ে ছিল, অন্তত দার্শনিকভাবে। আমাদের দেশের দিক থেকে দেখলেও, রোগ উপশমে অথর্ববেদের নিদান মেনে দেবদেবীর আরাধনা, যাগযজ্ঞ ইত্যাদি থেকে প্রাকৃতিক উপাদানকে চিকিৎসায় ব্যবহার করার আয়ুর্বেদীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছানো নিঃসন্দেহে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক উল্লম্ফন। কিন্তু আজকের দিনে আয়ুর্বেদ ব্যবহারের আর কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। সংক্ষেপে কারণগুলি মোটামুটি এরকম:
(১) প্রাচীন কোনও চিকিৎসার কার্যকারিতাই আমাদের আজকের বৈজ্ঞানিক মাপকাঠিতে প্রমাণিত নয়। যে সব জটিল ও দীর্ঘ পদ্ধতিতে আজকের দিনে কোনও বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি বা ওষুধের রোগারোগ্যের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়, সেসব প্রাচীনকালে আদৌ জানা ছিল না, এবং সে সময়ের চিকিৎসকেরা তাঁদের নিজস্ব অপ্রমাণিত বিশ্বাস অনুযায়ীই বিধান দিতেন। সে বিশ্বাসের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক নেই, এবং শুধুমাত্র প্রাচীন কোনও গ্রন্থে বলা আছে বলেই আজকের দিনে তা বেচারা রোগীর ওপর প্রয়োগ করতে হবে— এ এক হাস্যকর আবদার বলেই ধরতে হবে।
(২) বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্ব: রোগ কেন হয় তা যতদিন সঠিকভাবে জানা ছিল না, ততদিন নানান মনগড়া বিষয় দিয়ে অসুস্থতাকে ব্যাখ্যা করা হত। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল শরীরের বিভিন্ন বাস্তব বা কাল্পনিক উপাদানের ভারসাম্যহীনতার তত্ত্ব। গ্রিক রসতত্ত্ব বা চিনা ইয়াং-ইন্ তত্ত্বের মতোই আয়ুর্বেদে বায়ু-পিত্ত-কফের ভারসাম্যহীনতাকে রোগের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। আজকে একে অর্থহীন বলে আমরা বুঝতে পেরেছি, বিশেষত শরীরের ওই তিনটি উপাদানের শারীরবৃত্তীয় ভূমিকার সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আর আমাদের অজানা নেই।
(৩) অবাঞ্ছিত ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা: গাছগাছড়ায় রোগ সারানোর উপাদান অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু অবিকৃতভাবে ভেষজ উপাদান খেয়ে নিলে শরীরে অনেক অবাঞ্ছিত জিনিস ঢুকে পড়ে, যাদের শারীরবৃত্তীয় ভালো-মন্দ আমাদের জানা নেই। তার চেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে উপাদানটিকে আলাদা করে নেওয়া। কিংবা, আরও ভালো হয়, যদি কৃত্রিমভাবে তা সংশ্লেষিত করা যায়।
(৪) মাত্রার প্রশ্ন: সর্পগন্ধার নির্যাস খেলে রক্তচাপ কমতেই পারে, কিন্তু কতটা আরক খেলে রক্তচাপ কতখানি নামবে, তার হিসেব কীভাবে করা যাবে? কোন গাছের কোন অংশের কী পরিমাণ রসে কতখানি রেসারপিন থাকবে, তার কোনও প্রামাণ্য হিসেব হয় না যে!
(৫) বিজ্ঞান থেমে থাকে না। চিকিৎসাও আয়ুর্বেদের যুগকে অনেককাল আগেই পেরিয়ে এসেছে। এর সদর্থক জ্ঞানটুকু ইতিমধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আজকে যদি কোনও গাছগাছড়ার মধ্যে করোনা চিকিৎসার উপযোগী কোনও উপাদান পাওয়া যায়, তা আধুনিক বিজ্ঞানের হাত ধরেই চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর জন্য আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণের কোনও প্রয়োজন নেই। স্বদেশের অতীত খুঁড়ে কেউ আত্মশ্লাঘা বোধ করতেই পারেন, তাতে হয়তো বা খুব বেশি দোষের কিছু নেই। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যনীতি তাকে আঁকড়ে ধরলে বুঝতে হবে যে, গোলযোগটা ঘটছে অন্যত্র!
