শতাব্দী দাশ
লেখক প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, শিক্ষক ও সমাজকর্মী
বিদ্যাসাগর মূর্তি-ভাঙার প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন ঘটনাচক্রে তাঁর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকীতেই।
তবু সে দুর্ঘটনা তাঁর দর্শন ও ভাবধারার পুনরালোচনার সুযোগ যদি করে দেয়, তা মন্দ নয়। মনে রাখতে হবে, ইতোপূর্বে মূর্তি ভাঙার কাজটি অন্য শিবিরের দ্বারাও সাধিত হয়েছে৷ ২০১৯ সালের ঘটনাটির পিছনে তাত্ত্বিক প্রস্তুতি ছিল কিনা বলা যায় না, তা স্রেফ গুণ্ডামিও হতে পারে। কিন্তু অতীতে মূর্তি ভাঙা হয়েছিল মতাদর্শ মেনেই। অর্থাৎ আলোচ্য ব্যক্তিটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না কখনই। বরং বলা যায়, চিরকালই ছিলেন ‘আউটসাইডার’। আউটসাইডার সেই বীরসিংহেও, যেখানে শেষ বয়সে আর ফেরেননি। কলকাতাতেও, যেখানে ইট-পাটকেল-হত্যার হুমকি বিস্তর পেয়েছেন। আবার কর্মটাঁড়েও, যেখানে শেষ বয়সে আশ্রয় নিলেন। একইভাবে, একদিকে আরএসএস তাঁকে ধ্বংস করে বিবেকানন্দকে উদযাপন করতে যাওয়ার পথে। আবার বামপন্থী তাঁর ‘ব্রিটিশ-তোষণের’ নিন্দা করে। উভয় শিবিরেই তিনি ‘আউটসাইডার’ থাকেন, যতক্ষণ না ব্যবহৃত হচ্ছেন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রয়োজনে।
বর্তমান লেখার উপজীব্য বিদ্যাসাগরের নারীমুক্তি প্রকল্প। বলা বাহুল্য, এই ক্ষেত্রটিতেও বিদ্যাসাগরকে একইভাবে সাদাকালোয় বর্ণনা করা যায় না, বরং বিশ্লেষণ করতে হয় গভীরে। ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় নবজাগরণের কালে নারীদের উন্নতিকল্পে সাবিত্রী ফুলে বা রমাবাঈ-এর মতো নারীদের যে অবদান অনালোচিত ছিল, বর্তমান নারীবাদী চর্চায় তা অন্বেষণ করাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাছাড়া পুরুষদেরও যে ভূমিকা ছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ তাঁরা মেয়েদের যে চোখে দেখতেন, যে পদ্ধতিতে মেয়েদের অগ্রগতির চেষ্টা করেছেন, তা নিয়ে সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁদের উদ্যোগ ও অবদানের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিদ্যাসাগর তেমনই এক ব্যতিক্রমী পুরুষ।
তাঁর সমাজসংস্কারের সব প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু ব্যর্থতা ও ভ্রান্তি সত্ত্বেও চেষ্টা তিনি করেছিলেন৷ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি, ঔপনিবেশিক সমাজ ও হিন্দুধর্ম যে সীমানাগুলি টেনে দিয়েছিল, সেগুলিকে স্মরণে রেখেই তাঁর কাজের বিচার হওয়া উচিত। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নারীসমাজের জন্য কোনও কাজ করতে গেলে যে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হত আর যে যে উপায়ে তাদের অতিক্রম করতে হত, তার থেকে আজকের প্রতিবন্ধকতা ও তাকে অতিক্রম করার উপায় আলাদা৷ অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রচেষ্টা সেই অনুযায়ী নিজেকে আকার দিয়েছে।
বাল্যবিবাহ
বিদ্যাসাগরের কথা বললেই একে একে এসে পড়ে বিধবাবিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রথম সমাজ-সংস্কারমূলক প্রবন্ধটি হল ‘বাল্যবিবাহের দোষ’৷ সেখানে স্পষ্টভাবেই বলছেন, শাস্ত্র ও সামাজিক বিধি দ্বারা আবদ্ধ হয়ে বাল্যবিবাহের মাধ্যমে বালিকাদের চিরস্থায়ী দুর্ভাগ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি ভবিষ্যতের ‘মায়েদের’ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার কথাও তোলেন। বলেন, অকালবৈধব্যর সম্ভাবনাও বাল্যবিবাহের ফলেই বাড়ে। বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই দাম্পত্যসুখ পেতে চাইলেও নারীকে পূর্ণবয়স্ক হতে হবে। বাল্যবিবাহের ফলেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গভীর হতে পারে না৷ বাল্যবিবাহ সম্পর্কে এভাবে যখন তিনি লিখছেন, তখন শাস্ত্রকে স্মরণ করতে হচ্ছে না, যেমনটা করতে হয়েছিল বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিক্রমই সাজাচ্ছেন।
বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আইন তিনি করতে পারেননি। হিন্দুসমাজ এককাট্টা হয়ে আটকে দিয়েছে তাঁকে। বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্রী প্রভাবতীকে খুব ভালোবাসতেন। ১৮৬৫ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে সে মারা যায়। তার মৃত্যুতে শোকাহত বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন: ‘‘…বোধহয়, যদি এই নৃশংস নরলোকে অধিকদিন থাকিলে, উত্তরকালে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ অপরিহার্য, ইহা নিশ্চিত বুঝিতে পারিয়াছিলে।” বাল্যবিবাহ, বাল্যবৈধব্য ইত্যাদির হাত থেকে মরে বেঁচে গেল তিন বছরের স্নেহের পুতুল, এমনই নিশ্চয় ভাবছিলেন বিদ্যাসাগর। নিজের পঞ্চান্ন বছর বয়সী শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে পনেরো বছরের বালিকাকে বিবাহ করতে দেখে বলেছিলেন, “এ জন্মে আর মুখও দেখব না আপনার।” সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বাল্যবিবাহ তিনি আন্তরিকভাবেই ঘৃণা করতেন। তার মধ্যে মাধুর্য দেখতে পাওয়ার মতো রক্ষণশীল চোখ তাঁর ছিল না! ‘এজ অফ কন্সেন্ট’ আইন শেষ পর্যন্ত চালু হয়েছিল ১৮৯১ সালে, বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর চার মাস আগে৷ যাঁদের উদ্যোগে তা হয়েছিল, তাঁরা রামমোহন বা ঈশ্বরচন্দ্রেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন, বলাই বাহুল্য।
