Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নহরণকারী রাজার মন্দিরযাত্রা আর করোনাচালিশা

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


লেখক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধকার। আলোচ্য বিষয়ে তাঁর একটি বই আছে: মন্দির মসজিদ বিসম্বাদ রাম মন্দির বাবরি মসজিদ বিতর্ক; বহুবচন প্রকাশনী (২০২০), কলকাতা।

 

 

 

 

গর্ভবতী স্ত্রীকে মিথ্যে কথা বলে ঘর থেকে খেদানো, চোরাপথে বালীবধের খলনায়ক, শূদ্র জ্ঞানসাধক শম্বুকের বর্বর হত্যাকারী, ভীরু কাপুরুষ রাম পশ্চিমবাংলার মাটিতে কোনওদিনই খুব একটা জনপ্রিয়তার জায়গা পায়নি। দেবতা হিসাবে সম্মান তো নয়ই। লব কুশ তাঁদের জননী চিরদুঃখিনী সীতার দুঃখের গান শুনিয়ে তারপর সম্মুখযুদ্ধ করে রামকে পরাজিত করে পরে মুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সীতার প্রশিক্ষণে তারা যে উদার চরিত্রমাহাত্ম্য পেয়েছিল, রামের সান্নিধ্যে থেকে সেটা সম্ভব হত না। ফলে বাংলার অ-বেদ আবহে রামের খুব একটা আদর জোটেনি।

ধর্মবিশ্বাসের কৌশলী তত্ত্বের জোরে রাম হয়ত বাঙালি মানসে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে একটা স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু তাতে কী? কূর্ম (কচ্ছপ), মীন (মাছ), বামন, বরাহ (শুয়োর) প্রমুখও বিষ্ণুর অবতার। পশ্চিমবাংলায় বাঙালি হিন্দুদের তৈরি যেমন কোনও কচ্ছপমন্দির বা শুয়োরমন্দির নেই, তেমনই রামমন্দিরও নেই। ইদানীন্তন কালে যে দুচার পিস রামমন্দির এখানে ওখানে দেখা যায়, তার প্রায় সবই হিন্দিভাষী অবাঙালিদের এলাকায়।

বৈষ্ণব সাধনমার্গ বাংলাদেশের উর্বর পলিমাটিতে আউল-বাউল সহজিয়ায় সহজ গ্রাহ্যতা পেলেও তা মূলত কৃষ্ণভক্তির উজান। তারই শাখাপ্রশাখা। রামাশ্রয়ী বৈষ্ণব প্রকরণ কৃত্তিবাসের প্রয়াস সত্ত্বেও বেশি উজিয়ে উঠতে পারেনি। হয়ত সঙ্গী বা সঙ্গিনীদের প্রচ্ছায়া এর জন্য কিঞ্চিদধিক দায়ী। প্রভুভক্তিতে আনত হনুমানের তুলনায় প্রেমের সাগরে নিমজ্জিত রাধা মনে হয় বাঙালির মনকে বেশি টেনেছে। “ওই মালতীলতা দোলে, পিয়াল তরুর শাখে …”

অবশ্য শুধু বাংলাই বা বলি কেন?

সারা ভারতেই ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী বিষ্ণুর বিবিধ অবতরণের পরিণতিতে কৃষ্ণমূর্তি কিন্তু রামমূর্তির চাইতে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কৃষ্ণ যেমন কেষ্ট, কিসান, সাঁবরিয়া, কানাই, কানহাইয়া, কানু, ইত্যাদি একেবারে ঘরের লোকের বিচিত্র ডাকনামে সম্বোধিত হয়েছে, জ্যেষ্ঠ দাশরথির কপালে তার তুলনায় বস্তুত কিছুই প্রায় জোটেনি। সাধারণ লোকের কথা থেকেই যদি লোককথার জন্ম হয়ে থাকে, কৃষ্ণ নিয়ে লোককথার সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বিপুল— বালা গোপাল, সাক্ষী গোপাল, ননী চোর, “ম্যায় নহি মাখন খাউঁ”, “আজি নন্দদুলালের সাথে …”, এমনি ধারা কত, কত!

