ইলিনা সেন
সদ্যোপ্রয়াত ট্রেড ইউনিয়ন এবং সমাজকর্মী ইলিনা সেনের এই স্মৃতিচারণ পেঙ্গুইন বুকস প্রকাশিত তাঁর ‘ইনসাইড ছত্তিশগড়: এ পলিটিকাল মেময়ার’ বইটির অংশবিশেষ। ইলিনা সেনের স্মৃতির উদ্দেশে লেখাটি গত ১০ আগস্ট স্ক্রল.ইন-এ প্রকাশিত হয়।
সেইসব দিনের ভালোবাসা, সাহচর্য সত্যিই অন্যরকম ছিল যা সারাজীবন মনে রাখার মতো। শুরুর বছরগুলিতে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি খুবই কম ছিল এবং এসবই কর্মীদের মধ্যে সমবন্টিত হত। ১৯৮০-৮১-র সময়ে কর্মীরা তীব্র দারিদ্র থেকে উঠে সবেমাত্র একটু সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন।
অনেকেই সময় বাঁচিয়ে তাদের বাড়ির কাজকর্মে মন দিতেন, কখনও পাহাড়ের দিকে বাগান করতেন, কিচেন গার্ডেন করতেন, কুয়ো খুঁড়তেন অথবা ফলের গাছ লাগাতেন। ল্যান্ডস্কেপিং-এর বদল, যত্রতত্র মাটি খোঁড়া পরে ১৯৮৬ সালে সাংঘাতিক বন্যার কারণ হয়েছিল, যদিও ১৯৮১-৮২-র সময়ে সবাই সুখে আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন।
ইউনিয়নে কাজ করা কোনও কর্মীই পয়সা পেতেন না, যদিও অফিসের চৌকিদার কিচেনের খাবার সবাইকেই দেওয়া হত। খাতায় কলমে, এই কমিউনিটি রিসোর্সের উপর ভর করে স্থায়ী কর্মীদের বেঁচে থাকার কথা শুনতে বেশ রোম্যান্টিক হলেও বাস্তবের চিত্রটি ছিল অনেকটাই আলাদা।
কমিউনিটি কিচেনে খাওয়ার একঘেয়েমি এবং বেশি খরচ পরে পুষিয়ে যেত সন্ধেবেলা কর্মীদের কারও না কারও ঘরে খাওয়ার নেমন্তন্ন পেয়ে, এবং, গড়ে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই সপ্তায় তিনদিন করে এমন নেমন্তন্ন পেতাম। ক্যাম্প এলাকায় থাকা অনেক কর্মীই তাঁদের পরিবারের সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে বা বিশেষ কোনও সান্ধ্য খাবার রান্না হলেই আমাদের ডাকতেন। এইভাবে তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও আমাদের ভাব-ভালোবাসা হয়ে যেত এবং কর্মীদের সাহচর্যে আমাদের জীবন তৃপ্ত হত।
প্রায় সব পরিবারেই স্বামী স্ত্রী দুজনেই খনিতে কাজ করতেন এবং কোথাও কোথাও দুটি প্রজন্মও একসাথে কাজ করত। অফিসের ইউনিয়নের সূত্রে এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁদের কাজ ও জীবনযাত্রার উপর বেশ কিছু মজাদার এবং আকর্ষণীয় ঘটনার কথা আমরা জানতে পারতাম। আমাদের বন্ধু বরসাইত জেকেএমএস সোসাইটিতে কাজ করতেন এবং থাকতেন বিলাসপুরিয়া অঞ্চলে, তিনিই সবচেয়ে আমাদের অফিসের কাছাকাছি ছিলেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন ইউনিয়নের মহিলা মুখিয়া যমুনাবাইয়ের কন্যা।
সন্তানপ্রসবের সময়ে স্ত্রীর মৃত্যুর পর বরসাইত আরেকবার বিবাহ করেন। একারণেই একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর জন্য শোকাতুরা যমুনাবাই বরসাইতকে তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন এবং বরসাইত যমুনাবাইকে দেখলেই অন্য কোথাও চলে যেতেন। বরসাইত সন্ধেবেলা হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ করতেন এবং অনেক রাত করে ঘুমোতেন। খনিতেও আসতেন অধিকাংশ সময়ে হাজরি (হাজিরা) হওয়ার ঠিক আগে। তাঁর পিতা এ ব্যাপারে অনেক সময়েই তাঁকে চিৎকার করে বলতেন, ‘ও দেখ, হামার ঘরকে কামাইয়া আভাত হ্যায়’ (দেখ, আমাদের পরিবারের আয় করা ছেলেটা আসছে)।
