Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি — দুই দিগন্ত, পর্ব ১

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

ওরে বিহঙ্গ

মে মাসের সূর্যস্নাত দিনগুলোয় মিশিগান গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। রাস্তার দুধারে নতুন পাতা মেলে দাঁড়ায় মেপল, কটনউড আর বাটারনাট। পিঠচলকানো রোদ নিয়ে হরিণ রাস্তা পারাপার করে ঝাঁ চকচকে গাড়িদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে। গ্রাফিত্তি-আকীর্ণ দেওয়াল ধরে আর একটু এগোলে গলাকাটা দামের পসরা সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকে ডাউনটাউন। রেস্তোঁরাগুলো পেভমেন্টে উপচে পড়ে রোদের সন্ধানে। টেবিল আলো করে বসে থাকে নানা বর্ণের মানুষ।

সব মিলিয়ে এক পুনর্জীবনের উৎসব, বাঁধভাঙা উচ্ছাসের স্বতঃস্ফূর্ত মিলনমেলা। কোনও মানুষের এমন সময় দুঃখ শোক থাকে না, এমন কি থাকলেও সমস্ত ব্যক্তিগত দুঃখ ভুলে এই আনন্দমেলায় অংশ নেওয়া যায়। অন্তত এরকমই মনে হয় হীরকের। একটা পরিতৃপ্তি ছেয়ে যায় তাকে। বহু দেশে শিকর ছড়ানো উদার, সম্পন্ন এই নগরবাসীদের সেও একজন, এই বিশিষ্ট আমন্ত্রণপত্র সে অর্জন করেছে। নিশ্চিত করেছে তার জীবনের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।

অ্যান আরবার গাড়ির শহর ডেট্রয়েটের থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে। তবু এই নগরীর চলার গতি ভিন্ন। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ঘিরে নবীন উল্লাস দেড়শো বছরের পুরনো শহরটাকে বুড়িয়ে যেতে দেয়নি। শহরের বয়স না বাড়লেও মানুষের বাড়ে। আশির দশকের শেষে এসেছিল হীরক, নয় নয় করে দশ বছর কাটিয়ে দিল এই শহরে। তার শহর, তার হুরন নদী আর কেন্টউড বুলেভার্ডে বাগানওয়ালা বাড়ি।

এখন তার বাড়ি বললে এটাই। যেখানে স্ত্রী মঞ্জিনি, মেয়ে তিস্তাকে নিয়ে গোছানো জীবন। তবু দেশছাড়া মানুষ আর একটা বাড়িও সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একটা বাড়ি, একটা পাড়া, একটা শহর, একটা ছেলেবেলা। যতই পিছনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যাক, কোনও কোনও দিন সেই ফেলে আসা সময় ঠেলেঠুলে সামনে এগিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে গাড়ি গ্যারাজে রেখে অভ্যাসবশত পোস্টবক্সের ঢাকনা খুলে চিঠির তাড়া বাছতে গিয়ে সেটাই হল।

শানুর চিঠি।

শানুর চিঠি পেলেই কেমন কেঁপে ওঠে হীরক। চিঠি তো নয় যেন কেউ এসওএস পাঠাচ্ছে। অদ্ভুত সব কথা থাকে ওর চিঠিতে, পড়লে ভয় লাগে। উত্তর তো দেওয়াই যায় না। তবু এক অমোঘ টানে বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে গেল হীরক। এয়ারমেলের ঢাকনা ছিঁড়ে শানুর কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা চিঠিতে প্রবেশ করল সন্তর্পণে।

হীরু

চিঠি দিলি না তুই এখনও। বলেছিলি লিখবি।

তোর চিঠি কেন আসে না রে হীরু? তুই আমার ঠিকানা লিখতে ভুল করিসনি তো? ঠিক লিখেছিলি ১৮/১ রিকল পার্ক, দুর্গাপুর?

