Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিধবাবিবাহ আন্দোলন: ইয়ং বেঙ্গল ও বিদ্যাসাগর

শুভেন্দু সরকার

 


লেখক ইংরিজি সাহিত্যের অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

সতীদাহ ১৮২৯-এ নিষিদ্ধ হওয়ার পর বাল্যবিধবার বিয়ের প্রসঙ্গ জোরালো হয়েছিল। এমনকি, ১৮৩০-এ রামমোহন ইংল্যান্ড রওনা দিলে (যেখানে ১৮৩২-এ প্রিভি কাউন্সিলে পেশ করা হয় সতীদাহর বিরুদ্ধে তাঁর শেষ প্রস্তাব) রটে যায়: তিনি বিধবা-বিবাহর পক্ষে সওয়াল করবেন সেখানে।[1] ততদিনে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক প্রগতিশীল গোষ্ঠী— ইয়ং বেঙ্গল। আধুনিক পাশ্চাত্য উদার ও যুক্তিবাদী ধ্যানধারণায় অনুপ্রাণিত ডিরোজিওর ছাত্ররা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি মেয়েদের দুর্দশা ঘোচানোর কথাও বলছিলেন। সেসব আগুয়ান তরুণদের মনে হল: অশিক্ষা, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণা আলাদা-আলাদা সামাজিক অসুখ নয়, এমনকি স্রেফ মেয়েদের বিষয়ও নয়। নৈতিকতা ও মানবিকতার পাশাপাশি এসবের সঙ্গে জড়িত আছে দাম্পত্য সুখ, পরের প্রজন্মর স্বাস্থ্য ও লেখাপড়া আর সার্বিকভাবে দেশের উন্নতির মতো ব্যবহারিক প্রসঙ্গ। রামমোহন লড়েছিলেন একা; অন্যদিকে, হিন্দু কলেজের ছাত্ররা— আর কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও সংস্কৃত কলেজের তাঁদের কিছু বন্ধু— সমাজ সংস্কারে নামলেন দলবদ্ধভাবে। সভা-সমিতি, পত্র-পত্রিকা আর ইস্কুল প্রতিষ্ঠা মারফত সামাজিক (ও রাজনৈতিক) সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললেন তাঁরা। মহিলাদের দুর্দশার মূলে রয়েছে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রর আদ্যিকালের অনুশাসন যা আধুনিক যুগে অচল— এমনই ছিল ইয়ং বেঙ্গলের মতামতের সারমর্ম। বহুদিনের আচার-ব্যবহারের প্রতি অন্ধ-আনুগত্য নয়, সবকিছু বরং যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে দেখতে চাইলেন তাঁরা। রামমোহনের মতো ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীও নতুন পথে হাঁটল। স্বাভাবিক যে, এবারও প্রগতির ধারাকে রোধ করতে এগিয়ে আসবে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। ইয়ং বেঙ্গলের তরুণরা বিলক্ষণ জানতেন, সংস্কারের রাস্তায় বিপদ অনেক— নিঃসাড় প্রথাসর্বস্ব সমাজকে পাল্‌টানোই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।[2]

এমন অবশ্য নয় যে, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের যুবকরা হিন্দু শাস্ত্রকে অচ্ছুৎ ভাবতেন। উল্‌টে, তাঁদের কারও কারও (যেমন প্যারীচাঁদ মিত্র) শাস্ত্রজ্ঞান রীতিমতো সমীহ জাগায়। একথা ভুল যে, পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা আর ইংরিজি ভাষার বাইরে তাঁদের উৎসাহ ছিল না। বরং বলা যায়, ইতিহাস সম্পর্কে ইয়ং বেঙ্গলের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বান্দ্বিক— অতীতের উজ্জ্বল কীর্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি আধুনিক যুগের অনুপযোগী সবকিছু নস্যাতের প্রবণতা। নিঃসন্দেহে তৎকালীন ইংরেজ ভারতবিদ্‌দের গবেষণা দেশের প্রাচীন সাহিত্য ও ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁদের আগ্রহ বাড়ায়।

বিধবাবিবাহ নিয়ে ইয়ং বেঙ্গল অন্দোলনের অভিমুখ গোড়া থেকেই খুব স্পষ্ট। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা (সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ, ১৮৩৮)-র সভায় ১৮৩৯-এ মহেশচন্দ্র দেবের বক্তৃতায় শাস্ত্রর বিধান পালনে অল্পবয়েসি বিধবাদের রোজকার জীবনে চরম দুঃখর বর্ণনা ছিল— যা তাঁর মতে কঠোর আত্মসংযমী সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের চেয়েও বেশি নির্মম। এর পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন, দুঃসহ একাকী জীবনে অনেকসময়েই প্রলোভনের শিকার হন বিধবারা। শারীরিক চাহিদার বশে ঘটে ব্যভিচার ও ভ্রূণহত্যা; এমনকি, সামাজিক লজ্জা থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যা।[3] খেয়াল রাখা দরকার: এই সভার অন্যতম সদস্য ছিলেন তরুণ বিদ্যাসাগর।[4]

ইয়ং বেঙ্গলের মতে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ছিল না। তাই তাঁদের এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, স্ত্রীবিয়োগের পর পুরুষের বিয়ে গ্রাহ্য হলে বিধবা-বিবাহে আপত্তি উঠবে কেন? ইয়ং বেঙ্গলের অন্যতম পত্রিকা (দ্বিভাষিক) দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর  (১৮৪২) বের করার একটি উদ্দেশ্য: স্ত্রী-শিক্ষা ও বিধবা-বিবাহর মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা আর প্রচলন। দেখার ব্যাপার: স্রেফ বিশুদ্ধ যুক্তি নয়, বিধবা-বিবাহ চালুর জন্যে শাস্ত্রগত সমর্থনও খোঁজেন ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা। দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর সংখ্যা ১ (এপ্রিল ১৮৪২)-এ এক পত্রপ্রেরক লিখলেন: “…অনেকে অসম্মত হইবেন কিন্তু  শাস্ত্রাদি গ্রন্থ দৃষ্টি করিলে জ্ঞাত হইতে পারেন যে উক্ত রীতি আধুনিক ব্যক্তিদিগের মনঃকল্পিত নহে কিন্তু প্রাচীন কালেও প্রচলিত ছিল।”[5] এরপর তিনি একে-একে নারদ, শঙ্খ, লিখিত, যাজ্ঞবল্ক্য, হারীত আর মনু-সংহিতা থেকে ‘পুনর্ভূ’ (যে নারী পুনর্বিবাহ করে) ও তার দ্বিতীয় স্বামীর পুত্র (‘পৌনর্ভব’)-র প্রসঙ্গ তুলে বোঝালেন, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। শুধু অতীত নয়, পত্রপ্রেরক এও মনে করালেন, দেশের নানা জায়গায় বিধবাবিবাহ সমকালেও চালু আছে। দেখার বিষয়: এই চিঠিতে আবার উঠে এল বিধবার ব্যভিচার ইত্যাদির মতো বাস্তব সমস্যা। তবু একটা খটকা রয়ে গেল— কলিযুগে পৈতৃক সম্পত্তিতে পৌনর্ভবের অধিকার নেই (শুধু ঔরস ও দত্তক পুত্রর সে-সুযোগ আছে)। তাই পত্রপ্রেরকের প্রস্তাব:

এক সভা সংস্থাপন করিয়া তাহাতে অধিকাংশ মান্য ব্যক্তি সভ্য এবং সুবিজ্ঞ পণ্ডিত নিযুক্ত করিয়া পৌনর্ভব পুত্রের দায়াধিকারক্রম এবং পুনর্ভূর বিবাহের শাস্ত্র উদ্ধৃত হয় এবং ন্যায় ও যুক্তিসিদ্ধ উক্ত বিষয়ে পণ্ডিতদিগণের ব্যবস্থানুরূপ রাজকীয় ব্যবস্থার প্রার্থণায় ভারতবর্ষীয় অধিকাংশ হিন্দু প্রজাগণের স্বাক্ষরিত এক আবেদন পত্র গবর্ণমেণ্টে প্রেরিত হইলে পরে পুনর্ভূর বিবাহ ব্যবহার করা যায়।[6]

এই ‘পত্রপ্রেরক’-এর পরিচয় জানা যায়নি। কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন একইসঙ্গে শাস্ত্রজ্ঞ, মুক্তমনা আর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সমর্থক।

দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর সংখ্যা ৫ (জুলাই ১৮৪২)-এর সম্পাদকীয়তে আগের চিঠির খেই ধরে এল বিধবাবিবাহের সমর্থনে ১৭৫৬-য় ঢাকার রাজা রাজবল্লভ রায়কে দেওয়া দেশের বিভিন্ন জায়গার পণ্ডিতের ব্যবস্থা— পরাশরের বচন: “স্বামীর দেশান্তর, গমন, মরণ, সন্ন্যাসধর্ম্মাবলম্বন, ক্লীবত্ব এবং পাতিত্য এই পঞ্চ প্রকার আপদে স্ত্রীলোকের প্রতি বিবাহান্তর করণের বিধি আছে।”[7] ইয়ং বেঙ্গলের সঙ্গে বন্ধুত্বের খাতিরে বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার আড়াল থেকে এই বচনটি জুগিয়েছিলেন— এমন অনুমান করেন শিবনাথ শাস্ত্রী।[8] এও খেয়াল রাখার মতো যে, মৃত পিতার সম্পত্তিতে পৌনর্ভবের অধিকার শাস্ত্রসিদ্ধ নয় বলে পত্রপ্রেরক যে সরকারের সাহায্য চেয়েছিলেন তাতে দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর পরিচালকদের সায় নেই। এর পেছনে ছিল তাঁদের আশঙ্কা— সরকারি হস্তক্ষেপে ধর্মীয় স্বাধীনতা নষ্ট হবে। তার বদলে দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর পরিচালকরা পরামর্শ দিলেন:

তাবৎ ব্যক্তিই স্বীয় ধন ব্যয় করতে সক্ষম অতএব পুনর্ভূ বিবাহ করিয়া জীবদ্দশায় তাহার এবং তদুৎপন্ন সন্তানাদির জীবিকা স্থাপন করা যাইতে পারে যদ্যপি তাহাতেও আশঙ্কা হয় যে অন্য উত্তরাধিকারিরা উহাদিগের ঐ প্রকার ধন বিভাগে বিবাদ উপস্থিত করিবেক তবে নিজ বিষয়ের নিয়ম পত্র আদালতে রেজিস্টরি করিয়া রাখিলেই এই সন্দেহ দূর হইতে পারিবেক।… হিন্দুজাতীয় বিধবার পুনর্বিবাহারম্ভের প্রতি পৌনর্ভব পুত্রের ধনাধিকার নিয়মাভাবরূপ যে প্রতিবন্ধক ছিল তাহারও এইরূপে খণ্ডন করা যাইতে পারে।[9]

দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর মতে স্ত্রীশিক্ষা আর যুবকদের সাহস বাড়লেই সমাজসংস্কারে আর বাধা থাকবে না। কিন্তু আর-এক পত্রপ্রেরক পত্রিকার খণ্ড ২ সংখ্যা ২ (জানুয়ারি ১৮৪৩)-এ আবার পৌনর্ভবের সম্পত্তির অধিকারের জন্যে সরকারি সাহায্য চাইলেন:

এতদ্দেশীয়দিগের ধর্ম্ম বা জনপদীয় বিষয়ের প্রতি গবর্ণমেন্ট যে হস্তক্ষেপণ করিবেন না এমত কোন লিখিত বা বাচনিক প্রতিজ্ঞা নাই, এবং আমাদিগের পৈতৃকাধিকার যে রূপে রক্ষণাবেক্ষণ হইয়া আসিতেছে তদ্দ্বারাও উক্ত প্রকার প্রতিজ্ঞার কোন সোপান পাওয়া যায় না। আমারা অনেকেই প্রাচীন রীতিবর্ত্ম পরিবর্ত্ত করিয়াছি ঐ সকল এইক্ষণে আর চলিত হইবার সম্ভাবনা নাই। জ্ঞান ও সভ্যতার যত বৃদ্ধি হয় ততই লোকেরদের সংস্কারের এবং চরিত্রের ও ধর্ম্মের পরিবর্তন হইয়া থাকে এবং তৎসমভিব্যাহারে প্রাচীন নিয়মেরও অন্যথা হয়।[10]

বোঝা যাচ্ছে, উপায় নিয়ে মতান্তর থাকলেও প্রথা ভেঙে সমাজসংস্কারে শিক্ষিত বাঙালির আপত্তি ছিল না।

দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর মতোই দেশে প্রচলিত ‘কৌলিন্যব্যবস্থা, বিধবাবিবাহপ্রতিষেধ, অল্প বয়সে বিবাহ’-র মতো ‘কুরীতি ও কদাচার’ দূর করা ছিল মাসিক সর্ব্বশুভকরীপত্রিকা (১৮৫০)-র উদ্দেশ্য। সেটি বের করতেন হিন্দু কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররা। গোড়াতেই অবশ্য স্পষ্ট জানানো হল সংস্কারের কাজ কত কঠিন— দেশাচারের ওপর মানুষের শ্রদ্ধা এতই গভীর যে, প্রয়োজনে তার  জন্যে নৈতিকতা আর ধর্মশাস্ত্রকেও অবজ্ঞা করতে পারে তারা।[11] এরই প্রথম সংখ্যায় রাজকৃষ্ণ মিত্রর অনুরোধে বিদ্যাসাগর লিখলেন বাল্যবিবাহের দোষ— যদিও লেখকের নাম ছাপা হয় নি তখন।[12] শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন না জানালে দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর দুই পত্রপ্রেরক আর পরাশর বচনের সম্ভাব্য জোগানদারের মতো এ ক্ষেত্রেও লেখককে সঠিক চেনা যেত না।[13]

লক্ষ করার ব্যাপার, বাল্যবিবাহর বেলায় ইয়ং বেঙ্গলের যুবকরা যেসব সমস্যা— যেমন দাম্পত্যসুখ ও শিক্ষায় বাধা আর নিজেদের ও সন্তানের দুর্বল শরীর— উল্লেখ করেছিলেন, সেগুলিবাল্যবিবাহের দোষ-এ ফিরে এল। পাশাপাশি উঠল বালবৈধব্যর কথা— যা বাল্যবিবাহর অন্যতম করুণ পরিণাম। বিদ্যাসাগর তুলে ধরলেন, শাস্ত্রবিধি আর লোকাচারের জাঁতাকলে পড়ে বাল্যবিধবার দুঃসহ জীবন আর প্রলোভনের বশে ‘বিপথগামিনী’ আর লোকলজ্জার ভয়ে ভ্রূণহত্যার মতো ‘বিগর্হিত পাপকার্য’-র প্রসঙ্গ।[14] বিশুদ্ধ যুক্তি, বাস্তব বুদ্ধি আর মানবিক আবেদন— বাল্যবিবাহের দোষ-এ এই ছিল তাঁর হাতিয়ার। ইয়ং বেঙ্গলের তর্কপ্রণালীর সঙ্গে এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কোনও তফাত ছিল না।

বিদ্যাসাগর অবশ্য খুব শিগগিরই বুঝলেন, স্রেফ যুক্তি-বুদ্ধি আর মানবিকতা দিয়ে চিঁড়ে ভিজবে না এদেশে। জানুয়ারি ১৮৫৫-য় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় আর পরের মাসে বই আকারে বেরোল বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব। তার গোড়ায় তিনি পরিষ্কার লিখলেন:

… বিধবাবিবাহ কর্তব্য কর্ম কি না, অগ্রে ইহার মীমাংসা করা অতি আবশ্যক। যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন।[15]

বিদ্যাসাগর জানতেন: উদারপন্থী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বাইরে যে বৃহৎ বাঙালি সমাজ, তা একেবারেই গতিহীন, ধর্মীয় অনুশাসন সেখানে মানুষকে বেঁধে রেখেছে। বাইরে থেকে আইন করলে কিছুই হবে না; বরং চাই গ্রাম-শহরের মানুষকে বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা সম্বন্ধে পাথুরে প্রমাণ জোগানো। প্রায় এক বছর ধরে পুঁথি ঘেঁটে সে-কাজটিই করলেন বিদ্যাসাগর; বিশদে সকলেকে তা জানালেনও সহজ সরল বাংলায়। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা হাজির করলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর লেখায় আগাগোড়া নজরে এল এক যৌক্তিক কাঠামো।[16] আর সর্বদা তাঁর লক্ষ্য থাকল স্থির। শাস্ত্র, ইতিহাস, বাস্তব সমস্যা আর মানবিক আবেদন— সবই ছিল বিদ্যাসাগরের লড়াইয়ের প্রকৌশল।

দেখার ব্যাপার, পরাশর-সংহিতা-র বচন (৪।২৬)-কে নানাভাবে কাজে লাগালেন বিদ্যাসাগর। দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এ ছিল ‘গতে’ পাঠ; বিদ্যাসাগর উদ্ধৃত করলেন ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে…’ পাঠ: ‘গমন’-এর বদলে ‘অনুদ্দেশ’। প্রথম প্রস্তাব-এ বিদ্যাসাগর সামনে আনলেন যুগধর্মর ধারণা— তা দিয়ে নস্যাৎ করলেন বিধবাবিবাহের বিপক্ষে যাবতীয় শাস্ত্রীয় বচন। যেহেতু শুধু পরাশর-সংহিতা-ই কলিযুগের ধর্ম, তাই তার বিধি কর্তব্য-কর্ম।

ভগবান্‌ স্বায়ম্ভুব মনু যে সমস্ত ধর্ম নিরূপণ করিয়াছেন, সত্যযুগের লোকেরা সেই সকল ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতেন। ভগবান্‌ গোতম যে সমস্ত ধর্মের নিরূপণ করিয়াছেন, ত্রেতাযুগের লোকেরা সেই সকল ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতেন। ভগবান্‌ শঙ্খ ও লিখিত যে সমস্ত ধর্ম নিরূপণ করিয়াছেন, দ্বাপরযুগের লোকেরা সেই সকল ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতেন। আর ভগবান্‌ পরাশর যে সমস্ত ধর্ম নিরূপণ করিয়াছেন, কলিযুগের লোকদিগকে সেই সকল ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক।[17]

এও লক্ষ্য করার, কীভাবে একইসঙ্গে পরাশরে উল্লিখিত ‘সহগমন’ আর ‘ব্রহ্মচর্য’-র বিধি সামলালেন বিদ্যাসাগর। সেখানে বিধবাবিবাহের ওপর শুধু এসবের স্থান নয়, পুণ্যর বিচারেও অনেক এগিয়ে। বিদ্যাসাগর লিখলেন:

পরাশর কলিযুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিতেছেন, বিবাহ, ব্রহ্মচর্য, সহগমন। তন্মধ্যে, রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবেক। কলিযুগে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্রা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান্‌ পরাশর সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন। সে যাহা হৌক, স্বামীর অনুদ্দেশে প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বৈগুণ্য ঘটিলে, স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহের স্পষ্ট বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, কলিযুগে, সেই সেই অবস্থায়, বিধবার পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রসম্মত কর্তব্য কর্ম বলিয়া অবধারিত হইতেছে।[18]

তবে ‘পৌনর্ভব’ নিয়ে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করাই বিধবাবিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় অবদান। পুনর্বার বিয়ের পর বিধবার জাত সন্তানের পৈতৃক সম্পত্তির বৈধ অধিকার শাস্ত্রগতভাবে প্রমাণ করা যায়নি আগে। এ হয়ে উঠেছিল বিধবাকে বিয়ে করার প্রশ্নে পুরুষের প্রধান আপত্তি। পরিবারের সঙ্গে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পর্ক যে নিবিড়! দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার মুক্তমনা তরুণদের মধ্যে পরাশরের বচনটি ঘুরছিল; বিদ্যাসগরের পক্ষে তা না-জানা খুবই অস্বাভাবিক। তাই মনে হয়, বচনটি ‘আবিষ্কার’ করে নয়, বরং পৌনর্ভবের সমস্যা কাটাতে পেরেই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। এও দেখার, সমস্যাটির সমাধানে যুক্তিবুদ্ধির প্রয়োগই শেষ কথা। এখানেই বিদ্যাসাগরের মৌলিকত্ব।[19]

পূর্ব পূর্ব যুগে দ্বাদশবিধ পুত্রের ব্যবস্থা ছিল। … পরাশর কলিযুগে ঔরস, দত্তক, কৃত্রিম ত্রিবিধ পুত্রের বিধি দিতেছেন, পৌনর্ভবের উল্লেখ করিতেছেন না। কিন্তু, যখন বিধবাবিবাহের বিধি দিয়াছেন, তখন বিবাহিতা বিধবার গর্ভজাত পুত্রেকেও পুত্র বলিয়া পরিগ্রহ করিবার বিধি দেওয়া হইয়াছে। এক্ষণে বিবেচনা করা আবশ্যক, ঐ পুত্রকে ঔরস, দত্তক অথবা কৃত্রিম বলা যাইবেক। উহাকে দত্তক অথবা কৃত্রিম বলা যাইতে পারে না; কারণ যদি পরের পুত্রকে শাস্ত্রবিধানানুসারে পুত্র করা যায়, তবে বিধানের বৈলক্ষণ্য অনুসারে, তাহার নাম দত্তক অথবা কৃত্রিম হইয়া থাকে। কিন্তু, বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্র পরের পুত্র নহে; এই নিমিত্ত, উহাকে দত্তক অথবা কৃত্রিম বলা যাইতে পারে না। শাস্ত্রকারেরা দত্তক ও কৃত্রিম পুত্রের যে লক্ষণ নিরূপিত করিয়াছেন, তাহা বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রে ঘটিতেছে না। কিন্তু ঔরস পুত্রের যে লক্ষণ নির্দিষ্ট করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণরূপে ঘটিতেছে। …  কলিযুগে বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রকে পৌনর্ভব বলিয়া গণনা করা কোনও ক্রমে পরাশরের অভিপ্রেত বলিয়া প্রতিপন্ন করা যাইতে পারে না। … অতএব, কলিযুগে বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রকে পৌনর্ভব না বলিয়া ঔরস বলিয়া গণনা করিতে হইবেক, তাহার সন্দেহ নাই।[20]

এভাবেই বিদ্যাসাগর প্রমাণ করলেন, কলিযুগে পৌনর্ভব বলে কিছু হতে পারে না, বিধবার সন্তানকে ঔরস পুত্র বলেই ধরতে হবে। সম্পত্তির অধিকারে তার কোনও শাস্ত্রীয় বাধা নেই। দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর-এর পত্রপ্রেরক অথবা পরিচালকরা এতটা ভাবতেই পারেননি।

দীর্ঘ দ্বিতীয় প্রস্তাব (অক্টোবর ১৮৫৫)-এ নানা বিরোধী প্রতিক্রিয়া ও মতামতের একে-একে উত্তর দিলেন বিদ্যাসাগর। সেখানে এল শাস্ত্র আর ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ; কিন্তু পরাশর বচন আর পৌনর্ভব-সমস্যার সমাধানের ভিত্তিতেই তিনি সেসব খণ্ডন করলেন। বিপক্ষর ছোট-বড় সবকটি আপত্তি ধৈর্য ধরে উত্তর দেবার পেছনে ছিল বিদ্যাসাগরের নির্দিষ্ট যুক্তি: যেহেতু সংস্কৃত বচনের অর্থর জন্যে বিষয়ী লোককে শাস্ত্রজ্ঞর ওপর নির্ভর করতে হয় আর সেই সুযোগে অনেক সংস্কৃত পণ্ডিতই বচনের একেবারে বিপরীত ব্যাখ্যা দেন, তাই দরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। আর সেটি ইচ্ছে করেই তিনি করলেন নিপাট বাংলায় (এমনকি, প্রতিবাদের ভাষা সংস্কৃত হলেও)।

দুটি প্রস্তাবেই অবশ্য বিদ্যাসাগর সেই বাস্তব সমস্যাগুলি— ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা ইত্যাদি— মনে করাতে ভোলেননি। শাস্ত্রের পাশাপাশি এসবের কথা বলে নিজের বক্তব্যকে আরও শক্তিশালী করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এভাবেই সাধারণ মানুষের মনকে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের পক্ষে আনতে চেয়েছিলেন তিনি।

হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ! … তোমরা প্রাণতুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ, তাহারা, দুর্নিবাররিপুবশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ; ধর্মলোপভয়ে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল লোকলজ্জাভয়ে, তাহাদের ভ্রূণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য! শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্যযন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ্‌ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহে। … হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিতবোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে।[21]

বিদ্যাসাগর অবশ্য জানতেন, শুধু শাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করলেই তাঁর উদ্দেশ্য মিটবে না। বিধবাবিবাহ চালু করতে গেলে চাই আইন। সেই লক্ষ্যেই ধাপে ধাপে এগিয়েছেন তিনি। এখানে খেয়াল রাখা জরুরি: বিদ্যাসাগরের সামনে ছিল রামমোহনের সার্থক মডেল; সেটি পুরোপুরি তিনি অনুসরণ করলেন। সহমরণ (ও অনুমরণ) বিষয়ে প্রথম বিসম্বাদ (১৮১৮)-এ রামমোহন শাস্ত্রীয় সমর্থন খোঁজেন, পরে দ্বিতীয় সম্বাদে (১৮১৯)-এ আরও বিশদে (যেখানে আসে নিষ্কামকর্মর তত্ত্ব) বিরোধী মতের জবাব দেন আর শেষে আইন তৈরির জন্যে সরকারের কাছে আবেদন দাখিল করেন (১৮২৯-এ বেরোয় সহমরণ বিষয়ে তাঁর তৃতীয় বাংলা লেখা)। এমনকি, রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও সরকারি কর্তৃপক্ষর সামনে রাখেন নিজের লেখার ইংরিজি অনুবাদ।

পার্থক্য এই যে, সতীদাহর বিরূদ্ধে রামমোহন হাতিয়ার করেছিলেন মনু-সংহিতাসেখানে কোনও সম্বাদেই একবারও যুগধর্মের কথা ওঠেনি। সহমরণের বদলে ব্রহ্মচর্যের পক্ষে বরং রায় দেন তিনি।[22] অন্যদিকে, বিদ্যাসাগর সত্যযুগের শাস্ত্র বলে মনু ও অন্যান্য সংহিতা বাতিল করলেন, শরণ নিলেন শুধু পরাশরের। বোঝা যায়, এঁরা দুজনেই ছিলেন সমান লক্ষ্যমুখী; নিজেদের কাজ হাসিল করতে সুবিধে মতো বেছে নিতেন কোনও না কোনও শাস্ত্রর ঢাল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত যুক্তির ধারালো ছুরি— যা দিয়ে ঘায়েল হত বিপক্ষ। রামমোহন আর বিদ্যাসাগর— দুজনের লেখাতেই এসেছে দেশাচার, পরম্পরা আর দীর্ঘ অভ্যেসের প্রসঙ্গ। অনিবার্যভাবেই সংস্কারক হিসেবে এঁরা মত দিয়েছেন পরিবর্তনের পক্ষে, স্থিতাবস্থার বিপক্ষে। এছাড়া, দুজনেই শেষে জানিয়েছেন গভীর সমবেদনা আর কাতর মানবিক আবেদন।

বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব দুটি রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল সে-সময়। বলা যায়, ১৮৫৫-য় প্রগতিশীল আর গোঁড়া হিন্দু সমাজের মধ্যে বিরোধ আরও চরমে পৌঁছল— বিধবাবিবাহকে ঘিরে দুটি দল তৈরি হল। স্বাভাবিক যে, ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা তখন বিদ্যাসাগরের পাশেই দাঁড়াবেন। কিন্তু প্রয়োগের বেলায় একমত হলেও তাত্ত্বিক প্রশ্নে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁদের খানিক ফারাক ছিল। নমুনা হিসেবে দ্য ক্যালকাটা রিভিউ-এ প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রর ‘হিন্দু বিধবার বিয়ে’ (‘Marriage of Hindu Widows’, ১৮৫৫) পড়া দরকার।[23] ১৮৪২ থেকে টানা তেরো বছর বিধবাবিবাহর সমর্থনে যা কিছু লেখা বেরিয়েছে, সেসব আর তার সঙ্গে আরও কিছু প্রাথমিক সূত্র যাচাই করে প্যারীচাঁদ নিজের মতামত দিলেন। তিনি তুলে ধরলেন: বিধবাবিবাহ ও অন্যান্য বিষয়ে নানা শাস্ত্রের মধ্যে মতানৈক্য; এমনকি, একই শাস্ত্রের বিভিন্ন ভাষ্যকারের আলাদা-আলাদা ব্যাখ্যা। প্যারীচাঁদ আরও বললেন: মনু-সংহিতা শুধু সত্য নয়, সব যুগের ক্ষেত্রেই খাটে; পরাশর-সংহিতা-র ভাষ্যকার মাধবচার্যর মতে: কলিযুগে বিধবাবিবাহ প্রযোজ্য নয়। পাশাপাশি প্যারীচাঁদ মনে করালেন যে, কলিযুগের শাস্ত্র হিসেবে পরাশর-সংহিতা  অসম্পূর্ণ— সেখানে জাত, বিয়ে, বিচ্ছেদ, অন্ত্যেষ্টি ইত্যাদি বিষয় কোনও বিধি নেই। তিনি আরও দেখালেন, কয়েকজন ইংরেজ ভারতবিদ লিখেছেন, শূদ্র ছাড়া বিধবাবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রমতে নিষিদ্ধ।

প্যারীচাঁদ জানতেন: হিন্দুশাস্ত্র সাক্ষাৎ কল্পতরু— সকলেই নিজের মতের সমর্থনে বচন (অথবা ব্যাখ্যা) পাবেন সেখানে। বিদ্যাসাগর যেমন বিধবাবিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ হাজির করেছেন, উল্‌টোদিকের লোকও সে-ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে না। অব্যাহত থাকবে উত্তর-প্রত্যুত্তরের ধারা। যুক্তিবাদী প্যারীচাঁদের তাই সাফ কথা: অতীতে নানা সময় লেখা শাস্ত্রগুলিকে শ্বাশত ও অপরিবর্তনীয় নয়, বরং নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়ের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে দেখা দরকার— পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় পরবর্তীকালে সেসব অচল। নাম না-করে বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে তিনি বলেন: শাস্ত্রের ভিত্তিতে আধুনিককালে কোনও ফয়সালা হবে শেষ বিচারে তাৎক্ষণিক। মানুষের মধ্যে যুক্তি ও নীতিবোধের প্রসার ঘটলেই হবে সত্যিকারের সংস্কার। যেখানে বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে কুশলী পদক্ষেপ নিলেন বিদ্যাসাগর, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি ফলের জন্যে বিকল্প বিশ্ববীক্ষার বিস্তার চাইলেন প্যারীচাঁদ। অবশ্য এই দুই বিরোধী নীতির মধ্যে কোন্‌টি বেশি কার্যকরী—আজও তা নিশ্চিত বলা যায় না। মজার ব্যাপার, ২৫ জুলাই ১৮৫৬-র আইনে বিধবাবিবাহ চালুর জন্যে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া উন্নত নীতিবোধ আর জনকল্যাণের কথাও বলা হল।

ব্যবস্থাপক সভায় বিধবাবিবাহ বিল জমা পড়ার পর প্যারীচাঁদের লেখা বেরোয়। সেই খসড়ায় তাঁর কিছু আপত্তি ছিল। বিধবাবিবাহের সংজ্ঞা আর বিধবার বিয়ের ন্যূনতম বয়েস নিয়ে ধোঁয়াশার পাশাপাশি সেখানে দেখা গেল: বিয়ে করলে মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার হারাবেন হিন্দু বিধবা। তাই প্যারীচাঁদের সুপারিশ ছিল: লেক্স লোসাই আইন (lex loci Act, 1850)-এর মতো হিন্দু বিধবাদের বেলায়ও সম্পত্তির অধিকার রক্ষা হোক।

৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬-য় বিধবাবিবাহের সমর্থনে প্যারীচাঁদ মিত্র, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ যে-আবেদন করেন (মোট ৩৭৫ জনের সই ছিল), তাতে শুধু বিধবাবিবাহ নয়, বিবাহ-সংক্রান্ত একটি সাধারণ আইনের উপযোগিতার কথাও বলা হয়। ইয়ং বেঙ্গলের প্রস্তাব ছিল, স্বামী-স্ত্রী লিখিতভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে; স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন স্বামী আর বিয়ে করবে না, অন্যথায় জরিমানা হবে। তাঁরা চেয়েছিলেন, এই দুটি চুক্তি বিয়ের ছ মাসের মধ্যে নিবন্ধীকরণ হোক আদালতে।[24] সরকার অবশ্য এসব কিছুই মানেনি। মনে রাখা জরুরি, পরবর্তীকালে অঙ্গীকারপত্রর গুরুত্ব বুঝেছিলেন বিদ্যাসাগর। আইনের দুর্ব্যবহার (বহুবিবাহ) ঠেকাতে পাত্রকে দিয়ে এক টাকার স্ট্যাম্প কাগজে চুক্তিপত্র সই করাতেন তিনি। সেখানে থাকত চারজন সাক্ষী।[25]

