প্রবীর মুখোপাধ্যায়
লেখক প্রবন্ধকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
পনেরোই অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হচ্ছে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। ছোটবেলা থেকে কৈশোরে পৌঁছানো পর্যন্ত এই উৎসবের ধারা ছিল একরকম। অধিকাংশ বাড়িতেই জাতীয় পতাকা টাঙানো হত। সকালবেলা ড্রাম বাজিয়ে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে পা মিলিয়ে প্রভাতফেরি, স্কুলে-কলেজে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান, সন্ধ্যাবেলায় ক্লাবে বা স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কোথাওবা প্রদর্শনী। আমরাও আনন্দের সঙ্গে এইসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। আমাদের স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে ছবি ও পোস্টারের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনও এক অধ্যায়ের ওপর প্রদর্শনী হত দুদিন ধরে। সব মিলিয়ে একটু অন্যরকম কাজের আবেশে ছুটির দিন কাটত।
সময়ের সঙ্গে রীতিনীতি গেল পালটে। এখন অনেক জায়গায় ১৪-১৫ অগস্টের মাঝ রাত বারোটায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অধিকাংশ অনুষ্ঠানেরই আয়োজক কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল। স্কুল বা কলেজে এখন নমো নমো করে কোথাও কোথাও পতাকা উত্তোলন হয়, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি সেখানে অকিঞ্চিৎকর, কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের-শিক্ষাকর্মীদের থাকতে হয় চাকরির বাধ্যবাধকতার কারণে। সরকারি অফিসেও পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান হয় একইভাবে। অধিকাংশ লোকেই এই বিশেষ দিনটি একটা অলস ছুটির দিন হিসাবে উপভোগ করেন, মাছ-মাংসের দোকানে ভীড় বাড়ে।
শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ পার হয়ে এসে কেন জানি না আজ হঠাৎ মনে হল ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর ‘রিয়েলিটি চেক’ করলে কেমন হয়। আসলে সেই ২৩ মার্চ থেকে ঘরে আবদ্ধ থেকে থেকে অলস মস্তিষ্ক সত্যিই বোধহয় শয়তানের আখড়া হয়ে গেছে। তা নইলে জন্ম-ইস্তক যাকে সত্য বলে জেনে এসেছি সেটা আজকে যাচাই করার ইচ্ছে হল কেন? ইতিহাস প্রমাণ দাবী করে— ‘মিথ’ বা কল্পকথার প্রমাণ দেবার দায় নেই। যাই হোক, ইচ্ছে যখন হয়েছে তখন তথ্যানুসন্ধান করা যেতেই পারে। ইন্টারনেটের সৌজন্যে এখন অনেক সুযোগই সহজলভ্য। অতএব শুরু করা গেল খোঁজ-খবর।
১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এর আগে ভারত ব্রিটিশ সরকারের শাসনাধীন। অতএব শাসনব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন করতে গেলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আর্কাইভে গিয়ে পাওয়া গেল:
Catalogue number : Parliamentary Archives, HL/PO/PU/1/1947/10&11G6c30
India Independence Act, 1947
An Act to make provision for the setting up in India of two independent Dominions, to substitute other provisions for certain provisions of the Government of India Act, 1935
Date: 18th July 1947
খুবই চিন্তার বিষয়। ‘ভারত স্বাধীনতা আইন’ বলছে ভারতে দুটি স্বাধীন ‘ডোমিনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করার কথা— ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’-এর কথা বলছে না। অবাক লাগছে, তাই না? তাহলে আর একটু বিস্তারিতভাবে দেখা যাক।
Indian Independence Act 1947
1947 CHAPTER 30
An Act to make provision for the setting up in India of two independent Dominions, to substitute other provisions for certain provisions of the Government of India Act,1935 which apply outside those Dominions, and to provide for other matters consequential on or connected with the setting up of those Dominions.
[18th July 1947.]
Be it enacted by the King’s most Excellent Majesty, by and with the advice and consent of the Lords Spiritual and Temporal, and Commons, in this present Parliament assembled, and by the authority of the same, as follows :—
1 The new Dominions
(1) As from the fifteenth day of August, nineteen hundred and forty-seven, two independent Dominions shall be set up in India, to be known respectively as India and Pakistan.
(2) The said Dominions are hereafter in this Act referred to as “the new Dominions”, and the said fifteenth day of August is hereafter in this Act referred to as “the appointed day”.