চ্যবনপ্রাশের কথাই ধরা যাক। এই কোবরেজি ‘টনিক’-টিতে কমবেশি ৪০টি গাছগাছড়ার নির্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উপরন্তু, বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রস্তুত চ্যবনপ্রাশ স্বাদে-গন্ধে হুবহু এক হয় না, কারণ এগুলিতে গাছগাছড়ার যেমন ভিন্নতা আছে তেমনি তাদের পরিমাণেও তারতম্য আছে। আর একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে দেখতে পাব, চ্যবনপ্রাশের মধ্যে উপাদান হিসেবে উপস্থিত রয়েছে অন্তত কয়েক হাজার রাসায়নিক পদার্থ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, এই রাসায়নিকগুলির মধ্যে এক বা একাধিক উপাদান ইমিউনিটিকে সাহায্য করার উপযোগী, তাদের চিহ্নিত করা সহজ নয়। এ ছাড়াও, চ্যবনপ্রাশে উপস্থিত বাকি পদার্থগুলির শারীরিক প্রভাব যেহেতু আমাদের জানা নেই, তাদেরকে শরীরে গ্রহণ করলে বাড়তি কোনও লাভ হচ্ছে না কিন্তু অনির্ণীত ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে। কাজেই, ওইসব বাড়তি পদার্থগুলিকে অবাঞ্ছিত বিবেচনায় সরিয়ে দেওয়া দরকার। এরপর আসছে, ইমিউনিটির উপরে কার্যকর উপাদানগুলির ক্রিয়াপদ্ধতির ব্যাখ্যা হাজির করার প্রশ্ন। এসব কারণেই আয়ুর্বেদ নিয়ে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক গবেষণা যেমন সমস্যাসঙ্কুল, তেমনি আযুর্বেদীয় সামগ্রীর গুণমান নির্ণয়ের কাজটিও ততখানিই দুঃসাধ্য। ভারতে আয়ুর্বেদ, য়ুনানি ও সিদ্ধা ওষুধের গুণমান নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ ও প্রসাধনী আইন, ১৯৪০-এর ৩৩ই ৩৩ইই, ৩৩ইইএ ধারায় যা বলা আছে, তা আধুনিক ওষুধের ক্ষেত্রে ১৭, ১৭এ ও ১৭বি ধারাগুলির সঙ্গে তুল্যমূল্য। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং ভেষজ ওষুধের নিজস্ব প্রকৃতির কারণে তা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়সাধ্য ও সময়সাপেক্ষও বটে। এক-একটি গাছগাছড়াকে অবিকৃত অবস্থায় হয়তো চেনা সম্ভব, কিন্তু একাধিক গাছগাছড়াকে পেষাই করে ক্কাথ বানিয়ে মিশিয়ে দিলে, তাদের আলাদা করে শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। রাসায়নিক উপাদানের হিসেবনিকেশের কথা না হয় তোলাই থাক!
২১ এপ্রিল আয়ুষ-এর টাস্ক ফোর্স করোনা মোকাবিলায় কয়েকটি ভেষজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য গবেষণা প্রকল্প আহ্বান করে। এই আহ্বানটি মাত্র ৯ দিন উন্মুক্ত ছিল এবং আবেদনের শর্ত ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলিও বায়োমেডিক্যাল রিসার্চের দিক থেকে বিবেচনা করলে অত্যন্ত অযৌক্তিক[10]: (১) গবেষণাটি ৬ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে; (২) গবেষণাখাতে সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হবে; (৩) গবেষণার ফলাফলকে কোনও ‘পিয়ার রিভিয়্যুড জার্নাল’-এ প্রকাশ করা হবে কিনা এবং সংগৃহীত তথ্য অন্যান্য নিরপেক্ষ গবেষকদের সরবরাহ করা হবে কিনা, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য কোথাও করা হয়নি; (৪) উপরন্তু, ট্রায়ালগুলিকে সিটিআরআই-এও নথিভুক্ত করা হবে না। ফলে গবেষণাগুলির গুণমান ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
বর্তমান রচনার গোড়ার দিকে ফ্রন্টিয়ার অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত যে গবেষণাপত্রটির উল্লেখ করেছিলাম, তাতে দেখা যাচ্ছে আয়ুষ দপ্তরের মতোই ৪৫ শতাংশ ওয়েবসাইট ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য হার্বাল মিশ্রণ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে, এছাড়া ডায়েটারি সাপ্লিমেন্টের মধ্যেও নানা ভেষজ ব্যবহৃত হয়। এখন প্রশ্ন হল, এ নিয়ে কি সত্যিই কোনও প্রামাণ্য গবেষণা আছে, যা থেকে আমরা মানবশরীরে গাছগাছড়ার ইমিউনিটি বাড়াবার ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি? এর স্পষ্ট উত্তর হল, নেই। গবেষণা যা আছে, তা থেকে কিছু ভেষজের ভাইরাসনাশক ক্ষমতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও নিশ্চিতভাবে কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।