কণিষ্ক ভট্টাচার্য
বাসের ভিড়ে হাতের তালুর থেকে গলে যাওয়া খুচরো পয়সা ফের আলোর দেখা পায় জনহীনতায়। ব্যবহারকারী বদলে যায় প্রতিদানবিহীন অন্য স্থানাঙ্কে। অসংখ্য প্লাতেরো ‘আমি’ হয়ে কাঁধে ব্যাগ তুলে নেয় আর সমস্ত বহনের পরিতাপময় প্রাপ্তি জুড়ে জুড়ে বাতিল সংখ্যাকে নির্ণয় করতে চায় নামতায়। সসীম সংখ্যার সঙ্গে আরও একটি শূন্য জুড়ে অসীম শূন্যতায় পোঁছে গোটা জাতি দেখে বামের ইতিবাচক সংখ্যাটি যে কখন অদৃশ্য হয়েছে খেয়াল করা হয়নি। রাতশেষে আহির ভৈরবীকালে ন্যালাখেপা ‘আমি’ বসে থাকে পথের মাঝখানে। কালো রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং-এর সাদা দাগগুলোকে সার দেওয়া ওয়ান লেখা ধরে নিয়ে পরের লাইনে ইটের টুকরো দিয়ে তার পাশে অসংখ্য লাল রঙের জিরো বসিয়ে চলে একমনে। পিঠের নুনের বস্তা গলিয়ে চুপচুপে ভেজা প্লাতেরো ফুটপাথে নির্বিকার মুখে চোয়াল নাড়িয়ে চলেছে। আমার আর প্লাতেরোর ভবিষ্যৎ নেই কোনও, অতীত কেবল কাটা কাটা গলা-মেটে-স্টমাকে দলা হয়ে প্লাস্টিকে ওজন হয়। ছেঁড়াখোঁড়া অতীতের নাড়িভুঁড়ির সঙ্গে দুএকটা রক্তমাখা পায়ের হাড়, নখ আর পালকের বর্তমান পাইল হয়ে আসে।
উৎসব এসে গেছে, শুরু করে দিয়েছি উলটো গণনা। একহাঁটু জলে ছাতা হাতে শারদ সংখ্যা কিনতে গিয়ে জেনেছি, বন্যার জল নামাটাই হল উৎসব। জলের সমোচ্চশীলতার পাঠ ক্লাস সেভেনেই ভুলে গিয়ে নতুন করে শিখছি রাজনীতির বাচন। তিনিই ত্রাতা তাই আর কেউ ত্রাণ সংগ্রহের অধিকারী নন। বাড়িতে রেইড হওয়ার ভয়ে নয়, টমেটো কেনার পয়সাই নেই আসলে। কোনওদিন যদি লুকিয়ে চুরিয়ে পনেরো টাকা দিয়ে একশো কিনে ফেলি, তবে রেইড হলে যে নিজেকে রাজনৈতিক চোর বলে ক্যামেরার সামনে বাইট দেব সেটা ঠিক করে ফেলেছি, কারণ সুভাষচন্দ্রও জেলে গেছিলেন। সুতরাং “মাসিমা বাড়ির কাজ করালে আমরা এটা পেয়ে থাকি, আপনি বরং সুভাষদাকেই ডেকে দিন।” বাজারে ‘পিঙ্ক স্লিপ’ অমিল। উইপ্রোর পরে বাকিগুলো অর্ডার দিয়ে দিয়েছে মাহিন্দ্রা। তিন থেকে তিয়াত্তর, ধর্ষণের কোনও বয়েস হয় না, শরীর থাকলে যেমন রোগ হয় তেমনই ধর্ষণের কেবল রেট আর প্রেক্ষিত হয়। উৎসব উৎসব, মদের লাইসেন্স আর কর আদায়ের উদারহণ দিয়ে সমোচ্চশীলতার ব্যাখ্যা পড়বে আমার সন্তান। পাশ করলে ভর্তির রেট অবশ্য লিপ্স এন্ড বাউন্সে বাড়বে। আমাদের কোনও লিপ্সা নেই কারণ আমরা আহ্লাদী নই। আমরা কাতুকুতুবুড়োর ডেরায় রয়েছি। আসমুদ্র… থুড়ি থুড়ি আজঙ্গলদার্জিলিং হাসতে আমাদের হবেই।
টস করার সময় মুদ্রার এই পিঠের ছবি ওই পিঠের ছবির সঙ্গে মিলে যায়। তারপর কোথাকার ভোট কোথায় ক্রস হয়, কার সততার রেট কত, হনুমান ন জানন্তি কুত মনুষ্যা। অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার বাধ্যতামূলক আর এক কোটি রাখলেই চার পারসেন্ট সুদ। নয়তো হাফ পার্সেন্ট মিঁত্রোর ভোগে। তাই হাসতে হাসতে জন্তুজানোয়ারকে অর্পণ করেছি পিতৃমাতৃপরিচয়। গোমূত্রে স্বচ্ছ হচ্ছে ভারত আর গরুর নিশ্বাসে অক্সিজেন এত বেড়ে গেছে পরিবেশে, যে দাহ্য হয়ে উঠেছে চারপাশ। যে কোনও মুহূর্তে জ্বলে ওঠার আগেই তাই আটচল্লিশ টাকা বাড়ানো হয়েছে, এরপর প্রতি মাসে চারটাকা হারে দাহ্য এলপিজির দাম বাড়াতে হবে। ভরতুকি একটি ঘৃণ্য শব্দ, কিন্তু কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়ের ক্ষেত্রে নয়। বেশি কথা বললে “বিপ” করে দেব। বিরোধিতার আগুন তারা পছন্দ করেন না। উলটো কথা বললেই রাস্তায় ফেলে ল্যাংটো করে এমন ক্যালাবো যে, তোর কোন অস্পৃশ্য পূর্বপুরুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল দূরের কথা, বৈদিক অতিথির জন্য যে গরুর মাংসের রোস্ট হত তাও ভুলে যাবি। “বোল মাদার…, জয় শ্রী রাম”। তারপর সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেব যাতে ভবিষ্যতে আর কথা বলার সাহস না দেখাস। ব্ল্যাক শার্ট-ব্রাউন শার্ট ছেড়ে আমরা এখন গেরুয়া সবুজ শার্ট পরেছি, মনে রাখিস। কেরোসিন বন্ধ। হরিয়ানায় রেশনই তুলে দিয়েছি। রাজস্থানে ইতিহাস বই লিখেছি নতুন করে। গোটা রবীন্দ্র রচনাবলীর একটাই লাইন বাজারে থাকবে, –“সেই সত্য যা রচিবে তুমি।” বাকিসব নাগপুরের পশ্চাতে।
প্রজ্ঞাবান তাত্ত্বিকেরা ধ্যানে মগ্ন। “পাত্রাধার তৈল, না তৈলাধার পাত্র” সময়ের দাবি মেনে এই ‘কাকদন্তগবেষণ’-ই একমাত্র মুক্তির পথ। এই সময় ধ্যানভঙ্গ করলেই কিন্তু তারা কুপিত হবেন। কুপিত হলেই অত সালের অমুক দলিলের তমুক পাতায় বলা হয়েছিল ইত্যাদি এবং প্রভৃতি। কুপিত হলেই তুমি বিচ্যুত। কফের মতো ফ্যাৎ করে তোমাকে রাস্তায় ছেৎরে পড়তে দেখে ফোকলা কাক ফিকফিক হেসে সাঁইসাঁই করে উড়ে যায়। ভগবান নিদ্রা গেলে যে গোলযোগ সইতে পারেন না।
কোথাও পাত্তা না পেয়ে একা হতে হতে আমাদের আর কোনও বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই। আমাদের কৃষক আত্মহত্যা করেও পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত হয় না। আমাদের পরিণত শিল্পের আততায়ীর অভাব ছিল না আবার সদ্যোজাতের আতুর ঘরে নুনেরও। আমাদের সংস্কৃতির মোচ্ছবে নাগরিক চাতুরালি আর গ্রাম্য ইতরতা ছাড়া শ্রমের যোগ নেই। আমাদের মাতৃভাষার ঘরে আমরা ‘সম্পর্কতা’র ‘ছেলে ঢুকিয়ে’ দিয়েছি। আমাদের বাইনারির শূন্য আর একে, আমরা সবাই মিলে সব সময়েই শূন্য এবং কখনওই এক নই। আমাদের অতীত আমরা জানি না। কেবল কতগুলো প্রাচীন জনপ্রিয় নাম জানি। তাকেই অতীত হিসেবে চালানোর চেষ্টা করি দরকারে। প্রতিদিনের অন্ধকার একটু একটু করে গাঢ় হয়। আমরা শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়ণের অপেক্ষা করি মৃত্যুর জন্য। আমাদের কোনও ব্যথাবোধ নেই কুষ্ঠ-আক্রান্ত চামড়ায়। সুচ গেঁথে দিলেও তাই পিন পতনের শব্দ হয় না আমাদের। মরা জাতির শেষ দুই প্রতিনিধি আমি আর প্লাতেরো তাই মুখোমুখি, ফেসবুক সামনে নিয়ে বসি। হেবি ফুর্তি আমাদের মনে। প্লাতেরো নুনের বস্তা গলিয়ে ফেলেছে আর আমি রাস্তার ব্ল্যাকবোর্ডে জেব্রা ক্রসিং-এর সাদা ওয়ানগুলোর পাশে ওই সাইজের অতগুলোই লাল জিরো লিখে এসেছি। প্লাতেরোর ভার লাঘব, আমার হাফ পার্সেন্ট সুদ খায় কে! তখন প্লাতেরো যদি সৌমিত্র হয় আমি উত্তমকুমার। আমি যদি সুপ্রিয়া হই প্লাতেরো সুচিত্রা। প্লাতেরো কারাত হলে আমি ইয়েচুরি। আমি মমতা হলে প্লাতেরো কেষ্ট। প্লাতেরো আশাপূর্ণা হলে আমি শরদিন্দু। আমি আমলকীর রাজা হলে প্লাতেরো গুপি। প্লাতেরো ‘তোমাকে চাই’ হলে আমি ‘কাঙালপনা’। প্লাতেরো ‘টু’ হলে আমি ‘পিকুর ডায়রি’। আমি মোদী তো প্লাতেরো নীতিশ। আমি ‘মগনলাল মেঘরাজ’ হলে প্লাতেরো ‘লালমোহনবাবু’। আমরা শুধু খেলে যাই। আমাদের শতরঞ্জ-এর বোর্ড জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে। আমাদের পাশ দিয়ে সেনাবাহিনি চলে যায়। পাশের জেলায় ইন্টারনেট বন্ধ থাকে পনেরো দিন ধরে আর দূরের জেলায় মাসাধিককাল। আমরা শুধু পাশ ফিরে বসি। আলো জ্বলে, আলো নেভে। আমি রাম, তুমি বলরাম। আমি অশোক তুমি চন্দ্রগুপ্ত। আমি এক তুমি শূন্য। আমি শূন্য তুমি এক। আমাদের কোনও দিন কোনও স্বর্গ ছিল না, স্যারিডনও লাগে না। আমাদের মাথা নেই তাই মাথাব্যথাও নেই। আমাদের অতীত কেবল কাটা কাটা গলা-মেটে-স্টমাকে দলা হয়ে প্লাস্টিকে ওজন হয়। ছেঁড়াখোঁড়া অতীতের নাড়িভুঁড়ির সঙ্গে দুএকটা রক্তমাখা পায়ের হাড়, নখ আর পালকের বর্তমান পাইল হয়ে আসে। এবার তুমি কী হবে প্লাতেরো? বলো, বলো …। ক্যাসিনোর চাকা ঘুরছে প্লাতেরো, কৃষ্ণগহ্বরের মতো টানছে আমাদের। কী হবে এবার? এই শেষ ঘূর্ণি। স্মৃতিফলকে এপিটাফ লিখবে না, প্লাতেরো?