অথবা কে জানে চিঠি আসে আর বাবা লুকিয়ে ফেলে কি না। আমার সেইটাই মনে হয়। আসলে বাড়িতে আমাকে কেউ ভালবাসে না রে হীরু। কেউ চায় না আমি বেঁচে থাকি। আমি কি আদপেই বেঁচে আছি? সব কিছু হারিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? না, আমিই আসলে হারিয়ে গিয়েছি। একসময় দপদপ করে জ্বলেছি, এখন দ্যাখ সেই আলো কোথায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া আলোরাই তো নীল হয়ে যায়, তাই না? আলোর নীল পাড়ের দিকটা সূর্য থেকে আমাদের দিকে আসতে আসতে কেমন ছড়িয়ে যায়। জলে, বাতাসে, অন্তরীক্ষে। সেই রঙ যখন অনেক গভীর জলের তলায় পৌঁছায়, সে খুব গাঢ় নীল। জল যত স্তব্ধ, স্পর্শহীন নীলের গভীরতা ততই বেশি। তুই সেরকম গভীর নীল দেখিসনি। চোখ বুঁজলেই মনে হয় সমুদ্রের সমুদ্র-নীল নীল মিশে গেছে আকাশের আকাশী-নীল নীলের সঙ্গে। সেই নীল চরাচরে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ আমি একা। দিনে দিনে আমার মনের পরতে পরতে সেইরকম গভীর নীল জমছে রে হীরু। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, আমার চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।

এইটুকু পড়ে থমকে গেল হীরক। শানুর কষ্টটা অনুভব করে শিউরে উঠল। সবাই বলে শানু পাগল। এই মনের কষ্টটাই কি পাগলামি? কিন্তু কোন পাগলটা এমনভাবে নিজের কথা লিখতে পারে?

মনে পড়ে বিনীত স্যার একবার ক্লাসে বলেছিলেন, দ্যাখ নাসা থেকে যত মহাকাশযান আকাশে ছোঁড়ে সব কি আর গন্তব্যে পৌঁছায়? তোদের মধ্যে কয়েকজন এই পৃথিবীর বাতাস ফুঁড়ে মহাকাশে পৌঁছে যাবে। আবার অনেকেই সেটা পারবে না, তার আগেই জ্বলে খসে পড়বে। কোথাও পৌঁছাবে না তারা। শানু যেন তেমনি একটা শাটল, যেটা আর উঁচুতে উঠতে পারছে না, জ্বলে যাচ্ছে। গেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে শক্ত মাটিতে। জানে হীরক। তবু অন্য সবার মত শানুকে কখনওই খরচের খাতায় ফেলতে পারেনি।

শেষবার দেশে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করেছিল। ওর বাড়িতেই। শানু বিছানার কোল ঘেঁষে বসেছিল। কীভাবে পাড়ার সুদীপদা ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি একদিন, সেটা বলতে বলতে ওর গলা ভেঙে যাচ্ছিল। ভাবতে পারিস দরজা আটকে দাঁড়িয়ে বলল পরে আসিস। আমার মেয়ের পরীক্ষা সামনে। বাড়িতে কথা বললে ওর অসুবিধা হবে। আমি তবু ঢোকার চেষ্টা করলাম। অনুনয় করে বললাম, একটা কথা বলব সুদীপদা, শুধু কয়েক মিনিট? লাভের খাতায় পেলাম সুদীপদার খ্যাঁকানি। কী বলবি শুনি? কথা তো সেই একই। পাগলছাগলের সঙ্গে নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। বল, তুই একবার বল হীরক। সুদীপদা আমাকে পাগলছাগল বলল। বলতে পারল?

হীরক জানে শুধু সুদীপদা নয়, আর যত পরিচিত তারাও আস্তে আস্তে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে শানুর সামনে। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কী করতে পারত হীরক! তুই কেন উত্তেজিত হয়ে যাস শানু? কেন নিজেকে সামলাতে পারিস না?

