Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উত্তরাধিকার ও গুরুদক্ষিণা: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রসঙ্গে কিছু কথা

স্বাতী মৈত্র

 


লেখক অধ্যাপনা করেন, প্রাবন্ধিক

 

 

 

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির সর্বশেষ, ক্যাবিনেট-অ্যাপ্রুভড খসড়া কিছুদিন আগে প্রকাশ হয়েছে। যদিও সেই খসড়া এর আগের দুই শিক্ষানীতির মতন (এখনও অবধি) সংসদে পেশ হয়নি, এ কথা মনে রাখা কর্তব্য যে শিক্ষা ‘নীতি’ কোনও নতুন ‘আইন’ নয় যে তা পাশ হওয়ার জন্য সংসদের সমর্থন প্রয়োজন। সংসদে পেশ হলেও যে তার খুব বেশি সংশোধন হওয়ার আশা রয়েছে, এমন কথাও বলা সম্ভব নয়। এর কারণ শুধু এই নয় যে শাসক দল, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির, লোকসভায় পূর্ণ গরিষ্ঠতা আছে এবং রাজ্যসভাতেও যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে, অতএব তাঁরা যা চাইবেন পাশ করিয়ে নিতে পারবেন। এর কারণ নতুন শিক্ষানীতির একদম শুরুতে, সেকশন ১,১-এই লেখা রয়েছে:

The previous policies on education have justifiably been preoccupied largely with issues of access and equity, but as a result have unfortunately dropped the baton with regard to quality of education. The implementation of the two previous education policies, especially with regards to quality, remains largely incomplete. The unfinished agenda of the National Policy on Education 1986, Modified in 1992 (NPE 1986/92), is appropriately dealt with in this Policy.[1]

অ্যাক্সেস ও ইকুইটি— অর্থাৎ সহজলভ্যতা ও সাম্য— ছাড়া শিক্ষার ‘কোয়ালিটি’ বলে কিছু হওয়া সম্ভব কি না কি না, সে প্রশ্ন কিছুক্ষণের জন্য মুলতুবি থাক। বরং একটু ভেবে দেখা যাক ১৯৮৬/১৯৯২-এর, অর্থাৎ রাজীব গান্ধি-নরসিংহ রাওয়ের আমলের, জাতীয় শিক্ষানীতির এমন কী অসম্পূর্ণ স্বপ্ন ছিল যা পূর্ণ করবার জন্য আজকের দিনে উৎসুক হয়ে উঠেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার? যে গান্ধি পরিবারের নাম শুনলেও আজকের শাসকেরা গঙ্গাস্নান করে আসেন, সেই পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত ১৯৮৬/১৯৯২-র শিক্ষানীতিতে এমন কী ছিল, যা দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলকে একই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে সক্ষম? এর উত্তর পেতে গেলে একটু ইতিহাসের পাতা উল্টানোই যথেষ্ট।

১৯৮৬/১৯৯২ সালের শিক্ষানীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা অবশ্যই শিক্ষার নব্যউদারীকরণ ও টেকনিক্যাল/ম্যানেজমেন্ট শিক্ষায় তার বিশেষ ভাবে প্রভাব ও প্রসার।[2] স্বাধীনতার আগে থেকেই ভারতবর্ষে তিন রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচলন ছিল— সরকারি, সরকারি-সাহায্যপ্রাপ্ত, ও বেসরকারি। আশির দশকে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তৎকালীন শিক্ষানীতি সিদ্ধান্ত নেয় যে ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের অনুমতি ছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। তৎকালীন শিক্ষানীতি এটাও জোর দিয়ে বলে যে ‘ফর প্রফিট’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না, অর্থাৎ শিক্ষাকে সরাসরি বাণিজ্য বানিয়ে ফেলা যাবে না। এ কথা বলা সত্ত্বেও কিন্তু ১৯৮৬/৯২-এর শিক্ষানীতি বেসরকারি ও সেবামূলক সংস্থানগুলোকে শিক্ষায় নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়। তারও ২০ বছর আগেকার কোঠারি কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করবার রূপরেখা নিয়ে কিন্তু সেরকম উৎসাহ দেখায়নি এই নীতি! বরং ভারতীয় অর্থনীতির তালা খোলবার ঠিক আগে ও পরে গঠিত এই নীতিতে বিশেষ করে জোর দেওয়া হয় টেকনিক্যাল/ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার ‘রিঅর্গানাইজেশন’ ও প্রসারের পক্ষে, আগামী দিনের কর্মী তৈরির কথা মাথায় রেখে। আস্তে আস্তে ‘অটোনমাস’ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা ও অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ প্রথাটিকে তুলে দেওয়ার স্বপ্নও কিন্তু প্রথম দেখে এই শিক্ষানীতি। আজকের দিনে বসে ফিরে দেখলে ‘৯০ দশকের শেষে এসে টেকনিক্যাল/ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার রমরমা ও সে প্রসঙ্গে বেসরকারি পুঁজির ক্রমবর্ধমান উৎসাহের মধ্যে ১৯৮৬/৯২ সালের শিক্ষানীতির প্রভাব খুব সহজেই বোঝা সম্ভব। সেই নীতিকে পাথেয় যে বর্তমান শাসক দলও মনে করে, তা তারা ক্ষমতায় আসবার পরেই ২০১৪ সালের অগস্ট মাসে লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে জানিয়ে দেন। সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী, স্মৃতি ইরানি, বলেন,

No recent study has been undertaken by the Government to assess the impact of privatisation of education in the country. However, the Government has consistently held the view that education in India cannot be regarded as a commercial activity and all educational institutions have to be set up in the “not for profit” mode. The National Policy on Education, 1986 (as modified in 1992), encourages non-governmental and voluntary efforts in Education, while preventing the establishment of institutions which intend to commercialize Education. The Policy envisages that in the interest of maintaining standards and for several other valid reasons, the commercialization of technical and professional education will be curbed. An alternative system will be devised to involve private and voluntary efforts in Education, in conformity with accepted norms and goals.[3]

ইরানির বক্তব্য খুব পরিষ্কার— ১৯৮৬/৯২-এর নীতির পথ ধরেই শিক্ষায় বেসরকারি পুঁজিকে ‘নট ফর প্রফিট’-এর ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করা তাঁর সরকারের উদ্দেশ্য, তবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁরা সদা জাগ্রত।

অবশ্য এ প্রশ্ন উঠতেই পারে, ২০১৪ সালে দাঁড়িয়ে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথেচ্ছ ফি, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফি বৃদ্ধি, শিক্ষা লোনে ক্রমবর্ধমান এনপিএ, অনিয়ন্ত্রিত কোচিং ইন্ডাস্ট্রির রমরমা, এ সমস্ত কিছু মাথায় রেখে, এই ধরনের বক্তব্য ঠিক কতটা যুক্তিসঙ্গত? তাঁর বক্তব্যের শেষ দুটি লাইনে ইরানি যেন সেটা মেনেই নিয়েছেন, “The Policy envisages that in the interest of maintaining standards and for several other valid reasons, the commercialization of technical and professional education will be curbed. An alternative system will be devised to involve private and voluntary efforts in Education, in conformity with accepted norms and goals.” ‘টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করা হবে’— হয়েছে নয়, হবে— এ কথা বলার অর্থ মেনেই নেওয়া যে বাণিজ্যিকীকরণ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, এবং বাকিটুকু স্রেফ মন্ত্রীসুলভ ভঙ্গিতে আশ্বাস দেওয়া, যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এখানে এই প্রশ্নও উঠতে পারে, যে জিনিসটা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে আগের সরকারের আমলে, তার প্রতিকারের দায় কেন নিচ্ছেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী? এর কারণ একটাই— ভারতবর্ষে আজও ‘শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ’ শুনলে বেশ বড় সংখ্যার মানুষই নড়েচড়ে বসেন, কিছুটা সময়ের জন্য টেলিভিশন-ওয়াটসঅ্যাপের জগৎ থেকে বেরিয়ে আগামী প্রজন্মের শিক্ষার অধিকার নিয়ে সওয়াল করতে বসেন। তাঁদের উত্তর দেওয়ার জন্য ১৯৮৬/৯২-এর শিক্ষানীতি একটি বৃহৎ ঢাল হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক শ্রেণির হাতে। বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সওয়াল করেও খাতায়-কলমে অন্য পথ ধরে, এক রকমের ‘ডাবলস্পিক’ ব্যবহার করে, বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত করবার উপায় দেখায় ১৯৮৬/৯২-এর শিক্ষানীতি। এবং ঠিক এই কারণেই ২০১৯ সালের শিক্ষানীতির প্রথমেই ১৯৮৬/৯২-এর শিক্ষানীতির অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, অর্থাৎ রাজীব গান্ধি-নরসিংহ রাওয়ের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, পূর্ণ করবার অঙ্গীকার একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যাশিত। দৈনন্দিন রাজনৈতিক তরজার চোখ দিয়ে তাকে দেখলে হবে না।

***

 

শিক্ষার নব্যউদারীকরণ— এ কথাটির অর্থ কী? অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভেবে নিই যে নব্যউদারীকরণের অর্থ শুধুই বেসরকারি পুঁজির প্রবেশ, অথবা সরকারি সম্পত্তিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু নব্যউদারীকরণ কেবলমাত্র এতটুকুতে সীমিত নয়। নব্যউদারবাদ একটি যুক্তি, এক প্রকারের আদর্শ, যা মূলত বাজারকেন্দ্রিক। নব্যউদারবাদ বাজারের সার্বভৌমতা ছাড়াও ‘স্বাধীনতার’ স্বার্থে রাষ্ট্রের ভূমিকা খর্ব করায় বিশ্বাস করে। বিশ্বের নানা প্রান্তে জাতীয় অর্থনীতির জগতে নব্যউদারবাদের প্রবেশ ওয়াশিংটন কন্সেন্সাস ও তার দশটি পলিসি রেকমেন্ডেশনের হাত ধরে। ভারতবর্ষের ১৯৯১ সালের অর্থনীতির তালা খোলা ও তার পরবর্তী নানা পদক্ষেপ-সংশোধন নীতিও এই ওয়াশিংটন কন্সেন্সাসের দেখানো পথেই এগিয়েছে।

নব্যউদারবাদী যুক্তির গোড়ায় যেহেতু রাষ্ট্রের নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, তাই প্রথমেই নব্যউদারবাদী চিন্তা আক্রমণ করে ‘পাবলিক গুডস’-এর ধারণার মূলে। সার্বজনীন সম্পত্তিকে পণ্য হিসেবে দেখতে শেখায় নব্যউদারবাদী চিন্তা, আর তার সমর্থনে থাকে কিছু অতি-আকর্ষণীয় শব্দ বা বাজওয়ার্ড— গুণমান (কোয়ালিটি), কার্যকারিতা (এফিসিয়েন্সি), প্রতিশ্রুতি (অ্যাসিওরেন্স), ইত্যাদি। রেল পরিষেবা থেকে পেনশন, স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা— প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তি আসে, নাগরিক ও বাজার একে অপরের মধ্যে রফা করে নেবে, এর মধ্যে রাষ্ট্রের থাকবার কী প্রয়োজন? যুক্তি আসে, বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে। নব্যউদারবাদী যুক্তির প্রাথমিক চাহিদা, যে কোনও ক্ষেত্রে, ‘ডিরেগুলেশন’— অর্থাৎ বাজারকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া। এরপরেই আসে ‘মার্কেটাইজেশন’, অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে নীতির সাহায্যে বাজারমুখী করে তোলা। নব্যউদারীকরণের আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বাজারের যুক্তি জীবনের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আদর্শের অংশ হয়ে দাঁড়ানো। এ হেন যুক্তিতে কেউ গান ভালোবেসে গান গাইলে চলবে না, সেই গান শেখা যাতে তার সিভিতে ‘অলরাউন্ড পার্সোনালিটির’ প্রকাশ হিসেবে দেখানো যায়, সে কথাও মাথায় রাখতে হবে। এ হেন যুক্তিকে সামাজিক কাজ শুধু কাজ নয়, ‘লিডারশিপ পোটেনশিয়াল’-এর প্রকাশ হতে হবে। এ হেন যুক্তিতে একজন ব্যক্তি শুধু ব্যক্তি নয়, তিনি একজন আত্মনির্ভর উদ্যোগপতি। তাঁর জীবনের প্রতিটা কাজ হতে হবে ‘ইউজফুল’, প্রতিটা মুহূর্ত হতে হবে ‘ওয়েল স্পেন্ট’। স্টক মার্কেট পোর্টফলিওতে শেয়ার কেনাবেচার মতন মানুষের জীবনটাকেও এক ধরনের পোর্টফোলিওতে পরিণত করে নব্যউদারবাদী চিন্তা। অধ্যাপিকা ওয়েন্ডি ব্রাউনের ভাষায় বললে, “…more than mere economic policy, neoliberalism is a governing social and political rationality that submits all human activities, values, institutions, and practices to market principles. It formulates everything in terms of capital investment and appreciation (including and especially humans themselves), whether a teenager building a resume for college, a twenty-something seeking a mate, a working mother returning to school, or a corporation buying carbon offsets.”[4] বেসরকারিকরণ বা প্রাইভেটাইজেশন এই পুরো প্রক্রিয়ার অংশমাত্র।

শিক্ষার মতন ক্ষেত্রে নব্যউদারবাদী যুক্তি কী করে? তা প্রথমেই শিক্ষাকে সার্বজনীন সম্পত্তি থেকে পরিষেবায় পর্যবসিত করে। শিক্ষার ‘আউটকাম’, অর্থাৎ আদর্শ কর্মী তৈরি করবার ব্লুপ্রিন্ট সম্পর্কে সম্পর্কে চিন্তাশীল হয়ে ওঠেন নীতি-নির্ধারকেরা। নব্যউদারবাদী যুক্তি দাবী করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাজারমুখী হয়ে ব্র্যান্ড তৈরি করতে হবে, ব্র্যান্ডের আকর্ষণ ও পরিষেবার গুণমান দেখে ইউজার— ছাত্র নয়— সেই প্রডাক্ট কিনবেন, প্রয়োজনে লোন নিয়ে। সেই গুণমান মাপবার জন্য তৈরি হয় নিত্যনতুন মেট্রিক্স আর কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স মেকানিজম, অর্থনীতিবিদের ভেক ধরে এফিসিয়েন্সি ও ডেলিভারেবল মাপজোক করে যান বাজার সরকারেরা।

১৯৮৬/৯২ থেকে ২০২০, ভারতবর্ষে শিক্ষাক্ষেত্রে যা যা সংশোধন ও পুনর্গঠন হয়েছে, তা সবই এই নব্যউদারবাদী যুক্তি দ্বারা পরিচালিত। এই কারণেই রাজীব গান্ধি-নরসিংহ রাওয়ের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূর্ণ করবার অঙ্গীকার করেন নরেন্দ্র মোদি, আত্মনির্ভরতার বয়ান হয়ে ওঠে শিক্ষায় নব্যউদারীকরণের মূলমন্ত্র।

***

 

১৯৯৫ সালে ভারত ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডাব্লুটিও) সদস্য হয়, এবং সেই সদস্যপদের অংশ হিসেবে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস (গ্যাটস) চুক্তির অংশীদার হয়ে ওঠে। গ্যাটস চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হল অবাধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, এবং ভর্তুকি-ইম্পোর্ট ডিউটি ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাকে যথাসম্ভব দূর করে প্রতিযোগিতার পথ প্রশস্ত করা। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যের পণ্য হচ্ছে ‘সার্ভিসেস’ অথবা পরিষেবা। ২০০০ সালে, একটি বহুচর্চিত সিদ্ধান্তে, ডাব্লুটিও শিক্ষাকে ‘সার্ভিসেস’-এর অংশ হিসেবে গণ্য করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ডাব্লুটিওর চতুর্মুখী নীতির হিসেবে শিক্ষার পাঁচটি ধারায় (প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি অথবা হায়ার, অ্যাডাল্ট, এবং আদার এডুকেশন) ক্রসবর্ডার সাপ্লাই, কনজাম্পশন অ্যাব্রোড, কমার্শিয়াল প্রেজেন্স ও প্রেজেন্স অফ ন্যাচারাল পার্সন্স[5] প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় সমস্ত সদস্য দেশকে। প্রথমেই ‘অফার’ দেয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা ও ইউরোপের কয়েকটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় সংগঠন শিক্ষাকে গ্যাটসের আওতায় নিয়ে আসার তীব্র বিরোধিতা করে। বিরোধিতা শোনা যায় পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও। ভারতবর্ষের শিক্ষক আন্দোলনেও এর তীব্র বিরোধিতা শোনা যায়, যদিও সেই বিরোধিতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে জনমানসে বিশেষ আঁচর কাটতে পারেনি।

এ কথা উল্লেখযোগ্য যে শিক্ষাক্ষেত্রকে গ্যাটস চুক্তির আওতায় নিয়ে আসা ডাব্লুটিওর সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু নব্যউদারবাদী যুক্তির জগতে বাধ্যতামূলক না হয়েও বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে অনেক কিছু, এবং এ ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের অন্যথা হয়নি। যে নব্যউদারবাদী চিন্তা আমরা ১৯৮৬/৯২-এর শিক্ষানীতিতে দেখতে পাই, সেই চিন্তারই ছাপ পাই আমরা ১৯৯৮ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর জোশির বক্তব্যে। প্যারিসে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন হায়ার এডুকেশনে তিনি বলেন, “Major efforts have been mounted for mobilization of resources and it has been recommended that while the Government should make a firm commitment to higher education, institutions of higher education should make efforts to raise their own resources by raising the fee levels, encouraging private donations and by generating revenues through consultancy and other activities.”[6] জোশির মুখে একই সঙ্গে দুরকম কথা শোনা যায়, যখন তিনি একদিকে বলেন, “It is not only justifiable but desirable to raise money from private sources in order to ease pressure on public spending”, আবার অন্য দিকে বলেন, “The Government wants to encourage private initiatives in higher education but not commercialization.” এ কথা বলাই বাহুল্য যে ১৯৯৮ সালে দাঁড়িয়েও ১৯৬৬ সালে কোঠারি কমিশন নির্ধারিত জিডিপির ৬ শতাংশ খরচের প্রসঙ্গ শুধু আলোচনা ও আশ্বাসের স্তরেই রয়ে গিয়েছিল।

বাণিজ্যিকীকরণ প্রসঙ্গে যে কথা জোশি নিজে বলতে পারেননি, সেই কথাগুলোই কিন্তু বাজার— তথাকথিত ‘ইন্ডিয়া ইনকর্পোরেটেড’-এর সদস্যরা— বারবার বলে গেছে, রাখঢাক না করেই। ২০০০ সালে প্রাইম মিনিস্টার্স কাউন্সিল অন ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি গভর্নমেন্ট ইন ইন্ডিয়ার একটি স্পেশাল সাবজেক্ট গ্রুপ, যার পুরো নাম স্পেশাল সাবজেক্ট গ্রুপ অন পলিসি ইনভেস্টমেন্ট ইন এডুকেশন, হেলথ অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট, একখানা রিপোর্ট জমা দেয়, যা আজকের দিনে বিড়লা-আম্বানি রিপোর্ট হিসেবেই পরিচিত।[7] সেই রিপোর্টে কিন্তু শুরুতেই বলে দেওয়া হচ্ছে, “User pays principle to be enforced strictly for higher education supported by loan schemes as well as financial grants for economically and socially backward sections of society.” এই রিপোর্টের চোখে প্রাইমারি বা এলিমেন্টারি শিক্ষা সার্বজনীন সম্পত্তি হলেও উচ্চশিক্ষা আরেক প্রকারের ‘সার্ভিস’ মাত্র— গুণমান বজায় রেখে পরিষেবা দিতে হলে বেসরকারিকরণ ও ফি বৃদ্ধি ছাড়া উপায় নেই, ডিরেগুলেশন করতেই হবে। এ কথা উল্লেখযোগ্য যে সেই রিপোর্টে এরকম নিদানও দেওয়া আছে, “Ban any form of political activity on campuses of universities and educational institutions.” রাজনীতি-সচেতন ছাত্রছাত্রীতে আপত্তি কেন, এ কথা অবশ্য তাঁরা খোলসা করে বলেননি, তবে রিপোর্টের দাবীদাওয়া থেকে তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না।

আবার ২০০৬ সালে ASSOCHAM-ICRIER একটি বিশ্বায়ন ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে কনফারেন্স সংগঠিত করে, যেখানে তাঁদের ২৭ পয়েন্ট দাবিদাওয়াতে নানা প্রকারের মণিমুক্তা পাওয়া যায়।[8] যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এসইজেড, পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে আসা, আইটি ও আইটি-এনাবল্ড সার্ভিসের সাহায্যে ‘হাইব্রিড’ মোডে ডিস্ট্যান্স শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া (আজকের অনলাইন শিক্ষার এভাঞ্জেলিস্টরা শুনলে খুশি হবেন), বিদেশি পুঁজির আমন্ত্রণ, ইত্যাদি। অবশ্য ২০০৬ সালে বসে এ হেন দাবিদাওয়া যে খুব আশ্চর্য কিছু, তা নয়। এর কারণ তার এক বছর আগেই, অর্থাৎ ২৪শে অগস্ট ২০০৫-এ ভারত সরকার ডাব্লুটিওর কাছে উচ্চশিক্ষাকে গ্যাটস চুক্তির আওতায় নিয়ে আসবার ‘অফার’ দিয়ে রেখেছে। সে সময় ক্ষমতায় মনমোহন সিংহের ইউপিএ সরকার, ন্যাশনাল নলেজ কমিশন নামক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের কর্ণধার রাজীব গান্ধির একদা উপদেষ্টা স্যাম পিত্রোদা, ও জোটসঙ্গী— আরও অনেক দলের সঙ্গে— বামফ্রন্ট। এর পরবর্তী নানা পুনর্গঠনের উদ্যোগ, যার অনেকটাই বাম-সমর্থিত শিক্ষক ও ছাত্র আন্দোলনের জেরে রাজ্যসভায় আটকে যায়, তা সবই গ্যাটস চুক্তির কথা মাথায় রেখে আনা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এর ব্যতিক্রম নয়।

***

 

এরপরেও কিন্তু সরকারি বুলির বদল হয়নি। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কখনওই মেনে নেওয়া যাবে না, এ কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গেই উচ্চশিক্ষাকে গ্যাটসের আওতায় নিয়ে আসবার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। যে চুক্তির উদ্দেশ্য অবাধ আন্তঃসীমানা বাণিজ্য, এবং যার ফল ফি বৃদ্ধি, শিক্ষা লোন বৃদ্ধি ও শিক্ষাক্ষেত্র থেকে সরকারের যথাসম্ভব সরে যাওয়া, তার সঙ্গে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কোনও সম্পর্ক নেই? যে পুনর্গঠনের মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক ‘স্বশাসন’, যার দাবী শিক্ষা সার্বজনীন নয়, কেবল একটি পরিষেবা মাত্র, তা আসলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নয়? বিড়লা, আম্বানি, অ্যাসোচাম, ফিকি— শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র ও শিক্ষকদের থেকে এঁদের মতামত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হয়নি/হবে না? যে সংশোধনের জাদুবাস্তব জগতে শিক্ষার গুণমানের বিচার বাজার সরকারের হিসেবে হয়, সহজলভ্যতা ও সাম্যের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকে না, তাকেও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বলা যাবে না? যে শিক্ষানীতির প্রাথমিক খসড়া (২০১৯) শুরুই হয় ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম নামক বিশ্বের ধনীতম সংস্থানগুলির ভাষায়, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অর্থাৎ আধুনিক গিগ ইকনমির জয়গান শুনিয়ে, তাতেও শিক্ষার সার্বজনীন চরিত্র সুরক্ষিত থাকে? যে দেশে আজও আর্থ-সামাজিক উত্তরণের একমাত্র পথ শিক্ষা, সে দেশে রাজনৈতিক শ্রেণি ও শিল্পপতিদের সর্বসম্মতিক্রমে উচ্চশিক্ষায় অবাধ আন্তঃসীমানা বাণিজ্য কার সুবিধা করে দেবে?

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিয়ে মূলধারার আলোচনায় এই একটা প্রশ্ন খুঁজে পাওয়াও কঠিন, উত্তর তো পরের কথা।


[1] https://www.mhrd.gov.in/sites/upload_files/mhrd/files/NEP_Final_English_0.pdf
[2] https://www.mhrd.gov.in/sites/upload_files/mhrd/files/upload_document/npe.pdf
[3] https://pib.gov.in/newsite/PrintRelease.aspx?relid=108677
[4] https://forums.ucdavis.edu/local_resources/docs/Brown_Neoliberalized-Knowledge.pdf
[5] https://www.wto.org/english/tratop_e/serv_e/gatsqa_e.htm#4
[6] http://docshare04.docshare.tips/files/3527/35277903.pdf
[7] https://ispepune.org.in/PDF%20ISSUE/2003/JISPE403/2038DOCU-3.PDF
[8] http://icrier.org/newsevents/conferences-workshops-details/?id=85