Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মন্দিরের জায়গায় স্কুল বা হাসপাতাল হলে ভালো হত– এ বিতর্ক অর্থহীন

পারভেজ খান

 

তিন দশক আগের যে ঘটনা ছিল লজ্জার, জাতীয় লজ্জার, তা হঠাৎ করে গৌরবের হয়ে যেতে পারে না। দেশের বিচারব্যবস্থা গতবছরের নভেম্বরে যখন রায় দিতে গিয়ে বলে সংখ্যাগুরুর বিশ্বাসের ভিত্তিতে রায় দিলাম, সেটা রায় থাকে না, সংখ্যাগুরু আধিপত্য থাকে তাতে। রে রে করে তেড়ে আসবে একদল, জিজ্ঞেস করবে– আপনি তাহলে সুপ্রিম কোর্টও মানবেন না? কিন্তু বন্ধু, সুপ্রিম কোর্ট যদি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি র বদলে বিশ্বাসকে রায়ের মাপদণ্ড করেন, তাঁরা কি নিজেদের মানছেন? তাঁরাই যদি নিজেদের না মেনে থাকেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টকে সম্মান করেই প্রশ্ন তোলা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। যাই হোক এই রায়ে বহু পক্ষের অনেকেই খুশি ছিলেন– বক্তব্য ছিল, অতঃপর যদি শান্তি আসে..। একদমই ঠিক এদেশে যতবার অশান্তি এসেছে, নিজে থেকে আসেনি, ধর্ম নয়, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা লোকজনেরা সেটা বাধিয়েছে। তাদের খেলায় মানুষ চশমা পরে থেকেছে, সাময়িক বোধবুদ্ধি হারিয়ে উন্মাদের মতো আচরণ করেছে। এখানে ধর্মটাকে বাইরে এনে সংখ্যার লড়াই, ক্ষমতার লড়াই, আগ্রাসন চলেছে।

যাই হোক এসব প্রসঙ্গে একটু পরে আসা যাবে আবার, এক বছর আগে আজকের দিনেই (২০১৯-এর ৫ই আগস্ট) জম্মু-কাশ্মিরকে ভাঙা হয়েছিল, রাজ্য থেকে জোড়া কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়েছিল আর ৩৭০ ধারা অনুযায়ী বাড়তি সুবিধার স্ট্যাটাস কেড়ে নেওয়া হয়েছিল শুধু ডেভেলপমেন্টের মেকি গল্প শুনিয়ে। আমার বহু বন্ধু বেশ উচ্ছ্বসিত ছিল সেদিন, হয়তো আজও আছে। অনেকে তো জমি বাড়ি ফ্ল্যাট প্রায় কিনেই ফেলেছিলেন। আজ সেখানকার লকডাউনের, হ্যাঁ তখনও করোনা আসেনি, সেই সময় ইম্পোজ করা লকডাউনের এক বছর কাটল। আপনি আমি এখনই অসহ্য বোধ করছি ইন্টারনেট সংযোগ থাকার পরেও। একটু ভাবুন কাশ্মিরের অবস্থা যেখানে বহুদিন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল, এখন ২জি চালু আছে কিছু জায়গায়! তাতেই চলছে অনলাইন এডুকেশন। নিউ ইন্ডিয়া। কাশ্মিরি পণ্ডিতদের একাংশ আবার হঠাৎই ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে।

দেশের সংবিধানে তো অনেক কথাই লেখা আছে, যদিও কেন আছে তাই নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ দুটি নাকি ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে যায় না। এই নিয়ে ২০১৬ তে এলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলা হলেও তা খারিজ হয়ে যায়, এবার সুপ্রিম কোর্টে ফের শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার জন্য মামলা করলেন বলরাম শিং ও করুনেষ শুক্লা নামের দুই আইনজীবী। অনেকে বলবেন যেটা প্র‍্যাকটিস হয় না, সেই গালভরা কথা রেখে কী হবে? আসলে যতবার আপনার মতকে দমিয়ে দেওয়া হবে, খাওয়ার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে, ততবার আপনার হয়ে সংবিধানের শব্দগুলি নিয়ে কেউ না কেউ আপনার জন্য ঝাঁপাবে, আপনার অধিকারের কথা বলবে, আর প্রস্তাবনা থেকে শব্দগুলি এক এক করে বাদ গেলে, একদিন সব চুপ হয়ে যাবে।

যাই হোক, ছিলাম অযোধ্যাতে, রামমন্দিরের ভূমিপুজোতে। মন্দির মসজিদ বানাতে এদেশে টাকার অভাব হয় না, অদূর ভবিষ্যতেও হবে না। নতুন একটা মন্দির হবে সেটা বিতর্কের বিষয় নয়। তা নিয়ে আপত্তি থাকারও কথা নয়। দেশে মানুষের নিজ নিজ ধর্মচর্চার সম্পূর্ণ অধিকার আছে সংবিধানসম্মতভাবেই। তাই জমি কেনা, বা দানের জমি যাই হোক সেখানে মন্দির তৈরি বা মসজিদ তৈরি করতেই পারে কোনও সংগঠন। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে রামমন্দির নির্মাণ এর সঙ্গে ধর্ম, মন্দির, রাম এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। একটি রাজনৈতিক দল এটি নির্বাচনের পর নির্বাচনে নিজেদের অ্যাজেন্ডা হিসেবে নিয়েছে, আর তারই ফসল এটি। অনেকে বলতেই পারেন একটা রামমন্দিরের গঠনে, প্রধানমন্ত্রী গেছেন, এত সমস্যার কী আছে? আছে। যে সময় দেশের হোম মিনিস্টার করোনা-আক্রান্ত, আর তার সংস্পর্শে আসা প্রধানমন্ত্রী নিভৃতবাসে না গিয়ে, আইসিএমআর-এর নির্দেশিকা উপেক্ষা করে মন্দিরের ভূমিপূজার অনুষ্ঠানে যেতে পারেন, ব্যক্তিগতভাবে নরেন্দ্র মোদি ধর্মপালন করতেই পারেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে তিনি যেটাকে প্রায়োরিটি দেখালেন তাতে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে কী বার্তা গেল? এছাড়াও আছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে এখনও মামলা চলছে আদালতে, আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বাবরি মসজিদের পূর্বে সেখানে মন্দির ছিল কি না। যাই হোক তবুও মন্দির না হয়ে হাসপাতাল বা কলেজ হলে ভালো হত এই বিতর্ক অর্থহীন ও আসল বিষয়ের গুরুত্বকে লঘু করে দেওয়া। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড তাদের প্রাপ্ত ৫ একর জমিতে মসজিদ, হাসপাতাল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত ভালো সিদ্ধান্ত এবং অবশ্যই যুগান্তকারী। মন্দির কমিটি মন্দির বানাবে তা তাদের সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে বলার কিছু থাকতে পারে না। থাকা উচিতও না। আসল বিষয় কী? এক, ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি; দুই, নিয়মভঙ্গ– এবার থেকে লকডাউনের নিয়ম ভেঙে কেউ রাস্তায় বেরোলে যেন পুলিশ কান ধরিয়ে, লাঠি পিটিয়ে শাস্তি না দেয়; আর তিন, আগ্রাসন– মন্দির ওহি বানা দিয়া।