মৈনাক পাল
(ঋণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদূষক গল্প)
১
গুজ্জুর রাজা ভারত জয় করতে গেলেন। তিনি হলেন জয়ী। চন্দনে, হাতির দাঁতে, আর সোনামানিকে হাতি বোঝাই হল।
দেশে ফেরবার পথে দাদরীশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে রাজা পুজো দিলেন।
পুজো দিয়ে চলে আসছেন— গায়ে রক্তবস্ত্র, গলায় দলিতের মুণ্ডমালা, কপালে আমেরিকান রক্তচন্দনের তিলক; সঙ্গে কেবল মিশ্র আর বিদূষক।
মুঘলসরাই নামে এক জায়গায় দেখলেন, পথের ধারে আমবাগানে ছেলেরা খেলা করছে।
রাজা তাঁর দুই সঙ্গীকে বললেন, ‘দেখে আসি, ওরা কী খেলছে।’
২
ছেলেরা দুই সারি পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার সঙ্গে কার যুদ্ধ?’
তারা বললে, ‘ভারতের সঙ্গে গুজ্জুর।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার জিত, কার হার?’
ছেলেরা বুক ফুলিয়ে বললে, ‘ভারতের জিত, গুজ্জুর হার।’
মিশ্রর মুখ গম্ভীর হল, রাজার চক্ষু রক্তবর্ণ, বিদূষক হা হা ক’রে হেসে উঠল।
৩
রাজা যখন তাঁর সৈন্য নিয়ে ফিরে এলেন, তখনও ছেলেরা খেলছে।
রাজা হুকুম করলেন, ‘এক-একটা ছেলেকে গাছের সঙ্গে বাঁধো, আর লাগাও সিডিশন।’
গ্রাম থেকে তাদের মা-বাপ ছুটে এল। বললে, ‘ওরা অবোধ, ওরা খেলা করছিল, ওদের মাপ করো।’
রাজা সেনাপতি আদিত্যকে ডেকে বললেন, ‘এই মুঘলসরাই গ্রামকে শিক্ষা দেবে, গুজ্জুর রাজাকে কোনওদিন যেন ভুলতে না পারে। আর গ্রামের নাম দেবে ওঁহিবানায়েঙ্গেপুর’।
এই বলে শিবিরে চলে গেলেন।
৪
সন্ধেবেলায় সেনাপতি আদিত্য রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। প্রণাম করে বললে, ‘মহারাজ, শৃগাল কুকুর ছাড়া ওঁহিবানায়েঙ্গেপুরে কারও মুখে শব্দ শুনতে পাবেন না।’
মিশ্র বললে, ‘মহারাজের মান রক্ষা হল।’
পুরোহিত সুব্রহ্মমনিয়ম বললে, ‘চতুর্বেদ মহারাজের সহায়।’
বিদূষক বললে, ‘মহারাজ, এবার আমাকে বিদায় দিন।’
রাজা বললেন, ‘কেন?’
বিদূষক বললে, ‘আমি মারতেও পারি নে, নাম বদলাতেও পারি নে, ইতিহাস বইয়ে শিফট+ডিলিট টিপতেও পারি নে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে ও খেতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি বিরিয়ানি খেতে ভুলে যাব।’