অসহায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল শানু। কী করব বল, ওরা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে, আমার মাথার মধ্যে উথালপাথাল করতে থাকে। কীরকম হয় জানিস? একটা চিন্তা পাক খেতে খেতে আর বাড়তে বাড়তে কেমন ঘুর্ণির মত হয়ে যায়। মনে আছে ছোটবেলায় কালবৈশাখী ঝড় এসেছিল রথের মেলায়? তুই আর আমি ছুটছিলাম আর সামনে ধুলোর ঝড় কেমন গোল গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে উঠছিল, দানা বাঁধছিল কোনও একটা অদৃশ্য কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে? আমরা পথ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। আমার মাথার মধ্যেও সেইরকম হয়ে যায়, আমি আর তখন সামলাতে পারি না। উদ্গত আবেগে শানুর কণ্ঠনালী দ্রুত ওঠানামা করছিল। হীরক ভাবছিল কী রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা! লম্বা চওড়া চেহারার শানুর কাঠামোটা পড়ে আছে, জীবনের খরস্রোত ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে বাকি আর সব। সরু সরু আঙুলের গাঁটগুলো ফোলা, নখের ডগায় নোংরা— বড় কষ্ট হচ্ছিল এই শানুর জন্য।

কিন্তু সাধারণ কথায় এরকমভাবে রেগে গেলে কী করে হবে শানু? ভাইয়ের মুখে শুনলাম তুই কদিন আগে সুবিমলদাকে রাস্তার মধ্যে ধরে পিটিয়েছিলি, বল সত্যি কিনা?

–সুবিমলদা কী বলেছিল সেটা শুনলে এমন বলতিস না।
–কেন কী বলেছে?
–বলে কিনা আজকের জীবনে রবীন্দ্রনাথের কবিতার কোনও স্থান নেই। কী করে বলে এমন মারাত্মক কথাটা? রবীন্দ্রনাথের কটা কবিতা পড়েছে সুবিমলদা?

শানুর বিপন্ন কণ্ঠস্বর শুনে কেউ বলবে কবিতা নয়, কোনও মহাসঙ্কট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সুবিমলদাকে হীরক চিনত। উনি একটা সাহিত্য পত্রিকা চালান দুর্গাপুরে। অসহায় বিরক্তি গলায় চেপে হীরক জানতে চেয়েছিল, সুবিমলদার সঙ্গে হঠাৎ কবিতার কথা উঠল কী করে?

আমার মাথায় ‘দুঃসময়’ কবিতাটা ঘুরছিল সকাল থেকে। ছটফট করছিলাম আমি। কারও সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছিলাম, কথা বলতে চাইছিলাম। শানু তার মগ্ন গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করে উঠল—

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,

সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,

যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,

যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,

মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,

দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—

তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

নিজেকে থামাল শানু। তারপর যদিও হীরককে সম্বোধন করে বলেছিল, মনে হল ও নিজের সঙ্গেই কথা বলছে— এ কবিতাটা আমাকে কীভাবে নাড়ায়, বোঝাতে পার না তোকে। আমার জীবনটা দ্যাখ, কীরকম সকালবেলায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কোথাও কোনও আলো নেই, আশা নেই, বন্ধু নেই, বান্ধব নেই। এক অন্ধ খোলের মধ্যে আমি তবু ডানা ঝাপ্টে চলেছি, ঝাপ্টে চলেছি— আমার জন্য আর কোনও আকাশ নেই রে হীরক। তবু ডানা ঝাপ্টে চলেছি, কোথায় যাব বলে? জানি না তো।

ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল শানু। ওর দু চোখের পাশের চামড়া একটু একটু কাঁপছিল, যেন সেও উড়তে চাইছে। হীরকের দিকে তাকিয়েছিল, আবার ছিলও না। চঞ্চল চোখের তারা ঘরে আটকে থাকতে চাইছিল না, একটানা পাওয়া আকাশের খোঁজ করছিল বুঝি।

কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না হীরক। বিছানার চাদরে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে হীরক চাইছিল এই নৈঃশব্দ থাকুক কিছুক্ষণ, অন্তত যতক্ষণ নিজের গলার স্বাভাবিকতা ফিরে না আসে। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছিল। মঞ্জিনি অপেক্ষা করছে বাড়িতে। দেশে কদিনের জন্য আসা, ওদের নিয়ে বেড়াতে বেরোনোর কথা আছে।

তাই চেষ্টা করেছিল শানুকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে— শুধু এই জন্যে তুই রাস্তার মধ্যে সুবিমলদাকে মারলি?

–আর ওরা যে আমায় মারল। দ্যাখ এখনও আমার হাতে কাটা দাগ আছে। সবাই মিলে আমাকে কুকুরের মত তাড়া করেছিল, আমি পাঁচিল টপকে পালাতে গিয়ে পড়ে গেলাম। ওরা আমাকে সবাই মিলে পেটাল। ছোট ছোট ছেলেগুলো পর্যন্ত।
–তুই কেন এসব ফালতু লোকের সঙ্গে কথা বলতে যাস?
–কী করব হীরক? কারুর সঙ্গে তো কথা বলতে লাগে। কার সঙ্গে বলব বল। বাড়িতে আমাকে দেখলে বাবা মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। মাকে বলে এই অপদার্থটাকে আমার সামনে থেকে সরাও। জানিস আমি এত মার খেয়ে বাড়িতে ফিরলাম, সারা গা-মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। বাবা একবার ঘুরেও তাকাল না। সুবিমলদারা বাবার কাছে এসেছিল, বাবা শুধু ওদের কথাই শুনল। আমার কথাটা শুনলই না। আর ওরা চলে গেলে বাবা আমার ঘরের দরজা অবধি এসে দাঁড়াল, কী ঘৃণা নিয়ে তাকাল বাবা। বলল— জীবনে তো কিছুই দিতে পারলে না আমাকে। তোমার ভার বইতে বইতে এই বুড়ো বয়সেও বসে ছাত্র পড়াচ্ছি, না হলে অন্ন জুটবে না। আর কিছু না পারো, আমাকে শান্তি তো দিতে পারো। পাগলামি করতে হয়, আমার বাড়িটা তো রয়েছে। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে পাগলামি করো। যতদিন বেঁচে আছি, সহ্য করে যাব। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে আমার যেটুকু সম্মান বাকি আছে সেটাকে কেন ধুলোয় মেশাচ্ছ? হীরক, আমার সারা গা তখনও রক্তে মাখা ছিল, পাজামাটা আধছেঁড়া, ধুলো আর রক্তে মাখামাখি। বাবা একবার জিজ্ঞেস করল না। কিচ্ছু না।
–আর মা?
–মা এসে আমাকে পরিষ্কার করিয়ে দিল। আসলে মা এতদিনে তার অপদার্থ পাগল ছেলেকে ভালোবাসতে শিখে গেছে। গলার থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে হাসল শানু। পুরনো তবলার বাঁধন আলগা হয়ে গেলে যেরকম ঢ্যাবঢ্যাবে আওয়াজ বেরোয়, যাতে তাল মেলানোর চেষ্টা আছে কিন্তু প্রাণ নেই, অনেকটা সেরকম। –মা যদি তখন আমাকে এভাবে ভালবাসতে পারত রে হীরক, যখন আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম, ডুবে যাচ্ছিলাম এক অসীম তলহীন অন্ধকারে! হয়তো, হয়তো তাহলে…