রাম নিয়ে এমন লোকপ্রিয় কথা ও কাহিনির সংখ্যা? রাম লক্ষণ চরিত্র নিয়ে সঙ্গীত? বাংলা না হোক, হিন্দিতে?? তুলসীদাস আর হনুমান চালিশার বাইরে??? ভারি মুশকিলে ফেললেন স্যর!!

তবে রাজনীতিতে কী না হয়? ভোটের রাজনীতিতে আরও কী না হয়? রামে যদি লোক আসে, ভোট আসে, অর্থ আসে, খবরের কাগজে বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রচার আসে, তখন সেই সব কিছুর মাধ্যমে রামও এসে যেতে পারে। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় রামমন্দির নামক মৌলবাদী মুদ্দা একটা ছিলই। সিপাহি বিদ্রোহ উত্তরকালে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী (ই-ই-কোম্পানি থেকে রানিমা) প্রচুর মাথা খাটিয়ে “প্রচলিত বিশ্বাস”-এর নামে বাবরের হাতে রামমন্দির ধ্বংস এবং সেই ভগ্নস্তুপের উপরে একটি মসজিদ নির্মাণের গল্প তৈরি করে অবধ দখলের নীল নকশা তৈরি করে ফেলেছিল। ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে শাসনের রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের প্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম তাস খেলার সেই তো আদি কাল। আরএসএস জন্মলগ্ন থেকেই মুদ্দাটিকে সঙ্ঘগত করে ফেলে। তারপর থেকেই বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে সেই জায়গায় একটা রামমন্দির বানানোর জন্য দুনিয়ায় হেন অপকম্ম নেই যা তারা করেনি।

অপকম্মগুলির সংক্ষিপ্ত তালিকা এইরকম:

  1. সংস্কৃত দলিলের নামে ভুল তথ্য পরিবেশন;
  2. ইসলামি সাক্ষ্যের নামে ভুয়ো দলিল উদ্ধার;
  3. পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের নামে ইংরেজদের দেওয়া জাল তথ্য প্রচার;
  4. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতি কুমার চ্যাটার্জী, সুকুমার সেন সহ সমস্ত মনীষীদের সম্পর্কে মিথ্যাচার ও নিন্দাবাদ;
  5. বিবেকানন্দের বক্তব্য অস্বীকৃতি;
  6. অসংখ্য অস্তিত্বহীন পুঁথি, বইপত্র, গেজেটিয়ারের উল্লেখ;
  7. ইতিহাসের সমস্ত সাল তারিখ তথ্য অস্বীকার ও জালিয়াতি;
  8. চোরাগোপ্তা কায়দায় বাবরি মসজিদে রামসীতার মূর্তি ঢুকিয়ে আসা;
  9. প্রশাসন ও আদালতের সাহায্যে মসজিদে নামাজ বন্ধ করানো;
  10. দলবল ও হাতিয়ার নিয়ে একটা সাতশো বছরের মসজিদ ধ্বংস সাধন;
  11. সরকারি ক্ষমতাবলে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা দপ্তরকে দিয়ে বাবরি ধ্বংসস্তুপ খনন করে সেখানে একটা বড় হিন্দু মন্দির থাকার দাবি করিয়ে নেওয়া;
  12. অবশেষে আদালতকে দিয়ে ধ্বংসস্তুপের জমি রামের নামে লিখিয়ে নেওয়া; ইত্যাদি।