[11] গোটা ইমিউনিটি ব্যবস্থার দিক থেকেও স্পষ্টভাবে এর উপযোগিতা নির্ণীত হয়নি। এর মধ্যে আবার অনেক গবেষণাই পদ্ধতিগত দুর্বল ডিজাইনের কারণে বিজ্ঞানীমহলে সমালোচিত হয়েছে। সংযোজনী–২ এ ব্যাপারে যে যে তথ্যসূত্র দিয়েছে, তাতে গুলঞ্চের মতো কিছু ভেষজ নিয়ে কিছু গবেষণার উল্লেখ আছে। এদের অনেকগুলি মনুষ্যেতর প্রাণীদের নিয়ে সংঘটিত গবেষণা, আবার কোনও কোনওটি মানবশরীরে প্রযুক্ত হলেও গবেষকরাই মেনে নিচ্ছেন যে, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়।[12]
মহামারিতে হোমিওপ্যাথির ‘সাফল্য’ ও আর্সেনিকামের কিস্সা
সাম্প্রতিক মহামারিতে ভারতে হোমিওপ্যাথি খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে। এমনকি, অতীত খুঁড়ে মহামারির ইতিহাসে হোমিওপ্যাথির ‘ঊজ্জ্বল’ ভূমিকাও এর প্রবক্তা ও সমর্থকরা উৎসাহের সঙ্গে তুলে ধরছেন। সংযোজনী–১ এও একই রকম দাবি করা হয়েছে।[13] সাধারণভাবে এই ঐতিহাসিক দাবিটি নিয়ে ও নির্দিষ্টভাবে আর্সেনিকাম অ্যালবাম 30C বিষয়ে আলোচনা করার আগে হোমিওপ্যাথি নিয়ে কয়েকটি গোড়ার কথা বলে নেওয়া দরকার।
হোমিওপ্যাথিতে নির্দিষ্ট রোগ বলে কিছু হয় না। ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রোগলক্ষণচিত্রটি মিলিয়ে যে ছবিটি ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে মেটিরিয়া মেডিকায় আগে থেকে অন্তর্ভুক্ত ভেষজের উপসর্গচিত্রটি (সুস্থ শরীর থেকে প্রাপ্ত) পুঙ্খানুপঙ্খভাবে মিলিয়ে রোগের ওষুধ নির্বাচিত হয়। ফলে হোমিওপ্যাথিতে ক্যানসার থেকে এইডস— কিছুই যেমন অনিরাময়যোগ্য নয়, তেমনি মহামারি পরিস্থিতিতেও সকলের জন্য একই ওষুধ নির্বাচিত হওয়ার কথা নয়! ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়েও আমরা হোমিওপ্যাথিকে তা সারিয়ে তোলার দাবি করতে দেখেছি। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন যে, করোনা প্রতিরোধে নির্বিচারে আর্সেনিকাম অ্যালবাম-এর প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর হোমিওপ্যাথির কিছু শিক্ষক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার এই ব্যক্তিসাপেক্ষতার কথা ক্ষীণস্বরে বলবার চেষ্টা করেছিলেন।
ইতিহাস জানে যে, হোমিওপ্যাথিতে এক সময়ে জীবাণুর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছিল। এমনকি, রোগে জীবাণুর ভূমিকা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও হোমিওপ্যাথদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, জীবাণুরা রোগের কারণ নয়, রোগের ফলাফল— এরা নাকি রোগ সারাতে আসে! হোমিওপ্যাথদের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ হল, হোমিওপ্যাথির জন্মদাতা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে শেষ কথাটি বলে গিয়েছেন এবং তিনি জীবাণু সম্পর্কে জানতেন না। এই প্রসঙ্গে একটি ভয়াবথ তথ্যও দিয়ে রাখা যাক যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন ‘বিকল্প’ চিকিৎসার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হোমিওপ্যাথি টিকাকরণের যে বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছিল, তা কয়েকটি দেশে আজও অব্যাহত আছে।[14][15] আজকে ভাইরাসঘটিত রোগের আলোচনায় হোমিওপ্যাথির প্রাসঙ্গিকতা খতিয়ে দেখতে হলে, এই গোড়ার কথাগুলি প্রথমেই জেনে রাখা দরকার।
উনিশ শতকে প্রাদুর্ভাব ঘটা বিভিন্ন মহামারি নিয়ে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই এটি স্পষ্ট যে, প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় হোমিওপ্যাথির ‘সাফল্যের’ হার তুলনায় বেশ ভালো।[16] কিন্তু এ থেকে কি এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, মহামারি মোকাবিলায় হোমিওপ্যাথি একটি কার্যকর চিকিৎসা? তথ্যগুলি আপাতভাবে আমাদের ওরকম ভাবিয়ে তুলতে পারে, কিন্তু যৌক্তিকভাবে কখনোই এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। কারণগুলি একে একে ব্যাখ্যা করা যাক:
(১) কোনও চিকিৎসাপদ্ধতি বা ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য চিকিৎসা বা ওষুধটিকে নিয়ন্ত্রকের বিপরীতে রেখে পরীক্ষা করতে হয়। এই ধরনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার উদ্দেশ্য হল, ওষুধের রোগ সারানোর নির্দিষ্ট ক্ষমতার বাইরে থাকা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত অনির্দিষ্ট মনোশারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবগুলিকে হিসেব থেকে বাদ দেওয়া। উনিশ শতকে কোনও চিকিৎসার কার্যকারিতাকে এভাবে বিচার করা হত না। ওই পরিসংখ্যানগুলিতে হোমিওপ্যাথিকে তুলনা করা হয়েছে সমকালীন চিকিৎসার সঙ্গে। ফলে এতে সমকালীন চিকিৎসার তুলনায় হোমিওপ্যাথিকে ভালো বলে বোঝা গেছে, কিন্তু রোগ সারানোর ব্যাপারে এর সত্যিকারের ক্ষমতা যাচাই হয়নি। অবশ্য মহামারি পরিস্থিতিতে এরকম না করে উপায়ও ছিল না। আর মুশকিলটা হয়েছে ওই জায়গাতেই। আমরা যে সময়কার কথা আলোচনা করছি, সেই উনিশ শতকে প্রচলিত চিকিৎসা যা ছিল, তাকে হাতুড়েপনা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। সত্যি কথা বলতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের সত্যিকারের জ্ঞান রোগীর ওপরে প্রয়োগ করার কায়দাকানুন তখনও আমাদের আয়ত্তে আসেনি। রোগের কারণ হিসেবে ইউরোপে তখনও গ্রিক রসতত্ত্ব চালু থাকায় যে কোনও রোগেই রক্তদুষ্টি কল্পনা করে শরীর থেকে রক্ত বের করে নেওয়া হত এবং নানা রকমের উত্তেজক ওষুধ অতি-উচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করার চল ছিল। কাজেই, রোগ-জর্জরিত শরীরকে হোমিয়োপ্যাথি সাহায্য করুক বা না-করুক, নিঃসন্দেহে মূলধারার ‘নৃশংসতার’ হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। কোনও পদ্ধতি দ্বারাই অচিকিৎসিত ছিলেন, এরকম রোগীদের নিয়ে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে, এদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল হোমিওপ্যাথিক মৃত্যুহারের খুব কাছাকাছি।[17]
(২) প্রচলিত চিকিৎসার হাসপাতালগুলির সঙ্গে হোমিওপ্যাথিক হাসপাতালগুলিও অনেক বিষয়ই তুল্যমূল্য ছিল না। ব্রিটেনে ১৮৫৪ সালের কলেরা মহামারির ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির ‘সাফল্যের’ পেছনে ব্রিটেনের অভিজাত মহলে এর জনপ্রিয়তা অর্থাৎ রোগী হিসেবে ধনী লোকদের পাওয়া ছিল অন্যতম কারণ। ফলে কলেরা সংক্রমণের পূর্বে রোগীদের শারীরিক অবস্থা ও রোগ সংক্রমণের অব্যবহিত পরে রোগীদের পরিচর্যার কথা বিচার করলে হোমিওপ্যাথিক হাসপাতালগুলি অনেকখানি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। এছাড়াও, হোমিওপ্যাথিক হাসপাতালগুলির পরিবেশ ছিল অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর এবং সেখানে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কলেরাবিধ্বস্ত ‘শুকনো’ শরীরকে চাঙ্গা করার জন্য রোগীকে প্রচুর জল পান করানো হয়েছে, যাতে কখনও কখনও লবণ মেশানো থাকত— এমন তথ্যও পাওয়া যায়।[18]
(৩) আজকে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, ঐতিহাসিক কালের ওই মহামারিগুলিতে প্রচলিত চিকিৎসা ও হোমিওপ্যাথি উভয় ব্যবস্থার তরফ থেকে যে ওষুধপত্তর প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাতে রোগগুলির নিরাময় ঘটা সম্ভব ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, উনিশ শতকের মূলধারার চিকিৎসায় ব্যবহৃত আফিম, ব্রান্ডি, মারকিউরাস ক্লোরাইড, ক্যাস্টর অয়েল সহযোগে রক্তমোক্ষণ বা কোষ্ঠশোধনের উৎকট পদ্ধতি কলেরা নিরাময়ে যেমন সফল হওয়ার কথা নয়, তেমনি সফল হওয়ার কথা নয় হ্যানিম্যান নির্দেশিত camphor, veratrum