সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
[সাধারণ সজ্জার একটা ঘর। একটা বইয়ের র্যাক এক কোণে রাখা। বইর্যাকের পাশেই একটা ছোট টেবিলে রাখা রয়েছে টেলিফোন। দেওয়াল জুড়ে কিছু হাতে আঁকা রঙিন ছবি আর একটা ক্যালেন্ডার টাঙানো।]
ধুস! গরমের ছুটির দিনগুলোতে এভাবে একা একা ঘরবন্দি হয়ে থাকতে একদম ভালো লাগে না। রোজই একরকম রুটিন— হয় টিভি খুলে বসে পড়া, না হয় কম্পিউটারে গেম খেলা! মা-বাবা দুজনেই ভারী দুষ্টু! আমার মত এমন টুকটুকে একটা ছেলেকে বাড়িতে একলা ফেলে রেখে রোজ অফিস চলে যেতে ওদের বুঝি এতটুকুও কষ্ট হয় না? আমার তো ওদের দুজনকে এভাবে ছেড়ে থাকতে ভারী কষ্ট হয়। ঠাম্মি যতদিন এখানে ছিলেন বেশ মজায় ছিলাম আমি। দুপুরবেলা যখন কেউ কোত্থাও নেই, একলাটি বিছানায় শুয়ে কমিকস পড়ে সময় কাটাচ্ছি, তখন পা টিপে টিপে ঠাম্মি ঘরে এসে কানের সামনে মুখ নামিয়ে কেমন ফিসফিসিয়ে বলতেন— “ও দাদুভাই, ঘুমোচ্ছিস? না ঘুমোলে উঠে আমার কাছে আয়। তোর জন্য আম আর পাকা তেঁতুলের আচার বানিয়ে রেখেছি। কেমন হয়েছে চেখে দেখবি চল।”
আমি তো আর তখন সত্যি সত্যি ঘুমোচ্ছিলাম না। ঘুমের ভান করে মটকা মেরে ঠাম্মির ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম। ডাক শুনেই বিছানা ছেড়ে দে ছুট ঠাম্মির ঘরে। ওঃ! কী দারুণ সোয়াদ আচারের! ঢাকনা খুলতেই আচারের মশলার গন্ধে সারা বাড়ি একেবারে ম-ম। আচার খেয়ে ঠাম্মির বিছানাতেই তাঁর কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়া। ঠাম্মির নরম তুলতুলে আঙুলের সুড়সুড়ি আর রূপকথার গল্পের জাদুছোঁয়ায় আমি তখন সত্যিসত্যিই ঘুমের দেশের সওয়ারি।
তা ভাবছ ঠাম্মির কাছে না গিয়ে এখন তোমাদের সাথে বকবক করছি কেন? ঠাম্মি যে এখন এখানে নেই। কাকাইয়ের বাড়ি গিয়েছে। দাদুন আকাশে তারা হয়ে যাওয়ার পর থেকে ঠাম্মি তো এখানেই ছিল। মাস কয়েক আগে এক রোববার মেঘে ঢাকা আকাশের মত মুখ করে কাকাই এল এ-বাড়িতে। বাবা-মার সাথে কত কথা হল, তারপর ঠিক হল ঠাম্মি ছ মাস এ বাড়ি আর বাকি ছ মাস কাকাইদের ওখানে থাকবে। সেই থেকেই আমি ঠাম্মি-ছাড়া। জানো, রোজ ক্যালেন্ডারের দিন গুনে গুনে হিসাব করি ঠাম্মি কবে আসবে, কবে আসবে! দাঁড়াও। তোমাদের বলছি আর কতদিন পরে ঠাম্মিকে আমার কাছে পাব আমি। ঠাম্মি ও-বাড়ি গিয়েছে গেল মাসের পাঁচ তারিখ, তার মানে… তার মানে মাত্র সাতাশ দিন হয়েছে। ছ মাস মানে একশো তিরাশি দিন। তার থেকে সাতাশ বাদ দিলে পড়ে থাকে… একশো ছাপ্পান্ন দিন! সে যে অনেক সময়! ততদিনে আমার গরমের ছুটি শেষ হয়ে যাবে। তাহলে? এই ছুটিটা এভাবেই কাটবে?
