বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়
লেখক এলজিবিটিকিউ অধিকাররক্ষা আন্দোলনের কর্মী, সমাজকর্মী
ভোটের রাজনীতিতে ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায় হিসাবে গণ্য হতে পারাটাও কিন্তু একটা রাজনীতি।
২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট যখন ৩৭৭ ধারা বহাল রাখলেন, তখন তাঁরা ব্যবহার করেন ‘minuscule minority’ শব্দবন্ধটি। বলেন, ‘এঁরা কোথায়? গুনতিতে আসে না এমন কিছু লোকের কথা বলতে এসেছেন!’
মজার ব্যাপার, সেই সময়ে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়েই লড়ছেন দুই সমকামী মহিলা আইনজীবী। মানেকা গুরুস্বামী এবং অরুন্ধতী কাটজুকে নাকি বিচারপতিরা বলেন ‘আপনার দেখেছেন এঁদের কখনও?’
পরের বার ২০১৮ সালের শুনানির সময় এই দুই তরুণী আইনজীবী বিচারপতিদের কাছে তাঁরাই যে এক সমপ্রেমী দম্পতি, তা খোলসা করে জানান!
এই প্রকাশও ২০১৮ সালের ৩৭৭-এর বিলুপ্তির একটি বড় কারণ হিসাবে মানা হয়। পরে এই দম্পতি টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন এইভাবে ‘personal is political’ শব্দবন্ধের মানে তুলে ধরে।
মোদ্দা কথা, সংখ্যার রাজনীতিতে সংখ্যাই একটা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র, অধিকার আদায়ের, দাবি-দাওয়া তুলে ধরার এবং সংসদ বা বিধানসভায় জনপ্রতিনিধিত্ব জাহির করার জন্য।
এখন ব্যাপার হচ্ছে, সামনেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। আর প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে যৌন এবং লিঙ্গ-সংখ্যালঘুদের দাবি-দাওয়া উঠবে কি না? কী ভাবছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি? কী চোখে দেখছে এই অংশের মানুষদের?
শেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানো হয় এবং বিভিন্ন মিটিং-এ তাঁদের সমস্যা, তাঁদের দাবি-দাওয়াগুলি তুলে ধরার কথা বলা হয়। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, যে এটা কি শুধুই নির্বাচনী চমক হিসাবেই থেকে যাবে, নাকি হার-জিতের বাইরেও এর একটা ধারাবাহিকতা থাকবে? আশ্বস্ত করা হয়েছিল, থাকবে।
গত জাতীয় নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলি তেমনভাবে কোনও দাগই ফেলতে পারেনি। তবু বলা উচিত, সিপিআইএম-এর গণসংগঠনগুলির মধ্যে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি নিয়মিত নিজেদের কাজে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের ইস্যুগুলি জাগিয়ে রেখেছে। এখন সেটা কতটা গভীরতার সঙ্গে, মনোযোগের সঙ্গে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছেই। তবে অন্তত জাগিয়ে যে রেখেছেন, তা বলা চলে।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দল, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এইরকম কোনও রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ঘটেনি। কিন্তু শুরুতেই রাজ্য সরকার, যা কিনা এই দলের দ্বারাই পরিচালিত, তাঁরা কিন্তু রাজ্যে ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করে দিয়েছিলেন। এখানে বলা দরকার, অন্যান্য রাজ্য যেখানে ট্রান্সজেন্ডার কল্যাণ পরিষদ বা ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এক ধাপ এগিয়ে কল্যাণ থেকে উন্নয়নে পৌঁছেছিলেন!
