শৈলেন সরকার
লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
বছর দশেক আগে দিল্লি রাজেন্দ্রনগরে আমার এক শিল্পী বন্ধুর বাড়ি গিয়েছি। ভাড়া বাড়ি, তিনতলা। বন্ধুর ছেলে বলল, চল ছাদে যাই। দেখি দুটো বছর তেইশ-চব্বিশের ছেলে গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। বন্ধুর ছেলে বলল, ওরা আইএএস দেবে, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য এখানে থেকে পড়াশোনা করছে। গুজরাটি, বরোদার। বাঙালি শুনেই সেই নকশাল রাজনীতি, মার্কসবাদ। ছেলেদুটিই রীতিমতো পড়াশোনা করা। বাংলার সাহিত্য, সিনেমা। প্রসঙ্গক্রমে আসে ভারতের ইতিহাস আর সমাজ নিয়ে টুকরো আলোচনা। আসেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে, রামস্বামী পেরিয়ার। ছেলেদুটির একজন কলকাতায় কাটিয়েছে দিন পনেরো। আত্মীয় আছে ওখানে। বলল, বাংলার সৌভাগ্য সেখানে শুধু রামমোহন বিদ্যাসাগর নয়, পরপরই এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। বললাম, তাতে কী? এবার ওর কলকাতায় থাকার অভিজ্ঞতা বলল একটি। কলকাতা থাকাকালীন ও দুটো বাঙালি পরিবারের আতিথ্য নিয়েছিল, মেট্রোতে যাতায়াতে যেচে গল্প করেছে পাশের মানুষের সঙ্গে। ছেলেটি বলল, কোথাও কেউ আমার জাত বা ধর্ম নিয়ে জানতে চায়নি। বলল, ভারতের আর কোনও জায়গায় এমনটা দেখতে পাবেন না আপনি। বলল, বাংলা বাদে সর্বত্র পনেরো মিনিট অপরিচিত কারওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে আপনার জাত বা ধর্ম নিয়ে জানতে চাইবেই।
কিন্তু না, গুজরাটি সেই ছেলেটি কোনও কারণে এতদিন পর বাংলায় এসে দেখবে, বাংলা পালটে যাচ্ছে। তাকে এবার সত্যিই কেউ জাত-ধর্ম নিয়ে জিজ্ঞেস করবে। ছেলেটি দেখবে, এই বাংলা এখন আর আগেকার বাংলা নেই, বরং সে বাকি ভারতের মতো হয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা অ্যালেক্স ট্রবের মনে ২০১৯-এই পশ্চিম বাংলার সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল। তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘The Collapse of Secularism in West Bengal’।
টাইমস নাউ ডট কম-এর কলামিস্ট প্লাবন গুপ্তার মনেও ঠিক এই অবাক হওয়াটাই ফুটে বেরিয়েছে। ১২ অক্টোবর ২০২০-র তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল, ‘Durga Puja grants, stipends for Imams: How Bengal’s politics has changed’। হ্যাঁ বাংলার শুধু পলিটিক্স নয়, বাংলা পালটে যাচ্ছে। পালটে জাতপাত আর ধর্মীয় বিভাজনের উত্তর ভারতীয় সাংস্কৃতিক অভ্যাসের অনুগামী হচ্ছে।
কিছুদিন ধরেই বাঙালি উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্মণ তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রী রাজীব ব্যানার্জি পশ্চিমবাংলা চষে ফেলছেন। তিনি ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পরিসংখ্যান নেওয়া বা তাদের মন বোঝার চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যেই বীরভূমের খ্যাতনামা অনুব্রত মণ্ডল তাঁর জেলায় ব্রাহ্মণ সম্মেলন ডেকে ফেলেছেন। গোটা জেলার ব্রাহ্মণদের ডেকে তাঁদের হাতে একটি করে গীতা ধরিয়ে দিয়েছেন। জড়িয়ে দিয়েছেন ধর্মীয় উত্তরীয়। হাতে দিয়েছেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-মা সারদা ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং অনুব্রতবাবু জানিয়েছেন যা তিনি করছেন তা পার্টির অনুমতিক্রমেই। আর এই ভাতা ঘোষণার দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, (এই ঘোষণা নিয়ে) কেউ যেন অন্য কিছু না ভাবেন। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীও জানেন, এই ঘোষণায় অন্য কিছু ভাবার সম্ভাবনা আছে। পিছিয়ে ছিল না কংগ্রেসও। মিল্টন রশিদের নেতৃত্বে বীরভূম জেলার কংগ্রেস কর্মীরা মিছিল করেন। দাবী ছিল মুসলিম ইমাম বা মোয়াজ্জেনরা যদি ভাতা পেতে পারেন তবে হিন্দু ব্রাহ্মণরাই বা পাবেন না কেন?
এইসব ইমাম মোয়াজ্জেন বা বামুন পুরুতের ভাতা ভারতের অন্য জায়গাতেও ছিল বা আছে। মধ্য প্রদেশ, দিল্লি, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু। দক্ষিণের রাজ্যে আবার মন্দিরের পুরুতদের একেবারে সরকারি চাকরির সব সুযোগসুবিধাই দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় সরকারি কর্মীদের ষাটে অবসর থাকলেও পুরুতদের পঁয়ষট্টিতে। বিভিন্ন মন্দিরের স্টেটাস আলাদা। সেই অনুসারে ভাতাও আলাদা। চিন্তা করবেন না, বাংলা একবার তার জাত নষ্ট করেছে যখন, তখন দ্রুতই সে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু বাংলার জাত কি সত্যিই এতদিনে নষ্ট হল? না, ২০১৩তে মমতা ব্যানার্জি যখন মৌলবী মোয়াজ্জিনদের ভাতা ঘোষণা করলেন তখনই তো শুরু হয়ে গেছে। ঠিক, কোর্টের বাধায় সরকার এখন সরাসরি দিচ্ছে না, দিচ্ছে একটু ঘুরিয়ে, সরকার দিচ্ছে ওয়াকফ বোর্ডকে, এবার ওয়াকফ বোর্ড দিচ্ছে মৌলবী মোয়াজ্জিনদের। না, ঠিক ২০১৩কেও বলা যাচ্ছে না। ২০০৮-০৯এ একটু লজ্জা লজ্জা করে বামেরা মৌলবী-মোয়াজ্জিনদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দেওয়া শুরু করেছিল। ওই শুরুটা ২০১৩তে গিয়ে কোথায় দাঁড়াত তা আল্লা বা ব্রহ্মাই জানেন।
বাইরের মানুষেরা বাংলার এই পরিণতির জন্য অবাক হন অনেকেই। জানতে চান, চৌত্রিশ বছর যে রাজ্যে বামপন্থীরা ক্ষমতাসীন ছিল সেখানে— । না, বিজেপিকে কেউ দায়ী করছে না। বিজেপিকে কোনও অর্থেই বাংলার সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহনের দল বলে কেউ ভাবে না। কিন্তু বামেরা? এই চৌত্রিশ বছর ধরে কী করল, শুধুই ভোটে জেতা? নিজেদের সংস্কৃতির কোনও ছাপই রাখতে পারল না মানুষের মনে? ভোটে বিদায় আর হুড়মুড় করে আর কেউ নয়, জাতপাত আর ধর্মের জিগির তোলা দল বিজেপি? সত্যি কথা বলতে কি, তৃণমূল এই ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট প্রকৌশলের বিজেপি-র বিরুদ্ধে অন্তত তত্ত্বগতভাবে লড়াই করবে এই আশা কেউ করবে না, আর তাত্ত্বিক লড়াইয়ে জিততে না পারলে তৃণমূল হয়তো পরের ইলেকশানে আটকে দেবে বিজেপিকে, কিন্তু বাংলা তার যাবতীয় গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে নিজে গলায় কলসি না বাঁধলেও আত্মহত্যাই করবে। কোনও রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী সাময়িক যতই জনপ্রিয়তা অর্জন করুন, যিনি শুধুই তাঁর সময়ের কথা ভেবে রাজনীতি করেন, তিনি ওই শুধুমাত্র দলেরই নেতা। যিনি দেশ বা জাতির নায়ক হন তিনি অনেক দূর ভবিষ্যতের কথাই ভাবেন।
কিন্তু এই বিভাজনের রাজনীতির ভিত্তি কি শুধুই ২০২০ বা ২০১৩। হ্যাঁ, মুসলিম ইমাম বা মোয়াজ্জিনদের সরকারের আর্থিক সুবিধার জন্য আলাদা চোখে দেখা, বা দুর্গাপূজার জন্য পূজা কমিটিকে টাকা দেওয়া, বা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের জন্য আলাদা আর্থিক ভাতার ব্যবস্থা করা— এসব আসলে বিভাজনের রাজনীতিই। নিজেদের সাময়িক রাজনৈতিক সুবিধার স্বার্থে কি তৃণমূল কি সিপিএম কেউই ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি। সেই দূরদৃষ্টিই এদের ছিল না বা নেইও। নইলে তৃণমূল ভোটে জেতার জন্য বিজেপি-র হাত ধরত না। হ্যাঁ, সিপিএমের সেই ভালো কংগ্রেসি আর খারাপ কংগ্রেসির মতো তৃণমূলের ভালো বিজেপি (অটলবিহারী) আর খারাপ বিজেপির ফারাক ছিল একেবারেই অযৌক্তিক আর চরম সুবিধাবাদ। সিপিএম আবার চতুর যুক্তিজালে কংগ্রেসকে হারাতে ১৯৮৯ সালে অটলবিহারীর হাত ধরল আর হিসাবে এক অতি দুর্বল রাজনৈতিক দলকে অমিত শক্তিধর করে তুলল। হ্যাঁ, বলা যায় বিজেপিকে অখুশি না-করার জন্যই বা হিন্দু ভোট হারানোর ভয়— যে কারণেই হোক ১৯৯০ সালে জ্যোতিবাবু আদবানির রামরথকে পশ্চিম বাংলার মধ্য দিয়ে যেতে কোনও বাধাও দিলেন না।
