প্রতিভা সরকার
লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী
এক রাজকুমারের কথা। খাস রাজস্থানি, বিশাল গুম্ফমণ্ডিত উন্নতদেহী রাজকুমার, রাজবংশের প্রতিভূ, সাক্ষাৎ রাজার ভাই। নামের আগে রাজা বসে তাঁরও। বিলেত থেকে এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশে চলে এসে রাজপরিবারের অন্যান্য অনেকের মতো পলিটিক্সে নামলেন। আর টপাটপ জিতে যেতে লাগলেন ইলেকশনগুলো। রাজভক্ত প্রজারা বছরের পর বছর তাকে নির্বাচিত করে যেতে লাগল। এমন একটা সময় এল যখন সাতবার দীগ কন্সটিট্যুয়েন্সি থেকে নির্বাচনে জেতার পর সকলে ধরেই নিয়েছে রাজাকে হারাবার ক্ষমতা ভূভারতে কারও নেই।
রাজা মান সিং। রাজ্য রাজস্থানের ভরতপুর। তার পূর্বপুরুষের তৈরি করা পক্ষীউদ্যান, কেওলাদেও ন্যাশনাল ফরেস্ট, হোলির দুদিন পরের ব্রজ ফেস্টিভ্যালের রঙে রঙিন রাজ্য মনোরম ভরতপুর। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর রাজ্যপাট গেলে কী হবে, খেতাব তো আছে। গান স্যালুটও।
হঠাৎ একদিন এ হেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজবংশীয়ের বক্ষদেশ তাক করে গুলি চালিয়ে দিল রাজস্থান সরকারের পুলিশ। স্পট ডেড। রক্তে ভিজে গেল রাজার প্রাইভেট জিপ। সঙ্গীসাথীদের মধ্যেও একজন নিহত। চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ। এফআইআর, তদন্ত কমিশন, আদালতে কেস ঠোকা। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। তবে নিছক কোনও গোয়েন্দা গল্প লেখার ইচ্ছে নেই, তাই সে কাহিনিতে যাওয়ার আগে দু-চারটি কথার কথা।
আসলে কী, একবার যদি আইনের শাসন প্রতিস্থাপিত হয় বন্দুকের নল দ্বারা, তাহলে আর করার কিছু থাকে না। সে বন্দুক তখন রাজা-গজা, দোষী-নির্দোষ, সাধারণ-হাই প্রোফাইল, কিছুই বিচার না করে আকণ্ঠ রক্তপান করতে শুরু করে। সে তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলে, কমে আর না। এখন সারা দেশ জুড়ে সেই অদম্য তৃষ্ণার বাড়বাড়ন্ত। এনকাউন্টার বা গুপ্তহত্যা নতুন নয় ঠিকই, কিন্তু প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি কেসের চারজন, বিকাশ দুবে, লকডাউনে দোকান বন্ধ করতে দেরি করে ফেলা তামিলনাড়ুর বাবা ও ছেলে, এত কম সময়ে এত হত্যা পরপর হওয়াটা নতুনরকম। তাই ঘুরে দেখা ভরতপুরের মহারাজা মান সিংহের জীবন ও এনকাউন্টারঘটিত মৃত্যুকে। মনে করিয়ে দেওয়া, এই প্রবণতা একবার জাঁকিয়ে বসলে সাধারণ মানুষ তো কোন ছাড়, রাজাগজারও রেহাই নেই।
না, কথায় কথায় বিকাশ দুবেদের টেনে আনার দরকার নেই। ঐ কেসগুলো ছাড়াও আরও একশো ঘটনা রয়েছে যেখানে এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় পুলিশ আইনের বিচার ছাড়াই তার নাগরিকদের হত্যা করেছে। এমন নয় যে সে হত্যা সবসময় সন্ত্রাসীদের নিকেশ করবার জন্য বা দাগী অপরাধীকে চুপ করাবার জন্য, যদিও আইনি বিচার তাদেরও প্রাপ্য। প্রায়ই প্রচুর নিরপরাধের প্রাণ যায় এবং পেছনে রেখে যায় একটি ঘাড়ত্যাঁড়া নাছোড় প্রশ্ন, রাষ্ট্রের পক্ষে কি বিচার ছাড়াই নাগরিকের হত্যালীলায় মেতে ওঠা সঙ্গত?