বহু বছর ধরে দাল্লিতে অনেক মানুষই এসেছেন, চলে গেছেন, কিন্তু বিএসপি টাউনশিপে আমাদের ফ্ল্যাটটি এবং শহিদ হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য নির্মিত ঘরটি আমাদের যৌথ জীবনের প্রধান কর্মকেন্দ্র হয়ে গেছিল। নিয়োগী, অন্যান্য মুখিয়ারা, স্বাস্থ্যকর্মীরা এবং প্রায় সমস্ত কর্মীদের আসাযাওয়ার মাধ্যমে হাসি, খাওয়া, গল্পের মধ্যে দিয়ে অনেক স্মৃতি জমে উঠেছিল।
সুরেশবাবু নামে দাল্লির ওয়ার্কার সমবায়ের এক করণিক টাউনশিপের উপকণ্ঠে চার একর জমিতে চাষ করতেন। আমাদের প্রথম পরীক্ষাই হয়েছিল সেই জমিতে জৈব চাষ করা, যার ফলশ্রুতি হিসেবে অনেক দুপুরেই আমরা তৃপ্তি সহকারে আহার সারতাম। পরে Illustartive Weekly of India-তে প্রকাশিত ডক্টর আর এইচ রিচ্চারিয়ার কাজের উপর বন্দনা শিবার লেখা পড়ে, আমরা দেশীয় বীজ থেকে ভাল গুণমান-সমন্বিত ধান উৎপাদনের ব্যাপারে পরিচিত হলাম এবং অজৈব সার এবং কীটনাশকের বদলে এই দিকটিই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হল আমাদের কাছে।
তখনই আমরা জানতাম যে ষাটের দশকের গভীর খাদ্য সমস্যার সময়ে দেশের কৃষি গবেষণা ক্ষেত্র এই সঙ্কট মোকাবিলার নিরিখে মৌলিক চিন্তাভাবনার দিক থেকে দুভাগে বিভক্ত ছিল। ডক্টর রিচ্চারিয়া বহু বছর ধরে গবেষণার পরে সিদ্ধান্তে আসা দেশীয় জার্মপ্লাজম নির্বাচনের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং পরে লড়াইয়ে জিতে যাওয়া বহু বিজ্ঞানীই আমদানি করা হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটি উৎপাদনের উপর জোর দিলেন। এই জয়ের ফলে ফিলিপিন্সের ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বীজ ও কীটনাশক সংস্থাগুলির টাকায় প্রচুর এ ধরনের ধান উৎপাদন হচ্ছিল।
ডক্টর রিচ্চারিয়ার কাজকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার পর রায়পুরে তাঁর কৃষি সংস্থাও বন্ধ করে দেওয়া হল, কিন্তু ছত্তিশগড়ের চাষিদের কাছ থেকে তাঁর দেশীয় বীজ সংগ্রহ একইরকমভাবে চলতে থাকল। তিনি তখন কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজের সংস্থাটি ভূপালে সরিয়ে আনলেন এবং সেখানেই নিভৃতে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকলেন।
আমি ভুপালে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম এবং দাল্লির কিছু ছোট চাষিকে দেশীয় বীজ নির্বাচন করে চাষ করানোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি করিয়েছিলাম। তিনি শেষমেশ এসেছিলেন, যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি তখন আর দাল্লি-রাজহারা এলাকায় থাকতাম না, যদিও সেই মানুষটির সঙ্গে কথাবার্তা বলা এবং তাঁর ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমি রায়পুরে চলে আসার পরেও রেখে দিয়েছিলাম। সুরেশবাবুই প্রথম যিনি ছত্তিশগড় দেশীয় ধানের সংরক্ষণের জন্য নিজের জমি দিয়ে দিতে চাইলেন। ডক্টর রিচ্চারিয়ার মৃত্যুতে পরে সমগ্র লাল-হারা কমিউনিটি এলাকার মানুষেরাই শোকে বিহ্বল হয়ে যায়।