বাংলার মাটিতে রামের জনপ্রিয়তা না থাকলেও বিজেপি-র রাজনীতির যেটা পেট্রল— মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণা— সেটা বাংলার নগরে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রামমন্দির আন্দোলন একটা আবেদন রাখার মতো খোলা পরিসর পেয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের বামপন্থী আন্দোলনের পরম্পরায় (শুধু ৩৪ বছরের আঙিনায় নয়) দুটো প্রদেশ ভাগকে “দেশভাগ” বলে চালানোর বিরুদ্ধে, আর্থ রাজনৈতিক ভিত্তিতে পারটিশনের সিদ্ধান্তকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি বলে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে, ভারতের ইতিহাস, ধর্ম, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হিন্দু রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামি, বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্ত বনাম বঙ্কিম-বিবেকানন্দের ভাবাদর্শগত বিরোধ, বেদ-গীতা-রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদির সামাজিক ঐতিহাসিক মূল্যায়ন, হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসী মতাদর্শের উত্থান, ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সমস্যা, মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ— ইত্যাদি জরুরি বিষয়গুলি কোনও দিনই জরুরি অ্যাজেন্ডা হিসাবে প্রতিভাত হয়নি। দলের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে জনগণের স্তর পর্যন্ত এই সব নিয়ে আলাপ আলোচনা স্টাডি ক্লাস জনসভা ইত্যাদি সংগঠিত হয়নি।

দীর্ঘদিন একটা বামপন্থী দলে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে কাজ করার সময় আমি প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ করেছি, এইসব বিষয়ে চর্চা করা, লেখালেখি করাতে দলের যৌথ নেতৃত্বের তরফে কী সাংঘাতিক আপত্তি। বাবরি মসজিদের জায়গায় অতীতে কোনও “রামমন্দির” হওয়ার অসম্ভাবনা নিয়ে ১৯৯২-৯৩ সালে আমার বাংলা প্রবন্ধ কোথাও প্রকাশ করতে পারিনি। পরে আমি ১৯৯৫ সালে আমাদের বিজ্ঞানের পত্রিকায় ইংরেজিতে একটা দু-কিস্তি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলাম বলে এক দিল্লিস্থিত কেন্দ্রীয় নেতা (এখন প্রয়াত) ভয়ঙ্কর বকাবকি করেছিলেন আমাকে— দেশের পরিস্থিতি বুঝি না বলে। আজকাল বসে বসে ভাবি, আমার চাইতে ওনাদের বেশি বুঝে যে দেশের কী লাভ হল!

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এবং জাতীয় মনন নির্মাণে নেহরু কংগ্রেসের (প্রজন্মান্তরেও) নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় যে পেলব সাম্প্রদায়িকতার চাষ হয়ে চলেছিল, তা শুধু যে শ্রেণিসংগ্রাম আর গণআন্দোলনের গরম উত্তাপে উচ্ছিন্ন হবে না— সে কথা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। মুসলমান, পাকিস্তান, কাশ্মির, চিন যেভাবে দেশের যে কোনও জ্বলন্ত সমস্যা থেকে জনসাধারণের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার কয়েকটা সহজ বোতাম হয়ে উঠছিল, বামপন্থার স্বর্গীয় সময়ে আমরা তার সমান্তরালে ইতিহাসে সমাজশাস্ত্রে নজর কেন্দ্রীভূত করার দীক্ষাদানের একটুও আয়োজন করিনি। অন্যদিকে সঙ্ঘ পরিবার ভূতাত্ত্বিক অগ্রগতির হারকেই আদর্শ মেনে কাজ করে গেছে। কংগ্রেসের জমিতে অল্প অল্প জল ঢেলেছে আর দুচারটে করে বিষবৃক্ষের বীজ দানা ফেলেছে। চিতার মতো শীতল অনন্ত অপেক্ষায়।

সেই চাষের জমিতেই এখন মোদি-গ্যাং গলা উঁচিয়ে কাজ করছে। তারা বুঝে ফেলেছে, দেশের কোটি কোটি মানুষের হাজারও রকম ক্ষতি করার পরও দুচামচ পাকিস্তান কাশ্মির সহযোগে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিলেই লোকে তা ভুলে যাবে। এমনকি মেনে নেবে। নানারকম আয়োজন করে করোনা ভাইরাসের গণসংক্রমণের পাকা ব্যবস্থা করে দিলেও নিজামুদ্দিনের জমায়েতকে ব্যাপকতর হিন্দুরা গাল পাড়তে পাড়তেই তিরুপতিতে গুলবর্গায় কিংবা পুরীতে অথবা অযোধ্যায় জমায়েতে দু হাত তুলে (পা নেহাত তোলা যায় না বলেই, নচেৎ ওটাও তুলে) নাচবে এবং লাফাবে। দেশে যখন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালসার অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কোভিড-১৯ বেসরকারি হাসপাতালের “বাণিজ্যে বসছেন লক্ষ্মী” কর্মসূচি সফল করে তুলছে, তখনও একটাও সরকারি হাসপাতালের দ্বারোদ্ঘাটন না করে রামমন্দিরের শিলান্যাস করতে চললেন প্রধান মন্ত্রী— এও এক বড় সংখ্যক হিন্দুর কাছে জায়েজ হয়ে যাচ্ছে স্রেফ একটা মসজিদকে ভাঙা গেছে বলেই।

আফশোস করে লাভ নেই। আরএসএস তার জন্মলগ্নের স্বপ্নকর্মসূচি— হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, মনুশাসন প্রচলন, নারী, দলিত ও মুসলমান দলন, ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনর্প্রতিষ্ঠা— করার দিকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি থাকার সুবাদে, দেশের মনোপলি কর্পোরেট পুঞ্জের আর্থিক ও মাধ্যমিক মদতে তারা এখন একটা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সমস্ত আপাতনিরপেক্ষ অঙ্গ— নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, পরিকল্পনা কমিশন, ইত্যাদি— হয় দখল করে নতুবা ভেঙে দিয়ে, বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার গঠিত হলে বিধায়ক কিনে সেই সরকারের গদি উলটে দখল করে, সর্বত্রগামী এক এক-দলগত শাসন চালু করে সঙ্ঘস্বপ্ন পূরণ করার পথে বড় বড় ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। আপাতত সময়টা ওদের। মঘা অশ্লেষা চিত্রা নক্ষত্র হয়ত এখন ওদের কপালেই নাচানাচি করছে।

দেশের বামপন্থী দলগুলির অবস্থা দেখে এবং নেতাদের বিবৃতি পড়ে মনে হয়, তাঁরা এখন খুবই দিশাহারা। রাহুল প্রিয়াঙ্কার মতো হিন্দু কলসি নিয়ে প্রচার করতে তাঁরা হয়ত পারছেন না, বা চাইছেনও না। কিন্তু মন্দির প্রকল্পের কতটা বিরোধিতা করা যাবে, কীরকমভাবে বললে (হিন্দু) পাব্লিক নেবে, পেছন থেকে সরে যাবে না— তা নিয়ে তাঁরা যথেষ্ট চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। রামমন্দির হওয়ায় আপত্তি নেই, কিন্তু এখন এটার সময় নয়; মন্দির হোক, কিন্তু পুরোহিতরা করুক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী যাবেন কেন; দুটো হাসপাতাল তৈরি করে একটা রামমন্দির করতে আসতেন, তাতে আমাদের কিছু বলার থাকত না— এই সব হাবিজাবি কথা শুনলেই বোঝা যায়, নেতারা এই মুহূর্তে কোদালকে কোদাল বলতে ভয় পাচ্ছেন। রাহুলদের পেছনে হাত ধরে থেকে ‘ওই কলসি আমাদেরও ছুঁতে আপত্তি নেই’ গোছের হাবভাব করে তাঁরা শ্যাম (মার্ক্সবাদ, বামপন্থা) আর কুল (ধর্মবিশ্বাসী জনগণ) যুগ্মভাবে রক্ষা করার কঠিন ট্র্যাপিজ খেলা চালাতে চাইছেন।

তাঁরা জোর গলায় বলতে সাহস পাচ্ছেন না— মন্দির না হয় হল, তাতে কী হল?

মজুর চাষির অনাহার অর্ধাহার? করোনাক্রান্ত কোটি কোটি মানুষ? উনিশ কোটি বেকার? লকডাউনের শিকার ৪৩ কোটি স্বনির্ভর রোজগেরে মানুষ— হকার, অটোওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সব্জিবিক্রেতা, মোবাইল কম্পিউটার টর্চ ইত্যাদি সারাইওয়ালা, ইলেকট্রকের মিস্ত্রি, ডেকরেটর, প্রমুখ? প্রাইভেট সেকটর থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা?

