Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: ফিরে দেখা

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি (সেস্টাস), কলকাতা-র সাধারণ সম্পাদক; মার্ক্সীয় পরিসরে বিজ্ঞানের দর্শন, সমাজতত্ত্ব বিষয়ক অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও লোকপ্রিয় প্রবন্ধ রচনায় নেশাগ্রস্ত

 

 

 

 

[১]

এই বছর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)-এর জন্মদ্বিশতবার্ষিকী। আমরা যারা বিভিন্ন কারণে এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করি এবং তাঁর জীবন ও চরিত্র থেকে কিছু শেখার কথা ভাবি বা বলি, তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কেন এই শ্রদ্ধা এবং শেখার ইচ্ছা, তার সপক্ষে কিছু কথা বলা। তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী চরিত্র! সেকালের একজন অসাধারণ বিদ্বান ব্যক্তি হয়েও তিনি কথা এতই কম বলতেন এবং লিখতেন— জ্ঞানগর্ভ কথা তো প্রায় বলেনইনি কোথাও— যার ফলে আমাদের কোনও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লেখার সময় তার ভেতরে গুঁজে দেওয়ার জন্য উদ্ধৃতিযোগ্য বাক্য (যাকে বাংলায় বলে কোটেশন) পাওয়া খুব কঠিন। আর যা কিছু বলেছেন (বা লিখেছেন) তা একেবারে একশো শতাংশ সত্য ও তথ্যে ঠাসা। নিশ্চিত বিবৃতি। যে কোনও বই খুলে দেখুন। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, উপর থেকে নীচে— যেদিকে খুশি যান, দেখবেন, ‘তবে’, ‘যদিও’, ‘কিন্তু’, ‘তাই নাকি’, ‘মানে’, ‘দেখি’, ‘হয়ত’, ‘দেখা যাবে’, ‘চেষ্টা করব’, …, এরকম পলাতকি অব্যয় (অথবা দ্বিধাজনিত বা কুণ্ঠাজড়িত তোতলামি) ঢোকানোর জায়গা কোথাও রাখেননি। এরকম একজন মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে নিজেদের দিকে তাকিয়েই অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব আসতে শুরু করে। তবুও কাজটা আমাদের করতে হবে।

না হলে বিদ্যাসাগর চর্চাটা ধাক্কা খেতে থাকবে। কেন না, বিদ্যাসাগর-বিরোধী একাধিক মহল আছে, যারা উপযুক্ত সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠে নানা যুক্তিটুক্তি তুলে তাঁর সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনকে গুরুত্বহীন করে দেখাতে থাকেন। বর্তমান কালে প্রথম বিরোধী দল হল সঙ্ঘ পরিবারের শাখাপ্রশাখা। বিদ্যাসাগর ওদের কাছে ভারি সমস্যার। শুধু এই জন্য নয় যে তিনি হিন্দু বিধবাবিবাহের আইনি আয়োজন প্রস্তুত করেছিলেন। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সহবাস সম্মতি আইনকে শাস্ত্রের বাইরে শারীরবৃত্তীয় বিচারে টেনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। এগুলো তো আছেই। এর উপরে আছে তাঁর দুটো লিখিত উক্তি। যা তাঁর জীবনকাল শেষ হওয়ার অনেক পরে (১৯২৬ সাল নাগাদ) আবিষ্কৃত হয়েছে। উক্তি তো নয়, দুটো কাল-ব্রহ্মাস্ত্র— সাদা বাংলায় যাকে বলে টাইম বোমা! অতএব—

অতএব উক্তি দুটোকে স্মরণ করতেই হয়।

[১] That Sankhya and Vedanta (sic!) are false systems of philosophy is no more in dispute. যস্যার্থ: “সাংখ্য ও বেদান্ত (হায়!) যে ভ্রান্ত দর্শন তন্ত্র, সে কথা আর বলতে!”

[২] ইংরেজরা জানতে চেয়েছিল, ভারতীয় দর্শনের কিছু বই কি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো যায় না? তখনও মাক্সম্যুলার ও ওল্ডেনবার্গ যুগ্মসম্পাদক হিসাবে সেই প্রাচ্যের পবিত্র কেতাবের পঞ্চাশ খণ্ড অনুবাদ কর্মে হাত লাগাননি। বিদ্যাসাগরের সাফ সাফ উত্তর, আরে মশাই, ওগুলো শুধু দুর্বোধ্য মনে হয় বলে অনুবাদ করা যাবে না— এমন নয়। আসলে কী জানেন, “there is nothing substantial in them”! যস্যার্থ: “অনুবাদ করার জন্য কিছু মাল মশলা থাকার দরকার হয়। ওগুলোতে সেরকম কিছু নেই!”

এই সব কথা বলার জন্য দেশের পেছন-তাকানো বেদপন্থী সনাতনপন্থীরা বিদ্যাসাগরকে কোনও দিনই ক্ষমা করতে পারছে না। যে বে-দা-ন্ত নিয়ে বিবেকানন্দের অত উদাত্ত আহ্বান, যে সাংখ্য বেদান্তকে দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানের শিরোমণি বলে কত পণ্ডিতের কত আস্ফালন, অত বড় একজন সংস্কৃতবিদ এরকম বলেছেন জানার পর তার আর কোনও ইজ্জত থাকে? ভূগোলে থাকলে তাঁকে সেদিন পাকিস্তানেই পাঠিয়ে দিত ওরা!

মানতে হবে, বিদ্যাসাগর প্রায় কোনও আন্দোলনেই সফল হননি। বিধবাবিবাহ আইন হলেও বৃহত্তর হিন্দুসমাজ একে মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেনি। বিধবা মেয়েরা সাদা থান পরে ফৌজি (পুং) কেশবিন্যাসে নিরাভরণ সাজে না খেয়ে আধপেটা খেয়ে ব্রত উপবাসে জীবন কাটাতে থাকবে— এর মধ্যে বিবেকানন্দ যে অপরিসীম সৌন্দর্য ও মাধুর্য দেখেছিলেন (দেখার চোখও বটে!), সেই দৃশ্যই তাদের পৌরাণিক মানসে বেশি পছন্দ হয়েছে। এক্কেবারে মনের মতো ছবি। বাল্যবিবাহ বহুবিবাহ তিনি বন্ধ করার আইনও করাতে পারেননি। সংস্কার তো বহুত দূর কি বাত! ঐতিহ্যের আগ্নেয়শিলা একেবারে এককাট্টা হয়ে আটকে দিয়েছে। যে অন্তরঙ্গ বন্ধু বিধবাবিবাহে সর্বক্ষণ পাশে ছিলেন, তিনিই বহুবিবাহের প্রশ্নে পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

বাল্যবিবাহেরও কত সুখ্যাতি স্বামীজির বাজপায়ি কণ্ঠে শুনেছি। বিদ্যাসাগর চাইলেই হল? পুরুষমানুষ হয়ে এত সুখ কেউ ছাড়ে নাকি?