দাল্লিতে থাকার সময়েই আমাদের কন্যা প্রাণহিতা আমাদের জীবনে আসে। ওর জন্ম হয়েছিল পুনেতে এবং যখন আমরা আমাদের ছ বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে এসছিলাম, তখন কর্মীরা স্নেহে, আদরে ওকে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিনায়ক এবং আমার দুজনেরই সাইকেল ছিল এবং আমরা দুজনেই সাইকেলে করে ওকে নিয়ে ইউনিয়ন অফিস আর হাসপাতাল করতাম। ছোট্ট মেয়েটা আর ওর বাবা-মার এই বৃত্তটি খুব সহজেই পরিচিত হয়ে উঠল এবং এখনও দাল্লিতে গেলে লোকে ওর কথা আমাদের জিজ্ঞেস করে।
প্রাণহিতার আসার দিনটি আমাদের ঘরেই একটি মাছভোজের আয়োজনের মাধ্যমে নিয়োগী, ইউনিয়ন নেতা এবং কর্মীরা উদযাপন করেছিলেন। আসো এক দুপুরে তার বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের ঘরে এল, সঙ্গে আনল একটা ৫ কেজির মাছ। সে আমাদের রান্নাঘরে ঢুকেই অতিথিদের জন্য রান্না করল, অতিথিরা এসেছিল যদিও তার প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পর। প্রাণহিতার শুরুর বছরগুলি এমনই আনন্দের মধ্যে কাটত, এবং মেয়েটি আমাদের মহিলা কর্মীদের অনেককেই মা বলে ডাকত। আমাকে ইল্লানামা বলত, আসোকে আসোমা এবং আমাদের বন্ধু শিববতী সাহুকে তাঁর ছোট মেয়ে শেষের নামে শেষুমা বলে ডাকত। আমরা যখন কাজে ব্যস্ত থাকতাম, এই শিববতীই আমাদের মেয়েকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুবই যত্ন করে রাখতেন।
আমাদের জীবনে আরেকজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন আরেঝার ডোকরা (আরেঝারের বৃদ্ধ) হালাল খোর। একবার এক অলস দুপুরে নিয়োগীর থেকে গ্রামে গাড়ি নিয়ে ঘুরিয়ে আসার আবদার আসে। দাল্লি তখন ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এবং আমরা যখন তেমনই এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, নিয়োগী ড্রাইভারকে গাড়িটি আরেঝারের দিকে নিয়ে যেতে বললেন।
আমার যখন গ্রামে এলাম সেই বৃদ্ধ গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে নিজের ঘরের বাইরে একটি খাটিয়ার উপর বসেছিলেন। তিনি প্রত্যেকের হাত ধরে সম্ভাষণ জানালেন এবং আমাদের বসতে বলার আগে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘মেরা উমর দেড়শ সাল’ (আমার বয়স দেড়শো বছর)। নিয়োগী সেই বৃদ্ধের পুরনো বন্ধু ছিলেন এবং আমাদের সেই খোশগল্পের মধ্যে বৃদ্ধের জীবনের কত যে গল্প উঠে আসছিল, তার ইয়ত্তা নেই।