শানুর কথা ভাবনায় মিশে গেল আলগোছে। লম্বা লম্বা আঙুলগুলো অবিন্যস্ত চুলে চালাতে চালাতে অদ্ভুত এক তৃপ্তিভরা হালকা হাসির আস্তরণ ওর মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। হীরকের ইচ্ছা করছিল ওর মনের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে। একবার দেখে কোন অস্ফুট সম্ভাবনার স্বপ্নজাল ওর মুখে এনে দিয়েছে এমন তৃপ্তির হাসি।

হঠাত চমক ভেঙে শানুই বলেছিল— তোর মেয়েটা খুব মিষ্টি হয়েছে হীরক। সেদিন রাস্তায় দেখলাম তোর বউয়ের হাত ধরে যাচ্ছিল। আমি ওকে আদর করতে গেলাম, মাথায় হাত বুলালাম, কিন্তু ও কেমন সিঁটিয়ে গেল।

–বাচ্চারা গোঁফ দাড়ির জঙ্গল দেখলে ভয় পায় শানু, যা একটা লম্বা দাড়ি বানিয়েছিস, ওর দোষ কী বল?

ওর পোশাকআশাকও তো সেরকম সুবিধের নয়। ঢলঢলে সাদা পাজামা, তার এখানে ওখানে ধূসরতা, যেটা ঝোলা পাঞ্জাবিতেও ঢাকা পড়ে না। তার মেয়ে এরকম কোনও আঙ্কল দেখে অভ্যস্ত নয়। তিস্তার কাকুজেঠুরা আসে অন্য দুনিয়া থেকে। তারা গাড়ি চড়ে আসে। ঝকঝকে সেই আঙ্কলদের সঙ্গে দেখা হয় চকচকে জায়গায়। কিন্তু হীরক সেটা মুখে বলল না।

–না, না সেটা আমি বুঝি। তাও তো ভালো, বল। তুই জানিস রথীন কিংবা সুরজিতের বাচ্চারা আমাকে দেখলে কী করে?

রথীন, সুরজিত ওদের কাছাকাছি সময়ে বড় হয়েছে, হীরকের ঠিক বন্ধু নয়। তবে শানুদের পাড়াতেই থাকে বলে ছোটবেলায় কখনওসখনও দেখা হয়েছে।

গলাটা আবার নিচু হয়ে গেছিল শানুর। কাতর, ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেছিল— যখনই খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাই, ওরা আমার পিছন পিছন ছুটে আসে রে হীরক। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো, যার মধ্যে রথীন, সুরজিতের ছেলেরাও, বলে পাগলা শানু! ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ পাগলা শানু যাচ্ছে। আমি একদিন রথীনকে বললাম— দেখ তোর ছেলে কেন আমায় পাগলা শানু বলে, কী শিক্ষা দিচ্ছিস তুই? বলতে পারিস না আমি তোর ছোটবেলার বন্ধু, শেখাতে পারিস না কাকু বলতে?

হীরক না শুনেও আন্দাজ করতে পারে এর উত্তরে রথীন কী কথা বলতে পারে। তাই শুনতে চাইল না। এসব কথা ভেবে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস শানু, থাক না।

না রে হীরক, ওর সঙ্গে ছোটবেলায় একসঙ্গে ফুটবল খেলেছি আমি, একসঙ্গে সাইকেল করে স্কুলে গেছি। রথীনকে কতদিন আমার সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে নিয়ে গিয়েছি তুই বল? সে সব ভুলে গেল? আসলে তুই ছাড়া হীরক কেউ আর আমাকে বন্ধু বলে মনে করে না। ওদের চোখে আমি আর মানুষ নই, একটা ছায়া।

হীরক জানে আসলে সেটাই তো সত্যি। শান্তায়ন চ্যাটার্জি, যে এক সময়ে ওদের সঙ্গে বেঁচেছিল, যে ওদের বন্ধু ছিল, সে তো আর নেই। শানু পাগলা তার ছায়ামাত্র। এক বিকৃত, ছিঁরিছাদহীন শূন্যতা।