কিংবা cuprum-এরও। এগুলি কলেরা রোগীকে কোনওভাবেই সাহায্য করে না। এখানে একটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার যে, ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক উইলিয়াম ব্রুক ও’শানেসি ল্যানসেট পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, তিনি কলেরার রোগীর শিরার মধ্যে লবণমিশ্রিত ঈষদুষ্ণ জল ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে চিকিৎসা করেছেন। বিষয়টি স্কটিশ চিকিৎসক টমাস লাট্টার মনে ধরে। তিনি এই পদ্ধতিকে পরের বছর থেকে অনুসরণ করতে শুরু করেন, কিন্তু বিষয়টি চিকিৎসক মহলে জনপ্রিয় হতে অনেকখানি সময় লেগে যায়। বস্তুত, ১৮৫৪ সালের মহামারির সময়েও এই পদ্ধতি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। এমনকি, ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন স্নো কলেরার কারণ হিসেবে দূষিত জলকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেও, তা ‘ভিক্টোরিয়ান’ ব্রিটেনে তা নজর কাড়তে ব্যর্থ হয়।[19]
কাজেই, মহামারিতে হোমিওপ্যাথি নিয়ে হোমিওপ্যাথদের তরফে যা প্রচার করা হয়, যুক্তি হিসেবে তা শক্তপোক্ত নয়। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে হোমিওপ্যাথি কতখানি কার্যকর, তা জানার জন্য আমরা এ ব্যাপারে সর্বোৎকৃষ্ট তথ্যটি হাজির করতে পারি। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ন্যাশনাল হেল্থ অ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (এনএইচএমআরসি) ৬১টি রোগাবস্থার জন্য বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উঁচু মানের প্রাসঙ্গিক গবেষণার তথ্যকে বিশ্লেষণ করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে যে, স্বাস্থ্যের এমন কোনও অবস্থা নেই, যার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতার নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।[20] বলা বাহুল্য, ইমিউনিটির সঙ্গেও হোমিওপ্যাথির কোনও সম্পর্ক অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
হোমিওপ্যাথি বিষয়ে সংযোজন–২এ মোট চারটি তথ্যসূত্র দেওয়া হয়েছে।[21] এদের মধ্যে একটি হল হোমিওপ্যাথি সংক্রান্ত একটি বই (পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ নেই), এটি দেখার সুযোগ না হলেও নাম দেখে বোঝা যায় যে, আর্সেনিকামকে নির্দেশ করে এটি লেখা হয়নি। অন্যগুলির মধ্যে দুটি ইনফ্লুয়েঞ্জা চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রয়োগ সংক্রান্ত গবেষণা; অবশ্য ১৯২১ সালের যে লেখাটিকে এতে জায়গা দেওয়া হয়েছে সেটিকে গবেষণা না বলে জনৈক হোমিওপ্যাথের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলাই শ্রেয়। পড়ে থাকা সূত্রটিতে উল্লিখিত গবেষণায় আর্সেনিকাম অ্যালবামের কার্যকারিতা নিয়ে কিছু তথ্য আছে, তা সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি (সিসিআরএইচ)ও নানা সময়ে তুলে ধরেছে। এই গবেষণাপত্রটি হোমিওপ্যাথির একটি জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।[22] এখানে এ নিয়ে দু-চার কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, গবেষণাটিতে অনেকগুলি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গবেষণার তথ্য একত্র করে এর ‘কার্যকারিতার’ সম্ভাব্য ক্রিয়াপদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে আর্সেনিকাম নিয়ে গবেষণার সংখ্যা ৪টি। দুটি হল আর্সেনিকাম প্রয়োগে গমবীজের বৃদ্ধি সংক্রান্ত গবেষণা, অন্য দুটি আর্সেনিকাম দিয়ে আর্সেনিক বিষের মোকাবিলা সংক্রান্ত গবেষণা— যথাক্রমে ই কোলাই ব্যাকটিরিয়া ও ইস্ট ছত্রাকের উপরে। সুতরাং কোনওভাবেই তাকে মানবদেহে ভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। দ্বিতীয়ত, গবেষণার মূল দাবিটি হল, একটি ব্যাকটিরিয়া, একটি ছত্রাক ও গমবীজের ক্ষেত্রে জিনকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে বাইরের বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়। টক্সিকোলজিতে এই ধরনের বিষয়কে বলে হর্মেসিস। হর্মেসিস (hormesis) নামক ঘটনাটি দিয়ে যা বোঝানো হয় তা হল, কোনও কোনও বিষাক্ত পদার্থ অধিক মাত্রায় ক্ষতিকর হলেও কম মাত্রায় কখনও কখনও শরীরে উপকারী প্রভাব তৈরি করতে পারে। হর্মেসিস আসলে বিষ বা রেডিয়েশন সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝবার উপযোগী এক ধরনের অরৈখিক জৈবনিক প্রতিক্রিয়াবিশেষ। ধারণাটি জীবদেহে পরিবেশ দূষণগত প্রভাবকে বোঝবার জন্য টক্সিকোলজি ও রেডিয়েশন জীববিদ্যার গবেষণায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এখনও তা অত্যন্ত শৈশবস্থায় রয়েছে। একে মানব ফিজিওলজি বা হোমিওপ্যাথির ব্যাখ্যা জোগানোর কাজে টেনে আনার মধ্যে চাতুরি থাকতে পারে, যৌক্তিকতা কিছু নেই এবং তা করোনা মোকাবিলায় আর্সেনিকাম প্রয়োগকে কোনওভাবেই সমর্থন জোগাচ্ছে না! আয়ুষ অবিজ্ঞানকে প্রোমোট করার জন্য কতটা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে, তা এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। মূল ভেষজকে পাতলা করে হোমিওপ্যাথিতে যেভাবে ওষুধ বানানো হয়, তাতে আর্সেনিকাম আ্যালবাম 30C-এর মধ্যে বাস্তবে দ্রাবক ছাড়া কোনও পদার্থেরই অণু থাকার কথা নয়। কাজেই, শরীরে এর কোনও প্রভাব থাকার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য।
‘ইমিউনিটি বাণিজ্য’ ও রাষ্ট্রের জনবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি
অনেকে হয়তো জানেনই না যে, মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনী প্রতারণা ও মিথ্যাচার নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারতে আইনকানুন আছে, এ ধরনের বিজ্ঞাপন সরকারের গোচরে আনার জন্য আছে স্বশাসিত সংস্থাও। তবে এ ব্যাপারে আমজনতাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। টিভি আর খবরকাগজে অহরহ প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের রমরমা দেখতে ভারতবাসী অভ্যস্ত। বিজ্ঞাপনের দৌলতে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, হেলথ ড্রিঙ্কসের সাহায্যে শিশুরা তরতরিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, বিশেষ বুদ্ধিবর্ধক ফর্মুলার সাহায্যে বানানো আরক খাইয়ে বাচ্চাকে আইনস্টাইনে পরিণত করা যায়, বিশেষ তেল মাথায় নিয়মিত ব্যবহারে টেকো লোকও নবকার্তিক হয়ে ওঠে, বিশেষ ক্রিমের মাহাত্ম্যে ষাটোর্ধ বৃদ্ধাকেও লাগবে পাশের বাড়ির টিনএজার মেয়েটির মতো!
উপভোক্তার অজ্ঞতাকে পুঁজি করে এইসব বিজ্ঞাপনী প্রতারণার বাজারটি শরীরস্বাস্থ্যের ব্যাপারে বেশ চওড়া। করোনা মহামারির কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার আবহে সুযোগসন্ধানীরা যথারীতি আসরে নেমে পড়েছে। হ্যান্ডওয়াশ আর স্যানিটাইজারের বাজারে ঢেউ উঠেছে, ঢেউ উঠেছে হেল্থ ড্রিঙ্কসের বাজারেও; প্রত্যেকেই তাদের প্রোডাক্টটি কত সহজে ভাইরাসকে কাবু করতে পারে বা রুখে দিতে পারে, তার হিসেব পাড়তে শুরু করেছেন। গুঁড়ো মশলার প্যাকেটেও আজকাল ইমিউনিটির হিসেবনিকেশ খোদাই করা থাকছে। আর ‘বিকল্প’ চিকিৎসাগুলির পালে লেগেছে উদ্দাম হাওয়া, রাষ্ট্রীয় স্নেহচ্ছায়ায় তাদের ছটফটানি এখন দেখে কে! কতজনই বা জানতেন যে, তাদের পরিচিত দুধ-হলুদ আর চ্যবনপ্রাশ দিয়ে এমন ‘কামাল’ সম্ভব! কিংবা জানতেন যে, পড়শি হোমিওপ্যাথের বিষণ্ণ চেম্বারের পুরনো কাঠের আলমারিতে সুরক্ষিত হোমিওপ্যাথির গুলিতেই রয়েছে করোনা মোকাবিলার ‘অব্যর্থ’ উপায়! ‘সিদ্ধা’ নামে আদৌ যে ভারতে এক চিকিৎসাপদ্ধতি আছে, এটাই বা ক-জনের জানা ছিল? গতকয়েক দিনে আমরা অনেকেই ‘কাবাসুরা কুড়িনীর’-এর নাম জেনে ফেলেছি। ঘরে ঘরে এখন হলুদ মেশানো দুধ আর রসুনের কোয়া খেয়ে ইমিউনিটি ‘বাড়াবার’ ধূম লেগেছে। গঙ্গাজল আর গোবর মাহাত্ম্যের কথা আর নাই বা তুললাম!