বিধবাবিবাহ নামক প্রকল্প
বিধবাবিবাহ প্রচলন সম্ভবত বিদ্যাসাগরের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও অপেক্ষাকৃত সফল প্রোজেক্ট৷ বিধবাবিবাহ সম্পর্কে প্রথম লেখাটি লেখেন ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে৷ ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’— এই নামেই তা প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়৷ প্রথম পর্বটির পর শহর কলকাতা থেকে পেয়েছিলেন প্রচুর তিরস্কার, অপমান, বিদ্রুপ৷ প্যামফ্লেটে ছেয়ে গেছিল শহর৷ সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ আসছিল সংস্কৃত পণ্ডিত মহল থেকে৷ ১৮৫৫ সালে যখন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্ব লেখেন, তখন নিজের বক্তব্যের সপক্ষে আরও বেশি শাস্ত্রীয় ব্যখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে যে উদ্ধৃতি বের করেন খুঁজে, তা হল—
নষ্টে মৃতেবপ্রবজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চিস্বাপৎসু নারীনাং পতিরন্যো বিধীয়তে
অক্ষয়কুমার দত্ত বা রাজেন্দ্রলালরা তো শাস্ত্রমুখাপেক্ষী হননি। অন্যদিকে ইয়ং বেঙ্গল বলছিল, নারীপুরুষের সমানাধিকারের কথা: বিপত্নীক বিবাহ করলে বিধবা কেন নয়? তাহলে সমকালের তুলনায় বিদ্যাসাগর কি পিছিয়ে ছিলেন?
অথচ ইংরেজরা যখন সিলেবাস প্রণয়ন বিষয়ে তাঁর পরামর্শ চেয়েছিল, জানতে চেয়েছিল, ভারতীয় দর্শনের কিছু বই ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো যায় কিনা, বিদ্যাসাগরের সাফ উত্তর দিয়েছিলেন, “There is nothing substantial in them”। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকে যে ধরনের সমাজসংস্কারের প্রয়োজন তিনি অনুভব করছিলেন, তা দর্শনের ক্লাসে বেদ-বেদান্ত পড়িয়ে সম্ভব হবে না, তা তিনি বলেছিলেন। তাহলে একই ব্যক্তি বিধবাবিবাহের সমর্থন জোগাড় করতে বাতির তেল পুড়িতে শাস্ত্র খুঁজতে গেলেন কেন?
১৮৫৬ সালের আগে বিধবাদের অবস্থা ছিল দুর্বিষহ। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রায়ই প্রকাশ করত, বিধবাবিবাহ প্রথার অনুপস্থিতিতে কীভাবে বিধবারা বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। ‘বিদ্যাদর্শন’ প্রকাশ করেছিল কলকাতার এক বিধবার চিঠি। সেখানে নিজেকে কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা বলে পরিচয় দেওয়া এক বেশ্যা বলেন, বেশ্যালয়ে এসে তিনি তাঁর গ্রামের আরও জনা কুড়ি বিধবার দেখা নাকি পেয়েছিলেন। যে জগদুর্লভ চৌধুরির বাড়িতে কলকাতায় এসে বালক বিদ্যাসাগর ঠাঁই পেয়েছিলেন, তাঁর বিধবা বোন রায়মণির ক্লেশের জীবনও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল৷
অন্যদিকে বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টাও চলছিল নানা ব্যক্তিগত স্তরে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ঢাকার বিক্রমপুরের রাজা রাজবল্লভ নিজের বিধবা কন্যার বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তার সভাপণ্ডিতরা তা ভেস্তে দেন।
শ্যামাচরণ দাস নামে এক বিত্তবান কামারের বিধবা মেয়ের বিবাহ দিতে প্রথমে সম্মত হয়েও, পরে পিছিয়ে আসেন পুরোহিতরা৷ মতিলাল শীল পুরস্কার ঘোষণা করেন বিধবাবিবাহের জন্য। মহারাষ্ট্র ও মাদ্রাজেও এরকম কিছু বিচ্ছিন্ন ও ব্যর্থ উদ্যোগ দেখা যায়।
১৮৪২ সালেই ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ আভাস দেয়, ‘পরাশর সংহিতা’-য় এমন কিছু থাকতে পারে যাতে বিধবাবিবাহের বিধিনিষেধকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। বিদ্যাসাগর আশার আলো দেখেন। অর্থাৎ কৌশলগতভাবে শাস্ত্রবাগীশদের বিরুদ্ধে শাস্ত্রকেই ব্যবহার করা যেতে পারে কি? বিদ্যাসাগর বললেন, শাস্ত্রের প্রকৃত অর্থের প্রতি অবজ্ঞা ও শাস্ত্রের বহিঃরূপের প্রতি অত্যধিক মনোযোগই জাতির অবনতির কারণ৷ ‘A total disregard of the shastras and a careful observance of mere usages and external forms is the source of the irreversible stream of vice which overflows the country’. (Proceedings which led to the passing of Act Fifteen of 1856, Bombay, 1885, Collection of Proceeding.)
বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমেই বিধবাবিবাহ প্রচলন করতে চাইলেন, যদিও তিনি জানতেন যে সিভিল আইন পাশ না হলে তা অসম্ভব৷ বিদ্যাসাগর প্রথমত সরকারকে প্রায় হাজার সই-সম্বলিত পিটিশন পাঠালেন। আইনসভায় বিদ্যাসাগরের প্রভূত প্রশংসা করলেন কোলভিল সাহেব৷ এরপর পক্ষে ও বিপক্ষে প্রচুর সই ও বিবৃতি আসতে লাগল৷ বিপক্ষেই বেশি, প্রায় ৫৬ হাজার মতো সই৷ কলকাতার রাধাকান্ত দেবই জোগাড় করেছিলেন ৩৭ হাজার সই৷ আর বিধবাবিবাহের পক্ষে সারা ভারত থেকে বিবৃতি এল মোটে ৫০০ মতো৷
শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ আইন-প্রণেতারা স্বাভাবিকভাবেই শাস্ত্রীয় ব্যখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাননি৷ সিলেক্ট কমিটি জানাচ্ছে— ‘This bill does not determine the question of interpretation of the Shastras, and is not founded upon the assumption that either the one or the other represents the orthodox doctrine.The Bill is founded on the principle of those who believe that widows may properly marry again, and ought not to be prohibited from so doing.’
ইয়ং বেঙ্গল কিন্তু শাস্ত্রমতে বিবাহের চেয়ে আইনমতে রেজিস্ট্রি বিবাহকেই সুপারিশ করেছিল বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাদের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন হিন্দু শাস্ত্রমতে। সিলেক্ট কমিটি এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবেই আস্থা রাখে। কারণ: ‘The class for whose relief this Bill is intended to provide are sincere, and in their own view, orthodox hindus. They would consider no marriage as made in accordance with their own law, and as therefore moral, which was not made according to their own rites.’
অর্থাৎ, তারা বুঝেছিল, বিদ্যাসাগর যে সামাজিক শ্রেণির বিধবারদের বিয়ে দিতে চাইছেন, তারা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করতে চাইবে না৷
উল্লেখ্য, বিদ্যাসাগর ভারতের প্রথম বিধবাবিবাহটি দেননি কিন্তু। প্রথম বিধবাবিবাহ নিজেই করেছিলেন ইয়ং বেঙ্গলের দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। বর্ধমানের রাজার বিধবা বসন্তকুমারীকে৷ অর্থাৎ ইয়ং বেঙ্গল যে সামাজিক স্তরে ওঠাবসা করে, তাতে তারা বিধবাবিবাহ করে ফেলতেই পারে, আইনপ্রণয়ন ছাড়াই। দক্ষিণারঞ্জনের বিবাহই তার প্রমাণ। কিন্তু বিদ্যাসাগর সাধারণ, দুঃস্থ বিধবাদের বিবাহ চাইছিলেন। আইনের গ্রহণযোগ্যতা চাইছিলেন৷ তাই তাঁর পথ ভিন্ন। র্যাডিকাল নয়, কিন্তু জনমুখী।
১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে এই বিল পাশ হয়৷ প্রথম যে বিবাহটি হল, তাতেই যথেষ্ট গোল বাধল। শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিধবাবিবাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পিছু হঠলেন মায়ের চাপে৷ এমতাবস্থায় বিধবাবিবাহের সমর্থক ও বিরোধী, উভয় দলই তৎপর হয়ে উঠল৷ রাধাকান্ত দেব একদিকে বিল খারিজ করার আর্জি জানিয়ে আইনসভায় আবারও পিটিশন পাঠালেন। বললেন, যদি বা এক-দুজন দরিদ্র বিধবা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণে রাজিও হন, তবুও পুরুষেরা যে বিধবা বিবাহে অরাজি, তা তো দেখাই যাচ্ছে। অন্যদিকে বিধবাবিবাহের সমর্থকদের কারও কারও উৎসাহে বিধবা কন্যা সুপ্রিম কোর্টে শ্রীশচন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও শোনা গেল। কিন্তু ঘটনাচক্রে শ্রীশচন্দ্র কথা রাখলেন। মাকে রাজি করালেন। ভাইরাও রাজি হলেন।
বিয়ে হয়েছিল ছিল পুলিশি প্রহরায়। দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল প্রায় সওয়া দুশো বছর আগে অনুষ্ঠিত সেই বিয়েতে। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকল, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য, রামধন তর্কবাগীশের পুত্র ও বিদ্যাসাগরের বন্ধু, প্রথম বিধবাবিবাহের বর। কনে কালীমতি, বয়স মাত্র দশ, ব্রহ্মানন্দ মুখার্জি ও লছমনি দেবীর কন্যা। তার প্রথম বিয়ে হয়েছিল চার বছর বয়সে। ছয় বছর বয়সে সে বিধবা হয়। ১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর উত্তর কলকাতার ১২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট (এখন ৪৮ কৈলাশ বোস স্ট্রিট) ঠিকানায় বিয়েটি হয়। বাড়িটি বিদ্যাসাগরের সুহৃদ ও সমর্থক রাজকৃষ্ণ ব্যানার্জির। সেখনে কনে আশ্রয় নিয়েছিল তার আত্মীয় সমেত। শ্রীশচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন৷ সুকিয়া স্ট্রিটে সেদিন ভিড় উপচে পড়েছিল ঐতিহাসিক বরকে দেখতে। বর কলকাতায় এসে উঠেছিলেন রামগোপাল ঘোষের বাড়িতে৷
কালীমতি অবশ্য বেশিদিন বাঁচেনি এরপরেও। বিবাহ তাকে বাঁচায়নি। শ্রীশচন্দ্র পরে প্রায়শ্চিত্ত করে জাতে ওঠেন।
বিদ্যাসাগরের সমকাল
বিদ্যাসাগর অপমানের শিকার তো হলেন বটেই রাস্তাঘাটে, খুনের হুমকিও এল। গ্রামের বাড়ি থেকে বাবা পালোয়ান পাঠিয়েছিলেন ছেলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে। তিনি যখন একের পর এক বিধবাবিবাহের জন্য পাত্র ও অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন আরেক ঈশ্বর, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত স্থূল কবিতা লিখছেন—
বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল
বিধবার বিয়ে হবে‚ বাজিয়াছে ঢোল।
আর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’-এ সূর্যমুখী তার পত্রে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় কে না কি বড় পন্ডিত’-কে গালমন্দ করছে, বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য। একবার কোনও এক সভায় বঙ্কিমকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে খানিক রসিকতাই করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বিধবা মেয়েদের সাদা থান পরে, আধপেটা খেয়ে থাকার মধ্যে বিবেকানন্দও দেখেছিলেন অপরিসীম সৌন্দর্য ও সহিষ্ণুতা। শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ হলেও বিদ্যাসাগর তা দেখতে অপারগ ছিলেন। আবার প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রাধানাথ শিকদার, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখরা বিদ্যাসাগরকে সমর্থনও করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের মাথায় তখন রোখ চেপেছে। ভাই শম্ভুচন্দ্রকে চিঠিতে লিখছেন, বিধবাবিবাহকেই জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ মনে করছেন।
কলকাতা শুধু নয়, গ্রামাঞ্চলেও বিধবাবিবাহ হতে লাগল। বিদ্যাসাগর চিরকালই বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী। কিন্তু ৬০টি বিবাহ দিতে তাঁর খরচ হয়েছিল ৮২০০০ টাকা, শোনা যায়। অর্থাৎ, এই ধরনের বিবাহে উচ্চ পণ দেওয়া আবশ্যক ছিল। বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় বিয়ে হলে বধূ অনেক গহনা পাবে, এই লোভে অনেকেই বিধবার বিবাহ দিতে চেয়েছেন বা বিধবাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন৷
অন্যদিকে বিধবাবিবাহ যে পরিবারগুলিতে ঘটছিল, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাঁকে নিতে হচ্ছিল বৈকি৷ এমনকি বিধবাবিবাহের পরও বউকে ছেড়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে বিদ্যাসাগরের থেকে টাকা নেওয়া হত শোনা যায়। কিছু ক্ষেত্রে বহুবিবাহের ঘটনাও ঘটতে শুরু করল৷ বিদ্যাসাগর বাধ্য হয়ে হলফনামা নিতে লাগলেন বরের থেকে যে বিয়েটি যেকোনও অবস্থাতেই করবেন এবং বউকে ছেড়ে যাবেন না। সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টের মধ্যে বিধবাবিবাহ-কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা এইবার অনুভব করলেন তিনিও৷ সেই সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট এল ১৮৭২ সালে।
উচ্চশিক্ষিত হিন্দু ও ব্রাহ্ম, দুপক্ষেরই অনেকে কথা দিয়েছিলেন বিধবাবিবাহ আন্দোলনে এবং কিছু কিছু পরিচিত বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রচেষ্টায় টাকাপয়সা দিয়ে এবং অন্য নানাভাবে সাহায্য করবেন। কাজে নেমে ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন, তাদের টিকিটিও নজরে আসছে না। ব্যক্তিগত চিঠিতে দু-একজনকে অনুযোগ করেছেন, তাঁদের কথায় ভরসা করে তিনি ধারবাকি করে ফেলেছেন, অথচ, তাঁরা যে দেবেন না, তাও জানালেন না। বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল কোনও বিধবাকে বিয়ে করবেন বলে বিদ্যাসাগরের থেকে হাত পেতে প্রচুর আর্থিক সাহায্য নিয়েছেন, অন্যান্য সুযোগসুবিধা আদায় করেছেন, কিন্তু তারপর বিয়ের সময় ঘনিয়ে এলে বাবা-মা-আত্মীয়-পরিজনের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে গেছেন, টাকা ফেরত না দিয়েই।
বিধবাবিবাহ সংঘটিত করতে গিয়ে বারবার প্রতারিত হয়ে পরম সুহৃদ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি লিখছেন, “আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।”
ঈশ্বরচন্দ্রের সাধের প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা
বিধবাবিবাহ আইনের কী কী সীমাবদ্ধতা ছিল? এই আইনে কিন্তু স্পষ্ট বলা হয়েছিল, বিধবাদের বিবাহ হলে পূর্ব-স্বামীর সম্পত্তিতে সব অধিকার তাঁরা হারাবেন৷ ফলে মধ্যবিত্তের সম্পদের মালিকানা বিষয়ক পিতৃতান্ত্রিক নীতিকে এই বিধবাবিবাহ আইন কোনওভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি৷ ১৮৮৫ সালে এমজি রানাডে বলেন, বিধবার মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার থাকা উচিত তার দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও৷
বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিধবাদের স্বনির্ভরতার উপরেও জোর দেয়নি৷ পণপ্রথা ছাড়া বাবুসমাজে তাকে প্রতিষ্ঠা করাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব হত৷ ‘সোমপ্রকাশ’ কাগজ জানিয়েছিল, বালবিধবাদের বিবাহের হিল্লে এর মাধ্যমে হলেও, পরিণত বয়সে যাঁরা বিধবা হয়েছেন, তাঁদের দ্বিতীয় বিবাহ দেওয়ার আগ্রহ দেখা যায়নি এই আইনের পরে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিধবাদের মধ্যে অবশ্যই তার কিছু সুফল ছিল৷
বিধবাবিবাহের ফলে সামাজিক ব্যভিচার কমেছিল কি?
সংবাদপত্রে বিধবাবিবাহের সংবাদ যত না ছিল, তার তিনগুণ ছিল বিধবার ‘কিস্সা’। “শুনা গেল রাজাবাড়ী স্টেশনের অন্তর্গত রাউৎভোগ গ্রামে একটি সামান্য জাতীয়া বিধবার গর্ভ হওয়াতে সমাজভয়ে উহার আত্মীয়গণ ঔষধ প্রয়োগবশতঃ তাহা নষ্ট করে।… বিধবা বিবাহ না দেওয়ার এই বিষম ফল,” (রঙ্গপুর দিক্প্রকাশ, ২৬ নভেম্বর ১৮৬৮)। ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায় ১৮৯০-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল কোন্নগরের এক বিধবার দেওর দ্বারা গর্ভবতী হওয়া, মৃত কন্যা প্রসব, বারান্দায় ও শ্মশানে রোগিনীকে ফেলে রাখা ও শেষপর্যন্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় তাকে হাসপাতালে আনার আখ্যান৷ ১৮৯১-এর ১৭ এপ্রিল ‘এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্তাবহ’ পত্রিকায় এরকম একটি খবর প্রকাশিত হয়: “গিরিজাসুন্দরী নামিকা একটী বিধবা ব্রাহ্মিকার হত্যা হইয়া গিয়াছে। অম্বিকাচরণ বসু নামক এক ব্যক্তি হত্যা করা স্বীকার করিয়াছে।”
অর্থাৎ বিদ্যাসাগর যদিও বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকের ভূমিকায় লিখেছিলেন— “বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যভিচার দোষ ও ভ্রূণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিনকুলের কলঙ্ক নিরাকরণ হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক…,” কিন্তু আইন প্রণয়নের পরও এসব থামেনি। আইন প্রণয়নের থেকেও কঠিন সমাজমানসের সংস্কার সাধন৷
দুটি বিশেষ বিবাহ
দুটি বিধবাবিবাহের কথা না বললে বিদ্যাসাগর ও বিধবাবিবাহের গল্প অসম্পূর্ণ থাকে। এক, তাঁর নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের বিবাহ। দুই, তাঁর গ্রামেই অনুষ্ঠিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাহ৷
পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ষোলো বছরের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিয়ে দিলেন ১১ অগস্ট ১৮৭০ সালে, নিজের পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে। পাত্রী ছিল ছেলেরই নির্বাচিত। বিদ্যাসাগরের স্ত্রী বা মা, কেউই সমর্থন করেননি এই বিয়ে। তাই বিয়ে হল মির্জাপুর স্ট্রিটে কালীচরণ ঘোষের বাড়িতে। নারায়ণের মা বা ঠাকুমা, কেউই আসেননি। নববধূকে বরণ করলেন তারানাথ তর্কবাচষ্পতির স্ত্রী। অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তখনও তিনি জানতেন না, এই পুত্রকে মাত্র দু বছরের মধ্যে ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন তিনি। এই পুত্রবিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই কার্যত পত্নীবিচ্ছেদ ঘটেছিল মানুষটির। পুত্রের প্রতি অনমনীয় মনোভাব মানতে পারেননি স্ত্রী। দীনময়ী দেবী মারা যান বিদ্যাসাগরের আগে। বিদ্যাসাগর সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে বীরসিংহে শ্রাদ্ধবাসরে যাননি।
তাঁর পিতৃভক্তি মাতৃভক্তি নিয়ে কত গল্প! বর্ষাকাল, দামোদর, সাঁতার… গুজব সন্দেহ নেই। কিন্তু বিধবাবিবাহ আইন প্রচলন ও প্রয়োগ করতে গিয়ে বাবা-মা-স্ত্রী পরিবারের প্রায় সকলের সঙ্গেই মতানৈক্য হয়েছিল। ভাই শম্ভুচন্দ্র যখন চিঠিতে লিখলেন, “পিতামাতা অসন্তুষ্ট হইতেছেন”, ঈশ্বরচন্দ্র প্রত্যুত্তর দিলেন, “আমি জ্ঞানত তাঁহাদের সুখের কোনও ব্যাঘাত ঘটাই নাই, তাঁহারা কেন আমার সুখপ্রদায়ক কর্মের ব্যাঘাত হইবেন?” বিদ্যাসাগর অটল ছিলেন। সেই অশান্তি চূড়ান্ত হল শেষে নারায়ণের বিয়ে নিয়ে।
আবার ১৮৬৯ সালে মেদিনীপুরের ক্ষীরপাই গ্রামের মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিধবা মনমোহিনীর বিয়ে স্থির হয়। এই বিয়ের খবরে গ্রামে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৬৫-তে ঠাকুরদাস কাশীযাত্রা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্রই তখন পরিবারের কর্তা। মুচিরাম ছিলেন গ্রামের হালদারদের ধর্মপুত্র। হালদারেরা একযোগে এসে দেখা করলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে, অনুরোধ করলেন, যাতে এ বিয়ে না হয়। ঈশ্বরচন্দ্র কথা দিলেন, এ বিয়ে হবে না। কেন এ অনুরোধ, আর কেনই বা বিদ্যাসাগর তা মানলেন, তা জানা যায় না। বিদ্যাসাগর মনমোহিনী ও তার মাকে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেন।
কিন্তু বর্ষার মধ্যে শেষ রাতে তাঁর ঘুম ভাঙল শাঁখের আওয়াজে। মুচিরাম ও মনমোহিনীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। এর প্রধান উদ্যোক্তা তাঁর নিজের লোকেরাই, বিশেষত দীনবন্ধু ও তাঁর পুত্র নারায়ণ।
ভোরে বিদ্যাসাগর কলকাতায় চিরতরে ফেরার উদ্যোগ নিলেন। বলেছিলেন, “আমি আমার কথা রাখতে পারলাম না। লোকের কাছে অপদস্থ হলাম। গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কখনও এ গ্রামে ফিরবো না।” এই কথাটি রেখেছিলেন। বিধবাবিবাহের রূপকার কেন এই বিশেষ বিধবাবিবাহটি নিয়ে রুষ্ট হলেন, তাও আমরা জানি না৷
বহুবিবাহ ও বিদ্যাসাগর
বহুবিবাহ রোধের চেষ্টাও করেন ঈশ্বরচন্দ্র৷ ১৮৭১ ও ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয় ‘বহুবিবাহ রদ হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ (পর্ব ১ ও ২)। এখানেও শাস্ত্রালোচনার মাধ্যমেই ঈশ্বরচন্দ্র দেখালেন যে বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। তার আগেই অবশ্য নানা পিটিশন জমা পড়েছিল বহুবিবাহের বিরুদ্ধে। ১৮৫৫ সালে একটি পিটিশন করেছিলেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং৷ তার পরের বছর বর্ধমানের রাজার পিটিশনে প্রায় একুশ হাজারজন সই করেন৷ অন্যদিকে বহুবিবাহ-লোপের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেবের পিটিশনে সই করেন মাত্র ১৬৩৮ জন৷ ১৮৬৬ সালে বাংলা গভর্নমেন্ট, গভর্মেন্ট অফ ইন্ডিয়ার নির্দেশক্রমে প্রভিনশিয়াল কাউন্সিলে বহুবিবাহ বিরোধী বিল প্রস্তাব করে। কিন্তু ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ইংরাজ সরকার ভারতীয়দের বিবাহনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে আর সহজে রাজি হল না।
অন্যদিকে, অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী মনে করতেন, শিক্ষার প্রসার ঘটলে বহুবিবাহ এমনিই লোপ পাবে৷ এই সংক্রান্ত কমিটিতে বিদ্যাসাগর ছাড়া অন্য তিন বাঙালি (সত্যশরণ ঘোষাল, রমানাথ ঠাকুর ও দিগম্বর মিত্র) সেই মতই প্রকাশ করেন৷ একমাত্র বিদ্যাসাগরই আইন করে বহুবিবাহ রদ করার প্রস্তাবে অনড় থাকেন, নোট অফ ডিসেন্ট দেন। তাঁর লেখার প্রথম পর্বে বিদ্যাসাগর বলেন, ইংরাজি শিক্ষা কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বহুবিবাহ কমিয়ে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে তার প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিটি কিন্তু বহুবিবাহ-বিরোধী শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা করেই ক্ষান্ত হননি। আইন প্রণয়নে অন্যরা পিছপা হলে তিনিই বরং নোট অফ ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সিভিল আইনের গুরুত্ব তিনি বুঝতেন।
নারীশিক্ষা ও বিদ্যাসাগর
নারীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে। তার উপর তিনি আবার বিদ্যালয় পরিদর্শক। ঝটপট তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় এবং ১০০টি বাংলা স্কুল স্থাপন করে ফেললেন। এমন এক সময়ে এসব তিনি করছেন যখন কিনা প্রবাদ ছিল, মেয়েরা লেখাপড়া করলে অল্প বয়সে বিধবা হয়। ‘সোমপ্রকাশে’ স্ত্রী শিক্ষার অন্তরায় সম্পর্কিত যে প্রবন্ধ বেরোয় ১৮৬৫ সালে, সেখানে পাঁচটি অন্তরায়ের কথা ছিল।
- পুরুষেরাই ভালোমতো শিক্ষিত নয়, তারা স্ত্রীশিক্ষার গুরুত্ব কী করে বুঝবে?
- অল্প বেতনের লোক দিয়ে শিক্ষার কাজ চলে না৷
- বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকায় বেশিদূর লেখাপড়া সম্ভব নয়।
- শ্বশুরবাড়িতে গেলে মেয়েরা লেখপড়া ভুলে যায়।
- ইউরোপের মেয়েরা হোটেলে খায়, তাদের রাঁধাবাড়া করতে হয় না। এদেশের মেয়েদের রান্নাবান্না ও গৃহকর্ম সামলে লেখাপড়া করা মুশকিল।
এইরকম পশ্চাৎপদ সমাজে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মেয়েদের স্কুল বানাতে থাকেন, কিছুটা নিজের অর্থ ব্যয় করে, কিছুটা উডের ডেসপ্যাচের বন্দোবস্ত অনুসারে পাওয়া অনুদানে।
স্কুলগুলি স্থাপিত হয় বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়া, হুগলি ইত্যাদি জেলায়। এছাড়া ১৮৪৯ সালে কলকাতায় বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ (বর্তমান বেথুন স্কুল) স্থাপন করা তো আছেই।
বেথুন সাহেব যখন স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের নানা চেষ্টা করে বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তখন বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁকে সাহায্য করেন৷ বিদ্যাসাগর সেই স্কুলের অবৈতনিক সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন৷ মদনমোহন তাঁর দুই কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে প্রথম দিনই ভর্তি করান ও কিছুদিন পাঠদানের দায়িত্ব নেন৷ মদনমোহন গোঁড়া পণ্ডিতদের দ্বারা গ্রামচ্যুত হন এ কারণে৷
এখানে আবার সেই শাস্ত্রের আশ্রয় নেওয়ার প্রসঙ্গটি আসবে। ঘোড়ার গাড়ি বা পালকিতে চেপে ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসত৷ বাস্তববাদী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিদ্যাসাগরের পরামর্শে সেই গাড়ি বা পালকির গায়ে খোদাই করে দেওয়া হয়েছিল মহানির্বাণতন্ত্রের মন্ত্র:
কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতি যত্নতঃ
অর্থাৎ, কন্যাকেও যত্ন করে পালন করতে হবে ও শিক্ষা দিতে হবে৷ তিনি বিলক্ষণ জানতেন শাস্ত্রের দোহাই না পাড়লে ধর্মভীরু মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না।
নারীশিক্ষায় আরেক বড় অন্তরায় ছিল, এদেশীয় শিক্ষিকার অভাব। শিক্ষানুরাগী মিস মেরি কার্পেন্টার এদেশে আসেন ১৮৬৬ সালের শেষ দিকে। লন্ডনে এই মিস কার্পেন্টারের বাবার কাছে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। মেরি এ দেশের স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে খুবই আগ্রহী। বেথুন স্কুলে পরিচয় হল বিদ্যাসাগরের সঙ্গে। বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখতে লাগলেন তিনি।
এই মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে একটি বিষয়ে বিদ্যাসাগরের মতপার্থক্য দেখা যায়। মিস কার্পেন্টার এদেশীয় শিক্ষিকা গড়ে তোলার জন্য বেথুন স্কুলে একটি নর্মাল স্কুল তৈরির চেষ্টা করতে লাগলেন৷ তখন একটি পত্রে বিদ্যাসাগর ছোটলাট উইলিয়াম গ্রে-কে লিখলেন, মিস কার্পেন্টারের পথ বাস্তবোচিত নয়। ছোট বালিকাদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে যে জাতির এত আপত্তি, তারা পরিণত বিবাহিতাদের শিক্ষিকা হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করতে পাঠাবে না। বিধবাদের অবশ্য এই কাজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাড়ির বাইরে পা রাখলে তারা আবার কলঙ্কিত হবে, একঘরে হবে ও তাদের সমাজে টেকা মুশকিল হবে৷ আজকের দিনে বিদ্যাসাগরের এই মতও অপ্রগতিশীল মনে হবে। বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার সমর্থক, অথচ নারীর পেশা নির্বাচন চাইছেন না?