পুরনো কথাগুলোকে ওলটপালট করতে করতে হীরকের বুকে কষ্ট বাড়ছিল শানুর জন্য। কল্পনায় শানুর সঙ্গে কথোপকথনের পথে নিজের ভাবনাকে কাটাছেঁড়া করছিল হীরক। তোকে কি আমিও বন্ধু বলে সত্যি মেনেছি শানু? না রে, মিথ্যের মুখোশ পড়ে তোকে ছেলেভুলানো দিচ্ছিলাম না। সেদিন যখন তোর সঙ্গে বিছানায় বসে গল্প করছিলাম, তোর পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা খাঁটি ছিল। অন্তত মনে মনে তাই ভেবেছিলাম। এখন বুঝি বর্তমানের খোলসে শুধু তোর অতীতটাকেই ছুঁচ্ছিলাম সেদিন। তখন আমিও সেটা বুঝতে পারিনি রে। আমি ভেবেছি, ইস রথীন, সুরজিত ওরা কেন এমন করে। কেন এত নিষ্ঠুর? মনে হয়েছে আমি তোকে মানসিক আশ্রয় দিয়ে তোর মনের নিরন্তর ঢেউ স্তিমিত করতে পারি।

এই অস্ফুট স্বীকারোক্তি কারও কানে পৌঁছানোর জন্য ছিল না, কিন্তু ভিতর থেকে হীরককে চুরমার করে দিচ্ছিল।

সেদিন শানুর হাত ধরে হীরক বলেছিল, তুই আমাকে চিঠি লিখবি। যখন খুব মন খারাপ করবে আমাকে ফোন করে কথা বলবি, ঠিক আছে?

কী গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে শানু হীরকের দিকে তাকিয়েছিল!

কিন্তু হীরক জানে ও পারেনি। পারেনি আজকের শানুকে হীরকের এখনকার জীবনে ঢুকতে দিতে। শানুর চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি। সময় কোথায়? ইদানীং হটমেল চালু হয়েছে, বাবা মাকে দরকারি কথা মেলেই জানিয়ে দিতে পারে। বাবা মা এখনও চিঠির আশা করে, তাই মাঝেমধ্যে লেখা। উড়ান ডেট্রয়েটে নাবতে নাবতে শানুকে চিঠি লেখাটা প্রায়রিটির তালিকায় একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। শানুকে উত্তর দেওয়াই হয়নি মোটে।

একটা অপরাধবোধ গ্রাস করল হীরককে। না, আজ একবার ওকে ফোন করবে, কতদিন আশা করে আছে ছেলেটা। ঘরে ঢুকে ডাইরি খুঁজে শানুর বাড়ির নাম্বারটা বের করল।

কটা বাজে এখন, ওদের জন্য খুব রাত কি? আচ্ছা একবার ফোন করব, কেউ না ধরলে রেখে দেব না হয়। প্রথমবারে কেউ ধরল না। কী মনে হল, আর একবার লাগাল।

কেউ ধরল। ঘুমজড়ানো গলায় মহিলা কণ্ঠ বাজল ওপার থেকে, কে?

–কাকিমা, ভাল আছ? আমি হীরু।
–এত রাতে? দেশে এসেছিস বুঝি? তোকে কতদিন দেখি না রে হীরু। উচ্ছসিত হয়ে উঠল শানুর মায়ের গলা।
–আমি আসিনি কাকিমা, একটু শানুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। ও কি জেগে আছে?
–হ্যাঁ আছে তো। থাকবে, ঘুমায় এত কম ছেলেটা। দাঁড়া ধর। তুই ফোন করেছিস, খুব খুশি হবে ও।

ফোনের অন্যদিকে শাড়ির খসখস সরে যাওয়ার আওয়াজ, তারপর সব চুপচাপ। এত রাতে ফোন করাটা ঠিক হল কি না ভাবছিল তখনি ফোনে এল শানু। হীরু তুই? ভাবতেও পারছি না রে! হড়হড় করে কথা বলতে চাইছিল শানু। কিন্তু কথার গতিপথ শুকনো জলের পাইপে হঠাত আসা জলের ছড়ছড়িয়ে বেরোনোর মত দিকদিশাহীন। –ভাগ্যিস তুই ফোন করলি হীরক, না হলে আমি যে কী করতাম!