বিদ্যাসাগরের শিক্ষা প্রকল্পও পুরোপুরি সফল হয়নি। তিনি যা চেয়েছিলেন, সিলেবাসে ঢুকেছে। কিন্তু যারা পড়ায় শেখায় তাদের মগজে ঢোকেনি। ব্যাচ বাই ব্যাচ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। “বিজ্ঞান পড়ছ অঙ্ক শিখছ ভালো কথা। কিন্তু মনে রেখো, এই সবই বেদে ছিল।” “অ্যাঁ, কোথায় কী আছে জানতে চাও? ভারি পাকা ছোকড়া তো হে তুমি। বলি কটা শাস্ত্‌র পড়েছ? সাত হাজার নশো ঊনষাটখানা পুঁথি আছে জানো? বাপের এক জন্মে শেষ করতে পারবে না!”— সেই সব মগজের সংস্কার তিনি করে যেতে পারেননি। বলেছিলেন, “সাত পুরু মাটি তুলে নতুন করে চাষ করতে হবে।” মাটি কোপানো শুরু করলেও বেশি দূর কাটতে বা তুলে ফেলতে পারেননি। হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।

ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটনে নারকেল ভাঙায় গত বছর যাঁরা অবাক হয়েছিলেন, তাঁরা বুঝতেই পারেননি, আমাদের জ্ঞানী পণ্ডিতদের সংখ্যাগুরু অংশের গুরুমস্তিষ্ক আসলে তো নারকেলডাঙাই। খানিকটা ছিবড়ে, আর খানিকটা জল। ব্যস, পুরো জ্ঞান একেবারে জলভাত! এঁরা খুব ভালো গুরুভক্ত হন, প্রভুভক্তও হন। দেশের দুহাজার সাতশো বেয়াল্লিশটা কুসংস্কারের প্রতিটাই এরা বহন ও প্রচার করে থাকেন বিজ্ঞান ভবনে বসে সবচাইতে দামি স্মার্টফোন হাতে নিয়েই। একধরনের তেরছা হাসি সহ। একুশ শতকেও এদের মগজ অনায়াসে প্রাক্‌-তক্ষশীলা যুগের বাক্‌ডিম পাড়ে।

তবু, যাঁরা অবাক হয়েছেন, যাঁরা আপত্তি জানিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বিদ্যাসাগর ঢুকে বসে আছেন! অত বড় এক অচলায়তন— তার দরজা ভাঙতে না পারলেও দেওয়ালে কিছু ফুটো তিনি করে দিয়ে গেছেন। সেই ফুটোগুলো মেরামতির অযোগ্য। ফলে কিছুটা হলেও বুদ্ধির প্রগতির মৌসুমী বায়ু ঢুকে গেছে কিছু মানুষের অন্তরে। হাতে এসে গেছে বাংলা অক্ষর। ঋ লি ইত্যাদিদের দোতলা বাসগুলি বসিয়ে দিয়ে। সংস্কৃত দাপট মুক্ত বাংলা ব্যাকরণ হয়ে গেছে সহজ সরল। কেমন একটা বাংলা-বাংলা ভাব নিয়ে। জল পড়ে যে দুচারটে পাতা নড়েছিল, তা দেখে আরও কিছু পাতা নড়েছে। তারপর আরও অনেক কটা।

অসংখ্য কুযুক্তির রংমশালের মধ্যেও কিছু কিছু লোকের হাতে যুক্তিবাদের মোমবাতিগুলো জ্বলছে তো জ্বলছেই।

তাঁরাই জ্ঞানের বাতিটা জ্বালিয়ে রেখেছেন।

হ্যাঁ, ওঁদের কথাও বলতে হবে বৈকি! তাঁরা হলেন আর এক জবরদস্ত প্রতিপক্ষ। চরমপন্থী মার্ক্সবাদী। এক কালে সেই অতিবাম পক্ষ এসে প্রশ্ন তুলেছিলেন: বিদ্যাসাগর কেন কৃষিবিপ্লবের পক্ষে কথা বলেননি, কেন সংস্কৃত কলেজের দরজা জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য খুলে দিতে পারেননি, কেন তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের রণহুঙ্কার দেননি, তিনি সিপাহি বিদ্রোহের সময় সংস্কৃত কলেজে ভবন ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কেন, ইত্যাদি। এই সব প্রশ্ন তুলে তাঁরা রাজনীতির আসর গরম করে ফেলেছিলেন। তাঁরা অনেকেই ছিলেন বিরাট মাপের বুদ্ধিজীবী। কবি ও লেখক। সদর্থেই। তাঁরাই কেউ কেউ আমাদের শৈশবে বিদ্যাসাগর পাঠের গুরু ছিলেন— বিনয় ঘোষ, সরোজ দত্ত, প্রমুখ। বোঝা যায়, বিদ্যাসাগরের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। সেই আশা ভঙ্গ হওয়ায় নিরাকার ভাবমূর্তি ভাঙতে চেয়ে তাঁদের কিছু কর্মী এখানে ওখানে বিদ্যাসাগরের সাকার প্রস্তরমূর্তি ভেঙে ফেলেছিলেন। ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতায় আজ তাঁদের উত্তরসূরিদেরও প্রগতির পপিং ক্রিজে বিদ্যাসাগরের ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েই প্রতিক্রিয়ার শিবিরের ক্রমবর্ধমান দক্ষিণপন্থী আগ্রাসনকে, মৌলবাদের বাউন্সারগুলিকে, সমাসে বলতে গেলে উপরে বর্ণিত প্রথম পক্ষকে, ঠেকানোর কথা ভাবতে হচ্ছে।

এটুকুতে বিদ্যাসাগর নিঃসন্দেহে জয়ী হয়েছেন।

 

[২]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যে কোনও কথার মানে একেবারে সেই কথাই। অন্য কথা নয়। তিনি যখন বললেন, “আমি দেশাচারের দাস নই। যা কর্তব্য মনে করি তা পালন করার জন্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতেও পিছিয়ে যাব না”— তার মানে একেবারে এটাই। তাঁর পিতৃভক্তি মাতৃভক্তি নিয়ে বাজারে কত গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বর্ষাকাল— দামোদর— ভয়ঙ্কর পদ্মাস্টাইল স্রোত— সাঁতার, এমনি আরও কত কিছু! অথচ বিধবাবিবাহ আইন প্রচলন ও প্রয়োগ করতে গিয়ে বাবা-মা-স্ত্রী পরিবারের প্রায় সকলের সঙ্গেই বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ভাই শম্ভুচন্দ্র যখন চিঠিতে লিখলেন, “পিতামাতা অসন্তুষ্ট হইতেছেন”, ঈশ্বরচন্দ্র প্রত্যুত্তর দিলেন, “আমি জ্ঞানত তাঁহাদের সুখের কোনও ব্যাঘাত ঘটাই নাই, তাঁহারা কেন আমার সুখপ্রদায়ক কর্মের ব্যাঘাত হইবেন?” বিদ্যাসাগর অটল রইলেন।