গ্রামে জন্মানোর পর সাত বছর বয়সে কিছু চা বাগানের কর্মীদের সঙ্গে তাঁকে অসমে নিয়ে যাওয়া হয়। অসমে যাওয়ার পথে তিনি ‘সমুদ্র’ পেরোন (সম্ভবত আজকের বাংলাদেশের কিছু নদীর কথাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন)। অনেকগুলি বাগানে থেকেছিলেন তিনি। একদিন হঠাৎই একশো বছর বয়স হলে তিনি আরেঝারে ফিরে আসতে চাইলেন।
তিনি ছত্তিশগড়ি ছাড়াও বাংলা এবং অসমীয়া ভাসায় দিব্যি কথা বলছিলেন এবং সেইসমস্ত ভাষায় নিজের দক্ষতা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। অসম থেকে ফেরার সময়ে কিছুটা ট্রেনে এসে বাকিটা দুর্গ স্টেশন থেকে বিশাল দূরত্ব হেঁটেই ফেরেন। কারণ তখন তিনি জানতেন না, দাল্লি-রাজহারায় ইতোমধ্যে রেল পৌঁছে গেছে। গ্রামে এসে তিনি দেখলেন, তাঁর পরিবারের কেউ আর নেই সেখানে। তিনি অসম থেকে অর্জিত কিছু টাকাপয়সা এবং দক্ষতার সাহায্যে একটি ছোট ঘর তৈরি করলেন। সেখানে থাকা শুরু করার পর কিছু বন্ধু হলে তাদের সবার কাছেই প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গ্রামে রয়ে যাওয়ার কথা বলে বেড়াতে থাকলেন। যখন শহিদ হাসপাতাল তৈরি হল, আরেঝার ডোকরাকে নতুন বাড়ি উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি তাঁর অসাধারণ বক্তৃতায় গ্রামে হাসপাতালের প্রয়োজন, স্বাস্থ্য সমস্যার বেশ কিছু দিক এবং এলাকায় মানুষের দুর্ভোগের কথাগুলি তুলে ধরেছিলেন। কয়েকমাস পরে তাঁকে হাসপাতালের কাজকর্মের তদারকি করতে অনুরোধ জানানো হয়। পরে যখন বয়স এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য তাঁর পক্ষে গ্রাম থেকে হাসপাতালে যাওয়ার একান্তই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল, তিনি তবুও খোঁজখবর চালিয়ে যেতেই থাকলেন এবং ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের তাঁর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত খবরাখবর দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দিতে থাকলেন।
তাঁর সঙ্গে কথোপকথনগুলি খুবই আকর্ষণীয় মনে হত আমার। তাঁর গল্পগুলি ভ্রমণকাহিনির পাশাপাশি চা বাগানের মানুষের জীবনের কথা, পুরাণ, জাদুবিদ্যা ইত্যাদি বহু দিকেই বিস্তৃত ছিল। আরেঝার ডোকরা আজ আর নেই এবং আমি নিশ্চিত তাঁর মতো মানুষ আর একজনও আসেনি তারপর। সবার চেয়ে অনেক বেশি করে ছত্তিশগড়ের মানুষের অলিখিত ইতিহাসের কথা তিনি আমাকে শুনিয়ে গেছিলেন।
পরে ছত্তিশগড় থেকে মাইগ্রেশনের ফলে চলে যাওয়ার ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে ততটা না হলেও হেঁটে আসা আরও বহু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলেম, যেমন স্বাধীনবাই, টিলডার কাছে এক গ্রামের এক অশিক্ষিত বউ, যে অসমের চা বাগানে জন্মে পরে একসময় বাবার সঙ্গে জাহাজে চায়ের রপ্তানির জন্য চিন গেছিল।
এইসব সান্নিধ্য আমার কাছে ছত্তিশগড়ের খেটে খাওয়া মানুষের ভেতরের বিশ্বজনীন দিকটি তুলে ধরেছিল, যার অন্যতম কারণ ছিল এই আউট-মাইগ্রেশন। ১৮৯০ সালের পর থেকে ক্রমাগত খরা, দুর্ভিক্ষ, অনাহার এই মাইগ্রেশনকে ত্বরান্বিত করেছিল। আমি পরে সুখভাসিন নামে একটি বইতে এই দিকগুলি তুলে ধরেছিলাম।