Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাশিয়ার কোভিড টিকা: সিল করা অ্যাম্পিউলের ঠান্ডা যুদ্ধ

স্বপন ভট্টাচার্য

 


লেখক প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

রাশিয়ার কোভিড ভ্যাকসিনের কথায় যাওয়ার আগে বলি বেঞ্জামিন জেস্টি নামের সেই ইংরেজ কৃষিজীবীর কথা যিনি এডওয়ার্ড জেনারেরও আগে নিজের ছেলেমেয়ের শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন গরুর বসন্তের গুটি থেকে নেওয়া পুঁজ। বসন্ত মহামারির প্রকোপের মধ্যেও তারা অসংক্রামিত থেকে গেল। কিছুদিন পরে জেস্টি সেই ছেলেমেয়েদের শরীরে প্রয়োগ করলেন মানুষের গুটি থেকে নেওয়া বসন্তের বীজ। তারা সুস্থ রইল দিব্যি। জেস্টি কৃষক ছিলেন, ফলাফল প্রকাশ করার দায় অনুভব করেননি তিনি। জেনার ছিলেন ডাক্তার। যোসেফ মেইস্টার নামক বালকের শরীরে গরুর গুটি থেকে জীবাণু নিয়ে তার শরীরে অনাক্রম্যতা এনে দিলেন তিনি, সেটা ১৭৯৫ সালের কথা। বালক যে ইমিউন তা নিশ্চিত করতে তিন মাস পরে তার শরীরে সক্রিয় গুটিবসন্তের জীবাণু প্রয়োগ করলেন জেনার। বালক সুস্থই রইল, আর এডওয়ার্ড জেনার ইতিহাসে অমর হয়ে গেলেন টিকাকরণের জনকরূপে।[1] এই যে দুটো উদাহরণের কথা বললাম, একটা যাকে বলে ‘র’ সায়েন্স বা অপরিপক্ক বিজ্ঞান আর অপরটা মেথড সায়েন্স বা রীতিমতো বিজ্ঞান, এই দুটো ক্ষেত্রেই লক্ষ করবেন অনাক্রম্যতা প্রমাণ হল টিকা পেয়েছে যে তাকে জীবাণু দিয়েও সংক্রমণমুক্ত রাখার পর। মানুষের শরীরকে ভাইরাসঘটিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা দিতে আজ পর্যন্ত মোট সতেরোটি ভ্যাকসিনের প্রায়োগিক স্বীকৃতি অনুমোদিত হয়েছে। SARS-Cov2 এই তালিকায় নতুন সংযোজন হবে এবং অনতিবিলম্বে হবে এই আশা বিশ্বের আপামর জনসাধারণের। কিন্তু রাশিয়ান টিকা এখনও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে যায়নি। SARS-Cov2 ভাইরাস যে টিকাপ্রাপ্ত শরীরে নিদেনপক্ষে দু তিন হপ্তা পরেও নখদন্তহীন সেকথা বলতে পারা গেল না অথচ বলা হচ্ছে টিকার অনুমোদন দিয়ে দেওয়া গেল! এটা একটু অতি তৎপরতার নমুনা বলেই মনে হচ্ছে সাদা চোখে।

সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে রক্তে সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হওয়াতেই শরীরের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধক্ষমতার প্রকাশ। এর কয়েকটি পূর্বশর্ত আছে যার মধ্যে প্রধানতম দুটি হল অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি। অ্যান্টিজেনের অভিজ্ঞতা না থাকলে অ্যান্টিবডি উৎপাদনকারী কোষগুলো আক্ষরিক অর্থেই অপাপবিদ্ধ। যার নির্গলিতার্থ এই যে, কোনও নির্দিষ্ট জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত শরীর সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলবে না। রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এক ধরনের শ্বেতকণিকা, যার নাম বি-লিম্ফোসাইট। সংক্ষেপে বি-কোষ (B-cells)। অপাপবিদ্ধ বি-কোষ একবার সংক্রামিত হয়ে অ্যান্টিবডি তৈরির মত পাপকাজটি করে ফেললে, তার একটা স্মৃতি থেকে যায় শরীরে। এই স্মৃতিবাহক বা মেমোরি বি-কোষ (Memory B cells) পরবর্তী যে কোনও সময়ে ওই একই জীবাণুর সংক্রমণে শরীরকে প্রণোদিত করে তার বিচিত্র তূণীর থেকে ঠিক ঠিক এবং বিশেষ অ্যান্টিবডিখানা বার করে তার মোকাবিলা করতে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া (Primary response) অপেক্ষাকৃত বেশি সময়সাপেক্ষ, যেহেতু তা প্রথমবারের দেখাশোনা। আর পরবর্তী সব মোলাকাতেই (Secondary response) শরীরের প্রতিক্রিয়া হয় দ্রুততর। সুতরাং বুঝতে অসুবিধে নেই নভেল করোনাভাইরাস বা SARS-Cov2 চরিত্রে নভেল বা নতুন হওয়ার দরুন তার অ্যান্টিজেনের সঙ্গে এই হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির কোনও সখ্য বা বৈরিতা গড়ে ওঠার সু্যোগই ছিল না এই কুড়ি কুড়ির অতিমারির আগে। এবং দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক মোলাকাতের ফলাফল এককথায় ভীতিপ্রদ, ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীর দুই শতাধিক দেশের সাড়ে সাত লাখের উপর মানুষ লোকান্তরিত, সুতরাং দরকার হয়ে পড়েছে শরীরকে এমন একটা জীবাণু-অভিজ্ঞতা প্রদান করার যাতে মানুষের শরীর উপযুক্ত অ্যান্টিবডি  তৈরি করতে পারবে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া ছাড়াই। সারা পৃথিবীর শতখানেকের উপর গবেষণাগারে একটা কার্যকরী টিকা তৈরির কাজ এখন ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে। এর মধ্যে অক্সফোর্ডের একটি, আমেরিকার মডার্না ল্যাবরেটারির একটি এবং চিনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস-এর একটি টিকা তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং দুনিয়ার নজর এদের দিকেই নিবদ্ধ ছিল মোটামুটিভাবে। হঠাৎ করে রাশিয়া এই দৌড়ে ঢুকে পড়ে সবার হিসেবই কেমন যেন ওলটপালট করে দিল। সকলেই সংশয়িত বললে পুরো বলা হবে না। বরং বলা যায় হতচকিত, কারণ অতিমারির বাজার ধরতে চাইছে সকলেই।

যে কোন নতুন টিকা নিয়ে গবেষণায় যে দুটো জিনিস সব সময়েই মাথায় রাখতে হয়— সেফটি, অর্থাৎ নিরাপদে ব্যবহারযোগ্যতা এবং এফিকেসি, মানে কার্যকারিতা। একটা জীবাণুর নখ-দাঁত ভাঙা যে নমুনাকে টিকাকরণের কাজে ব্যবহার করা হয় সেটি এই দুই ধর্মের নিরিখে প্রায় সব সময়েই ব্যস্তানুপাতিক, প্রায় দ্বিফলা ছুরির মত। নিরাপত্তা বাড়াতে গেলে প্রায়ই কার্যকারিতা বিসর্জন দিতে হয়। এবং নীতিগতভাবে পাল্লা সব সময়েই নিরাপত্তার অনুকূলে হওয়ার কারণে, ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও বাজারে একটা ভ্যাকসিন ছেড়ে দিলাম— এটা হয় না সাধারণভাবে। এর পাশাপাশি সংক্রামক ভাইরাস এবং তার পোষকের মধ্যে সম্পর্ক টিকার সম্ভাব্যতা ও কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। জরুরিভাবে বিবেচনার সম্পর্ক দুটি— এক, টিকার পোষক শরীরে ঢোকা থেকে শুরু করে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার অন্তর্বর্তী সময়কাল আর দুই, শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধক্ষমতার স্থায়িত্বকাল অর্থাৎ একবার তৈরি হওয়ার পরে কতদিন পর্যন্ত সেই অ্যান্টিবডি শরীরকে প্রতিরোধক্ষম রাখতে কার্যকরী হচ্ছে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের আগে এ বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভবই নয় এমনটা জানা ছিল এতদিন। অতিমারি অবশ্য একশো বছরের মানব ইতিহাসকে এক ঝটকায় রাজপ্রাসাদ থেকে রাস্তায় এনে ফেলেছে, সুতরাং মানুষের প্রাণ যখন অন্য কোন প্রতিষেধকে বাঁচছে না তখন হয়ত এই অতি তৎপরতার একটা নজিরকে এখনও ততটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি যতটা স্বাভাবিক সময়ে হতে পারত।