এই জেদ বংশগত বা জিনগত নয়। এ কোনও রামজয় বা তর্কভূষণ থেকে আসেনি। রবীন্দ্রনাথ বললেও এইসব মামুলি কথায় বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, এ নিছক জেদ ছিল না, এ ছিল এক দৃঢ় সঙ্কল্প, অর্জিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির ফসল, বিশেষ কিছু আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতার লক্ষণ। সততা আদর্শনিষ্ঠা তিনি হয়ত পারিবারিক সূত্রেই কিছুটা পেয়েছিলেন। কিন্তু নবজাগরণের নব্য ঐহিক মানবতন্ত্রের প্রেরণা তাঁকে দিয়েছিল আধুনিক জ্ঞান ও প্রগতির বার্তা। যাঁরা এই গঙ্গাজলের সন্ধান ও স্পর্শ পাননি, ঘটিপুকুরের পানিকেই গঙ্গাজল ভেবে সন্তুষ্ট চিত্তে কিছু কিছু মানবসেবা করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা তাই একটু-আধটু প্রগতি করেই দেহে মনে ক্লান্ত হয়ে বিরতি খুঁজেছেন আর বিদ্যাসাগরের অস্থির অচঞ্চল কর্মস্পৃহাকে বাৎস্য জেদ বলে সরল বা তরল করে দিতে চেয়েছেন।

তাই দেখলাম, তিনি যখন স্থির করলেন, ছাত্রদের জন্য প্রাচীন টুলো শিক্ষা নয়, “কে কী শিখল, তাতে আমার কী আসে যায়?”-জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি নয়, আধুনিক বৈজ্ঞানিক মানবতান্ত্রিক শিক্ষা চালু করতে হবে, ভাষা সাহিত্য ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান অঙ্ক শেখাতে হবে, ধরাবাঁধা আনুষ্ঠানিক নিয়মানুগ পদ্ধতিতে শেখাতে হবে, ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়পক্ষকে ঘড়ি-ঘন্টা মেনে শিক্ষায়তনে এবং শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে হবে, পড়তে হবে এবং পড়াতে হবে, তিনি সংস্কৃত কলেজে এবং পরে মেট্রোপলিটান স্কুলে সেটা প্রয়োগ করে দেখালেন। যে সমস্ত শিক্ষকরা বয়সের দোহাই দিয়ে দেরি করে কলেজে ঢুকতেন, ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদেরও ফটকের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে লজ্জা দিয়েছেন। “এই এলেন বুঝি? আচ্ছা যান, ভেতরে।” সেটাই অনেক ঠেলাধাক্কা খেয়েও (কেন না, এই দেশের উত্তর-বিদ্যাসাগর বহু-প্রজন্ম এর মর্মার্থ সেদিন থেকে শুরু করে আজ অবধি বুঝতে পারেনি) শেষ পর্যন্ত টিকে রইল। এমনকি অনেকের ঘোরতর অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

যদিও আমাদের ৯১.২৭ শতাংশের এখনও হাতে ঘড়ি পরার এবং দেওয়ালে ঘড়ি টাঙানোর তাৎপর্য খুব একটা মালুম হয়নি। অনেকেই সেই কারণে নরেন দত্তকে মেট্রোপলিটান স্কুলের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ঘটনাটা ক্ষমা করে উঠতে পারেননি। অথচ, নরেন স্যার ক্লাসে নিয়মিত আসবেন না, এলেও ছাত্রদের কাছে দক্ষিণেশ্বরের কালীসাধকের গল্প বলে সময় খরচ করবেন— এটা তাঁর আক্ষরিক অর্থেই না-পসন্দ ছিল। আমরাও আমাদের কালে কোনও বিদ্যালয়ে এরকম শিক্ষকের দেখা পেলে অপছন্দই ব্যক্ত করি, শিক্ষকদের জাত তুলেও গাল পাড়ি, কিন্তু তাই বলে নরেন দত্তর বেলায় একই নিয়ম খাটানো যায় নাকি? “জানেন, তিনি শেষ পর্যন্ত কে হবেন? কী করবেন?” না, ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র দুই বছরের জন্য জেনে যেতে পারেননি। যেটুকু জেনেছিলেন, তাতেই অবশ্য তিনি কী চান বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ইস্কুল মানে যে ছাত্রদের পড়াশুনার ক্ষতি করে গল্প করার জায়গা নয়, তিনি সেদিন এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন!

যে “সুবিস্তৃত” দেশজ শিক্ষার বিকল্প হিসাবে বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষার সামান্য কিছু বৃক্ষরোপন করতে পেরেছিলেন মাত্র, অচিরেই তা ছাত্রসংখ্যায় এবং শিক্ষার গুণেমানে আপামর জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক জীবনযাপনের তুল্য বিদ্যা ও জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দিল। এর সুফল বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি। কাব্যে সাহিত্যে নাট্যমঞ্চে বিজ্ঞানে সাংবাদিকতায় গতানুগতিকের সীমানা পেরিয়ে একদল নতুন মানবসংস্কৃতি কর্মী এসে দেখা দিলেন দেশের বুকে। সেদিনও যার চণ্ডীপাঠ কিংবা ঝুড়ি বোনার বাইরে সরস্বতীর কাছে কিছু চাইবার বা পাওয়ার ছিল না, সুদূর পল্লীর তেমন বালকেরও শিক্ষক অধ্যাপক উকিল জজ বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন জাগ্রত হল। কেননা, তখন দিন বদলের দিন এসে গেছে।

আমার অবশ্য নরেন দত্ত প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ভিন্ন একটা কথা আছে।

বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকারীর দরকার ছিল। মশালটাকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য। নরেন দত্ত ছিলেন তার জন্য একজন অন্যতম ও অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উপযুক্ত চরিত্র। যিনি যেখানেই থাকবেন, নেতা হয়েই থাকবেন। সে গানের দল, ইস্কুল আর সন্ন্যাসীর আশ্রম— যেখানেই হোক। মেট্রোপলিটান যুগে তখনও তিনি পথ নির্বাচন চূড়ান্ত করে ফেলেননি। রামকৃষ্ণ তাঁকে টানলেও পুরোটা ধরে ফেলতে পারেননি। মন্দিরে বসে কালীপূজা আর ধ্যান করার পাত্র তিনি নন। অথচ, রামকৃষ্ণর কাছে আর বৃহত্তর কোনও অ্যাজেন্ডা নেই। ফলত, দ্বিধাদ্বন্দ্বের পালা চলছিল। সেই সময় যদি ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারতেন, একটু সময় দিয়ে তাঁকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন ও প্রদানের কাজটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারতেন— তাহলে এই দেশের ইতিহাস আজ আর একটু অন্যরকম হলেও হতে পারত। সেটা হল না। নরেন দত্ত চাকরি খুইয়ে তাঁর ক্যারিয়ার নির্মাণের জন্য বাধ্য হয়ে সেই দক্ষিণেশ্বরেই ঝাঁপ দিলেন!

যে পঞ্চান্ন বছর বয়সী শ্রদ্ধার পাত্র শিক্ষককে পনেরো বছরের বালিকাকে বিবাহ করতে দেখে বলেছিলেন, “এ জন্মে আর মুখও দেখব না আপনার”— সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। বাল্যবিবাহ তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন। বাল্যবিবাহের পরিণতিতে যে বালবিধবা জন্মায়, তার সর্বাত্মক দুঃখজনক পরিণতিতে তিনি হৃদয়ের অন্তঃস্থলে এক নিরুপায় অনুপশম্য ব্যথা অনুভব করতেন। ওর মধ্যে সৌন্দর্য মাধুর্য দেখতে পাওয়ার মতো নান্দনিক চোখ তাঁর ছিল না! তাই সেই সত্য পালন।

জীবনের কোনও এক সময় তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, শত নিন্দা শুনলেও কারও বিরুদ্ধে কোনও নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করবেন না, তাঁর জিহ্বা তাঁর কলম তা একশো শতাংশ রক্ষা করে গেছে। মতাদর্শগত বিতর্কে বিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক কড়া কথা উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারও বিরুদ্ধে নিন্দা করার নীচতা তাঁর ছিল না। তাঁর সমালোচক তাঁর নিন্দুক সেইকালে তো কম ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো উচ্চশিক্ষিত সাহিত্যিক মানুষও তাঁকে বিরোধিতা করে কলম ধরেছেন, উপন্যাসের এক চরিত্রের মুখ দিয়ে খুবই অশালীন মন্তব্য করিয়েছেন। বিদ্যাসাগর তাতে নিশ্চয়ই দুঃখ পেয়েছিলেন, কিন্তু পালটা একটাও কটু কথা তিনি বলেননি। বরং একবার যখন কোনও এক সভায় সুযোগ এল, তিনি বঙ্কিমকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে খানিক রসিকতাই করেছিলেন!

তাঁর রচিত “বর্ণপরিচয়” আজও আমাদের বর্ণ পরিচয়ের সিংহদরজা— দুদিক থেকেই: আমরা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হই এই বই হাতে নিয়ে। আর আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি নীতিবোধ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সেই দরজার মুখেই।

এই একটি মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর মতো কঠিন কাজ আর কিছু নেই!

সেই রাস্তা সেই জন্যই নানা ছলে অনেকে পরিহার করে থাকেন হয়ত!

 

[৩]

বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে বসে এক স্মরণসভায় ভাষণ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপার বিস্ময়ের সঙ্গে একটা খুব জরুরি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন: এই বাংলাদেশে তাঁর মতো চরিত্র কী করে কোত্থেকে জন্ম নিল? বিষয়টা উনিশ শতকের শেষ পাদে যেমন জটিল ছিল, আজ এই একুশ শতকের পথে চলার সময়ও একইরকম জটিল আছে। আমাদের চারপাশে যাদের আমরা প্রতিদিন দেখি— আমাকেও আপনি দেখেন, আপনাকেও আমি দেখি, এটা তার মধ্যে ধরা আছে কিন্তু— সেই আমরা প্রায় সজ্ঞানেই কিছু না কিছু অন্যায় করে ফেলি, কিছু না কিছু অন্যায়ের সমর্থনে বক্তৃতা দিই, নানা জায়গায় অন্যায় সুবিধা নেওয়ার বা পাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু অন্যকে সেই চেষ্টা করতে দেখলে নিন্দা করি, নিজের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করি না, কিন্তু অপরের একইরকম দায়িত্বহীনতা নিয়ে আমরা তুমুল সরব। এটা ভাবলে ভুল হবে যে এরকম স্বভাব শুধু একালেই আমাদের মধ্যে জন্মেছে, বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের আমলে এদেশের বেশিরভাগ লোক খুব ভালো ছিল। আমাদের লোকেরা মিথ্যা কথা বলতে, ছলচাতুরি করতে একদম জানত না; এই সবই ইউরোপীয় সাদা চামড়ার রেনেশাঁস-পুষ্ট ঔপনিবেশিক সাহেবদের দান। আমরা এখনকার লোকেরা সাদা সাহেবদের খুব গাঢ় শ্রদ্ধার চোখে দেখি বলে নিজেদের দেশের লোকেদের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনোভাব নিয়ে চলি। এটা ভাবতে পারলে দারুণ সুবিধা হয় ঠিকই। দোষটা পশ্চিমে হেলিয়ে দিতে পারলে তুলসীপাতা দিয়ে আর প্রতি দিন ধুতে হয় না নিজেদের। এরকম মানুষ যে তখনও অনেক ছিল, বস্তুত বেশিরভাগই ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ বা রামেন্দ্রসুন্দরের লেখা পাঠেই জানা যায়!

বাস্তব ঘটনা দেখেই বোঝা যাবে। বিদ্যাসাগরকে অনেকেই— তাঁদের মধ্যে ব্রাহ্ম এবং উচ্চশিক্ষিত হিন্দু, দুপক্ষেরই লোক ছিলেন— কথা দিয়েছিলেন, বিধবাবিবাহের আন্দোলনে এবং কিছু কিছু পরিচিত বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রচেষ্টায় টাকাপয়সা দিয়ে এবং অন্য নানাভাবে সাহায্য করবেন। কাজে নেমে ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন, তাদের আর টিকিটিও নজরে আসছে না। ব্যক্তিগত চিঠিতে দু একজনকে অনুযোগ করেছেন, তোমাদের কথায় ভরসা করে আমি এদিক ওদিক থেকে অনেক ধার বাকি করে ফেলেছি। আজ সেই সব ঋণ শোধ দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি, অথচ, তোমরা যে দেবে না, তাও জানালে না।

বেশ কয়েকজন (তৎকালীন) প্রগতিশীল বাতেলাবাজ লোক কোনও বিধবাকে বিয়ে করবে বলে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে হাত পেতে প্রচুর আর্থিক সাহায্য নিয়েছে, অন্যান্য সুযোগসুবিধা আদায় করেছে; কিন্তু তারপরও কেউ কেউ বিয়ের সময় ঘনিয়ে এলে বাবা মা আত্মীয়পরিজনের দোহাই দিয়ে— অর্থাৎ, সমাজের নাম করে— পিছিয়ে গেছে।

উঁহু, ঠিকই আন্দাজ করেছেন। তারা টাকাগুলো তাই বলে বিদ্যাসাগরকে ফেরত দেয়নি।

আজকাল অনেকে এই সব অপ-দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাঁর এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে বেঁটে করে দেখাতে চান। “উৎকোচের বিনিময়ে সমাজ সংস্কার” বলে উপহাস করতে চান। সে তাঁরা করতেই পারেন। কেন না, তাঁদের তো কোনও কিছুর বিনিময়েই সমাজে কোনও বৃহতের সাধনা করতে হচ্ছে না। যাঁরা কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের ছিদ্র অন্বেষণ করেই প্রায় দিন কাটাতে হয়। বা কাটালেও হয়।

এরকম আরও অনেক নীচতা ক্ষুদ্রতাকে প্রত্যক্ষ করেই তো রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বললেন যে ছোট জিনিসকে বড় দেখাবার যন্ত্র হিসাবে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিপরীতে আমরা যদি চারপাশের আপাত দৃষ্টিতে বড় জিনিসগুলিকে ছোট দেখাবার কোনও একটা যন্ত্রের কথা ভাবি এবং খুঁজি, আমাদের বেশি দূরে যেতে হবে না। বিদ্যাসাগরের কথা ভাবলেই হবে। বিদ্যাসাগরের জীবন এবং চরিত্রের পাশে দেশের আর পাঁচটা বিনা বাছাই লোককে দাঁড় করিয়ে দিলেই সেই ঈপ্সিত কাজটি হয়ে যাবে। এবং আবার সখেদে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই ছোট দেখানোর যন্ত্রটাকে “আর লাগবে না” বলার জায়গায় আজও আমরা পৌঁছতে পারিনি।

এটাও রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সঠিক কথা বলেছেন যে বিদ্যাসাগরের নামের আগে দেশবাসীর তরফে দানসাগর, দয়ার সাগর ইত্যাদি ভালো ভালো কিছু বিশেষণ বসিয়ে দিয়ে তাঁর ভেতরের আসল “মানুষ”-টাকে কার্যত অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যা বা দয়া নয়, তাঁর চরিত্রের আসল পরিচয় যে তাঁর “অক্ষয় মনুষ্যত্ব” এবং “অজেয় পৌরুষ”-এর মধ্যে পাওয়া যাবে, এই জিনিসটা তারা ধরতেই পারেনি। রাজা হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যানে দানধ্যানের অনেক কথা আছে। শোনা যায় রাজা হর্ষবর্ধনও নাকি প্রচুর দান করতেন। বাংলাদেশের অনেক জমিদারই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি বাড়ি টাকা পয়সা দান করেছেন। লক্ষ করলেই দেখবেন, সেই সব দানকীর্তি ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে লিখিত স্থায়ী দলিল বানিয়ে রাখা আছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের গায়ে সেই সব দাতাদের (বা তাদের পিতামাতার নাম) নাম অমুঞ্চ্য অক্ষরে লেখা আছে। মাঝে মাঝে সেখানে চুনকাম করে রংটং লাগিয়ে চকচকে করে তোলা হয়। সবাই যেন দেখতে পায়!

বিদ্যাসাগরের দানের একটা স্থায়ী লিখিত নথি বের করুন দেখি! সারা বাংলায় একটা প্রতিষ্ঠান, একটা ভবন, একটা বিভাগ খুঁজে বের করা যাক— যার দেওয়ালে বা কোথাও সিমেন্ট বা পাথরে খোদাই করে বা লিখে বিদ্যাসাগরের দানের কোনও স্বীকৃতি আছে! বিদ্যাসাগরের দানে, তাঁর সহায়তায় সেই কালে উপকৃত হননি, এমন মানুষ, এমন স্কুল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছাড়া আর কজনকে আমরা দেখি সেই কৃতজ্ঞতার সামান্যতম প্রকাশ ঘটাতে? এই রকম সাহায্য, যা যে দেয় আর যাকে দেয় সেই দুজনের বাইরে আর খবর হয় না, এটা করতে পারার জন্য বিরাট ক্ষমতা লাগে। মনের বিপুল উচ্চতায় পৌঁছতে হয়। নৈতিক মূল্যবোধের এক শক্তিশালী পরাকাষ্ঠা লাগে। একবার সেই চূড়ায় উঠলেই হয় না, সেখানে নিজেকে ধরে রাখতে হয় দৃঢ়ভাবে। অনেক দিন ধরে। চতুর্পার্শ্বের নীচতা ক্ষুদ্রতা সঙ্কীর্ণতা স্বার্থপরতা দুর্বলতা যাতে নাগাল না পায় তাদের আস্তাবলে টেনে নামানোর। মাও সে-তুং-এর কথা ধার করে বলা যায়: একটা দুটো ভালো কাজ করা তেমন কঠিন নয়, সারা জীবন ধরে ভালো কাজ করে যাওয়াটা যথার্থই দুরূহ! জানতে পারলে মাও হয়ত চিনের লোকদের বলতেন, ভারতের এই মানুষটাকে দেখে রাখো; তাহলে আমার কথাটা খানিক বুঝতে পারবে। ঘোষিত ও পোষিত আদর্শের সঙ্গে মানুষটা যেন একাত্ম হয়ে ছিলেন।

পৌরুষের কথাটাও এখানে সুপ্রাসঙ্গিক। লিঙ্গ-সুবেদী লোকজন হয়ত আজকের দিনে এই শব্দটায় আপত্তি জানাতে পারেন। তবে আমার মতে আক্ষরিক (রমণীয়তার বিপরীত) অর্থে না ধরে এর মধ্যে নিহিত ভাবার্থটিকে ধরতে হবে। ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র অর্থে। ব্যক্তি আমরা সকলেই— কি সেদিন কি আজ! কিন্তু ব্যক্তিত্ব সকলের থাকে না। ব্যক্তিত্ব এক রকমের সজীব স্বকীয় সক্রিয় স্বাতন্ত্র্য— নানা গুণের সমাহার হিসাবে যা একজনকে অন্যদের থেকে, গড়পড়তাদের থেকে, পৃথক সত্তা বলে চিনিয়ে দেয়! স্বার্থবোধ ও স্বার্থপূরণকে কেন্দ্র করে সমাজে সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তির যে নিরন্তর চলমান অনিরসনীয় দ্বন্দ্ব, সেখানে প্রতিটি সংঘর্ষই ঘর্ষণের মতো চলিষ্ণু মানুষের প্রগতির গতিকে থামিয়ে দিতে চায়। নানা রঙের পিছুটান! ফলে, ভেতর থেকে ক্রমাগত আত্মিক আদর্শগত বল প্রয়োগ করে সেই ঘর্ষণ অতিক্রম করার মতো শক্তি সঞ্চয় করে যেতে হয়। তবেই না থেমে ক্রমাগত পথ চলা যায়। আপন গন্তব্যের অভিমুখে।

বিদ্যাসাগর থামতে পারেননি। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও কিছু না কিছু কাজ করেছেন। কেন না, তাঁর এরকম এক জীবন্ত ব্যক্তিত্ব ছিল, অটল চরিত্র ছিল। যা কোনও চাপ, কোনও লোভ বা কোনও ভয়ের কাছে মাথা নোয়ায় না। মগজে স্যাপিয়েন্স হলেই সকলে মেরুদণ্ডে ইরেকটাস হয় না। অনেকেই একটু প্লাস্টিক ভাব নিয়ে চলে। যেখানে যেমন দরকার হয় এদিকে ওদিকে সামনে সম কোণ থেকে এঁকেবেঁকে চলে। বিদ্যাসাগরের এই নমনীয়তা ছিলই না। যা ঠিক বলে বুঝেছেন করে গেছেন। দায়িত্ব নিয়ে যা করার কথা, করতে না পারলে পদ ছেড়ে দিয়েছেন। পদ বাঁচিয়ে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার কায়দাকানুন তিনি কখনই আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। এও আর একটি সেই স্বভাবগুণ, যা আমরা বেশিরভাগই আজও অর্জন করিনি। নীতিহীন ক্ষমতাশালী এবং হতচরিত্র বিত্তবানের কাছে আপস আমাদের প্রায় স্বাভাবিক আচরণ হতে চলেছে। বিদ্যাসাগর তাঁর অটুট ঋজুত্ব নিয়ে আজও আমাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বেমানান!

তিনি যে কার সাহেবকে সচটি বদলা-অভ্যর্থনা জানাতে পেরেছিলেন, এটা খুব সহজ কাজ নয়। যাঁরা বিদ্যাসাগরের মধ্যে ইংরেজপ্রীতি সাহেবসান্নিধ্য রাজানুগ্রহ প্রাপ্তির ছাপ খুঁজে গবেষণা করে বেড়ান, তাঁদের কাছে এই একটি ঘটনাই চাইলে চক্ষুউন্মীলক হিসাবে কাজ করতে পারে। চটি পরে এশিয়াটিক সভাঘরে যাওয়া যাবে না বলায় তিনি যে সেখানে আর কোনও দিনই পা রাখেননি, এও এক নীরব প্রতিবাদ! স্যুটবুট না পরে লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যাবে না বলে তাঁকে একবার যখন দরজা থেকে প্রহরীরা ফিরিয়ে দিল, তিনি বাঙালি পোশাক পরেই আসতে পারেন বলে একাধিকবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও তিনি আর কোনও দিনই ওমুখো হলেন না! উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের আওতায় ফেলে এই সব ঘটনাকে বোঝা যাবে না। আমাদের কালেই বা কজন প্রতিবাদী এরকম সাহস দেখাতে পারেন?

বিদ্যাসাগরের নিন্দা করায়, ত্রুটি খোঁজায় খরচা নেই, বিপদও নেই! কিন্তু তাঁর চরিত্রের দু একটি গুণও আয়ত্ত করতে হলে খরচা আছে। ঝুঁকিও আছে। আমরা অনেকেই যে তাই নির্ঝঞ্ঝাট অপশন বেছে নিচ্ছি, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই!

 

[৪]

বিদ্যাসাগরের যে ব্যক্তিত্বের কথা আমি বলেছি, তা ছিল সময়ের ফসল, ইতিহাসের নির্মাণ! বাংলার সমাজ, বাংলার ইতিহাস তখন বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস পেরিয়ে লালনের কালে এসে উদার ধর্মসংস্কৃতির প্রচারের মধ্য দিয়ে যে দেশজ নবজাগৃতির দিকে এগোচ্ছিল (এই পর্যবেক্ষণের জন্য আমাদের সেস্টাসের বাংলা পত্রিকা প্রেক্ষার ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত আমার পুত্র শ্রীমান অনর্ঘর একটি প্রবন্ধের কাছে আমি ঋণগ্রস্ত), ডিরোজিও এবং রামমোহন এসে যার মধ্যে কিছুটা ইউরোপীয় আলো ফেলে দিলেন, আধুনিক শিক্ষা এবং যুক্তিতর্কের পথ ধরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার আবাহন এবং ইংরেজি ভাষার চর্চা শুরু হয়ে দেখবার যে বাতায়নটিকে অনেক প্রশস্ত করে দিল, ঈশ্বরচন্দ্র তার প্রত্যক্ষ তাৎক্ষণিক এবং শ্রেষ্ঠ উপজ বলা যায়! এই ঘটনা তখন হওয়ারই ছিল। না হলে প্রায় একই সময়ে প্রায় সমমতির অন্তত আরও দুটি উজ্জ্বল প্রতিভার সাক্ষাত আমরা পাই কেমন করে? হ্যাঁ, আমি অক্ষয় কুমার দত্ত এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কথা বলছি। তার মানে বাংলার তথা ভারতের ইতিহাসে তখন এরকম (অন্তত) একজন মনীষার জন্মগ্রহণের সামাজিক সাংস্কৃতিক চাহিদা তৈরি হয়ে গেছে। সেই মানুষটি যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তা এক আপতিক ঘটনা মাত্র।

অ্যাডামসের শিক্ষা সংক্রান্ত নোট্‌স, মেকলের সুপারিশ— এগুলো ঔপনিবেশিক প্রশাসনের রুটিন কার্যকলাপ মাত্র। সেই সব ফাইলের ঝুল ধুলো ময়লা দিয়ে বাংলার রেনেশাঁসের সারমর্মকে বোঝা যাবে না। হ্যাঁ, একথা ঠিক, ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই এগুলোর উপর প্রচারের প্রবল আলো ফেলেছেন, যাতে তাঁরাই ভারতে আধুনিক জ্ঞানের মশাল জ্বেলেছেন বলে আত্মপ্রসাদ পাওয়া যায় এবং সেই সুবাদে এই উপনিবেশে তাঁদের স্বদেশের কোম্পানির সওদাগরি সাম্রাজ্যিক শাসনটা একটা ন্যায্যতার সৌরভ লাভ করে।

এর দুটি পরিণাম দ্রষ্টব্য।

এক দিকে রবীন্দ্রনাথের মতো অনেকেই এর বিরোধিতা করতে গিয়ে কখনও কখনও আধুনিক শিক্ষার উপরেই তাঁদের যাবতীয় রাগ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। বহু কাল তপোবন রোমান্টিকতায় ভুগেছেন আর আপন উদ্যোগে গাছতলায় বসে শিক্ষার কথা ভেবেছেন। অন্য দিকে আর একদল এই সাম্রাজ্যিক প্রচারে এতটাই আস্থা স্থাপন করে রেখেছেন যে সেই কালের ইতিহাস লিখতে আর বুঝতে গেলেই ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলাদের কথার উপর ভরসা করে এগোতে থাকেন। “রেনেশাঁস” “ফেনেশাঁস” যাই বলি তা সেই অ্যাডাম আর মেকলেদেরই দান! তবে তাঁরা খুবই স্বজাতিসচেতন। বিদেশিদের উচ্ছিষ্ট হাত পেতে নিতে নারাজ! এসব নিতে নেই। বাজে জিনিস! ছিঃ বিদ্যাসাগর কী করে ওদের গোলামি করলেন?

মেকলের ক্ষমতা সত্যিই অপরিসীম। তাঁর মিনিট্‌স আমাদের অসংখ্য বামপন্থী প্রগতিশীল এবং ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের এক জায়গায় এনে বেঁধে ফেলেছে। বাংলার ইতিহাসের অন্তত একশো বছর তাঁরা পারলে ছেঁটে ফেলতে তুমুল আগ্রহী। তাঁরা অনেকেই এই কাজে আবার রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষী মানেন— মানারই কথা— কিন্তু বোধ হয় খেয়াল করেন না, কবিগুরু তাঁর পরিণত জীবনে “শিক্ষার মিলন” শিরোনামক একটি মাত্র প্রবন্ধে মেকলের বিরুদ্ধে তাঁর নিজেরই উত্থাপিত কম-বেশি সমস্ত যুক্তিকেই (নামে না বলে) বাতিল করে দিয়ে গেছেন। শেষ জীবনে তিনি এমনকি তপোবন রোমান্টিকতাকেও অতিক্রম করে এসেছেন। ভালো করে মন দিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করলেই ধরা পড়বে, তাঁর বিশ্বভারতী শিক্ষাঙ্গনের প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত যে শিক্ষা পরিকল্পনা, তা প্রায় আক্ষরিক অর্থে বিদ্যাসাগরের নোট্‌সের সার্থক রূপায়ন। সেখানে মেকলে টেকলে নয়, বিদ্যাসাগরই অশরীরে বর্তমান!

কী সেই নোট্‌স? কী তার সার কথা?

দুচার কথায় সেটা বলে নেওয়া যাক।

তাঁর প্রথম লক্ষ্যই হল বাংলা ভাষায় এক দল এমন শিক্ষিত মানুষ তৈরি করা, যারা পরবর্তীকালে ছাত্রদের বাংলাতেই ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান অঙ্ক শেখাতে পারবেন। তাঁদের মধ্য থেকেই একদল উন্নত বাংলা সাহিত্যের জন্ম দিতে পারবেন। মেকলের নোট্‌সমূহের যে লক্ষ্য, একদল ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষিত তৈরি করা, যারা দেহে ভারতীয় মনে ইংরেজ, এবং শিক্ষা শেষে ভালো কেরানি এবং প্রশাসক হয়ে ইংরেজ বণিকের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে— তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের এই ঘোষিত লক্ষ্যের কোনও সম্পর্কই নেই। সাদৃশ্য তো নেইই।

তাঁদের ভালো করে শেখাতে হবে সংস্কৃত এবং ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্য। যাতে তাঁরা বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারেন। সংস্কৃত থেকে আসবে শব্দ ও ব্যুৎপত্তিজ্ঞান। তার থেকে আসবে জ্ঞানের নিত্য নতুন বিকাশমান শাখাগুলির জন্য প্রয়োজনীয় নতুন নতুন শব্দ উৎপাদনের ক্ষমতা। রামমোহনের মতো ফার্সি না জানা থাকায় বাংলা শব্দভাণ্ডারের আর একটি বড় উৎস সম্পর্কে তাঁর খুব ভালো ধারণা ছিল না। তথাপি, এটা না বলে পারছি না, তাঁর সেই ধ্রুপদী সাধু ভাষায় লেখা সুললিত বাংলা গদ্যসাহিত্যের মধ্যেও মাঝেমাঝেই মানুষের মুখের কথায় প্রচলিত বিভিন্ন আরবি ফারসি উর্দু হিন্দি শব্দ সাঁতার কেটে যেত! তার মানে, সেই সব শব্দের ক্ষেত্রে তাঁর কোনও অস্পৃহা বা ছুঁৎমার্গ ছিল না! যদিও আজকাল অনেকেই এই প্রশ্নেও ফুটো বের করতে সক্ষম হয়েছেন! তিনি নাকি সাধারণের চলিত ভাষাকে খুন জখম করে সাধু সুসংস্কৃত বাংলা গঠন করে ভাষার জগতে সৌজাত্যের কারিকুরি করে গিয়েছিলেন। যাঁরা মনে করেন, বাঙালিদের মধ্যে মৌলিক চিন্তার অভ্যাস নেই বা উঠে গিয়েছে, বাঙালি শিক্ষিতরা কোনও বিষয়েই নতুন কথা বলতে বা ভাবতে পারেন না, বিদ্যাসাগর গবেষণার প্রশ্নে এসে তাঁরা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হবেন। বিদ্যাসাগর বধে গত দেড় শতাব্দ ধরে অনেক নতুন নতুন অজুহস্ত তৈরি হয়েই চলেছে।

ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথেরও সংস্কৃতের প্রতি নির্ভরশীলতার এই সীমাবদ্ধতা ছিল। বিশাল রবীন্দ্র সাহিত্যে আরবি তুর্কি ফার্সি উর্দু শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। সেটা খুব সম্ভবত প্রচলিত কথ্য ভাষাকে হত্যা করবার অভিপ্রায়ে নয়, নিতান্তই আয়ত্তাধীন শব্দকোষের ভূগোলক্রমে!

তার মানে কি বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষার পেছনে দৌড়চ্ছিলেন? সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ ব্যুৎপত্তি ও উচ্চতর পরিশংসার কারণে তাঁর কি খুব সংস্কৃতপ্রেম ছিল?