তাহলে বলা যায়, এই হিন্দুত্ব এই জাতপাত বা ধর্মীয় বিভেদের একটা উৎস বাংলায় আগে থেকেই ছিল। হ্যাঁ, ভালোভাবেই ছিল। শুধু রামমোহন বা বিদ্যাসাগর বা অক্ষয় কুমার দত্তের হাত ধরে যে আধুনিকতার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম তা একটা প্রলেপ হয়ে কিছুদিন আমাদের মুখমণ্ডলে বিরাজ করছিল মাত্র। কিন্তু পরিবর্তনটাকে আমরা আমাদের হৃদয়ে জায়গা দিতে পারিনি। হৃদয়ে জায়গা দিয়েছিলাম—
এ দেশে বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন এ দেশে চিরকাল। যদি পছন্দ না হয়, সরে পড় না কেন।[1]
কথাটা কার বলুন তো? কী মনে হচ্ছে দিল্লির কপিল মিশ্র বা অনুরাগ ঠাকুর? না না।
আবার,
এইটি বিশেষ ভাবে লক্ষ করিও যে, মুসলমানগণ যখন ভারতে প্রথম আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল, আজ তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে।[2]
না, এটিও কোনও প্রজ্ঞা ঠাকুরের কথা নয়।
আচ্ছা,
ব্রাহ্মণের জন্ম দেবার্চনার জন্য। জাতি যত উচ্চ সামাজিক বিধিনিষেধ তত বেশি। জাতিপ্রথা আমাদিগকে হিন্দু জাতিরূপে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। এই প্রথার অনেক ত্রুটি থাকিলেও বহু সুবিধা আছে।…… এই ব্যবস্থায় সবাই নিজ জাতের রীতিনীতি মানিতে বাধ্য।[3]
বা জনৈক ব্রাহ্মণ সন্তানের প্রতি তাঁর উপদেশ,
তুই বামুন অপর জাতের অন্ন নাই খেলি।[4]
এটি? না, এটিও গুজরাট বা রাজস্থান বা উত্তরপ্রদেশের কোনও দলিত পেটানো বিজেপি নেতার কথা নয়।
আচ্ছা,
বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না।[5]
এটি? বা,
ধার্মিক হইতে গেলে আমাদের প্রথমেই গ্রন্থাদি ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন ততই ভাল।[6]
বা,
গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকারক মতবাদ দেখা যায়, সেগুলোর জন্য এই সকল গ্রন্থই দায়ী।[7]
না এগুলি দেশপ্রাণ মোদির শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মার্কশিট প্রথা তুলে দেওয়ার কাছাকাছি হলেও, এই কথাগুলির একটাও মোদি বা তার কোনও দাসানুদাস দিলীপ ঘোষেরও নয়।
আচ্ছা আর একট কথা দেখা যাক,
সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে— ইংরেজ আমাদের দাও। বাপু কত আর দেবে, রেল দিয়াছে, তারের খবর দিয়াছে, ডাকাতদের তাড়াইয়াছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়াছে। আবার কী দেবে? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি তোরা কী দিয়েছিস?[8]
না, এটিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই না করা কোনও আরএসএস বা বিজেপি-র পূর্বসূরি কোনও জনসঙ্ঘ নেতা বা আরও বিশেষ করে বললে, আন্দামান দ্বীপান্তরের হাত থেকে ছাড়া পেতে চেয়ে ব্রিটিশদের কাছে বারবার ক্ষমাভিক্ষা করে নাকে খত দেওয়া ‘বিপ্লবী’ বীর সাভাররেরও নয়।
সর্বোপরি,
বেদান্ত, কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোনও ধর্মই নয়।[9]
বা,
আমরা যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করিবার কথা বলিতেছি উহা অসাম্প্রদায়িক হইবে। উহাতে সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ উপাস্য ওঙ্কারেরই কেবল উপাসনা হইবে। যদি কোনও সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপসনায় আপত্তি থাকে, তবে তাহার নিজেকে হিন্দু বলিবার অধিকার নাই।[10]