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অনেক নির্দোষকে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এটা এই তথ্যপ্রযুক্তির রমরমার যুগে সবাই জানে। জেনেও না জানার ভান করতে পারি আমরা, কিন্তু তাতে তো ঘটনা পাল্টাবে না যে নকশাল ছেলেদের তো বটেই, সে আন্দোলনের সঙ্গে দূরতম সংস্পর্শ নেই এরকম তরুণদেরও মহা উৎসাহে জবাই করেছে রাষ্ট্র। কাশীপুরের গঙ্গা সাক্ষী আছে কত লাশ ভেসে গেছে। কলকাতার ল্যাম্প পোস্ট বলবে কতজনকে তার সঙ্গে বেঁধে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করা হয়েছে।
কাশীপুর জানে, কাশ্মিরও কি জানে না? রাষ্ট্রের প্রধান বধ্যশালায় অদম্য উৎসাহে বলি চড়ানো হয়েছে, হচ্ছেও। এ অব্দি ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত। এবং এ সংখ্যাটা মৃত টেররিস্টদের নয়, সিভিলিয়ানদের, সাতেপাঁচে না থাকা কাশ্মিরি আমজনতার। কিছুদিন আগে ভাইরাল ভিডিও এখনও মাথায় ঘাঁই মারে— নিজের গাড়ির খোলা দরজার নীচে চিত হয়ে পড়ে আছে বৃদ্ধ দাদুর মৃতদেহ আর তার বুকের ওপর বসে আকুল হয়ে কাঁদছে আড়াই বছরের নাতি। পরিবার সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দাবী করেছে নাতিকে নিয়ে অনতিদূরে নিজের ব্যবসাস্থল পরিদর্শন করতে যাওয়া বৃদ্ধ ভারতীয় সেনার শিকার। কাশ্মিরে ঠান্ডা মাথায় রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার নারী এবং শিশুও।
আশ্চর্য কথা, গোটা দেশ জুড়ে এই রাষ্ট্রীয় হত্যার কোনও ফয়সালা না হওয়াই দস্তুর। তদন্তই হয় গা-ছাড়া, দোষী ধরা পড়ে না, সাজা তো দূরের কথা। সাংবাদিকরা মাঝেমাঝে খোঁচান ঠিকই, তবে খুঁচিয়ে ঘা করতে পারেন না। কারণ অপরাধী হিসেবে যে ধরা পড়ে বা যার বিচার শেষে শাস্তি হয়, সেইই যে গোটা ঘটনার মাস্টারমাইন্ড এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। নাহলে ৬০খানা মামলায় জড়িত গুন্ডেশ্বর কীভাবে সবকটিতেই জামিন পেয়ে সদর্পে বাইরে ঘুরে বেড়ায়? ঘরে ঢুকে রাজনৈতিক নেতাকে খুন করলেও আবার নিহতের সতীর্থরাই বা কী করে খুনীর মাথায় হাত রাখে? আসলে চূড়ান্ত প্রভাবশালী এইসব মাস্টারমাইন্ডরা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয় নিজের পরিচয় গোপন করতে এবং শাস্তি এড়াতে। চুনোপুঁটিরা তিন দশক বাদেও সাজা পায়, আড়ালে থেকে যায় রাঘব বোয়ালেরা, যাদের আমরা উঠতে বসতে সেলাম ঠুকি। এক অর্থে মামলা ঠোকা মানে যেন কাতিলের কাছেই প্রাণভিক্ষার আর্জি পেশ করা। যে রাষ্ট্র গুপ্তহত্যায় জড়িত, তার কাছেই গুপ্তহত্যার শাস্তি চাই বলে আবেদন জানানো।
ভরতপুরের রাজা মান সিংকে হত্যা করা হয়েছিল কীভাবে?
