Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাশ্মির আমাদের থেকে পিছলে সরে যাচ্ছে: সেহলা রশিদ

বেতয়া শর্মা

 

গত ৬ই আগস্ট নতুন দিল্লিতে এসেছিলেন সেহলা রশিদ। ঠিক এক বছর আগে ৫ই আগস্ট ২০১৯ জম্মু ও কাশ্মিরের অর্ধ-স্বশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভারতীয় সংবিধানের কে ৩৭০ ধারাটি আছে, তা বিলোপ করেন নরেন্দ্র মোদি সরকার। এর ফলে ভারতের একমাত্র সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্যটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। এবং সেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় সেখানকার কয়েক হাজার সমাজকর্মী, আইনজীবী এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের। এর পরে গত এক বছরে মোদি সরকার সেখানে যাতে ভারতীয়রা ভোটাধিকার এবং জমি কেনবার ব্যবস্থা করতে পারেন, তা সম্ভব করেছেন। এছাড়া, সংসদীয় এবং বিধানসভা নির্বাচন ক্ষেত্রগুলিকে নতুন করে নির্ধারণ করেছেন যাতে হিন্দু-অধ্যুষিত জম্মু ডিভিশনের ভোট নিশ্চিত করে ক্ষমতার ভারসাম্য নিজের অনুকূলে রাখতে পারেন। আগে এই অঞ্চলে জমি কিনতে হলে ভারতীয় সুরক্ষা বাহিনীর থেকে একটি নো অবজেকশন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হত। মোদি সরকার সেই আদেশও প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গত বছরের ৫ই আগস্ট থেকে এখন অবধি জম্মু ও কাশ্মিরের আর্থিক ক্ষতির হিসাব প্রায় ৪০.০০০ কোটি টাকা।

২০১৯-এর আগস্টে কাশ্মিরি রাজনৈতিক কর্মী সেহলা রশিদ ট্যুইটার-এর মাধ্যমে অভিযোগ জানান যে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তব্ধ করে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মিরিদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। সেইসময়ে তাঁর যুক্তি ছিল যেহেতু মিডিয়াকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে, তাই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই গুরুতর অভিযোগ জানানো ছাড়া তাঁর গত্যন্তর ছিল না। তাঁর ট্যুইটের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ দায়ের করা হয়। দিল্লি পুলিশ একটি এফআইআর বানিয়ে বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে।

রশিদের অনলাইন ভক্তের সংখ্যা কম নয়। তিনি মোদি সরকারের সমালোচনায় বরাবর সোচ্চার। জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’ ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৬ সালে জেএনএউ-এর তিন ছাত্র কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সরব হওয়ার সময়ে তিনি সবার নজরে আসেন। ২০১৯-এর মার্চ মাসে সহযোগী এক কাশ্মিরি এবং প্রাক্তন আইএএস অফিসার শাহ ফয়জল-এর প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন রশিদ। তারপর ১৪ই আগস্ট থেকে শাহ ফয়জলকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে।

সংবাদ পোর্টাল হাফপোস্ট-এ ৫ই আগস্ট ২০২০-তে প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে রশিদ ৩৭০ ধারা বিলোপের একটি বছর, তাঁর আনা অভিযোগের জেরে কী সমস্যার সম্মুখীন তাঁকে হতে হচ্ছে এবং তাঁর মতো একজন তরুণ কাশ্মিরির চোখে কাশ্মিরের রাজনীতি কেমনভাবে ধরা পড়ছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন বেতয়া শর্মা-র সঙ্গে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য রইল সেই সাক্ষাৎকারের বাংলা ভাষান্তর। ভাষান্তর করেছেন সত্যব্রত ঘোষ

৩৭০ ধারা বিলোপের এক বছর পর কী মনে হচ্ছে?

