তানিয়া লস্কর
লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, পেশায় আইনজীবী
ভারতীয় উচ্চতম ন্যায়ালয় গত ১১ আগস্ট বিনীতা শর্মা বনাম রাকেশ শর্মা মামলায় একটি রায়ের মাধ্যমে ২০১৫ সনের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের একটি নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ভারতীয় নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব তার চেয়েও বেশি। পারিবারিক আইন ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য সারা বিশ্বের রাজনীতিতেই তা একটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় বটে। যেহেতু বিতর্কিত তাই রাজনীতির সুযোগও প্রচুর। সুতরাং দলমতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের সরকারগুলোই এই বিতর্ককে কাজে লাগিয়ে নানারকমভাবে নিজেদের রাজনৈতিক রুটি সেঁকতে চেষ্টা করেন। বলাই বাহুল্য যে ফ্যাসিবাদী সরকারগুলোও এর থেকে বাদ পড়ে না। ১১ আগস্টের রায়টিকেও এই পটভূমিতে বিচার করা উচিত।
ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং লৈঙ্গিক ন্যায় আদায়ের রাজনীতি
ফ্যাসিবাদ যেহেতু একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারণার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চায় সেজন্য তারা প্রচলিত সামাজিক নৈতিকতাতে কিছু বিশেষ পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদেরকে জাহির করতে চায়। অবশ্য নৈতিকতার ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রায় সবকটি সমাজেই মহিলাদের ভূমিকা, তাদের অধিকার একটি বিশেষ স্থান নিয়ে থাকে। তাই সারা বিশ্বে যখনই ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তারা নিজেদের মতো করে নারীর অধিকারকে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। হিন্দু-ফ্যাসিবাদও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ২০১৮ সনে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে নতুনভাবে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারের সপক্ষে ব্যাখ্যা করার পটভূমিও কিছুটা সেরকমই ছিল। সেই রায় আসার কয়েক মাস আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রে তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের অবস্থান কী হবে সে নিয়ে নানারকম লেখালেখি ছাপা হচ্ছিল। অ্যাবরোগেশন অফ ৩৭৭ নামে জি-নেটওয়ার্কের যে ছবিটি রিলিজ করেছে সেটি মন দিয়ে দেখলেও এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ঠিক সেরকমই একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখা যাবে সেই তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রে মহিলাদের ভূমিকা কী থাকবে সে বিষয়ে বিশেষ কিছু ওয়েবসাইটে বেশ কিছুদিন ধরেই বিশেষ কিছু লেখা ছাপা হচ্ছে। যেগুলিতে আরএসএস মহিলাদের অধিকার নিয়ে কতটা সচেতন কিংবা জিন্স পরা মহিলারাও যে আরএসএসের সদস্য হতে পারেন সে বিষয়ে বেশ কিছু ইংরাজি নিবন্ধ আছে। সুতরাং এই রায় খুব একটা অপ্রত্যাশিত মোটেই নয়। বরং এক ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে। তার আভাস কিছুটা দেখাও যাচ্ছে। অনেকেই সামাজিক মাধ্যম ইতিমধ্যেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড এবং মুসলিম উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন। সুতরাং মেরুকরণের রাজনীতির পোয়াবারো।
এই রায় এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি
ভারতীয় সংবিধানের সূচনা পর্ব থেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এ বিষয়েও নানা জনের নানা মত। বিশিষ্ট সামাজকর্মী এবং নারীবাদী আইন বিশেষজ্ঞ ফ্লেবিয়া অ্যাগনিসের মতে ‘Aim Should Be Uniformity of Rights, Not a Uniform Law.” অর্থাৎ অধিকারের ক্ষেত্রে অভিন্নতা আসুক আইনের ক্ষেত্রে নয়। তিনি বারবার বলেছেন যে এই সব বিষয়ে আইনের পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ বদল সম্ভব নয় বরং সামাজিক ধ্যানধারণার পরিবর্তন বেশি প্রভাবশালী হয়। অমর্ত্য সেন তার “দি আইডিয়া অফ জাস্টিস” বইয়ে দুরকম ধারণার কথা বলেছেন। Arrangement-focus Justice এবং Realisation-focus Justice। অর্থাৎ ব্যবস্থায়িক ন্যায় এবং বাস্তব-ন্যায়। ব্যবস্থাতে পরিবর্তন করা ন্যায় প্রতিষ্ঠার শুধু একটি অংশ। সেই ব্যবস্থা সমাজে কতটা বাস্তবায়িত হল সেটা বিচার করে বোঝা যায় আসলে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হল কি না। এই নতুন পরিবর্তিত আইনের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। বিশিষ্ট আইনজীবী করুণা নন্দীও বিভিন্ন টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে একই কথা বলেছেন। সুতরাং এখনই অত্যোৎসাহের চোটে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের দাবি করে বসা ফ্যাসিবাদীদের ফাঁদে পা দেওয়া হবে।
উপসংহারের বদলে
পারিবারিক আইন সামাজের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের একটি অঙ্গ। আবার একজন নারীবাদী হিসেবে আমি কখনই নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের আপস হোক এটা চাইব না। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদেরকে এখানে তলিয়ে ভাবতে হবে সেটি হল নারী-অধিকার এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড ইংরাজিতে যাকে বলে কোনও ‘আইদার-অর’ ব্যাপার নয়। আমাদেরকে ভেবেচিন্তে নিজেদের লড়াই নিজেদেরকেই লড়তে হবে। সুতরাং উচ্চতম ন্যায়ালয়, তার বর্তমান চরিত্র এবং সমকালীন রাজনীতির কথা মাথায় রেখেই নিজেদের দাবিগুলো তুলতে হবে। যে তরোয়ালের দুদিকেই ধার সে নিয়ে খেলা না করাই ভালো।