গত ১১ আগস্ট তারিখে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকে জানিয়ে দেন যে তাঁর দেশের টিকাকরণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যকর একখানা টিকা সাধারণের মধ্যে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের ভ্যাকসিন-বিজ্ঞানীদের মধ্যে হইচই পরে যায়। বলা হয় যে একটি অসম্পূর্ণভাবে ট্রায়ালে থাকা টিকাকে ব্যবহারযোগ্য বলে অনুমোদন দেওয়া হল সেটির নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ছেলেখেলা করা। পুতিনের ঘোষণা থেকেই জানা যাচ্ছে মস্কোর গামালেয়া মহামারি ও মাইক্রোবায়োলজি সংক্রান্ত গবেষণাগার (Gamaleya Research Institute of Epidemiology and Microbiology in Moscow) থেকে বাজারে এসে পড়া এই টিকা এখনও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে যায়নি। টিকার নাম দেওয়া হয়েছে Gam-Covid-Vac। যে কোনও টিকার তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতের, বর্ণের, বয়সের মানুষের উপর করা হয়ে থাকে। সেটাই রীতি। রাশিয়ার কোভিড টিকা সংক্রান্ত যেটুকু ফলাফল হাতে এসেছে, পুতিনের মেয়ের উপর তা প্রয়োগ করা হয়েছে এটুকু ছাড়া, তা নির্দিষ্ট কোনও প্রকাশিত গবেষণার আকারে আসেনি যেমনটা কিনা অক্সফোর্ড টিকার ক্ষেত্রে হয়েছে। ফলে peer reviewed ফলাফল তাকে বলা যাবে না। তবে মানতেই হবে যেটুকু তারা প্রকাশ করেছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে রাশিয়ান টিকার ফলাফল যেমন যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক বলতে পারা যাবে না আবার খুব হতাশাব্যঞ্জক বলার মত কোনও তথ্যও আমাদের হাতে নেই। বরং একটু তুলনা করে নেওয়া যেতে পারে অক্সফোর্ডের টিকার সঙ্গে।

মুশকিল হল, এ পর্যন্ত যা জানানো হয়েছে তা বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের প্রথম/দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের সঙ্গেই কেবল তুলনীয় মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। রাশিয়ান টিকা সম্পর্কে মূল অভিযোগ তথ্য সম্পর্কিত অস্বচ্ছতার। যেহেতু ফলাফল সম্পর্কিত প্রায় কোনও তথ্যই তারা সামনে আনেনি তাই বাকি বিশ্ব তাকে বালখিল্য এবং হাস্যকর বলতেও ছাড়েনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটাও যে, রাশিয়া বলেই দিয়েছে যা পেয়েছে তারা, তার পেটেন্ট বিক্রি করবে না। টিকা হল বিশ্বের স্বাস্থ্য রাজনীতির সেরা আয়ুধ। এই কোভিড পরিস্থিতিতে একটা টিকা একটা দেশের জিডিপি বদলে দিতে পারে, অর্থনীতির ডুবন্ত জাহাজকে ভাসিয়ে রাখতে পারে, বেকারিও মুছে দিতে পারে যথানিয়মে। আর বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থার জিগির তুলে হিরোশিমা ঘটিয়েছিল কারা ভুলে গেলে চলবে কেন? বলে রাখা ভালো, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়াসহ বিশ্বের নানা জায়গার ২০টা দেশ থেকে ১০০ কোটি ডোজের অর্ডার এখনই রাশিয়ার হস্তগত। এসব দেশেও তো বিজ্ঞানীরা আছেন এবং রাশিয়াকে টেনে তুলতে তাঁরা দেশের লোকের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করবেন না এমন মনে হলেও অতিমারি পদে পদে দেখিয়ে দিচ্ছে হকার থেকে রাষ্ট্রপ্রধান সকলেই কমিশনের কাঙাল। সুতরাং অর্ডার পেয়েছে মানেই টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা প্রমাণিত এমনটা মনে করার কারণ নেই। আবার ছেলেখেলা বলে উড়িয়ে দেওয়ারও কোনও কারণ দেখি না। সবাই তো সব কাজ দরজা হাট করে খুলে রেখে করে না। তথ্য গোপন রাখার অধিকার কেউ যদি প্রয়োগ করে তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের তোয়াক্কা না রেখেই করবে। সেভাবেও যে করা যায় সে পথ তো ডোনাল্ড ট্রাম্পই দেখিয়ে দিয়েছেন সেখান থেকে বেরিয়ে এসে।

 


[1] বিষে বিষে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ১ জুন ২০২০

তথ্যঋণ: