Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘রক্ত দেখে কি ভয় পেয়েছিলে তুমি?’— সের্হিও রামিরেসের কথাসাহিত্য

‘রক্ত দেখে কি ভয় পেয়েছিলে তুমি?’— সের্হিও রামিরেসের কথাসাহিত্য -- মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

এমন বলা হয়ে থাকে যে ডাবলিন শহরটি যদি কোনওদিন ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে জেমস জয়েস-এর 'ডাবলিনার্স' উপন্যাসটি থেকে আবার তা গড়ে নেওয়া যাবে। ঠিক একই কথা একটু অন্যভাবে প্রযোজ্য হতে পারে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৮-২০২০)-এর ক্ষেত্রেও। শুধুমাত্র তাঁর অনূদিত গল্প-উপন্যাস-কবিতার মাধ্যমে বাংলাভাষার পাঠকের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছে লাতিন আমেরিকার ভূ-প্রকৃতি, মানুষজন, সেখানকার রাজনীতি। লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশের আত্মাকে বাঙালির সঙ্গে এমনভাবে পরিচিত করেছেন মানবেন্দ্র, যেন লাতিন আমেরিকা আমাদের দ্বিতীয় স্বদেশ। শুধু লাতিন আমেরিকা কেন, আফ্রিকা ও আরবি সাহিত্য থেকেও বিস্তর অনুবাদ করেছেন তিনি৷ বাদ যায়নি আমাদের দেশজ ভাষাও। বস্তুত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার পেয়েছেন মালয়ালম লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশীরের ছোটগল্প অনুবাদের জন্যেই৷ এমন একজন আন্তর্জাতিক মানের অনুবাদক যেকোনও জাতি ও ভাষার অন্যতম সম্পদ। অনুবাদক পরিচিতির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তাঁর মৌলিক কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও কবিতার বিপুল সম্ভার যা নিজগুণে উত্তীর্ণ। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ-ক্ষণে আমরা তাঁর লেখা উদ্ধৃত করেই স্মরণ করছি তাঁকে। এ মাসের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে রইল তাঁর 'বাস্তবের কুহক, কুহকের বাস্তব' প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে একটি লেখা, যেখানে নিকারাগুয়ার কথাসাহিত্যিক সের্হিও রামিরেজের জীবন ও কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি৷ 'বাস্তবের কুহক, কুহকের বাস্তব' বইটির প্রকাশক প্রতিভাস। প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৩, বইমেলা।

ভারি অদ্ভুত দেশ এই নিকারাগুয়া। মধ্য-আমেরিকার এই দেশের একটি অংশের নাম  ব্লুফিল্ডস- আর এই দুর্গম জায়গায় ইংরেজিও চলে, নামটা থেকে যা খানিকটা আন্দাজ করা যায়। সেখানে যেমন স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের অত্যাচার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া-ঔপনিবেশিকবাদের প্রতাপ ও দুর্বিপাকে সাধারণ মানুষের জীবন জর্জর, তেমনি কবিতায় গানে গল্পে উপন্যাসে অনেকদিন থেকেই এই দেশ– অথচ — সারা লাতিন আমেরিকায় তার অবিসংবাদিত প্রভাব ফেলে এসেছে। আর প্রভাব ফেলেছে তার সাধারণ মানুষের দুর্মর প্রাণশক্তি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সর্বাত্মক প্রয়াস। এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন রুবেন দারিও, যাঁকে বলা হয় লাতিন আমেরিকার আধুনিক কবিতার জনক। সিমোন বোলিভার যখন স্বপ্ন দেখেছিলেন খণ্ড-ছিন্ন-ক্ষত-বিক্ষত এস্পানিওল আমেরিকাকে একসূত্রে গেঁথে দিতে হবে তখন নিকারাগুয়া থেকেই নিখিল এস্পানিওল আমেরিকার স্বপ্ন অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানেই সান্দিনো লড়েছিলেন সোমোসা বংশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে– তাঁকে শহিদ হতে হয়েছিল, কিন্তু তাঁর মৃত্যু আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো উদ্বুদ্ধ করেছিল হাজার-হাজার মানুষকে। আর এই অনুপ্রেরিত শত-সহস্র মানুষ সান্দিনোর আদর্শেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বলেই তাদের নাম সান্দিনিস্তা।

লাতিন আমেরিকায় একশো বছর আগেও চার্চের ভূমিকা আদপেই ভালো ছিল না, অথচ এখানেই গড়ে উঠতে থাকে লিবারেশন থিওলজি, যার প্রবক্তাদের একজন হলেন এর্নেস্তো কার্দেনাল, কবি, পাদ্রি ও বিপ্লবী। তাঁর সোলেন্তিনামে চার্চ থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল মুক্তির বাণী, সোমোসাদের বিরুদ্ধে আমরণ লড়বার আহ্বান। পরে যখন সোমোসাকে সরিয়ে সান্দিনিস্তারা বামপন্থী সরকার গঠন করে তখন এর্নেস্তো কার্দেনাল তার সংস্কৃতি মন্ত্রী হয়েছিলেন। পৃথিবীব্যাপী তাঁর খ্যাতি বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি হিশেবে, যে-কবিতায় জিশুর বাণী, বিপ্লব ও ভালোবাসা একাকার হয়ে আছে।

আজকে, এখানে, এখন আমরা যাঁর গল্প নিয়ে বলবো, সেই ডক্টর সের্হিও রামিরেস এই সান্দিনিস্তা সরকারেরই উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। কলম ছেড়ে একসময় তাঁকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল, যেমনভাবে জপের মালা ছেড়ে এর্নেস্তো কার্দেনালও একদিন অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। কার্দেনালের জিশু সশস্ত্র বিপ্লবী, এবং সাধারণ মানুষেরই জন্যে তাঁর সমস্ত কান্না। সের্হিও রামিরেসের হাতে কলমই  হয়ে উঠেছিল বন্দুকের নল; যখন তিনি পাহাড়-জঙ্গলে দশ বছর গেরিলা সংগ্রামীদের সঙ্গে মিলে সোমোসাকে তাড়াবার জন্যে লড়ছেন, তখন দশ বছর তাঁর লেখনী স্তব্ধ ছিল বটে কিন্তু সেই সঙ্গে প্রস্তুতিও চলছিল বিপ্লবের পরে তিনি কী লিখবেন।

লাতিন আমেরিকার প্রায় সব বিখ্যাত লেখকদেরই প্রিয় প্রসঙ্গ কোনো ডিক্টেটরের উত্থান এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। পর-পর নাম মনে পড়ে যায় আমাদের: আলেহো কার্পেন্তিয়ের, মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস, আউগুস্তো রোয়া বাস্তোস, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস, হুয়ান রুলফো৷ এমনকী দক্ষিণপন্থী ঔপন্যাসিক মারিও ভার্গাস য়োসাকে পর্যন্ত দুটি উপন্যাসে একনায়কতন্ত্র এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রসাঙ্গকে টেনে আনতে হয়েছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গ নিয়ে, সোমোসা যুগকে নিয়ে, বিশাল প্যানোরামিক উপন্যাস লিখেছেন সের্হিও রামিরেস– একই সঙ্গে যে উপন্যাস পরিশীলিত, গীতিময় অথচ যাতে আছে এপিকের বিস্তার৷ যে উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছিল নিকারাগুয়ার একটি ঘুমপাড়ানি ছড়া থেকে:

তোমার মা কি খুন করেছেন শুওর?
রক্ত দেখে কি ভয় পেয়েছিলে তুমি?

‘তে দিও মিয়েদো লা সাংগ্রে’ অর্থাৎ রক্ত দেখে কি ভয় পেয়েছিলে তুমি? (নামটি কোনো অজ্ঞাত কারণে ইংরেজি তর্জমায় এই নামে প্রকাশিত হয়েছে ‘টু বেরি আওয়ার ফাদার্স’)। হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’র যেমন উপনাম ছিল: মেহিকোর একটি উপন্যাস, তেমনি এই উপন্যাসেরও উপনাম : ‘নিকারাগুয়ার একটি উপন্যাস’। এই বিশাল উপন্যাস পডতে-পড়তে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে সোমোসার আমল: একদিকে আছে ক্যাবারে গায়িকা, দেশ থেকে বিতাড়িত বা স্বেচ্ছানির্বাসিত মানুষ, ন্যাশনাল গার্ডসম্যান, গেরিলা বাহিনী– অস্ত্রের চাইতেও যাদের বেশি ভরসা, মরণপণ জেদের ওপর, আছে রাতারাতি বড়োলোক হবার স্বপ্ন-দেখা ব্যবসাদার যে ঠিক জানেই না তার জন্যে কোন দাম দিতে হবে, আছে নিকারাগুয়া স্ত্রী সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, আর্মি যার তদারক করে, আর বিউটি কুইনের খেতাব যদি প্রেসিডেন্টের মনোতোষিণী কারু ভাগ্যে জোটে তো অবাক হবার কেউ নেই, আর আছে গণিকারা ও হবু রাষ্ট্রপতিরা (এক নিঃশ্বাসেই তাদের উল্লেখ করা উচিত), আর আছে বিদ্রোহ আর নৃশঃস দমনপীড়ন। কিন্তু এত-সব সত্ত্বেও হয়তো উপন্যাসটি সম্বন্ধে কোনো ধারণা জন্মায় না– যদি-না আমরা উল্লেখ করি, ভাষা, পরিহাসবোধ ও শ্লেষ আর কাহিনীর সরল গতিকে ভেঙে যেভাবে টুকরো-টুকরো করে দেওয়া হয়েছে (অর্থাৎ ‘ইস্তোয়ার’ আর ‘রেসিতে’ মেতেছে এমন-এক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে যা এর আগে লাতিন আমেরিকার আর-কোনো লেখকের রচনাতেই আমরা দেখিনি। সের্হিও রামিরেসের রাজনীতি যেমন আস্থায় ভরপুর হয়েও জানে যে-কোনো মুহূর্তে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট কন্ট্রাদের হাতে মৃত্যু হতে পারে, তেমনভাবে তাঁর রচনাকৌশল বিস্তর ঝুঁকি নিয়ে এগোয়, নিজের কাছে সৎ থাকার দাবি করে পাঠকের সততা ও অভিনিবেশ, আর তৈরি করে দেয় একটা খুবই মজার কিন্তু অতীব মানবিক উপন্যাস, যে-কারণে সে পাঠকের কাছ থেকে এও দাবি করে ফিরে পড়ে ভেদ করে নিতে পারে শ্লেষের ব্যাসকূটের আড়ালে সত্যি-সত্যি সে-কোন বাণী স্পন্দিত হয়ে উঠেছে, কোন-সে ইতিহাস চায় উদঘাটন৷

সের্হিও রামিরেসের জন্ম ১৯৪২। উপন্যাসটি ১৯৭৭ সালে তাঁকে বার করতে হয়েছিল– না, নিজের দেশে তিনি সেন্সরশিপের দৌলতে তা করতে পারেননি তখন, বইটি বেরিয়েছিল ভেনেসুয়েলার কারাকাস থেকে। গেরিলা শিবিরে বসে একটু-একটু করে লেখা। সান্দিনিস্তারা ক্ষমতায় আসার পর আরো উপন্যাস লিখেছেন তিনি– আর সবসময়েই লিখে চলেছিলেন বোমাবর্ষণের ফাঁকে-ফাঁকে তাঁর আশ্চর্য ছোটোগল্পগুলো। তাঁর প্রথম গল্পের বই(যাতে ছিল মাত্র ছটি ছোটোগল্প) বেরোয় ১৯৭৬-এ, মেহিকোতে, নির্বাসনে। নিজের দেশের বহুরূপী বাস্তবতাকে তিনি ছুঁতে চাচ্ছেন, ভাষায় যাকে ধরতে চাচ্ছেন অবিকল, তাঁকে কিনা নিজেকে প্রথম প্রকাশ করতে হয় বিদেশে: পরে অবশ্য সান্দিনিস্তাদের আমলে তাঁর বই নিকারাগুয়ার মানাগুয়া থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। স্বাধীন নির্বাচন সম্পন্ন করে– গণতান্ত্রিকতার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে– সান্দিনিস্তারা এখন ক্ষমতাচ্যুত। ‘রক্ত দেখে কি ভয় পেয়েছিলে তুমি?’ উপন্যাসে নির্বাচনের বর্ণনা আছে, আছে হাতসাফাই, কারচুপি, রিগিং-এর দুর্দান্ত বিবরণ: সোমোসার আমলে মার্কিন সাহায্যের জন্য হাত পাততে গেলে মাঝে-মাঝে মার্কিন তদারকিতেই প্রতি নির্বাচনেই সোমোসা কী করে জিতে যেতো, তার চমকপ্রদ ও অট্টহাস্যমুখর বর্ণনা আছে এইখানে৷

সান্দিনিস্তাদের নির্বাচনে হারা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না, কেননা, দেশে প্রায় শতকরা আড়াই হাজার ছিল মুদ্রাস্ফীতির হার– সবই কন্ট্রা ও মার্কিন অবরোধের দৌলতে। কিন্তু গ্র‍্যাহাম গ্রীন তাঁর ‘গেটিং টু নো দ্য জেনারেল’ বইতে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে এক বছরের মধ্যেই নিকারাগুয়া দেশের বেশির ভাগ লোককেই শুধু সাক্ষর নয়, শিক্ষিত ও সৃজনশীল লেখক-লেখিকা করে তুলেছিল। আমি যদি দেশের লোকের জন্য লিখি, অথচ বেশির ভাগই থাকে নিরক্ষর ও অশিক্ষিত, তবে যত চমকপ্রদভাবে নতুন ধরনে পরিশীলিত উপন্যাস লিখি না কেন, তা থেকে যাবে উদ্দিষ্ট পাঠকদের অগম্য। তাই এইসব রচনার একটা উদ্দেশ্য ছিল এমনকী সদ্যসাক্ষরদেরও শিক্ষিত করে তোলা– তারা বুঝবে না, এই কথা ধরে নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়ে তাদের স্তরে নেমে এসে লেখা নয়, বরং তারা যে-লেখা বুদ্ধি ও আবেগ মিশিয়ে তারিয়ে তারিয়ে পড়ে নিজেদের আরো শিক্ষিত করে তুলবে, তাই লিখতে চেয়েছিলেন সের্হিও রামিরেস। আছে  জিগেস করেছিলেন: ‘রক্ত দেখে কি ভয় পেয়েছিলে তুমি?’


বানান অপরিবর্তিত