কিন্তু ওই আর কী! নাম, সাইনবোর্ড হয়ে রয়ে গেলে কি আর পরিচিতি তৈরি হয়? গত পাঁচ বছরে এই বোর্ডের কাজকর্মের হদিশ নিলে দেখা যাবে, সবেতেই বিশাল ফাঁকি। সবথেকে জরুরি কথা হল এই যে পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এই তথ্যটুকুও বার করেনি যে পশ্চিমবঙ্গে রূপান্তরকামী মানুষের সংখ্যা কত? সব উন্নয়ন ভুলে যান, বোর্ডকে যদি এই কথাটি জিজ্ঞাসা করেন যে পাঁচ বছরে আপনারা কি জেনেছেন যে রাজ্যে এলজিবিটিকিউ-র মধ্যে শুধু ট্রান্সজেন্ডার অংশটির সংখ্যা কত? উত্তর পাবেন না। কাজেই বাকি কথায় আর না যাওয়াই ভালো।
তবে এই সঙ্গেই এটাও বলা উচিত, এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকার কারণে এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সুবিধা-অসুবিধাগুলি নিয়ে লড়তে গিয়েও একটা অনুভব এসেছে (হতে পারে সেটি খুব নৈর্ব্যক্তিক নয়) যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এলজিবিটি সম্প্রদায়ের ব্যাপারে কিছু হলেও চেষ্টা করতে চান। বারবার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সাম্প্রতিক কালে রাজ্য সরকারের কিছু তৎপরতা লক্ষ করেছি। বিশেষত এই করোনা-কালে দুটি-তিনটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার। সেই সাম্প্রতিক আলোকরেখাগুলির কথাই বলা যাক এবার।
রূপান্তরকামী নেতৃবৃন্দের আবেদনে সাড়া দিয়ে অন্তত কলকাতায় একটি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে ট্রান্সজেন্ডার বেড সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। স্বাস্থ্যভবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতার এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে ছয়টি বেড ট্রান্সজেন্ডার ভাইবোনেদের জন্য নির্দিষ্টকৃত হল। এর আগেই মাননীয়া স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী শ্রীমতি চন্দ্রিমা ভট্ট মহাশয়ার আবেদনে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছিলেন। কিছু জেলাতেও সাধারণ হাসপাতালে ট্রান্সজেন্ডার বেডের ব্যবস্থা হয়েছে। ভারতের মধ্যে এইভাবে সরকারি কোভিড হাসপাতালে তৃতীয় লিঙ্গের সহনাগরিকদের জন্য এই পরিষেবা প্রথম হল আমাদেরই রাজ্যে, বাংলায়।
রেশন দেওয়ার ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করা এলজিবিটিকিউ সংগঠনগুলিকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য সরকার রেশন পৌঁছে দিতে জরুরি ভূমিকা নিয়েছেন।
সম্প্রতি, ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য ডিজিটাল রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এগুলি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ।
কলকাতায় একটি বেসরকারি বাস সংস্থা তাদের বাসে দুটি করে আসন সংরক্ষণ করেছে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য। আশা করা যায়, এর পরে সরকারি বাসেও তেমনটা হবে। সম্প্রতি ঢাকুরিয়ার একটি রক্তদান শিবিরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের স্বপরিচয়ে রক্তদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতদিন এ নিয়ে ছিল নানা ভ্রান্ত ধারণা। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মানেই যৌন-রোগাক্রান্ত, হাই-রিস্ক গ্রুপ, সুতরাং রক্তদানের অনুপযুক্ত, এধরনের অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শোনা যেত কান পাতলে৷ সে অন্ধকারও কাটিয়ে উঠল কলকাতা। আশা করা যায় ভবিষ্যতে সরকার এই বিষয়েও সচেতনতা প্রসার করবেন।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, নীতিগতভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের এলজিবিটিকিউ অধিকারের ক্ষেত্রে অবস্থান ঠিক কী? বা আদৌ কোনও অবস্থান আছে কি?