ভারতীয় মুসলিম এবং কাশ্মিরি মহিলা— এই দুই জটিল পরিচিতি নিয়ে আমাকে বাঁচতে হচ্ছে। নতুন এই ভারতে একজন মহিলা হিসেবে, একজন মুসলমান হিসেবে, একজন কাশ্মিরি হিসেবে, একজন গবেষণার ছাত্রী হিসেবে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে আমার বাঁচার পরিসর। এই বিশাল বিবিধধর্মী দেশটায় সবাইকে এক রঙে রাঙিয়ে সমগোত্রীয় বানাবার একটা চেষ্টা চলছে। আগে দিল্লিতে থাকতে একজন কাশ্মিরি হিসেবে ভয় পেতাম। এখন কাশ্মিরেই একজন কাশ্মিরি হয়ে থাকতে ভয় করে। হয়তো এই ভয় মনস্তাত্ত্বিক, কিন্তু সরকার এখন এটাই করছে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল এই অসুরক্ষিত মনোভাব। কাশ্মিরে, আমাদের নিজেদের বাড়িতে এমনটাই চলছে। আগে যেখানে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রচলন ছিল বিশেষ করে। এখন মনে হচ্ছে সব যেন পিছলে যাচ্ছে আমাদের থেকে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আমাদের থেকে। আমরা ইতিমধ্যেই স্মৃতিবেদনায় ভুগছি।

মনে হচ্ছে যে কাশ্মির আমাদের ঠিকানা, যেখানে আমাদের সংস্কৃতি স্পষ্টতই সমৃদ্ধ হত, তা যেন পিছলে সরে যাচ্ছে আমাদের থেকে।

কেন মনে হচ্ছে পিছলে যাচ্ছে?

মনে হচ্ছে কারণ, সাংস্কৃতিক স্তরে আমরা আক্রান্ত, এই ভয়টি আমাদের আছে। মোদ্দা বিষয়টা হল, কাশ্মিরে যে আমরা কাশ্মিরিদের মাঝখানেই রয়েছি এটা নয়। যে পরিসরে আমরা আমাদের অধিকার, আমাদের সংস্কৃতি, আমরা যেমনভাবে থেকে এসেছি, যেভাবে জামাকাপড় পরেছি, যেভাবে কথা বলেছি, তার সম্মান থাকবে কি না।

এই দেশে আমরা এখন সংখ্যালঘু। একটা রাজ্য ছিল যেখানে মুসলমানদেরই সংখ্যা বেশি। আমরা জানি সংখ্যালঘুদের কীভাবে কাশ্মিরের বাইরে চাকরির ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বাসস্থানের ক্ষেত্রে বিভেদের শিকার হতে হয়। আমরা ভেবে এসেছি অন্তত একটা জায়গা আছে যেখানে কাশ্মিরি মুসলমানদের থাকবার জন্য বিভেদের সম্মুখীন হতে হয় না। কাশ্মিরে মুসলমান হয়ে থাকতে আমার ভয় করে না। কিন্তু বাকি ভারতের ক্ষেত্রে তা নয়। কাশ্মিরে আমি একজন সংখ্যালঘু নই, আমার সংস্কৃতি দেখে কেউ ভুরু কোঁচকাবে না, ইনসানাল্লাহ অথবা আলহামাদুইল্লাহ বলবার জন্য আমাকে দুবার ভাবতে হয় না। এখানে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নই।

মনে আছে যখন আমি প্রথমবার চাকরি করতে দিল্লি গেছিলাম, তখন বিশেষভাবে আবেদন করেছিলাম ইদ-এ যেন আমাকে ছুটি দেওয়া হয়, যাতে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে দিনটা উদযাপন করতে পারি। আমি তখন একজন শিক্ষানবিশ, তাই ছুটিটার জন্য যথেষ্ট লড়তে হয়েছিল। এটাই বলতে চাইছি। আপনার সংস্কৃতিকে এখানে অবজ্ঞা করে মার্জিনের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়।

আপনার কেন এটাও মনে হচ্ছে আপনার বাড়িও হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে?

মনে হচ্ছে যেন আমাদের নিয়ে টানাটানি চলছে, রাজনীতির ফুটবলের মতো আমাদের ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতাশীল দলের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী। তাই একধরনের অসহায়তা কাজ করছে।

আমাদের বলা হয়েছে এই পরিবর্তন করা হচ্ছে অঞ্চলটির উন্নয়নের স্বার্থে, কিন্তু এক ন্যক্কারজনক উপায়ে এলাকাটিকে নিজের হাতে নেওয়ার জন্যই তো এসব করা হয়েছে। এটা আমাদের উন্নয়নের জন্য বা জাতীয় মূলস্রোতে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। মানুষদের দরিদ্রতর বানানো হয়েছে। ইচ্ছাকৃত উপায়ে কাশ্মিরের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। বহু মানুষ তাঁদের দেনা শোধ করতে পারছেন না। তার উপর ওনারা আবার ধার নিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। ধার একবার শুধতে না পারলে, বিশেষ করে ব্যবসায়ী এবং উদ্যোগকারীদের জমিগুলি বহিরাগতদের জন্য নিলামে ডাকা হচ্ছে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরবর্তীকালে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দুর্ঘটনাবশত এই অর্থনৈতিক ধ্বংসলীলা চলছে, এমনটা কিন্তু নয়। অর্থনৈতিক ধ্বংসলীলাটাই কাশ্মিরের রাজনৈতিক অধিগ্রহণের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে।

যখন ৩৭০ ধারা বিলোপ হল, কাশ্মিরিরা প্রথমে তা নিয়ে কী বলছিলেন? গত এক বছরে তাঁদের এই প্রসঙ্গে কথাবার্তায় কেমন ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে?

যখন প্রথম ঘটল, তখন লড়ে ফেরত পাওয়ার একটা মানসিকতা ছিল। বিলোপ করার সিদ্ধান্তটির বিরুদ্ধে মামলা করবার তাগিদ ছিল, এই আশায় যে আমরা জিতব কারণ যুক্তি আমাদের পক্ষে। এখন অবসাদ ঘিরে ধরেছে। আমরা এখনও বিশ্বাস করি আমাদের যুক্তি যথেষ্ট মজবুত, কিন্তু সমস্যা হল সুবিচার হবে কি না, তা নিয়ে দোলাচল রয়েছে। আমরা বুক বেঁধে আছি সুপ্রিম কোর্ট কী বলে তা নিয়ে, কিন্তু সরকার আমাদের স্বচ্ছন্দে জিতে মামলা নিরসন করতে দেবে না। এই লড়াই তো নিয়ম মেনে হচ্ছে না। এখানকার মানুষ যখন জিজ্ঞাসা করছেন সুপ্রিম কোর্টে চলা মামলাটার কী হল, আমরা কি জিততে পারি, তখন প্রশ্নটাই অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আপনিও কি হতাশ?

হতাশ কি না, তা নিয়ে কথা বলাটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভুল। তবে আমরা যা দেখছি, তার ব্যাপকতা মানতেই হবে। কাশ্মিরি হিসেবে আমার যে প্রত্যয়, তা ৫ই আগস্ট ২০১৯-এই চুরমার হয়ে গেছে। কমবয়সী অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ এক ভারতবর্ষের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল, কিন্তু নাগরিক সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর তাদের বিশ্বাসও ভেঙে গেছে। এখন ৫ই আগস্ট রাম মন্দিরের উদ্বোধন হবে।

এই যে মুহূর্তটির মধ্যে আমরা আছি, তাতে যে অবিচার চলছে, তা স্বীকার করতে না পারলে, সম্পূর্ণ ছবিটা আমাদের চোখে ধরা দেবে না। একের পর এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার ফলে যে মূল্যবোধগুলির প্রতি এই দেশ দায়বদ্ধ ছিল, সেগুলিকে দলে পিষে দেওয়া হয়েছে— কিছুটা ধর্মনিরপেক্ষতা, কিছুটা যুক্তরাষ্ট্রতন্ত্র, কিছুটা ন্যায় আর সুবিচারের আশা।

হতাশা নিয়ে কথা বলাটা রাজনৈতিক অর্থে ভুল হলেও এই যে অবিচার প্রত্যক্ষ করছি তা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।

আপনি এমনভাবে বলছেন যে কাশ্মিরে জনতত্ত্বের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী এখন অবধি বহু মানুষ কাশ্মিরের তুলনায় জম্মুতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করাটাকে শ্রেয় মনে করছেন?

এই পরিবর্তনগুলি এত দ্রুত ঘটানো হচ্ছে এবং আমরা তার ধাক্কা সামলাতে পারছি না। ২০১৯-এর ৩রা আগস্ট আমি একটি ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে মানুষদের আশ্বস্ত করে বলি যে প্রত্যাহার নিয়ে যে গুজবগুলি ভাসছে সেগুলি মিথ্যা এবং মানুষ যেন সেগুলি বিশ্বাস না করে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যা আইন, ইতিহাস এবং যুক্তির ভিত্তিতে তৈরি, সেই ৩৭০ ধারাটি নিয়ে ছেলেমানুষি করা যায় না। কিন্তু সবকিছু এত দ্রুত পালটে গেল, যে তার ধাক্কাটা কম নয়। আমার কিন্তু যে জোরালো বিশ্বাস ছিল ৩৭০ ধারাটি ছোঁয়া যায় না, তা আর নেই। অন্য যা কিছু ঘটেছে একে অনুসরণ করেই ঘটেছে। আমরা যদিও তার আইনসিদ্ধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছি, কিন্তু আমাদের কথা ভেবে কিন্তু স্টে দেয়নি আদালত। এ কম বড় আঘাত নয়। সরল সাদাসিধেভাবেই আমরা আশা করেছিলাম স্টে পাব। কারণ এত বড় একটি সিদ্ধান্ত। আদালত স্টে দিতে পারতেন। এমনটা বিশ্বাস করবার কারণ নেই যে এমনটাই ঘটবে না বা অমনটা ঘটবে না।

৩৭০ ধারা আপনাদের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন?  

৩৭০ ধারা পারস্পরিক বিশ্বাসের নিদর্শন। আমি মনে করি উন্নয়ন মানে মানুষের উন্নয়ন। আমার বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মানব উন্নয়ন সুনিশ্চিত করে। রাজ্যগুলি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। শুধুমাত্র কাশ্মিরে ৩৭০ ধারাই নয়। আপনি দেখুন অন্য রাজ্যগুলিতেও সরকার ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রথার প্রতি বর্তমান সরকারের বিশেষ সম্মান নেই।

আমি এমন এক রাজ্যে বড় হয়েছি যেখানে ভূমিসংস্কার বেশ ভালোভাবেই কার্যকর হয়েছে, শিক্ষাসংস্কার ভালোভাবে কার্যকর হয়েছে। আমি যে স্কুলে পড়াশুনা করেছি সেখানে যথেষ্ট সমমাত্রিক ভাবনা ছিল। আমি মানুষদের না খেয়ে কাতর হতে দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম প্রথম লকডাউনের সমর্থন করেছি বলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমি তখন মেসেজ লিখে জানিয়েছি যে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা লকডাউনে আমাদের সবার সমর্থন করা উচিৎ। কাশ্মিরে ছোটবেলা থেকে এত লকডাউন দেখে আসছি, কিন্তু কাউকে দেখিনি খাবার না পেয়ে কেউ কষ্ট পাচ্ছেন। কয়েক মাস আগে দিল্লিতে আমরা যা দেখেছি তা ঘৃণার্হ অপরাধ। দেশের রাজধানী থেকে মানুষ হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফিরছেন।

আপনি প্রথমদের মধ্যে একজন যিনি ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মিরের সাধারণ মানুষের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যাচার নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন আপনি ট্যুইট করেছিলেন

তা নিয়ে আমার কোনও অনুতাপ নেই। আমি মিথ্যা বলিনি। যা বলেছি পরবর্তীকালে নামজাদা মিডিয়া হাউসগুলি তা নিয়ে রিপোর্ট করেছে। এই সত্যিগুলি সেই কাহিনিরই অংশ যাতে ইনসারজেন্ট-দের অন্যায়গুলিকে সবার দৃষ্টিগোচর করা হয়েছে, আমার মিথ্যা বলবার কোনও কারণ নেই। আমি মিথ্যা বলিনি। আমি সত্যি বলেছি এবং বলব। আমাকে আবার যদি ঐ অবস্থায় ফেলা হয়, তাহলেও আমি আবার একই কাজ করব। আমার মনে হচ্ছে যখন কেউ কিছু বলছে না, তখন কথাগুলি বলা আমার কর্তব্য। এখন, অনেক কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন। কাশ্মিরিরা ট্যুইটার আর ফেসবুকে লিখছেন, সাংবাদিকরা রিপোর্ট করছেন, বহু রাজনৈতিক নেতা এখন মুক্ত। কিন্তু তখন যে  কয়েকজন কথা বলতে পারছিলেন, আমি তাঁদের একজন। আমার মনে হয়েছিল— ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর শের আছে না— “বোলকি লব আজা়দ হ্যাঁয় তেরে…”, যতক্ষণ বলতে পারবে ততক্ষণ অত্যাচারিতদের কথা বলো।

রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল

আমি দিল্লি পুলিসের স্পেশাল সেল-এর সঙ্গে সহযোগিতা করেছি। আমি জানি না কেন এই মিথ্যা কেসটির তদন্তে স্পেশাল সেল-কে নিযুক্ত করা হয়। সময়ের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এর কারণ সেই নজর অভিলাষী আইনজীবীটি (যিনি অভিযোগ করেছিলেন)। কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছি। আমি যা বলেছি, তাতে অভিযোগটি খণ্ডন করা গেছে। আমার মনে হয় না কেসটির আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে। কিন্তু বিচারব্যবস্থা কেমনভাবে কাজ করে আমরা জানি। সমাজকর্মীরা অন্যায় না করেও জেলে বন্দি।

এটা কি বিরক্তি?

বিরক্তির চেয়েও বেশি। এটা বিপত্তি। পরের বার যখন আমি জানব যে কোনও অনাচার ঘটেছে অথবা মানুষ ভয়ে আছে এবং আমি জানি তাঁদের কাছে আশার আলো পৌঁছে, তা আমি থামাতে পারি, তখন আমি পা বাড়াব কিনা চিন্তা করব। এক সময় সত্যি গ্রেপ্তার হয়ে যাবার ভয় ছিল। আমার চারপাশের মানুষগুলিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কেস রুজু হয়েছে। আমার পরিবারকে তখন আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত করছি, আমি গ্রেপ্তার হলে কী হবে। আমি তাঁদের বলেছি আমাকে যদি গ্রেপ্তার করে, করুক। আমার বোন ভেঙে পড়ছিল, কারণ আমি যে গ্রেপ্তার হতে পারি সেই সম্ভাবনা মেনে নিতে পারছিল না সে। পরিবারের উপর এই এফআইআর যেভাবে চাপ ফেলে, তাতে দুবার ভাবতে হয়। একটা দোটানা চলছে। আমি চাইছি রাষ্ট্র যেন অনাচার করা থেকে নিবৃত্ত হয়ে নিজের সম্মান বাঁচায়। আর ওরা চাইছে আমার বিরুদ্ধে এফআইআর করে আমাকেই যেন নিবৃত্ত করা যায়।

এখন তো শোনা যাচ্ছে জম্মু-কাশ্মিরের রাজ্য অবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা চলছে

আমরা যারা ৫ই আগস্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন করেছিলাম, রাজ্য অবস্থা ফিরিয়ে দেওয়াটা তাঁদের কাছে আংশিক জয় মাত্র। ১৯৫৩ সালের পরে রাষ্ট্রপতির যে নির্দেশগুলি আরোপ করা হয়েছে আমাদের আবেদনে আমরা তার সবগুলিকে চ্যালেঞ্জ করেছি। রাজ্যগুলির পুনর্সংযুক্তিকরণও চাইছেন ওনারা। লাদাখের যে মানুষরা আলাদা রাজ্য পেয়ে খুশি, আমি তাঁদের সম্মান করি। তবে প্রায় তত সংখ্যক মানুষই অখুশি, বিশেষ করে কার্গিলে। দীর্ঘ এক সময় ধরে আমাদের জীবনে লাদাখিরাও আমাদের কর্মক্ষমতা এবং সাংস্কৃতিক পরিসরের অংশ। সেই বন্ধনকে অত্যন্ত হিংস্রভাবে ছেদ করা হয়েছে।

এখন কাশ্মিরের রাজনীতি বলতে আপনি কী বুঝছেন?

কাশ্মিরের রাজনীতি এখন পুতুলনাচ। যাদের মানসিকতা একটু বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে, তাঁরা হয়তো বলবেন বরাবরই এখানকার রাজনীতি পুতুলনাচই ছিল। নৈরাশ্যবাদীরাই শেষ হাসিটা হাসছেন। আমরা সিস্টেমের মধ্যে কাজ করবার চেষ্টা করেছি, সিস্টেমকে কাজে জড়িয়ে রেখেছি এবং সেই নৈরাশ্যবাদীদেরও জড়িয়েছি যারা হয়তো বলেছেন ভারতীয় গণতন্ত্র একটা বুজরুকি। আমরা বলতে চেয়েছি যে সিস্টেমের সঙ্গে আমাদেরও জড়াতে হবে, আমাদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়তে হবে, প্রকৃত নেতৃত্ব খুঁজে তাঁকে সমর্থন জোগাতে হবে এবং প্রকৃত অর্থে মানুষের কণ্ঠস্বর হতে হবে। আমরা ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছি।

আর এখন?

আমরা যদি সুপ্রিম কোর্টের মামলায় না জিতি, তাহলে আমি নিজেকে রাজনীতিতে ফিরে যেতে দেখতে পাচ্ছি না। পরিবর্তন বিষয়ে আমার যে তত্ত্ব ছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। আমার যুক্তি ছিল ভারত কিছুতেই ৩৭০ ধারায় বদল ঘটাতে পারে না। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বড় হয়েছি। ১৯৫৩ সালে যা ঘটেছিল, ২০১৯-এ তা ঘটতে পারে না। কারণ আমাদের হাতে ইন্টারনেট আছে। এর থেকে আমি বলতে চাইছি, যখন শেখ আবদুল্লাকে জেলে বন্দি করা হল, তখন বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়ে গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়নি। আমি ভেবেছিলাম আমাদের নেতাদের জেলে বন্দি করা হলে আমরা চিৎকার করব এবং জিতে আমাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনব। কিন্তু স্পষ্টতই আমি ভুল ভেবেছি। সরকারকে শুধু স্যুইচগুলি অফ করতে হল এবং আমাদের কণ্ঠস্বরগুলিকে স্তব্ধ করতে হল এবং তাঁরা সেটাই করেছেন। পরিবর্তন নিয়ে আমার তত্ত্ব চুরমার হয়ে গেছে। আমার মনে হয় জনগণের কাছে আবার ফিরে গিয়ে একই কথাগুলি আরেকবার আউরানোটা সত্যিকারের বোকামি হবে। যে মানুষেরা বলেন ভারত একটি দখল বাহিনী, ভারত সরকার তাঁদের ধারণাকে ঠিক বলে শিলমোহর দিলেন।

আপনার কি মনে হয় রাজ্যের মর্যাদা ফিরে এলে কাশ্মিরি রাজনীতিবিদরা ভারত সংক্রান্ত বিষয়ে যোগ দিতে আরও বেশি ইচ্ছুক হবে?

সবার কথা বলতে পারছি না। কারণ, প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা এক এক রকমের। প্রত্যেকেই বিভিন্ন পর্বের মধ্যে দিয়ে গেছেন। আমাদের বিশ্ববীক্ষা তৈরি হয় আমরা যা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাই, তার ভিত্তিতে। সম্ভবত রাজনীতিতে আমি কনিষ্ঠতম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি জানি না কেমন করে এই ব্যাপারটিকে আত্মস্থ করব। আমার যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল ৩৭০ ধারাটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় না। আমার মনে হয় রাজ্যসত্তা ফিরিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্রীয় সরকার দরকষাকষির একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করছেন। আমরা যদি সূর্য দাবি করি, আমাদের দেওয়া হবে চাঁদ। কিন্তু আমরা যদি চাঁদ পাওয়ার দাবি নিয়ে শুরু করি, তাহলে আমার মনে হয় না আমরা কোথাও পৌঁছাব। আমার মনে হয়, দাবি নিয়ে আমাদের অনড় থাকা উচিৎ। আমি একা আমার কথাটুকুই বলছি। কিন্তু ২০১৯-এর ৫ই আগস্টের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়াটা ছাড়া আর কোনও কিছুতেই আমার মনে হবে না যে আমরা জিতেছি।

এই এক বছর কেমন কাটালেন?

নীরব থেকে আমি বুঝতে চেয়েছি পরিবর্তন নিয়ে আমার যে তত্ত্ব, তার স্বরূপটি কী। আমি যুক্ত থেকে কাজেতে বিশ্বাসী, উন্নয়নের প্রতি আমার আস্থা আছে এবং মনে করি দরকষাকষি করতে হলে সমবেতভাবে করতে হবে। সেই ভাবনাগুলি এখন চুরমার হয়ে গেছে। এখন আমি পড়ি বেশি, লিখি কম।