এই ঘটনাগুলো তাতে চাপা পড়ে যাবে?

রামের মন্দিরে তাদের পেট ভরবে? তাদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা হবে? হিন্দু হলে, রামমন্দিরের পক্ষে হাত তুলে লাফালে তাদের ঘরে কি মা লক্ষ্মীর কৃপা বর্ষাবে?

অসমে এনার্সিতে যে বারো লক্ষ হিন্দু সহ মোট উনিশ লক্ষের নাম কাটা গেল, রাম এসে তাদের বাঁচাবে?

এই আওয়াজে এখন থেকেই আকাশবাতাস ভরিয়ে তুলতে হবে। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা একটা অপরাধ। ফৌজদারি অপরাধ। একটা বাসের কাচ ভাঙলে যে সরকার গ্রেপ্তার করে অভিযুক্তের গৃহসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করছে, এবং তা আবার আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ লঙ্ঘন করে, তাদের তো আদবানি, উমা ভারতী, অশোক সিঙ্ঘল, প্রমুখকে সেলুলার জেলে (নতুন করে বানিয়ে) পাঠানোর কথা। তার বদলে, সেখানে যারা আদালতের আদেশ রান্না করে নিয়ে এসে মন্দির বানাচ্ছে তাদের উদ্দেশে আপাতত এক দলা থুথু ছাড়া আর কিছুই দেবার নেই!

সেই কথাগুলিই বলুন! মিন্‌মিন্‌ করে নয়, জোর গলায়! অন্তত ক্রিমিন্যালদের চাইতে উচ্চস্বরে!

প্রশ্নগুলো এখন থেকেই তোলা উচিত। লোকের মর্জিমেজাজ বুঝে পরে তুলব, এখন বললে লোকে নেবে না— এই সব আত্মরক্ষামূলক ভাবনাকে জঞ্জালের বালতিতে ফেলে দিয়ে সাহস করে সত্য কথা সঠিক দাবিগুলিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামনে ঠেলে দেওয়া দরকার। যুক্তিতথ্যের চর্চাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে সমাজের বুকে চলমান করে ফেলতে হবে। শক্তি সংখ্যা জ্ঞান বুদ্ধি বামপন্থীদেরও নেহাত কম নয়। হাতে হাত না ধরে অতীতের গদি ও পুঁজিমুখী ত্রুটিবিচ্যুতিগুলিকে নির্মূল করে রাষ্ট্রীয় ও কর্পোরেট ক্রীড়াছকের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের তত্ত্ব ও কৌশল প্রয়োগ করার এবং তার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র উপস্থিতি জানান দেবার এখনই সময়। এই ব্যাপারে সমস্ত বামশক্তিকে এক জায়গায় আনা যায় কিনা তারও প্রয়াস শুরু হোক। মৌলবাদী জঙ্গি হিন্দুচক্রের কৌশলকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের সৃজনশীল কলাকৌশল দিয়ে পরাস্ত করতে শিখতে হবে।

আর একটা নিবেদন। সচেতন ধীমান লেখকরা এগিয়ে আসুন। নতুন করে গল্প উপন্যাস লেখা হোক। যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে শোষণ অপশাসন বিভেদ বিদ্বেষ বিরোধী মানবিক মূল্যবোধ ও গণমুক্তির আবেদনপৃক্ত গান নাটক কোরিওগ্রাফির বন্যাস্রোতে আবার ভাসিয়ে দিতে হবে বাংলা তথা ভারতের সংস্কৃতির খরা।

আসুন, ওদের পলস্থায়ী মন্দির প্যাঁচকলের বিরুদ্ধে ঐক্য, সাহস, বুদ্ধি, সত্য আর সৃজনশীলতাই হোক আগামী দিনে আমাদের দীর্ঘ যাত্রার পাথেয়।