বলা ভালো, এই সব বিতর্ক থেকে শত হস্ত দূরে আর দুটি জাতীয় দল— জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব এবং ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব এখনও অবধি এই ব্যাপারে কোনও বাক্য ব্যয় করেনি। কাজেই ধরে নেওয়া যেতেই পারে, এই ব্যাপারে তাদের এই মুহূর্তে অন্তত কোনও অবস্থান নেই।
এ তো গেল রাজ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে লিঙ্গ রাজনীতির নিরিখে রাজনৈতিক দলগুলির কিছু ঘোষিত কাজ এবং অবস্থান।
কিন্তু এর বাইরে একটা বিরাট এবং জরুরি ক্ষেত্র পড়ে রইল— সংখ্যা। যা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম।
সুপ্রিম কোর্টের নালসা এবং ৩৭৭ ধারা সংক্রান্ত রায়ের পর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। মজার ব্যাপার হল, রাজ্য বা কেন্দ্র, কেউই এখনও অবধি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের উপরে কোনও সুমারি করেনি। রাজ্য ও কেন্দ্র-দুই-ই এই দোষে দুষ্ট। কোনও দপ্তরের কাছে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ভারতে কত তার কোনও পরিমাপ নেই। কাজেই আজও যদি কলমের খোঁচায় বলে দেওয়া হয় এঁরা ‘নগণ্য সংখ্যালঘু’, তাহলে উন্নয়নের চেষ্টাও আর থাকবে না৷
এইখানেই একটি প্রশ্ন ঘনীভূত হয়।
‘সংখ্যা’ মানেই গণতন্ত্রের বৃত্তে একটি জরুরি প্রশ্ন। যথেষ্ট সংখ্যা মানেই নীতি নির্ধারণ। নীতি নির্ধারণ মানেই বাজেট। বাজেটে কী ব্যয়-বরাদ্দ করা হল তা সরাসরি একটি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান নৈর্ব্যক্তিকভাবে স্পষ্ট করে দেয়।
প্রশ্ন হল, কোনও রাজনৈতিক দলই কি চায় যৌন ও লিঙ্গ-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা সরকারিভাবে স্পষ্ট হোক?
রাশিয়া একটি অত্যন্ত হোমোফোবিক দেশ। রাজনৈতিকভাবে সেই দেশের বক্তব্য, সেখানে অ-বিষমকামী কেউ নেই। পাশেই চেচনিয়া। অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন পৃথিবী জুড়ে দেখাচ্ছেন, বলে চলেছেন, চেচনিয়ায় সমকামীদের খুন করার জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্প খোলা হয়েছে। কিছু মানুষ, যাঁরা ওই বর্বর হত্যার হাত থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছেন, তাঁদের আখ্যান বুক কাঁপিয়ে দেয়।
অর্থাৎ এই সময়েও এমন আন্তর্জাতিক উদাহরণ যথেষ্ট আছে, যেখানে এই ‘মিনিস্কিউল মাইনরিটি’-র আখ্যানকে ‘নেই’ করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, নিয়মিত।
ভয়টা কীসের?
আসলে কি ‘যৌন ও লিঙ্গ-সংখ্যালঘু’ শব্দবন্ধটি একটি সোনার পাথরবাটি? আসলে কি পিতৃতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পারিবারিক সম্পত্তির বংশানুক্রমিক ধারা ঠিক রাখার জন্য যা স্বাভাবিক ও সহজ, যৌনতা ও লিঙ্গপরিচয়ের সেই ঢেউকেই ভয়? তাই কি সুমারি হয়নি এবং কোনও রাজনৈতিক দল দাবিও তুলছে না? আসলে কি পিতৃতান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী, পারিবারিক, পুঁজিনির্ভর সমাজব্যবস্থা তার রাজনৈতিক ভাষ্যে যৌনতা এবং লিঙ্গপরিচয়কে নগণ্য করে, কিছু দাবি-দাওয়া পাইয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমিত রাখতে চান?
এলজিবিটি অধিকার আন্দোলনে তাই নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য লেখার সময় এসে গেছে! ২০২১ সালের নির্বাচন তার একটি মহড়া মাত্র। ধারাবাহিকভাবে খুচরো দাবিদাওয়া থেকে এগিয়ে, এই বৃহত্তর রাজনৈতিক বার্তালাপের সময় এখন। সেই সংক্রান্ত রাজনৈতিক সক্রিয়তা এখন সময়ের দাবি।