Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উন্নয়নের বিভ্রম এবং গণপ্রতিরোধ

তুষার চক্রবর্তী

 

অধ্যাপক অভী দত্ত মজুমদার স্মারক বক্তৃতা চতুর্থ বর্ষ অতিক্রম করল। এই বছর স্মারক বক্তৃতা দিলেন প্রখ্যাত সমাজকর্মী এবং রাজস্থানের মজদুর কিষান শক্তি সংগঠনের নেত্রী অরুণা রায় এবং মানবাধিকার কর্মী ও ছত্তিশগড়ের বনবাসী চেতনা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা হিমাংশু কুমার। এবারের বক্তৃতার শিরোনাম ছিল উন্নয়নের বিভ্রম এবং প্রতিরোধের গণভাষ্য, দু’জনের শাণিত ভাষণে যার স্বরূপ নানাদিক থেকে উন্মোচিত হল।

অরুনা রায় দেখালেন এখন দেশজুড়ে উন্নয়নের বিভ্রম কিভাবে তৈরি করা হচ্ছে। এর একদিকে আছে রোজকার জি ডি পি ও স্টক মার্কেট। সরকার ও কর্পোরেট দু’তরফের কাছে সেটাই যেন উন্নয়নের ম্যাজিক। বহুজাতিক সংস্থাদের লগ্নি যে ভাবেই হোক যেন ধরে রাখতে হবে! নয়া উদারবাদ দেশের অর্থনীতি তাই এক ছাঁচে বদলে নিতে চায়। আবার অন্যদিকে, অতীত ইতিহাসটাও বেমালুম বদলে ফেলা হচ্ছে। সত্যমিথ্যা গুলিয়ে দিয়ে একটাই ভাষ্য উঠে আসছে! যেমন ধরুন হলদিঘাটের যুদ্ধের ফলাফল। রানা প্রতাপ নাকি সেই যুদ্ধে হারেননি, বরং জিতেছিলেন! সুতরাং, দেশের যে বহুত্ববাদ ছিল তা লোপাট করে দেয়া হচ্ছে! এখন এক দেশ, এক স্বপ্ন! সেই বিভ্রমে উজ্জীবিত হবার দিন! কিন্তু, সরকার যেখানে ফ্যাসিবাদী, সেখানে প্রতিরোধ সবচাইতে জরুরি। যা এখন ঘটছে। আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও বোধহয় প্রমাণিত হয়ে চলেছে যে আমরা আসলে স্বাধীন নই! স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় ভাষণের শেষে এসে এই প্রশ্নও তাই তুলে ধরলেন যে, আজাদ হু তো ফরিয়াদি কিঁউ? স্বাধীন হলে দেশপ্রেমীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে কেন? মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে কেন? সবার বিরুদ্ধে এত মামলা মোকদ্দমা কেন? মোদী হোক বা মমতা, নির্বাচনের পথ দিয়ে কেন উঠে আসছে স্বৈরাচার? কেন? তার উত্তর মনে হয় একটাই। লাগামহীন পুঁজিবাদ হল পচা গোবর। যাকে প্রশ্ন করতেই হবে। জনঅধিকার আদায় করতে হবে। বলতে হবে প্রজাতন্ত্র আমার, এ কারও বাপের সম্পত্তি নয়! বললেন, আন্দোলনকারীরাই ভরসা, দেশকে তারাই বাঁচিয়ে রাখছেন। রাখবেন।

হিমাংশু কুমার জানালেন বিজ্ঞানী অভী দত্ত মজুমদারের সঙ্গে আন্দোলনের মঞ্চে পরিচয়ের স্মৃতি। তারপর মেলে ধরলেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। মুজফফরনগর থেকে ছত্তিশগড়ে এসে তার বনবাসী চেতনা আশ্রম কি ভাবে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল আর কেনই বা তাকে রাতারাতি গুড়িয়ে দেয়া হল তার মর্মান্তিক বিবরণী। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি যদিও ছিল গ্রামের উন্নতিসাধন, এখন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। না, এসব কোনও একটা আধটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বা ভুলচুক নয়। তার মতে, সুপরিকল্পিতভাবে এই পথেই চলা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের যে উন্নয়নের মডেলকে গান্ধী বলতেন শয়তানের পথ, সেই পথেই দেশকে চালিত করা হচ্ছে। ইংরেজের রাজত্বে সূর্য ডোবে না এই কথাটা যেমন চালু ছিল, তেমনি এটাও বলা যেত যে ইংরেজের রাজত্বে রক্ত কখনও শুকোয় না। তা প্রতিষ্ঠিত ছিল অন্তহীন যুদ্ধের ওপর। আর আজকের এই দেশব্যাপী সর্বভুক উন্নয়নের মডেলে, সরকারকে দেশের লোকের সঙ্গেই এখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। যা ভারতের এক গোপন যুদ্ধ।

সবশেষে, তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে যুক্ত মাটির মানুষ প্রবীণ যুবক বলরাজজি ধুলোপায়ে মঞ্চে উঠে এসে জানালেন কিভাবে সর্দার সরোবর প্রকল্পের জন্যে নর্মদা পারের গ্রামকে গ্রাম জলে ডুবিয়ে উচ্ছেদ চালাবার প্রতিবাদে জীবনপণ অনশন করছেন মেধা পাটকরসহ নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের কর্মী গ্রামবাসীরা, যাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার নামিয়েছে সরকার। স্বৈরাচারের উত্থান ও প্রতিরোধের গণভাষ্য তখন জীবন্ত হয়ে আছড়ে পড়ল পূর্ণ পেক্ষাগৃহে।

এক কথায় বললে, একচেটিয়া পুঁজির রাজনীতি কিভাবে এখন দেশজুড়ে উন্মোচিত হচ্ছে নতুন এক ফ্যাসিবাদী পর্বে, তার একটা সামগ্রিক রূপ তুলে ধরল এই অনুষ্ঠান।