এবার নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, উপরের সব কটি কথাই আমাদের বাংলার বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের। সত্যি কথা বলতে কি, এই প্রায় সব কটি কথার একেবারে উলটো কথাও কিন্তু তিনি বলেছেন কোথাও না কোথাও। সেই বিচারে তিনি একেবারে ‘যখন যেমন, তখন তেমন’— একালের রাজনীতির নেতা-নেত্রীদের মতোই। তাঁর এই অসাধারণ গুণের কথা উল্লেখ করে তাঁরই জীবনীকার ক্রিস্টোফার ইশারউড লিখেছেন, ‘স্বামীজি আজ যা বলতেন, পরদিন তার কথার সাথে কোনও মিল থাকত না।’[11] ক্রিস্টোফার ইশারউডের এই কথার একেবারে জ্বলজ্বলে উদাহরণ তাঁর সেই ডোম, মুচি, মেথরদের বা শূদ্রদের নিয়ে বিখ্যাত ভাষণ। অথচ সেই তিনিই বলছেন, ‘ব্রাহ্মণদের মধ্যেই অধিকতর মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন মানুষের জন্ম হয়।’[12] তাঁর ভাবনায় জাতপাত দূরীকরণের উপায় ‘উচ্চবর্ণকে নিম্ন করিয়া, আহারে বিহারে যথেচ্ছচার অবলম্বন করিয়া, কিঞ্চিত ভোগসুখের জন্য স্ব স্ব বর্ণাশ্রমের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া জাতিভেদ সমস্যার মীমাংসা হইবে না, পরন্তু আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই যদি বৈদান্তিক ধর্মের নির্দেশ পালন করে, প্রত্যেকেই যদি ধার্মিক হইবার চেষ্টা করে, প্রত্যেকেই যদি ব্রাহ্মণ হয়, তবেই এই জাতিসমস্যার সমাধান হইবে।’[13]
এই বৈদান্তিক স্বামীর বিপরীতে বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালে দেখব, উনি তখন বলছেন, ‘…কতগুলো কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়— কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত সে সম্পর্কে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই।’ সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হয়ে তিনি কিন্তু শিক্ষার অধিকারকে উচ্চবর্ণ হিন্দু বা ব্রাহ্মণদের কুক্ষিগত করে রাখতে চাননি। ১৮৫১ সালের ২৮শে মার্চ ভারত সরকারের শিক্ষাসচিবকে লেখা এক চিঠিতে তিনি হিন্দু কলেজে অব্রাহ্মণ হিন্দুদের পাঠাধিকার দানের সুপারিশ করেন। কবে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে শূদ্ররা ব্রাহ্মণত্বে উপনীত হবে তাঁর ভরসায় থাকার লোক বিদ্যাসাগর ছিলেন না। শিক্ষার প্রসারে তাঁর নারী-পুরুষ বা ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদ ছিল না। বেদান্তবাদীদের মতো তাঁর কাছে নারীর আদর্শ ‘পতিব্রতা, লাজুক ও বিনয়ী সীতা, সাবিত্রী বা দময়ন্তী ছিল না।’ সেই যুগে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে প্রথম ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের জীবনী প্রচার করেছিলেন যিনি, ইতিহাস ও দর্শনভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে যিনি গণিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার কথা বলছেন, তিনি নিশ্চয় নারী আদর্শ হিসেবে মাদাম ক্যুরির কথাই বলতেন। তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের ধর্মের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনও অনধিকার চর্চা করা শিক্ষকদের পক্ষে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ।’ (বেথুন স্কুলের সম্পাদক থাকাকালীন সরকারের কাছে সচিব এ ইন্ডেনের কাছে দেওয়া বাইশ দফা প্রস্তাবের ১৬ নম্বর প্রস্তাব, ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৬২)। আর এই বিষয়ে তিনি যথেষ্টই কঠোর ছিলেন। ক্লাসে এসে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা গল্প করেন এই অভিযোগে ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’র শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে তিনি বহিষ্কার করেন। ছাড়েননি পরবর্তিতে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ হওয়া নরেন দত্তকেও। ক্লাসে পড়াতে পারেন না, ছাত্রদের এই অভিযোগ শুনে তাঁকেও বরখাস্ত করেন।
