Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্মার্টফোন কি এখনকার সময়ের আফিম?

সুমন সেনগুপ্ত

 


লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার, সমাজকর্মী

 

 

 

 

বহুদিন আগে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের সহায় আর মানবজাতি যাতে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে ধর্ম হল সেই আফিম। আজকেও কি তাই বলা যায়? আজকেও কি সেই ধর্মের ধ্বজাধারীরাই নিয়ন্ত্রক? মন্দির, মসজিদ, গির্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনের প্রধান অর্থাৎ পুরোহিত, ইমাম বা পাদ্রিরাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন? নাকি আজকের সময়ে এই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছেন অন্য কেউ বা অন্য কিছু?

এই মুহূর্তে করোনা সংক্রান্ত লকডাউন উঠে আমরা আনলকের প্রথম পর্যায়ে আছি আর পাশাপাশি ভারতবর্ষ একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। অনেকে ভাবছেন হয়তো করোনার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বা চিনের সঙ্গে লাদাখে যে ছোটখাটো সংঘর্ষের কথা বলা হচ্ছে সেই সংক্রান্ত বিষয়ের কথা বলা হচ্ছে। না, তা নয়। এটা হচ্ছে ভারতের বাজার দখল করার যুদ্ধ। সারা দেশে বিভিন্ন ভাষায় যে সিনেমা এবং টিভির লাইভ স্ট্রিমিং চালু হয়েছে দেশের প্রায় সাড়ে ৮ কোটি স্মার্ট ফোনে সেই বাজার দখল করার যুদ্ধ। নেটফ্লিক্স, ডিজনি, অ্যাপেল টিভি, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই আরও অজস্র এইরকম মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে অলিখিত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের এই বাজারের কে সবচেয়ে বেশি দখল নিতে পারে সেই নিয়ে চলছে লড়াই। কোনও কোনও কোম্পানি বাজার ধরার জন্য তাঁদের এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাসিক খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ অবধি কমিয়ে দিয়েছে। ঠিক যেভাবে ওয়ালমার্ট এবং অ্যামাজন বিশ্বের বাজার ধরেছে ঠিক সেভাবেই আগামী দিনে এই তথ্য প্রযুক্তির জলহস্তীরা আঞ্চলিক বাজার ধরতে ঝাঁপাবে এটা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা কি আর নতুন করে বলতে হয় যে একটি সমাজে যত রকমেরই বৈচিত্র থাকুক না কেন, বিনোদন এবং তথ্য হচ্ছে সেই দুই অস্ত্র যা দিয়ে সেই সমাজকে সহজেই কব্জা করা সম্ভব। যদি সেই পাভলভের বিখ্যাত কুকুরের লালারসের নিষ্ক্রমণের পরীক্ষার কথা মনে করা যায় তাহলে কি বলা যায় না যে সেই সমাজকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করার অস্ত্র কারও কারও হাতের মুঠোয় এসে গেছে এখন এবং আজকের সময়ে তাঁরাই নিয়ন্ত্রক?

ব্রিটিশ লেখক, অ্যালডস হক্সলে তাঁর বিখ্যাত, ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ বইতে যে ছবিটা দেখিয়েছেন তা দেখলেই বিষয়টি হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে। তিনি বলেছিলেন যে এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ আর কিছু ভাববে না, চিন্তা করবে না, পড়াশুনা করবে না, কোনও বৈধ প্রতিবাদে সামিল হবে না কারণ তাঁদেরকে ব্যস্ত রাখা হবে বিনোদন দিয়ে। তিনি হয়তো সেদিন এই কথাটা পরিষ্কার করে ভেবে উঠতে পারেননি, কিন্তু সহজ করে বললে, হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্মার্ট ফোনে ২৪ ঘণ্টা এবং ৩৬৫ দিন বিনোদন এবং তথ্যের যে ভাণ্ডার আমাদের সামনে রোজ আসছে তাতে কি কোনও মানুষের পক্ষে কোনও কিছু গভীরভাবে জানা সম্ভব? এই মানুষেরা কি ইতিহাস সম্পর্কে ঔৎসুক্য দেখাতে পারে? এই মানুষেরা আত্মম্ভরী, নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সুতরাং তাঁদেরকে নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র বিনোদন।

অন্যদিকে জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত ‘১৯৮৪’ বইতে দেখিয়েছেন যে এমন একটা সমাজ যেখানে মানুষেরা অত্যন্ত সন্ত্রস্ত, ভীত। তাঁদের কোনও নিজস্বতা নেই, চিন্তা-ভাবনা করাই একটা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, কোনও বিদ্রোহ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইতিহাস সেই সমাজে সঙ্কলিত করে রাখা একটি বস্তু— যা ছুঁতে নেই। আজকের সময়টা হয়তো এই দু ধরনের মানুষের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। যারা একদিকে ভীত, সন্ত্রস্ত অন্যদিকে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, নিজেদের বিনোদন, নিজেদের খাবার-দাবার এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে তার ছবি দেওয়া এবং এই সমস্ত আত্মম্ভরিতা তাঁদের ঘিরে রেখেছে। এই করোনা সংক্রান্ত ভয় এবং তার সঙ্গে যুক্ত লকডাউন হয়তো এই সংমিশ্রণকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। পুরো লকডাউন জুড়ে এই মানুষেরা ব্যস্ত থেকেছেন মূলত নিজেদের নিয়ে, এই লাইভ স্ট্রিমিং সিনেমা দেখে আর সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখে বা ছবি দিয়ে। এই যে প্রধানমন্ত্রীর কথায় প্রচুর মানুষ করোনার মোকাবিলা যারা করছেন তাঁদের জন্য থালা বাজালেন, ঘণ্টা বাজালেন বা আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন সেটাও ওই বিনোদনেরই অংশ। প্রধানমন্ত্রীও সেটা জানেন বলেই তাতেই যাতে নাগরিকেরা ব্যস্ত থাকেন তার বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেটা নিয়েই যাতে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা হয়, যাতে আসল সমস্যার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখা যায় তাই এই ব্যবস্থা। পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাস্তায় হাঁটছেন, কিন্তু সেটা নিয়ে না ভেবে, না চিন্তা করে যাতে এই ‘ গিমিক’ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হয় সেটা কি শাসকের জন্য সুবিধাজনক নয়?