খবরে প্রকাশ যে, অ্যাডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ড্স কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এএসসিআই), যে সংস্থাটি ভারতবাসীকে বিজ্ঞাপনী প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত, কেবলমাত্র বিকল্প চিকিৎসার তরফে অন্তত ৫০টি আপত্তিজনক বিজ্ঞাপন খুঁজে পেয়েছে। তাও এটি কেবল এপ্রিল মাসের হিসেব। আলাদাভাবে উল্লেখ করার যে, আর্সেনিকাম অ্যালবাম 30C সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনকেও এএসসিআই আপত্তিজনক বলে সাব্যস্ত করেছে।[23] কিন্তু, এই পর্যন্তই!
বর্তমান মহামারি পরিস্থিতি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল চিত্রটি বেআব্রু করে দিয়েছে, কিন্তু সরকারের তরফে এটি মেনে নিতেই তীব্র অনীহা। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির মাত্র ১ শতাংশে নামিয়ে আনলে রুটিন কাজকর্ম চালানোই মুশকিল হয়ে পড়ে, তা মহামারি পরিস্থিতি সামাল দেবে কীভাবে? তাই, ‘ইমিউনিটি বাণিজ্যের’ পেছনে কোনও ‘বিজ্ঞান’ না-থাকলেও এ নিয়ে সরকারি চিত্রনাট্যটি সন্তর্পণে নির্মাণ করতে হয়। এই সঙ্কটকালেও, বরাবরের মতোই, রাষ্ট্রের জনবিরোধী রাজনীতি সাধারণের মুখে চিকিৎসার ‘বিকল্প’ চুষিকাঠিটি গুঁজে দিয়ে সকলের জন্য সমমানের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ন্যায্য দাবিটিকে পিষে মারতে চায়। শাসকরা বিজ্ঞান বোঝেন না তা নয়, না বুঝলে হোমিওপ্যাথি-কোবরেজি-হেকিমির এইসব দাবিকে শিরোধার্য করে নিতেন ও দেশের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার পরিকাঠামো ভুলুণ্ঠিত করে রাজাগজাদেরও বিপদ ডেকে আনতেন। ‘বিকল্প’ চিকিৎসাকে তাঁরা সত্যিই বিপত্তারণ বলে ভাবলে মহামারি মোকাবিলার সমস্ত দায়িত্ব এর কাঁধেই তুলে দিতে বিলম্ব করতেন না। কিন্তু তাঁরা তা করছেন না, কেবল মূর্খ জনগণের জন্য অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে এগিয়ে দিচ্ছেন। কে সাহস করে বলবে যে, তাঁরা বিজ্ঞান বোঝেন না?
হ্যাঁ, বিজ্ঞানটা তাঁরা নিশ্চয়ই বোঝেন। তবে কিনা, প্রতারণা আর শোষণের অঙ্কটা হয়তো বা আরও ভালো বোঝেন!
[1] Cassa Macedo A, Oliveira Vilela de Faria A and Ghezzi P (2019): ‘Boosting the Immune System, From Science to Myth: Analysis the Infosphere With Google’, Front. Med., 6:165. doi: 10.3389/fmed.2019.00165
[2] Ragab D, Salah Eldin H, Taeimah M, Khattab R and Salem R (2020): ‘The COVID-19 Cytokine Storm; What We Know So Far’, Front. Immunol., 11:1446. doi: 10.3389/fimmu.2020.01446
[3] PIB (2020): ‘AYUSH Advisory for Corona virus: Homoeopathy for Prevention of Corona virus Infections, Unani Medicines useful in symptomatic management of Corona Virus infection’, Posted on: 29 Jan 2020 10:29AM by PIB Delhi, Release ID: 1600895
[4] Ministry of AYUSH (2020): Covid-19 Inputs. http://ayush.gov.in/covid-19-inputs?fbclid=IwAR3Ila-mdesAzJcpI76VoYz-XUY_jn_s2cLKnKxFumgF5BGqAnosekfX6vw [accessed 3 Apr 2020] [Dead Link]
[5] Pandey, Neelam (2020): ‘Heard Charles took Ayurveda treatment: Minister seeks evidence-based AYUSH drugs for Covid-19’, The Print, 2 Apr 2020, https://theprint.in/india/looking-at-evidence-based-ayush-medicines-to-treat-covid-19-minister-shripad-naik/393407/?fbclid=IwAR2s1ZQJHaL-OZEtoyjQdYqnJBDPJG5qSM6za78K-SdL06Mjg7vvVrpmyQA [accessed 3 Apr 2020]
[6] PIB (2020): ‘Ayurveda’s immunity boosting measures for self care during COVID 19 crisis’, Posted on: 31 Mar 2020 2:31PM by PIB Delhi, Release ID: 1609524
[7] PTI (2020): ‘Press Council of India Asks Print Media to Stop Advertisement of AYUSH-related Claims for COVID-19 Cure’, 3 Apr 2020, https://www.news18.com/news/india/press-council-of-india-asks-print-media-to-stop-advertisement-of-ayush-related-claims-for-covid-19-cure-2563661.html [accessed 4 Apr 2020]
[8] Ministry of AYUSH (2020): Dept. Order No. S. 16030/18/2019-NAM, 6 Mar 2020
[9] The Wire (2020): ‘Will COVID-19 Change AYUSH Research in India for the Better?’, 16 May 2020, https://science.thewire.in/the-sciences/ministry-of-ayush-task-force-clinical-trials-herbs-prophylactics/ [accessed 11 Jul 2020]
[10] ঐ
[11] Ernst, E. (2020): ‘Covid-19 Pandemic: are antiviral herbs an effective option? (two of my own systematic reviews)’, https://edzardernst.com/2020/03/covid-19-pandemic-are-antiviral-herbs-an-effective-option-two-of-my-own-systematic-reviews/ [accessed 5 Apr 2020]
[12] ৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য
[13] ঐ
[14] Schmidt, K., Ernst, E., Andrews (2002): ‘Aspects of MMR. Survey shows that some homoeopaths and chiropractors advise against MMR’, BMJ, 325(7364): 597.
[15] Stoneman, Justin (2020): ‘Society of Homeopaths under review amid claims standards chief promoted anti-vaccine propaganda’, The Telegraph, 11 Jul 2020, https://www.telegraph.co.uk/news/2020/07/11/society-homeopaths-review-amid-claims-standards-chief-promoted/?fbclid=IwAR249OrVFnu1X5aaPEZzGrudfciV9fZL6iq7uVpGqjzG1hMzj-zwy7GrvIQ [accessed 12 Jul 2020]
[16] Singh, S. & Ernst E. (2008): Trick or treatment?: Alternative Medicine on trial, London: Bantam Press, pp. 107-08
[17] Raj, N. (n. d.): ‘The homeopathic treatment of cholera: a historical study’, Bulletin Ind. Inst. Hist. Med., v. VIII: 39-43
[18] Dean, M. E. (2016): ‘Selective suppression by the medical establishment of unwelcome research findings: the cholera treatment evaluation by the General Board of Health, London 1854’, J. R. Soc. Med., 109(5): 200-205
[19] Halliday, S. (2001): ‘Death and miasma in Victorian London: an obstinate belief’, BMJ, 323: 1469-71
[20] National Health and Medical Research Council (2015): ‘NHMRC Information Paper: Evidence on the effectiveness of homeopathy for treating health conditions’, Canberra: National Health and Medical Research Council
[21] ৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য
[22] Bellavite, P. et al (2015): ‘Cell sensitivity, non-linearity and inverse effects’, Homeopathy, 104: 139-60
[23] PTI (2020): ‘ASCI flags 50 ad campaigns by Ayurveda, homeopathic drug makers offering COVID-19 cure in April’, Outlook India, 24 Jun 2020, https://www.outlookindia.com/newsscroll/asci-flags-50-ad-campaigns-by-ayurveda-homeopathic-drug-makers-offering-covid19-cure-in-april/1875666 [accessed 24 Jun 2020]