৩৫ বছর ধরে মামলা চলার পর গত ২১ জুলাই, ২০২০, মথুরার এক আদালতে ১১ জন পুলিশ, তাদের মধ্যে এক ডিএসপিও আছে, মান সিং হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্ত হয়। সিবিআই ১৮ জনের নামে চার্জশিট দিলেও এই দীর্ঘ সময়ে ৪ জন মারা যায় এবং ৩ জন বেকসুর খালাস পায়।
সাল ১৯৮৫। তারিখ ২০শে ফেব্রুয়ারি। রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। যথারীতি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট হিসেবে রাজা মান সিং দাঁড়াবেন এবারও, আটবারের বার। অজেয় রাজার বিরুদ্ধে কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছে এক প্রাক্তন আইএএস অফিসারকে। যার হয়ে দীগে নির্বাচনী প্রচারে এসেছেন রাজস্থানের তৎকালীন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী শিব চরণ মাথুর। মিটিং শুরু হবার আগেই কংগ্রেস এবং মান সিংয়ের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মধ্যে প্রথমে ঝগড়া, তারপর হাতাহাতি শুরু হয়। কংগ্রেসিরা নাকি ভরতপুরের ফ্ল্যাগের লাঞ্জনা করে। ভারত স্বাধীন হয়ে গেলেও হাতে গোনা রাজপরিবারের মধ্যে ভরতপুরও ছিল এক অতীত দেশীয় রাজ্য, যার তখনও আলাদা ফ্ল্যাগ ব্যবহার করবার অনুমতি ছিল। সেই ফ্ল্যাগের লাঞ্ছনা! রাজরক্ত এতটাই তপ্ত হয়ে ওঠে যে মান সিং নিজে জিপ চালিয়ে ফুঁড়ে দেন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তৈরি করা সুসজ্জিত মঞ্চ। তাতেও মাথা ঠান্ডা না হওয়ায় তিনি সেই জিপ চালিয়েই মাঠের পাশে অপেক্ষারত হেলিকপ্টারটিকে আক্রমণ করেন। সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরদিন। মাথা ঠান্ডা হলে মান সিং হয়ত ভেবেছিলেন, সত্যি তো আর রাজজমানা নেই যে এইসব কাণ্ড করেও পার পাওয়া যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি। নিদেনপক্ষে লোকদেখানো গ্রেপ্তারি তো সরকারের চাইই। রাজপ্রাসাদে পুলিশ ঢুকলে সে বড় লজ্জার কথা হবে। তার থেকে আত্মসমর্পণই শ্রেয়। আবার লোকলস্কর, এমনকি নিজের জামাইকেও সঙ্গে নিয়ে জিপে উঠে রাজা থানায় চললেন ধরা দেবেন বলে। কিন্তু থানার চৌকাঠ পেরোতে হয়নি তাকে। বুক বরাবর বন্দুক তাক করে গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয় স্বয়ং পুলিশ। নিহত হন রাজা মান সিং ও জিপে থাকা তার আর এক সাথী। বেঁচে যাওয়া জামাই-রাজা তখনকার মতো পালিয়ে বাঁচলেও পরে ফিরে এসে সেই পুলিশের কাছেই এফআইআর করে, যে পুলিশ বয়ান দিয়েছিল মারমুখী রাজার কাছ থেকে আত্মরক্ষার্থেই তারা গুলি চালিয়েছে।
রাজবংশের রক্তপাতের জের বহুদূর অব্দি গড়ায়। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কেস সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রাজস্থানের বাইরে মথুরায় নিয়ে যাওয়া হয় এই হত্যামামলা। কারণ মান সিংয়ের মেয়ে কৃষ্ণন্দু কাউর দীপা চাননি যে কোনও রাজস্থানি কোর্টে তার পিতার হত্যামামলা চলুক। এই দীপাই রাজস্থানে গত বিজেপি সরকারের ট্যুরিজম মন্ত্রীর দায়িত্বভার পেয়েছিলেন। সেই বৈরিতার ট্র্যাডিশন সমানেই চলছে। গেহলট সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য জোট বেঁধেছে শচিন পাইলটের নেতৃত্বাধীন যে ১৮ জন এমএলএ, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বিশ্বেন্দ্র সিং, রাজা মান সিংয়ের ‘ভাতিজা’।