সোশানা জুবফ, হার্ভার্ডের অধ্যাপক তাঁর বিখ্যাত ‘দি এজ অফ সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিসম’ এ লিখেছেন একজন মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কী করে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজমের আওতায় আনা হয়। সহজ করে বললে, একজন ব্যক্তি মানুষ ইন্টারনেটে যা কিছু দেখে, যা কিছু খোঁজে, ভবিষ্যতে সেভাবেই তাঁর ব্যবহারকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাই হল সারভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম। একজন মানুষ যখন গুগলে কিছু জিনিস খোঁজেন, সেটা হয়ে যায় সেই মানুষটির ব্যবহারের মাপকাঠি। এরপর সেই ব্যবহার দিয়ে মানুষটিকে চেনা হয়, ঠিক একই রকম ভাবে অ্যামাজন বা ফেসবুকে একজন মানুষ যা যা করেন ঠিক সেইরকমভাবেই তাঁর পছন্দ অপছন্দগুলো জানা হয়ে যায় ওই কোম্পানি বা কর্পোরেটদের, সেইমতো পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ করা হয় মানুষদের। কিছুদিন আগে ফেসবুকের মালিক মার্ক জুকেরবার্গ আমেরিকার এক সংবাদপত্রে একটি উত্তর সম্পাদকীয়তে লিখেছেন যে তাঁরা এতটা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন যে তাঁরা এই করোনার মতো অতিমারির কী করে মোকাবিলা করা যায় সেই সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবেন শুধু ফেসবুকের তথ্য সংশ্লেষণ করেই। শুনলে আরও অবাক লাগতে পারে প্রতি সেকেন্ডে একজন মানুষ এরপরে কী লিখবেন সেটাও তাঁরা বলে দিতে পারেন। উনি বলেছেন যে যেহেতু এই মুহূর্তে সরকারগুলো ভাবছে কি করে এই করোনাকে মোকাবিলা করবে, তাই ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারে, কোথায় ভেন্টিলেটর লাগবে, কোথায় পিপিই লাগবে, কাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, বা কোন অঞ্চলকে করোনা মুক্ত বলা যাবে, এই সমস্ত বিষয়ে নাকি ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম সাহায্যে আসতে পারে। সমস্ত অঞ্চলের সমস্ত তথ্য যেহেতু সরকারের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তাই এই কোটি কোটি মানুষের তথ্য যা ফেসবুকের কাছে সবসময়ে থাকে তা দিয়ে এই করোনার বিরুদ্ধে কী করে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তা কাজে আসতে পারে বলে জুকেরবার্গ তাঁর অভিমত জানিয়েছেন।

নাৎসি জার্মানির সময়ে ছিল আইবিএম। কীভাবে তাঁরা ইহুদিদের চিহ্নিত করেছিল তারপরে গণহত্যা করেছিল তার সম্বন্ধেও বহু লেখাপত্র আছে। দিল্লির গণহত্যাতেও এরকম বেশ কিছু মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হয়েছিল। সরকার করোনা মোকাবিলার নামে ‘আরোগ্য সেতু’ বা সরকারি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আধারকেও একইভাবে ব্যবহার করার দিকে এগোচ্ছে। এখন যেভাবে তথ্য নেওয়া হচ্ছে তাতে  এটা কি বলা যায় না যে আর বেশিদিন নেই, কিছু মানুষের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচনের ফলকে এদিক ওদিক করানো হবে? একটা সময়ে ছিল যখন ধর্মকে আফিম বলাটা যুক্তিযুক্ত ছিল এবং সেটাই ছিল নিয়ন্ত্রক আর এখন কি তাহলে স্মার্টফোন এবং তার সঙ্গে আসা হোয়াটস্যাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়াই আমাদের চালনাকারী? বলা ভালো নিয়ন্ত্রক ?

যার বাজার দখলের জন্য এই অলিখিত যুদ্ধ চলেছে? ফেসবুক, অ্যামাজন, গুগল না অ্যাপেল কে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তার লড়াই? মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে তাঁর ভবিষ্যতকে নাকি এই ধরনের কোম্পানিরা নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষকে তা হয়তো আগামী দিনে বোঝা যাবে, কিন্তু যেখানে এই কোম্পানিদের বেড়ে ওঠা, সেখানকার মানুষেরা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছেন যে মানুষই তাঁর ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রক কোনও স্মার্টফোন বা তার সঙ্গে আসা সোশ্যাল মিডিয়া নয়। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর লড়াই যেভাবে সংগঠিত হয়েছে তাতে কি আশা জাগে না যে লড়াইটা অন্যভাবে করা যায়, কিংবা সম্ভব?