–কেন, তোর আবার কি হল? কথোপকথনটা হাল্কা রাখতে চাইছিল হীরক।
–জানিস আমিই ভাবছিলাম তোকে একটা ফোন করব, কিন্তু তোর নাম্বারটাই তো নেই আমার কাছে। একে তো তোর সঙ্গে আমার সময়ের এত তফাত, কখন করি, কখন না করি হিসাব মেলে না। তার উপর নাম্বার নেই। মুশকিল না বল?
–আচ্ছা, আচ্ছা এবার তো আমাকে পেয়ে গেলি, কী বলবি বল সেটা তাড়াতাড়ি। দূরপাল্লার ফোনে বিল বাড়ছে সেটাও মাথায় খেলছিল হীরকের।

কী কাণ্ড! এইটুকুতেই অভিমানে গলা বুজে গেল শানুর। জানি, তোরা খুব ব্যস্ত মানুষ, কত কাজে জড়িয়ে আছিস। একটা চিঠির উত্তরও দিয়ে উঠতে পারিস না। আমারই অন্যায়, আমি বুঝি। আসলে এটাই তো আমার অসুখ হীরক। আমার মাথায় কিছু একটা এসে গেলে আর যেতে চায় না। একদম ছায়ার মত লেপ্টে থাকে। আমি সরাতে চাই, আমার মন থেকে তাড়াতে চাই, কিন্তু ছিনে জোঁকের মত আঁকড়ে ধরে। আমার ডাক্তার সেন, উনিও এটাই বলেন। বলেন— শান্তায়ন, ভাবনাকে নিজের কন্ট্রোলে আনতে হবে, যেখানে সেখানে ঘুরতে দেবে না।

হীরক বুঝল শানুর কথাকে বল্গা পরানো তার কর্ম নয়। ফোন যখন নিজেই করেছে, তখন চালিয়ে যাওয়াই ভালো। বলল, তাহলে শুনিস না কেন ওর কথা?

–উনি তো বলেই খালাস। উত্তেজিত হলেই কোনও বস্তুতে মনসংযোগ করবে। ভাবনা যেন অনুভূতিসর্বস্ব না হয়। বললেই হয় সেটা? ভাবছি কিছু একটা নিয়ে, আর হঠাৎ সেসব ছেড়ে চেয়ারের দিকে তাকিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করলাম…! ধুর ডাক্তাররা কিচ্ছু জানে না। আচমকা গলায় ঘড়ঘড় শব্দ তুলে হেসে উঠল শানু।
–সে না হয় হল, কিন্তু তোর ভাবনাটা কী নিয়ে? কেউ কিছু বলেছে?

এবার হীরককে অবাক করে দিয়ে শানু বলে উঠল— না, না খারাপ কিছু নয়। আসলে আমার মনটা এত ভালো হয়ে আছে যে ভালোলাগাটা ফানুসের মতন বেড়ে বেড়ে আমাকে ছেয়ে ফেলছিল। তুলতুলে ভালো লাগায় আমার দম আটকে আসছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চেষ্টা করেও অন্য কিছুতে মন বসাতে পারছি না। আমি ভাবছিলাম তোর সঙ্গে কথা বলে যদি ভাবনাটা ছাড়াতে পারি। আর তুই, যে কোনওদিন আমাকে ফোন করিস না, আজকে করে দিলি। টেলিপ্যাথি একদম, তাই না রে?

–আচ্ছা খুলে বল না কী হয়েছে? হীরক অধৈর্য হচ্ছিল।

ওদিক থেকে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। শানু কি বোঝে না দূরপাল্লার ফোনে কত টাকা ওঠে?