বারোটা বাজল। এক্ষুনি ড্যাড ফোন করবে। ওই যে ফোন বাজছে। টেলিপ্যাথির কেমন জোর দেখেছ! বাবা জিজ্ঞেস করবে, কী করছ? লাঞ্চ হয়ে গেছে? সব ঠিকঠাক খেয়ে নেবে। শোনো, অচেনা কেউ এলে একদম দরজা খুলবে না। আর তুমিও দরজা খুলে বাইরে যাবে না। খেয়ে একটু শুয়ে পড়ো বরং। যে টাস্কগুলো দিয়ে এসেছি সেগুলো ঠিকঠাক করো, ফেলে রাখবে না। মনে রেখো, টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েটস ফর নান। রোজ একই কথা! আচ্ছা বাবা হলেই কি আর নতুন কথা ভাবতে নেই? কেটে যাওয়া রেকর্ডের মতো সেই একই কথা! স্কুলে থাকলে বরং এই যন্ত্রণার হাত থেকে খানিকটা রেহাই মেলে। না হলে…। আরে বাবা, সেই থেকে নাগাড়ে বেজে চলেছে! কান ঝালাপালা হয়ে গেল…
হাই ড্যাড! গুড নুন! আমার লাঞ্চ হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক খেয়ে নিয়েছি। অচেনা কেউ আসেনি। দরজা বন্ধ আছে, আর আমিও দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। টাস্কগুলো এখনও করা হয়নি। তবে তুমি আসার আগেই মনে হচ্ছে করে ফেলতে পারব। তোমার অ্যাডভাইসটা মনে আছে। টাইম এন্ড টাইড ওয়েটস ফর নান। রাখছি।
উফ! আর পারছি না! (আবার ফোন বেজে ওঠে…) আবার ফোন বাজছে কেন? মম নয় তো? হ্যালো? ‘কিরে দাদুভাই, কিসব আবোলতাবোল বকছিলি! খুব রেগে আছিস মনে হচ্ছে?’
ঠাম-মি-ই-ই-ই! ঠাম্মি তুমি! (ফোনটাকে গভীর আবেশে চুমু খায় বারবার) তার মানে আগের ফোনটা তোমারই ছিল? কেমন আছ তুমি ঠাম্মি? আমাকে ছেড়ে ভালো আছ? আমি কিন্তু একদম ভালো নেই। খুশমন খুব আদর খাচ্ছে, তাই না? তিলতক্তি আর আমসত্ত্ব বানিয়েছ? আ… আ… কতদিন কাঠবিড়ালির মতো কুটুস কাটুস দাঁতে ভেঙে তোমার তৈরি তিলতক্তি খাইনি! ক-ত-দি-ন তোমার নরম আঙুলের সুড়সুড়ি পিঠে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে রাজকন্যার খোঁজে যাওয়া রাজপুত্তুরের গল্প শুনিনি! ক…ত…দি..ন! খুশমনকে একটু ফোনটা দাও না। ওর মুখ থেকে তোমার কথা শুনি। দাও না ওকে ফোনটা। এই খুশমন… কী বলছ ঠাম্মি? খুশমন বাড়িতে নেই? কাকাই, কাম্মা, খুশমন কেউ বাড়িতে নেই? কোথায় গিয়েছে? উইকেন্ড কাটাতে দীঘা? তুমি যাওনি? তার মানে আমার মত তুমিও একা! পুরো একা! ঠাম্মি, আমি যে আর এসব কথা শুনতে পারছি না! কীভাবে সময় কাটছে তোমার? এভাবে এই বয়সে… একদম একা!! আচ্ছা ঠাম্মি… একটা কথা জিজ্ঞেস করব… রাগ করবে না তো? বড় হলে যদি আমাকে বা খুশমনকে কখনও আমাদের মম বা ড্যাডকে ছমাসের জন্য অন্য কোথাও রাখতে হয়, তখন আমরা তাদের কোথায় কার কাছে রাখব? কোথায় রাখব? বলো ঠাম্মি কোথায় রাখব? চুপ করে থেকো না ঠাম্মি, বলো…