সকলেই জানেন: আইন পাশের পর বিদ্যাসাগরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন প্যারীচাঁদ ও তাঁর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বন্ধুরা। নানা জায়গায় বক্তৃতা দেওয়া থেকে ৭ ডিসেম্বর ১৮৫৬-য় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নর বিয়ে অব্দি— সর্বত্রই ছিল ইয়ং বেঙ্গলের উজ্জ্বল উপস্থিতি।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে দেখা উচিত সার্বিকভাবে। ১৮৩৯ থেকে ১৮৫৬ অব্দি অক্লান্তভাবে লড়াই চালিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি। সব ব্যাপারে একমত না-হলেও এঁরা সকলেই প্রগতিশীল— পিছিয়ে-পড়া সমাজব্যবস্থাকে পাল্টাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বলা বাহুল্য, এঁরা ছিলেন নিতান্ত সংখ্যালঘু। প্রতিকূল আর্থ-রাজনৈতিক পরিবেশে এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সেইজন্যে তাঁদের চিন্তাভাবনা আর কাজকর্ম তৎকালীন সমাজে রাতারাতি বৈপ্লবিক অদলবদল ঘটাতে পারেনি। বেশ কিছুদিন ধরে ইয়ং বেঙ্গল আর বিদ্যাসাগরের কীর্তিকে শেষ বিচারে ব্যর্থ বলে দেখানো হচ্ছে ঐতিহাসিক মহলে। অথচ এই সহজ কথাটা অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন যে, বেশিরভাগের মানসিকতা প্রগতিশীল হলে এমনিতেই সতীদাহ বন্ধ আর বিধবাবিবাহ চালু থাকত— আইনের দরকারই পড়ত না। আজও যখন মোটের ওপর পরিস্থিতি খুবই হতাশজনক তখন দেড়শো-দুশো বছর আগের বাঙালি সমাজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।


[1] Pearychand Mittra, ’Marriage of Hindu Widows’, Selected English Writings, Bangiya Sahitya Parishat, 2015, p.356 দ্র.।
[2] Gautam Chattopadhyay, ed. Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century (Selected Documents), Progressive Publishers, pp.194-95 দ্র.।
[3] Gautam Chattopadhyay, p.104 দ্র.।
[4] Gautam Chattopadhyay, Introduction, p. xl দ্র.।
[5] বিনয় ঘোষ, সম্পা. ও সং,সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, খণ্ড ৩, বীক্ষণ, ১৯৬০, পৃ. ৭৭-৮০।
[6] বিনয় ঘোষ, সম্পা., পৃ.৮০।
[7] বিনয় ঘোষ, সম্পা., পৃ. ৯১।
[8] শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স, ২০০১, পৃ. ১১০ দ্র.।
[9] বিনয় ঘোষ, সম্পা., পৃ. ৯১।
[10] বিনয় ঘোষ, সম্পা., পৃ. ১৩০।
[11] বিনয় ঘোষ, সম্পা., পৃ. ৫৩১-৩২ দ্র.।
[12] বিনয় ঘোষ, সম্পা., পৃ. ৫৩৫-৪১ দ্র.।
[13] শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১২৯৮ ব., পৃ. ৮২ দ্র.।
[14] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাল্যবিবাহের দোষ, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, খণ্ড ২, সম্পা. গোপাল হালদার, পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, ১৯৭৪, পৃ.৩-৯ দ্র.।
[15] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পৃ. ২১।
[16] এ বিষয় বিস্তৃত জানার জন্যে, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১, পৃ. ৫১-৬৬ দ্র.।
[17] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৩।
[18] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পৃ.২৬।
[19] এ ব্যাপারে চমৎকার আলোচনার জন্যে, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, পৃ. ৩৭-৪৩ দ্র.।
[20] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৬-২৭।
[21] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৫৫।
[22] রামমোহন রায়, রামমোহন রচনাবলী, হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৩, পৃ. ১৬৯-৭৫ দ্র.।
[23] Pearychand Mittra, ’Marriage of Hindu Widows’, pp. 347-65 দ্র.।
[24] বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৯৯, পৃ. ২৬১-৬৩ দ্র.।
[25] চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, কলেজ স্ট্রীট পাবলিকেশন, ১৩০২ ব., পৃ. ৩০০; বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৭৭ দ্র.।

 

*হেডার এবং ভেতরের ছবিটি Drawing Academy: YouTube থেকে গৃহীত