তাহলে আবার তাঁর শিক্ষা নোটের অন্তর্ভুক্ত এই প্রস্তাবটা দেখুন। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের অঙ্কটা শেখাতে হবে আধুনিক কালের লেখা ইংরেজি বই থেকে। লীলাবতী আর বীজগণিত নামক সংস্কৃত পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা আর উচিত হবে না। অঙ্কের বই পড়ার জন্য সংস্কৃত আয়ত্ত করে তারপর উপরোক্ত বইদুটো থেকে যে পরিমাণ অঙ্ক শেখা যাবে, আধুনিক ইংরেজি বই থেকে একই সময় খরচ করে অর্ধেক আয়াসে তার দ্বিগুণ পরিমাণ অঙ্ক শেখা সম্ভব হবে। দ্বাদশ শতাব্দের অঙ্ক নয়, উনিশ শতকে বীজগণিত ও পাটিগণিত যে স্তরে এসে পৌঁছে গিয়েছিল, বিদ্যাসাগর সেই স্তরের অঙ্ক শেখাতে বলছেন।

সংস্কৃতপ্রীতি দেখতে পাচ্ছেন নাকি কেউ? মেকলের ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন? বা ব্যালান্টাইন? বা রাজানুগ্রহ? রাজারা কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের সেই প্রস্তাব একটাও গ্রহণ করেনি।

বাংলা গদ্য ভাষার সংস্কার শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। এই ব্যাপারে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের কথা যেমন বলতে হবে, তেমনই রামমোহন, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, ঈশ্বর গুপ্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং আরও অনেকের কথাও স্মরণ করতে হবে। বিদ্যাসাগরের প্রায় সমকালেই, সম্ভবত কিছু কাল আগেই— ১৮৪০-এর দশকে অক্ষয় কুমার দত্ত এবং ১৮৫০-এর দশকে রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাংলায় প্রবন্ধ ও পাঠ্যপুস্তক লেখার কাজ শুরু করেছিলেন। এমনকি, বাংলা গদ্যে (দাঁড়ি বাদে) ইউরোপীয় সমস্ত যতিচিহ্নের গৃহপ্রবেশের জন্য রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে কৃতিত্ব উজার করে দিলেও, এরও মূল হোতা ছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা অতি মাত্রায় সত্য, বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন! আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণের প্রথম পেশাদার বাস্তুকার ছিলেন।

সেটাও মেকলের মিনিট্‌সে পাওয়া যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস।

বর্ণপরিচয় দিয়ে শুরু। সেকালের সবচাইতে পণ্ডিত মানুষটা বই লিখছেন সবচাইতে নিম্নশ্রেণির ছাত্রদের জন্য। বাংলা ভাষায় ডবল-ঋ ডবল-লি তুলে দিলেন। অন্তঃস্থ-ব রাখলেন না, উচ্চারণে নেই বলে। বাঙালির উচ্চারণে লাগে বলে ‘ড়’ এবং ‘ঢ়’ চালু করলেন। অন্তঃস্থ-‘য’ আর অন্তস্থ-‘য়’ (ইয়)-দের উচ্চারণগত কারণে আলাদা করে দিলেন। এক আলতো টোকায় এইভাবে বাংলা সেদিন সংস্কৃত থেকে একটা পৃথক ভাষা হিসাবে দাঁড়িয়ে গেল। বহুবচনে বিশেষ্য পদের পরিবর্তন হবে না, বহুবাচক অনুসর্গ বসিয়ে বহুবচন বানাতে হবে। বালকাঃ নয়, বালকগণ। দ্বিবচনের তো অতএব প্রশ্নই নেই। বালকৌ লেখার বদলে বালকদ্বয় লিখলেই হবে। কিংবা দুজন বালক। বিশেষণেও লিঙ্গ বা বচনের প্রভাব অনাবশ্যক হয়ে এল। অন্য সমস্ত প্রাচীন ভাষার মতোই সংস্কৃতে কোন পদ কোথায় বসবে তার কোনও নির্ধারিত নিয়ম নেই। যে কোনও পদ, এমনকি অব্যয় দিয়েও বাক্য শুরু হয়ে যেতে পারে। বাংলা গদ্যে তা নয়। অক্ষয় দত্তের অনুসরণে ব্যাকরণসম্মতভাবে কর্তা ক্রিয়া কর্ম ইত্যাদির স্থান নির্ধারণ ও নির্দেশ করে বাংলায় বাক্য গঠনের এক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সুষমা গড়ে দিলেন। সেটাই আজও চলছে।

সন্ধির নিয়ম প্রায় একই রইল; কিন্তু সংস্কৃতের বিপরীতে সন্নিকটস্থ শব্দের সন্ধির আবশ্যিক ব্যবহার উঠে গেল। বাংলা কারক এবং সমাসও সংস্কৃতের থেকে অনেকাংশে আলাদা ও সরলতর হতে শুরু করল বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই। শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্থ করে শব্দ ব্যবহার নয়, মূল শব্দ এবং ক্রিয়াপদের কর্তানুযায়ী রূপ জানলেই বাক্য গঠন করা যাবে। রেফ্‌-এর ব্যবহার যথা সম্ভব কমে গেল। কালীপ্রসন্ন সিংহ (বা তদানীন্তন আরও অনেকের) মতো কর্ছে, মর্ছে, ফির্ছে নয়, করছে, মরছে, ফিরছে লেখা চালু হল।

তা সত্ত্বেও একথা সত্য যে বিদ্যাসাগরের বাংলা সাধু ভাষা। আমরা শুধু যে এখন আর সেই ভাষায় কথা বলি না বা লেখালেখি করি না তাই নয়, আজকের দিনে বসে সেই ভাষার দিকে তাকালে তাকে বেশ কঠিন কঠিন বলেই বোধ হয়! তখনও তা অনেকটাই সংস্কৃত ঘেঁষা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংস্কৃতের কঠিন শৃঙ্খল থেকে মুক্তিও তিনিই এনে দিয়েছেন। বাংলা গদ্য ভাষা বিবর্তনের রাস্তাটা তিনিই খুলে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বরাবর এবং রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন সেই সাধু ভাষাতেই গদ্য লিখলেও অচিরেই কথ্য ভাষায় বাংলার সাহিত্য-ব্যবহার শুরু হল বিশ শতকের একেবারে গোড়া থেকেই। গল্প উপন্যাসে লেখকের নিজস্ব বয়ান যদি বা সাধু ভাষায় হয়ও, সংলাপগুলিতে কথ্য ভাষা জাঁকিয়ে বসে গেল। নাটকেও একই সময়ে কথ্য ভাষার ব্যবহার পুরোদমে চালু হল। বিবেকানন্দের বাংলা সমস্ত রচনাই শুরু থেকে কলকাতার কথ্য ভাষার পোশাক পরে খুব শক্তিশালী গদ্যশৈলীতে উঠে এল।

সূত্রপাত? না, গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানেও মেকলে নয়, বিদ্যাসাগরের নাম ধরেই খুঁজতে হবে।

বিদ্যাসাগরের নাম মুছে দিয়ে, মেকলের মিনিট্‌সের হাত ধরে, বঙ্কিমচন্দ্র মধুকবি দীনবন্ধু মোসারফ হোসেন রবি ঠাকুর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রোকেয়া শেখাওয়াত শরৎচন্দ্র নজরুলের ঠিকানা খুঁজে বের করা বেশ একটু অসুবিধাজনক! বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির শেকড় আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলে মেকলে-উচ্চারকদেরও বিদ্যাসাগরকে লাগবে।

আরও অনেক দিন।