এখন কেউ যদি ভাবে এটি সত্যি সত্যি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মামলা, রাজার রক্ত হিম করা মূর্তি দেখে পুলিশ বন্দুক তাক করে তাকে শুইয়ে দিল, তার কাহিনিতে লোকে ততটাই আস্থা রাখবে যতটা রেখেছে বিকাশ পালাতে পালাতে একেবারে বুক পেতে অজস্র গুলি খেয়েছে জেনে। লোকে তো আর বুক চিতিয়ে পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে পালায় না। রাজস্থানিদের মধ্যে স্ব স্ব রাজ্যের রাজকুলের প্রতি অচলা ভক্তি এখনও আছে এবং মান সিংয়ের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাতবারের এমএলএ এবং রাজবংশের প্রতিভূ যাদের পেশিশক্তিই সম্ভ্রম জাগাবার মূল, তারা মঞ্চ ও হেলিকপ্টারে সামান্য গুঁতো মারলে লোকে খুব বিচলিত হবে, মনে হয়! একেবারে গুলি করে মেরে ফেলবে! তাও ডিএসপি র্যাঙ্কের চুনোপুঁটি পুলিশের নির্দেশে! সত্যি কী ঘটেছিল, কারা ছিল এইসবের পেছনে, সেসব কালের প্রলেপেই ঢেকে যায়। তাও ঢালের মতো সামনে যারা ছিল তাদের শাস্তি হল মান সিং রাজা, বিধায়ক ও প্রভাবশালী ছিলেন বলেই।
৩৫ বছর খুব দীর্ঘ সময়। এত সময় যদি লাগে মামলার ফয়সালা হতে তাহলে বিচারব্যবস্থার ওপর থেকে লোকের ভক্তি চটে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। লোকে মুম্বাইয়ের দয়া নায়কদের ওপর ভরসা করতে শুরু করবে, যার সঙ্গে এনকাউন্টারে ৮৩ জন আন্ডারগ্রাউন্ড বাহুবলীর প্রাণ গেছে। বছরের পর বছর আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ব্যর্থ সিস্টেমে চক্কর কাটতে বাধ্য হলে, ধনেপ্রাণে শেষ হওয়ার উপক্রম হলে, মানুষ হায়দ্রাবাদি কায়দায় পুলিশের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করবেই। ভুলে যাবে রাষ্ট্র বা প্রভাবশালীর বিরাগভাজন হলে ঐ বন্দুকের নল যে কোনও মুহূর্তে ঘুরে যেতে পারে তার নিজের দিকে।
কিন্তু এসব যুক্তি এনকাউন্টারকে বৈধতা দিতে পারে না। তাহলে ব্যক্তি অথবা সমাজের প্রতিশোধস্পৃহা এবং সযত্নে লুকিয়ে রাখা রক্ততৃষ্ণাকে মান্যতা দিতে হয়। ইতিহাস সাক্ষী আছে, আমাদের বর্তমানও জানে, রাষ্ট্রের রক্তপিপাসা কীভাবে টার্গেট করে নিরীহ নাগরিককে, যার নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করাই রাষ্ট্রের মূল কাজ। এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে এক সংবিধানবদ্ধ রাষ্ট্রের পার্থক্য তো এইখানেই যে সে সন্ত্রাসীর মতো ক্যাঙারু কোর্ট বসিয়ে যাকে ইচ্ছে তাকে খতম করে দিতে পারে না। নাগরিকের জানমালের হেফাজত করা তার অবশ্যকর্তব্য। সে জন্য তাকে বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই যেতে হবে, কাউকে ফাঁসি দিতে হলেও বিচার সম্পন্ন করেই দিতে হবে।
তবু যদি রাষ্ট্রের অবিবেচনা এবং দীর্ঘসূত্রিতায় জনমত বিপুলভাবে ঝুঁকে পড়ে এনকাউন্টারপন্থীদের দিকে তাহলে শিগগরিই এমন এক রাষ্ট্রের অধিবাসী হব আমরা, যার সঙ্গে তুলনীয় হবে সার্কাসপার্টির একটি লোহার শক্তপোক্ত খাঁচা। সে খাঁচায় থাকবে গর্জনরত এক বুভুক্ষু শ্বাপদ যাকে বাগে আনবার কোনও কৌশল জানা তো দূর অস্ত, আমাদের হাতে নেই ভয় দেখাবার মতো একটি সপাট চাবুকও!