১৮ জুলাই ১৯৪৭ তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ পাশ হল। আইনের উদ্দেশ্য ভারতে দুটি স্বাধীন ‘ডোমিনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য, আর ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনে কিছু পরিবর্তন আনার জন্য আর এই দুই ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা করার কাজের জন্য বিভিন্ন আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার জন্য।
আইনে পরিষ্কারভাবে বলা হল যে ঊনিশশো সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাসের পনেরো তারিখ থেকে ভারতে দুটি স্বাধীন “ডোমিনিয়ন” প্রতিষ্ঠা হবে যাদের ভারত আর পাকিস্তান এই নামে অভিহিত করা হবে। আর পনেরোই আগস্ট-এর পর থেকে এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট দিন হিসাবে পরিগণিত হবে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদিত এই দলিল অনুসারে তাহলে ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ “ডোমিনিয়ন দিবস”— এখানে স্বাধীন ‘ডোমিনিয়ন’-এর কথা আছে, রাষ্ট্রের কথা নেই। ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ হছে উপনিবেশের থেকে একটু উন্নততর শাসনব্যবস্থা যেখানে কিছু শাসনসংস্থার পরিচালনভার স্থানীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেওয়া হবে। কিন্তু মূল অধিকার ঔপনিবেশিক সরকারের হাতেই থাকবে। ‘স্বাধীন’ ডোমিনিয়ন কথাটা অনেকটা ‘সোনার পাথরবাটি’ বা ‘কাঁঠালের আমসত্ব’-এর মত ব্যাপার আর কি। কোনও দলিলেই ব্রিটিশ সরকার ‘স্বাধীন’ ডোমিনিয়ন বলতে কী বোঝাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করেনি। ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ দিতে ব্রিটিশ সরকার অনেকদিন আগে থেকেই রাজি, সেই ১৯২০-২১ থেকেই এই প্রস্তাব দিয়ে আসছে আর আমরা নাকচ করছি। আমরা ভারতীয়রা চেয়েছি পূর্ণ স্বাধীনতা। এমনকি ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ তারিখে গান্ধিজি ভাইসরয় লিনলিথগো-কে জানাচ্ছেন যে ব্রিটিশ প্রস্তাব এমন হওয়া উচিত যাতে করে ভারত কী চায় সেটা ভারতই স্থির করবে। [সুত্র – Viceroy Linlithgow’s record for the British Cabinet of his conversation with Gandhi, 5th February 1940 (CAB 67/5/24)]। আর সেটা স্থির করার জন্য গঠিত হয়েছে কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান সভা। সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচনের কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৯৪৬ সালের অগস্ট মাসে। এর প্রথম মিটিং হয় ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৬। ১৪ অগস্ট ১৯৪৭-এ এর সদস্যরা আবার মিলিত হয় এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সব সার্বভৌম ক্ষমতা এই সংবিধান সভার হাতে তুলে দেওয়া হয়। সংবিধান সভার সদস্যরা কিন্তু ব্রিটিশ রাজার নামে শপথ গ্রহণ করে সদস্য হয়েছিলেন। আর ভারত যে স্বাধীন ‘রিপাব্লিক’ বা সাধারণতন্ত্র হিসাবে পরিচালিত হবে সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ভারতের সংবিধান সভা নিয়েছে ১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এর অনেকদিন পরে।
১৯২৭ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পেশ করেন ভগত সিং। গান্ধিজির প্রবল বিরোধিতায় সেই প্রস্তাব তখন পাশ হয়েনি। ভারতে স্বাধীনতা দিবস পালন শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সাল থেকে। লাহোরে ইরাবতী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর ১৯২৯ কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জওহরলাল নেহরু “পূর্ণ স্বরাজ” প্রস্তাব ঘোষণা করেন। সরকারিভাবে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে সকল ভারতীয়কে ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালন ও ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার আহ্বান জানান হয়। তখন থেকেই ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। সংবিধান সভা ২৬ জানুয়ারিকে ঐতিহাসিক মান্যতা দিয়ে ঐ দিনটিকে সাধারণতন্ত্র দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। আর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে ভারত এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়েছে।
তাহলে ১৫ অগস্ট দিনটি কী করে স্থির হল? বিশ্বস্ত সূত্র হাতে আসেনি, তবে অনেক ঐতিহাসিকই উল্লেখ করছেন যে ঐ দিনটিতে জাপানি ফৌজ লর্ড মাউন্টব্যাটনের কাছে রেঙ্গুনে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই কারণে তখনকার গভর্নর-জেনারেল মাউন্টব্যাটেন ঐ দিনটি ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন হিসাবে স্থির করেন আর নেহরু সেটি মেনে নেন।
১৫ অগস্ট ১৯৪৭ থেকে ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ অবধি ভারত এক ‘স্বাধীন’ ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন— অবশ্য এ শব্দগুচ্ছ কী অর্থ বহন করে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে দাঁড়াল এই যে ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ প্রকৃতপক্ষে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ দিবস, স্বাধীনতা দিবস নয়।