যাইহোক, ‘ফিমেল নর্মাল স্কুল’ তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ কিন্তু কয়েকবছর চলার পর দেখা যায়, বাস্তববোধ বিদ্যাসাগরের প্রগাঢ়। আগ্রহী শিক্ষিকা এল কই? শিক্ষিকা-শিক্ষণের এই স্কুল পরে তুলে দেওয়া হয় অগত্যা।
সমালোচনা হতে পারে আরও নানারকম। বিদ্যাসাগর নিজের স্ত্রীর শিক্ষালাভের চেষ্টা করেননি কেন? তাঁর কন্যারা শিক্ষার আলো পেলেন না কেন? প্রত্যক্ষ কারণ ছিল তাঁর পিতা ঠাকুরদাসের অমত। অবশ্য শুধু কন্যাদের নয়, পুত্র নারায়ণেরও সঠিক শিক্ষালাভ হয়নি ঠাকুরদাসের অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে।
আচ্ছা কালীমতিকেই বা আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য তৎপর হলেন কেন? দশমবর্ষীয়া কালীমতি স্কুলে গেল না কেন?
যে বিদ্যাসাগর নারীর দুঃখকষ্টে সমব্যথী ছিলেন, দুঃখ মোচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনিই আবার নাট্যমঞ্চে মেয়েদের অভিনয়ের বিরোধিতা করেন চরমভাবে।
উনিশ শতকীয় দ্বন্দ্বের এমনই ছবি।
নিজের পরিবারের নারীদের শিক্ষিত না করতে পারলেও, শিক্ষাভিলাষী নারীর প্রতি তাঁর ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন ছিলই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৮৬ সালে শ্রীমতী চন্দ্রমুখী বসু প্রথম এমএ পাশ করেন। বিদ্যাসাগর তখন তাঁকে একটি সচিত্র শেক্সপীয়র সমগ্র উপহার দিয়েছিলেন। স্বহস্তে লিখেছিলেন,
To Srimati Chandramukhi Basu, The First Bengali Lady who has obtained the Degree of Master of Arts of the Calcutta University from her sincere well-wisher Iswar Chandra Sarma.
কর্মটাঁড়ে, বর্তমান ঝাড়খণ্ডে, তিনি যে মেয়েদের স্কুল তৈরি করেন আদিবাসী বালিকাদের জন্য প্রথম স্কুলও সম্ভবত সেটিই।
আজকের নারীবাদে ঈশ্বরচন্দ্র
আউটসাইডার এই মানুষটিকে বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন বা নারীশিক্ষার প্রসারে সদর্থক ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞচিত্তে মনে রাখবে আজকের নারীবাদী, সব সমালোচনা সত্ত্বেও। সেই যে তাঁর কথায় কথায় শাস্ত্র টেনে আনার প্রবণতা, তাকেই বা কী চোখে দেখব? বিদ্যাসাগর দেখিয়েছিলেন, তর্কে পরাস্ত করতে গেলে প্রতিপক্ষের পছন্দের শাস্ত্রকেই অবলম্বন করা যায়৷ হিন্দু শাস্ত্রে ‘না’ বলা থাকলে তিনি কি বিধবাদের বিবাহ অনুচিত মনে করতেন? না। বহুবিবাহের বিপক্ষে শ্লোক খুঁজে না পেলে কি বহুবিবাহ উচিত মনে করতেন? না। শাস্ত্র অনুমতি না দিলে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাতেন না? না।
তা সত্ত্বেও হিন্দুশাস্ত্রের দ্বারস্থ তিনি হয়েছেন বারবার, যাতে সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টাগুলি এই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ হয়নি, কিন্তু হয়েছিল ধীরে ধীরে৷ কৌশলগত দিক থেকে তাই তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। বিদ্যাসাগর হিন্দুশাস্ত্র অনুসরণ করেন না, তাকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করেন৷ তাই বিজেপি-অধ্যুষিত ভারতে তিনি নতুন করে ভাবান। তিনি অ্যাক্টিভিজমের এক জনমুখী রূপ, যা থেকে বিচ্যুত হওয়ার একটা প্রবণতা মেধাগত উচ্চম্মন্যতার আছে। তাঁর এই অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনের কৌশল, এই বিকেন্দ্রীকরণ ও এই জনমুখিতা— এই তিনে মিলে তাঁর প্রতিরোধের নিজস্ব আঙ্গিক, যা নিয়ে পুনরালোচনার এটাই উপযুক্ত সময়।
ঋণস্বীকার:
- বিদ্যাসাগর রচনা সমগ্র
- Vidyasagar and his Elusive Milestones: অশোক সেন
- করুণাসাগর বিদ্যাসাগর: ইন্দ্র মিত্র
হেডার ছবি:
- Drawing Academy: YouTube