হ্যাঁ, সেই বিবেকানন্দের জয়ধ্বজা ওড়ানো বিজেপিওয়ালারাও বিদ্যাসাগরকে ছাড়বে কেন, একেবারে প্রথম সুযোগেই দল বেঁধে হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ধ্বংস করেছে।
আজকের বাংলার এইসব মৌলবী মোয়াজ্জিন বা বামুন পুরুতদের আলাদা তোয়াজ করে রাজনীতি করার সংস্কৃতি বা দুর্গাপুজোয় উদ্যোক্তাদের নামে হাজার হাজার টাকার খয়রাতির উৎস বাংলায় আগে থেকেই উপস্থিত। সেই বীর সন্ন্যাসীকে আমরা শুধু হৃদয়ে জায়গা দিইনি, দিয়েছি স্টেডিয়ামে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারে, বড় বড় সড়কে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে, তাঁকে মোড়ে মোড়ে হিন্দু ধর্ম আর ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য বর্ণনার জন্য দাঁড় করিয়ে, তাঁর নামে যুবকদের মধ্যে উদ্দীপনা জাগানোর জন্য ‘দিবস’ ঘোষণা করেছি। আর তাঁর ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন’ নীতির চমৎকার প্রয়োগে, তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেই যেমন খুশি রাজনীতির ভাষণ মারছি।
সব শেষে শুরুর সেই গুজরাটি ছেলের কথা। বললাম, বিবেকানন্দের কথা বললে না কেন? বলল, আমাদেরও তো মোহনদাস গান্ধি আছে, তাতে কী হয়েছে গুজরাটের? জাতপাত আর ধর্মীয় বিদ্বেষ কমেছে? অনার কিলিং? কন্যাভ্রূণ হত্যা? রামমোহন বিদ্যাসাগর না এসে যদি বিবেকানন্দ আসতেন, আপনাদের বাংলা গুজরাটেরই একটি কপি হয়ে উঠত।
সংস্কৃতির সঙ্গে পালটায় ভাষাও। বিজেপির আগ্রাসনে এবং তাদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার নামে চরিত্র পাল্টাবে বাংলার রাজনৈতিক দলগুলিও, আর এদের আনুকূল্যে পাল্টাতে থাকবে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একই সঙ্গে ভাষাও। আর গুজরাটের সেই ছেলেটি কোনও কারণে বাংলায় এসে পনেরো মিনিট কাটাতে হবে না, আলাপচারিতার শুরুতেই কোনও বাঙালির মুখ থেকে তাকে শুনতে হবে, ‘আপোনি কি ব্রাম্মোন আছেন?’
[1] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৬, পৃ ১৮
[2] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৫, পৃ ২৬২
[3] স্বামীজির বাণী ও রচনা, পৃ ৫২-৫৩
[4] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৫, পৃ ৩৭
[5] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৪, পৃ ৮৫
[6] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৪, পৃ ৯৯
[7] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৪, পৃ ১০৯
[8] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৯, পৃ ২৫৩
[9] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৫, পৃ ৫৪
[10] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৫, পৃ ১৫৪
[11] ক্রিস্টোফার ইশারউড, রামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্যগণ, পৃ ২৭৮
[12] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৫, পৃ ১৪৬
[13] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড ৫, পৃ ৬৬-৬৭