–আমি না আমার গোঁফ দাড়ি কেটে ফেলেছি। হাসিটা হাঁড়ির ঢাকনা ওল্টাতে চাওয়া ফুটন্ত ভাতের বুগবুগানির মতন উথলে পড়ছিল শানুর গলায়।
–আর সেই খবর দিতে তুই আমাকে এত দূর থেকে ফোন করবি ভাবছিলি? তুই কি পাগল? বলেই বুঝল হীরক, কী ভুল কথাটা বলে ফেলেছে।

শানু মোটেই রাগ করল না। বরং হা হা করে হেসে উঠল। লোকে তো তাই বলে রে হীরক, আমি তো পাগল।

–সরি, শানু, আমি সেটা বলতে চাইনি। বলছিলাম শুধু গোঁফ দাড়ি কেটেছিস বলে…
–কেন কাটলাম, সেটা তো বলবি? আবার খুক খুক করে হেসে উঠল।

এই শানুকে হীরক চেনে না। একটু বিরক্ত লাগছিল। হঠাৎ মাথায় আচমকা খেলে গেল। –শানু, কোনও মেয়ে?

এবার ফোনের অপর প্রান্তে শুধুই হাসি। সেই হাসি নির্মল। পাহাড়ি ঝর্নার মত নিভৃত। হঠাৎ পাওয়া খুশিতে ভরপুর। কিন্তু হীরকের খুব ভয় লাগল শানুর জন্য। আবার এ কিসে জড়াচ্ছে ও? কোন মেয়ে এই আধপাগলকে ভালবাসবে? এবার বুঝি ও পুরো পাগল হতে চলেছে।

–শানু, কী বলছিস তুই? যা করছিস, ভেবে করিস।

ভীষণ রেগে গেল শানু। –কেন, কেন ভাবব? যদি তোর অন্য কোন বন্ধু এরকম বলত, তুই তাকে বাহবা দিতিস। আমার বেলায় অন্য নিয়ম? আমি পাগল বলে? নাকি আমি তোর বন্ধু নই? সব শুধু তোর মুখে।

হীরক বুঝতে পারছিল ব্যাপারটা খারাপ দিকে চলেছে। সে ওকে বলতে পারত আমার আর কোনও বন্ধু বললেও আমি কনগ্র্যাচুলেট করতাম না। কারণ ওর সব বন্ধুই বিবাহিত। ওদের মুখে এরকম কথা শুনলে যে কারণে ভয় পেত, শানুর বেলায় সেটা সম্পূর্ণ অন্য। কিন্তু এসব কথা শানুকে বললে ও আরও এক্সাইটেড হয়ে যেত। তাই হীরক ওকে থামাল না। তার উপর যত রাগ করার করে নিক।

কিছুক্ষণ রাগ দেখানোর পরে ও শান্ত হল।

হীরক জিজ্ঞেস করল, এবার বল কে এই মেয়েটা? আমি চিনি?

–না, তুই চিনিস না। কিন্তু তোকে এখন আর কিচ্ছু বলব না। তুই এরপর যখন আসবি, সব জানতে পারবি। তোর সঙ্গে কথা বলে রাখলাম। যদি কোনও ঝামেলা হয় তুই আমাকে সামলাবি, ঠিক আছে? দ্যাখ, কেমন আমার মাথা থেকে চিন্তাটা এবার সরে যাচ্ছে। কীরকম হাল্কা হয়ে যাচ্ছে রে মাথাটা। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে কথা বললাম হীরক।

ফোন রেখেও অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল হীরক। তার মাথাটা ভারী হয়ে উঠছিল। কী ফ্যাসাদ বাঁধাচ্ছে ছেলেটা কে জানে! হাজার হাজার মাইল দূরে বসে হীরক কিভাবে ওকে সামলাবে?

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)