পবিত্র সরকার
পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ স্রষ্টার মৃত্যুর দিনে আমরা শুধু তাঁর জন্য শোক করার কথা যদি ভাবি, তবে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি তাঁর জীবন আর সৃষ্টিকে এক অভাবিত পূর্ণতায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন, সেই পূর্ণতাকে আমরা প্রণাম করি, সেই পূর্ণতা দিয়ে আমরা নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করার কথা ভাবি।
সমৃদ্ধ করার একটা উপায় হলো, জীবন, বিশেষত মৃত্যু নিয়ে তাঁর কথাগুলো যদি একবার ভাবি। তরুণ যারা, তাদের হয়তো এখনই ভাববার দরকার নেই, কিন্তু একটা সময় তো কাউকে না কাউকে ভাবতেই হবে! সারা পৃথিবীর মানুষ যখন ভাবে, দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা থেকেই ভাবে! একা রবীন্দ্রনাথই বলেন, বাঁচাকে সার্থক করো, মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতি আর বিশ্বজগতের সঙ্গে মিলে। একা বাঁচা কোনো বাঁচা নয়। একা মানুষ ভয়ংকর অর্থহীন, সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাঁচাই মানুষের বাঁচার একমাত্র পথ।
পূর্বজন্ম, পরজন্ম আছে কি না কেউ নিশ্চয় করে জানে না, আমরা দেখি যে আমাদের জীবন এই পৃথিবীর একটিমাত্র রেখা। তা সরলরেখা প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই নয়। কিন্তু তার আরম্ভসীমানার বিন্দুটি জন্মের, আর শেষ সীমানার বিন্দুটি মৃত্যুর। মাঝখানে একটা কম্পমান চেতনার পরিসর। এই চেতনার আঁকাবাঁকা রেখাটির শেষ ছেদই মৃত্যু।
রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে, মানুষের জীবন একটা প্রত্যাশিত আয়ু পায় বলে, নিজের অতিশয় ইতিবাচক জীবনদর্শন থেকে, ‘গীতাঞ্জলি’-তে লিখেছিলেন, ‘ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা– মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা!’ এক একবার মনে হয় সেটাই পৃথিবীর নিয়ম, প্রত্যেক মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে একটা পূর্ণ জীবন পায়। রবীন্দ্রনাথ যেন এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবেননি যে, পূর্ণতার অর্থ কী? তা কি নিছক বছরের হিসেবে, না কি তা অন্য কোনো অর্জন আর উপলব্ধির হিসেবে? রবীন্দ্রনাথের জীবন যে অর্থে পূর্ণতা পেয়েছিল, হরিপদ কেরানির জীবন কি সেই অর্থে পূর্ণ ছিল? কিন্তু এ সব প্রশ্নের মধ্যে না গিয়েও রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর একমাত্র অনিবার্য ঘটনা মৃত্যু সম্বন্ধে আমাদের বহু সান্ত্বনার কথা শুনিয়েছেন। মহাজীবন আর মহামরণ দুয়েরই শরণ নিয়েছেন তিনি, যেন এই অসীম বিশ্বজগতের বোধ, কিংবা তাঁর নিজস্ব ঈশ্বরের বোধ তাঁর মন থেকে মৃত্যুভয় মুছে দেয়। “মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ, তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই।” বলেছেন “নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ– সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।”
কিন্তু বাস্তব এই মানুষের পৃথিবীতে জীবনের সেই পূর্ণতা কোথায়? কেউ মাতৃগর্ভ থেকে আলোর মুখ দেখে না, কেউ কৈশোরে শেষ হয়ে যায়– যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব– মানুষের মৃত্যুর বহু অনির্দিষ্ট অবস্থান আছে। পূর্ণতা জীবনে কতটা, কোথায়? “যে ফুল না ফুটিতে লুটাল ধরণীতে”– তার জন্য রবীন্দ্রনাথ কোন সান্ত্বনা রাখলেন?
এখানে আমরা দুই রবীন্দ্রনাথকে দেখি। অপূর্ণতার যে শোক তাঁর কাছে ব্যক্তিগত, তাঁর নিজের শোক, তাকে তিনি প্রায় নিঃশব্দে বহন করেন, তার মধ্যে যেন নিখিল বিশ্বের এক অনিবার্যতা লক্ষ করেন তিনি। তেরো বছরের কিশোরপুত্র শমীন্দ্রনাথ যখন মারা যান, তাকে দাহ করে ফিরে আসার কথা লেখেন রবীন্দ্রনাথ, বহু পরে তাঁর ছোটো মেয়ে মীরা দেবীকে, মীরা দেবীর একমাত্র পুত্র তরুণ নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে সান্ত্বনা দিয়ে– “শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে।” নির্মলকুমারী মহলানবিশকে তিনি বলছেন, “খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না যে মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মূল্যই থাকে না… তাই শোকটাকে অত বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়….”
কিন্তু যে মৃত্যু অনিবার্য নয়? যখন জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটে? যখন যুদ্ধে “নারীঘাতী শিশুঘাতী কুৎসিত বীভৎসা” জেগে ওঠে? যখন বিপ্লবীদের হত্যা করা হয়? সেই অমানবিক নিষ্ঠুর মৃত্যুর বিরুদ্ধে আর এক রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর তীব্রকঠোর ধিক্কার উচ্চারণ করে। সে মৃত্যুকে ক্ষমা করেন না রবীন্দ্রনাথ। তা আর শান্তি থাকে না, তা দুঃসহ শোক হয়ে ওঠে।
আর এই মহাস্রষ্টার লেখা যখন এন সি ই আর টির পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেবার কথা বলে কোনো এক অর্বাচীন দীননাথ বাত্রা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতা, তখন আমরা যদি কেবল স্তম্ভিত হয়ে আমাদের দায় শেষ হলো বলে মনে করি তবে সেটা রবীন্দ্রনাথকে অপমান করাই হবে। আমাদের ঘৃণার উচ্চারণ স্পষ্ট হোক, আমাদের ধিক্কার সর্বত্র ছড়িয়ে যাক। যে মূর্খতার দুঃসাহস এমন স্পর্ধা দেখাতে পারে তা অপমানিত এবং পরাভূত হোক।