অরবিন্দ রায়
লেখক অসমের শিলচরের বাসিন্দা। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক আধিকারিক। রাজনৈতিক প্রতিবেদক
অসম চুক্তির ৬নং ধারা নিয়ে ফের সরব হল আসু। অসম চুক্তির ৬নং ধারার চূড়ান্ত প্ৰতিবেদন এখন কোথায়? এই কথা জনসমক্ষে তুলে ধরতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে আসু। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ৬ নং ধারা কমিটি এই প্রতিবেদনটি অর্পণ করেছিল মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে সরকারের কাছে।
উল্লেখ্য, ৬ নং ধারায় অসমিয়া মানুষের সুরক্ষাকবচের কথা বলা রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘অসমিয়া মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভাষিক পরিচয়ের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এবং তার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম সাংবিধানিক, আইনি ও প্রশাসনিক সুরক্ষাকবচ দেওয়া হবে।’ ‘সাংবিধানিক, আইনি ও প্রশাসনিক সুরক্ষা’— এই শব্দবন্ধের অর্থ, অসমিয়াদের জন্য ১০০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনে লড়া, চাকরি, ভূমির অধিকার— সমস্ত কিছুতে শুধু অসমিয়ারাই সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ অ-অসমিয়ারা শুধু বসবাস করবেন, আর কিছু নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে কমিটি সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করেছিল যে ১৯৫১ সাল অসমের আদিবাসীদের সংজ্ঞার ভিত্তিবছর হওয়া উচিত, যারা চুক্তির ৬ নং ধারায় সাংবিধানিক সুরক্ষার জন্য যোগ্য হবে। এছাড়াও, কমিটি জমি অধিকার সুরক্ষার বিভিন্ন উপায়ের পাশাপাশি পুরো রাজ্যে ইনার লাইন পারমিট (আইএলপি) প্রবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে বলেও জানা গেছে। বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) বিপ্লব শর্মার নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নিযুক্ত কমিটি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শেষে ১০ ফেব্রুয়ারি ৯১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে।
সূত্র মতে, ১৯৫১ সালকে বেস বছর হিসাবে সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিক রেজিস্টার (এনআরসি)-এর অন্তর্ভুক্ত আদিবাসী অসমিয়া ও তাদের বংশধররা সাংবিধানিক সুরক্ষার অধিকার পাবে।
‘কে হবেন অসমিয়া, বা আদিবাসীদের এই সাংবিধানিক সুরক্ষার জন্য কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে? এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকেরই অন্য যে কোনও জায়গায় ভারতের প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের সমস্ত নাগরিকত্বের অধিকার থাকবে। তবে ভারতের সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হওয়ার আগে অসমে বসবাসকারী আদিবাসী বংশোদ্ভূত লোকদের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রয়োগের সময় অসমে আদিবাসীদের ধর্ম বা ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত লোককে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এই উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র রেফারেন্স ডকুমেন্ট পাওয়া যায় ১৯৫১ সালের এনআরসি’, হরেকৃষ্ণ ডেকা বলেছেন।
ফলে অসমে দুই প্রকারের নাগরিক হবে— নাগরিক অধিকারসহ ১৯৫১ সালের আগে বসবাস করা নাগরিক এবং ১৯৫১ সালের পরে অসমে বসবাস করা নাগরিক যাদের কোনও নাগরিক অধিকার থাকবে না। তার মানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক যা ভারতের সংবিধান বহির্ভূত।
এর ফলে চাকুরি ব্যবসা শিক্ষা জমি নির্বাচন সব ক্ষেত্রে ১৯৫১ সালের পরে অসমে বসবাস করা নাগরিক বঞ্চিত হবেন। যেহেতু পাকিস্তান থেকে বেশিরভাগ হিন্দু উদ্বাস্তু ১৯৫১ সালের পরে অসমে এসেছেন তাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি হিন্দুরা হবেন। স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তুদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে প্রচেষ্টা অসমের জাতীয়তাবাদীরা করে আসছে ৬ নং ধারার রূপায়ণ তারই ফলশ্রুতি।
এই অসম চুক্তির ৬ নং ধারা অনুযায়ী অসমিয়া জাতির সংরক্ষণের কথা বলা আছে। অর্থাৎ বাঙালি চাকরিবাকরির অধিকার হারাবে, ভোটে লড়তে পারবে না, জমি-বাড়ি কিনতে পারবে না, ব্যবসা করতে পারবে না ইত্যাদি। সংখ্যার নিরিখে অসমে বাঙালি প্রায় ৪০ শতাংশ, কিন্তু বাঙালি সুযোগ অনেক কম পাবে, নগণ্য। বাঙালি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকও না, দাস হয়ে বাঁচবে। এটা অবৈধ অসমের আপামর বাঙালির জন্য। অর্থাৎ যাদের নাম এনআরসি-তে উঠে গেছে, তারাও দাস।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন ক্যাবিনেট অসম চুক্তির ৬ নং ধারা বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি হয়েছে, যেখানে কোনও বাঙালি নেই।
অসমিয়া জাতিগোষ্ঠীগুলিকে এসটি ক্যাটেগরিতে ঢোকানো হচ্ছে, Schedule Tribes বলে সংরক্ষণ দেওয়া হবে অসমে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালও এখন থেকে এসটি হয়ে যাবেন, সংরক্ষণ পাবেন। ৬টা গোষ্ঠীকে এসটি বানানো হয়েছে বিল এনে সংসদে।
১৯৫১ সালকে যদি কাট-অফ বছর করা হয়, তবে অসম নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন থেকে সরে আসবে না, তবে আসন সংরক্ষণ মঞ্জুর হলে এবং জমি স্থানান্তরকে সীমাবদ্ধ করা হলে আদিবাসীদের রাজনৈতিক ও জমির অধিকার সুরক্ষিত হবে। ‘আমাদের সাংবিধানিক সুরক্ষা দরকার, তবে কোনও সিএএ নয়— কারণ এটি সাংবিধানিক নীতি ও জনগণের ভ্রাতৃত্ববোধের বিরোধী’, আসামের প্রাক্তন ডিজিপি হরেকৃষ্ণ ডেকা বলেছেন।
বিষয়টি শুধু জটিল তা নয় অত্যন্ত সংবেদনশীল। অসম সমস্যা কখনও বহিরাগত বনাম খিলঞ্জিয়া (স্থানীয়), কখনও ভাষাবিবাদ, বা বিদেশি খেদাও এবং অসম আন্দোলন— নানা ভয়ঙ্কর রূপ ধরে আমাদের সামনে এসেছে।
অসম চুক্তি হওয়ার পর মূলত বোড়ো/কাছারিদের মুখপত্র ‘দি প্লেনস ট্রাইবাল কাউন্সিল অফ অসম’ বা পিটিসিএ অসম চুক্তির অংশ না-হওয়ার জন্য খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। “Once again it has been proved beyond doubt that the movement leaders are concerned with the security of the Assamese linguistic minority only, and they are neither concerned about nor do they represent the indigenous linguistic and ethnic groups of Assam.” বিরূপ বোড়োরা পিটিসিএ-র মাধ্যমে ১৯৭০ সাল থেকেই অসমের মধ্যে স্বশাসিত অঞ্চল ‘উদয়াচল’-এর দাবি জানিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে এই দাবি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে স্বাধীন ‘বোড়োল্যান্ড’ রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছায়। এই বোড়ো জনজাতিকে একটি স্বতন্ত্র জনজাতি হিসেবে মানতে রাজি হননি স্বয়ং গোপীনাথ বরদলৈ। তিনি মনে করতেন বোড়োরা বৃহৎ অসমিয়া জাতির অংশ।
অসম চুক্তির ৬ নং ধারার রূপায়ণ এই লক্ষ্যে হচ্ছে যাতে অসমে অ-অসমিয়া জনগোষ্ঠী অদূর ভবিষ্যতে বৃহৎ অসমিয়া জাতির অংশ হয়ে যায়।
বস্তুত অসমিয়ারা শঙ্কিত। অসমে ব্যপক হারে প্রব্রজন হয়েছে। এর ফলে অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জবরদখল হয়েছে। বিশেষত নিম্ন অসমের অবস্থা ভয়াবহ। অসমিয়ারা সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত। অনেক নির্বাচনক্ষেত্র তাদের হাতছাড়া। এমতাবস্থায় অসমের জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা চাইছেন ভূমিহস্তান্তরে বাধানিষেধ। উপমন্যু হাজরিকার মতে এটাই হবে অ-অসমিয়াদের ভূমি আগ্রাসন থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। তাই ভূমি হস্তান্তরে বাধানিষেধ প্রত্যাশিত। কিন্ত এতে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ের মতো বরাকবাসী অযথা হয়রানি ও অবিচারের সম্মুখীন হতে চলেছে। বরাক উপত্যকা ৬ নং ধারার আওতায় আসতে পারে না। বরাকের ইতিহাস স্বতন্ত্র। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে পৃথক। এমনিতেই বরাকবাসী প্রতিটি ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। চাকরিবাকরি এখানকার তরুণ-তরুণীরা পায় না। এবার আইন করে শিক্ষার অধিকারও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। অথচ মজার কথা যে আমাদের এই উপত্যকার জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চুপ। এটাও রাজনীতির খেলা। তবে মনে রাখা ভালো যে এই ধারার রূপায়ণ হিন্দু মুসলমান সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সমানভাবে। এই উপত্যকার বেশিরভাগ হিন্দু বাঙালি ১৯৫১ সালের পরের বাসিন্দা। কিছু হিন্দু ও বৃহৎ সংখ্যক মুসলিমরা হয়তো ১৯৫১ সালের পূর্বের। কিন্ত এতে সমস্যা আরও বাড়বে বই কমবে না।
অতএব যারা ভাবছেন যে আমরা ১৯৫১ সালের পূর্বের বাসিন্দা, আমাদের কিছু হবে না— তারা স্বপ্নের জগতে আছেন। কারণ ছয় নম্বর ধারার রূপায়ণের উদ্দেশ্যেই হচ্ছে অসমিয়াদের উচ্চস্তরের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এখানে অসমিয়া মানে অসমিয়া মাতৃভাষা যাদের আদি থেকে আছে। এখানে কিন্তু নব্য অসমিয়ারা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তাই আমরা ছয় নম্বর ধারা রূপায়ণের বিরোধিতা করি। এটা যে আকারেই রূপায়িত হোক না, এ এক বিষবৃক্ষ। এটি অ-অসমিয়াদের বিনাশের জন্য। অতএব এই ধারা অসমের অ-অসমিয়াদের জন্য অশনিসঙ্কেত।
কারণ ১৯৫১ সালের পূর্বের নথিপত্র সবার থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত এইসব নথিপত্র কি বর্তমান উত্তরপুরুষদের সঙ্গে ১৯৫১ সালের পূর্বের পূর্বপুরুষদের যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে নাগরিকপঞ্জির নবায়নে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি নামবিকৃতি বা অপভ্রংশের ফলে। তাছাড়া এইসব নথিপত্রগুলো যাচাই যারা করবেন তারা বেশিরভাগই এই উপত্যকার না হওয়ায় সংবেদনশীল হবেন বলে মনে হয় না। ফলে হয়রানির চূড়ান্ত হবে, যা নাগরিকপঞ্জির নবায়নের সময়ের থেকেও বেশি।