অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সে সুদর্শনা নয়, সুশ্রী বলা চলে বড়জোর। সেকালের মধ্যবিত্ত ঘরের মা-ঠাকমারা ননীর পুতুল ছেলেটার বা নাতিটার মুখ চেয়ে যেমনধারা মেয়ে পছন্দ করে আনতেন, অনেকটা সেই ধাঁচের। তাদের মতোই একজনের সঙ্গে আমার আলাপ, হ্যাঁ— ঐ ফেসবুক-নামক যন্ত্রণাটির দেওয়ালেই— মাত্রই এই মাস পাঁচ-ছয় আগেকার দুর্ঘটনা বোধহয়। কী দেখেই যে ছাই পছন্দ হল, আর কী দেখেই যে ছাই বন্ধুত্ব পাতাতে চাইলাম মনে পড়ছে না সঠিক। তবে কেবল যে মুখশ্রীর কাটাকাটা রূপ দেখেই “নয়ন ভুলেছিল” তেমনটা নয়। একটা সার্বিক আপিল— নাকি আরও কিছুই, নাঃ সে কথা বরং থাক। তার আসল যে নাম, তা যা একটা কিছু ধরে নেওয়াই যায়; আমি তার নাম দিয়েছিলাম কাঁচাসুন্দরী। এমন নাম দেওয়ার অভিপ্রায়?— আরেকটু খোলসা করেই তাহলে বলি। শুনতে শুনতে আপনারা কল্পনা করে নেবেন।
আমার বয়স ছাব্বিশ, লেখালিখির বদভ্যাস আছে ভীষণ— কাজেই যেমনতেমনটা করে প্রেমে পড়তেও পিছপা হই না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে সমস্ত প্রেম শুদ্ধ অঙ্কুরেই নির্মমভাবে বিনষ্ট হয় বলেই— হয়তো বা আজকাল “রক্তমাংসের নারীদিগের” সঙ্গে ভাব জমানোটা ভয়ানক রকমেই কঠিন বলে বোধ হতে লেগেছে। আমার লেখার তার দেখেই, হয়তো বা বুঝে গিয়েছেন— এ বয়সটাতে জল দেওয়া আছে নিঘঘাত করেই। লেখার ধরনে, লেখকের বয়স যে স্রেফ ছাব্বিশ এমনটা মানতে মন চাইছে না, ছেচল্লিশ কিংবা ছিয়াত্তর হলেও চলে যেত বোধহয়— কিন্তু তাই বলে ছাব্বিশটা একেবারেই মিথ্যাচারণ বলে মনে হতে পারে আপনাদের। তবু আশ্চর্যের কথা এটাই— যে, এ তথ্যটিকে আপনি অবিশ্বাস করলেও— তা সত্যি, গল্প বলেই সত্যি। সত্যিটাকে মেনে নিতে শিখুন।
আজকালকার মেয়েরা প্রগতিশীল হোক বা না হোক, তারা প্রগ্রেসিভ। এর সুদিক-কুদিক দুদিকই বর্তমান। তারা দুনৌকোয় পা দিয়ে চলবার চেষ্টা শানায়, ফলে হোঁচট খায়। পা টলে, নৌকো দোলে— এবং তারা হুমড়ি খায়। কাঁচাসুন্দরীর স্বভাব তেমনটা ছিল না। প্রথম আলাপেই সে অনেক কথা বলেছিল, একবার না দুবার দেখা করতেও রাজি হয়েছিল নির্দ্বিধায়। তার আচরণটা তখনও একটা অদৃশ্য লক্ষণগণ্ডির ভিতরেই টেনেটুনে বন্ধ করা থাকলেও— কপাটের ফাঁক দিয়ে রোদ-হাওয়ারও অল্প চলাচল ছিল। যখন সে আমার কোনও আলগা রসিকতায়, হেসে উঠত হঠাৎ– দুখানি গজদাঁত দেখা যেতো, আর তক্ষুণিই আমি প্রেমে পড়ে যেতাম।
আমার বন্ধু সুমিত, যাদবপুরের নব্য পিএইচডি-গবেষক। সাহিত্যে-ফিল্মে-নাট্যোৎসবে তার দোর্দন্ডপ্রতাপ বিচরণ দেখেছি। অথচ কেরিয়ারের খাতায় পথ ভুলে, সে বেছে নিয়েছে এঞ্জিনিয়রিং— তাতে অবিশ্যি তার নেশা বদলাতে পারেনি। আমার একটা লেখা বোধহয় সে সেদিন উলটিয়ে পালটিয়ে দেখছিল আমার বাড়িতেই। পড়া শেষ হলে পরে, ডায়েরীটা ছুঁড়ে ফেলে একটা কিং-মার্কা গোল্ডফ্লেক ধরিয়ে, সুখটান দিতে দিতেই সে বললে, “তোর যেমন লেখা, এমনভাবে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-আর-শরৎ চাটুজ্জেকেই আঁকড়িয়ে ধরে বসে থাক, ক্লাসিকস তো আর পড়বিনি কোনোদিন।” আমি চোখ গোলগোল করে ব্যাটাকে মাপছিলুম। সে বললে, “তুর্গেনেভ পড়েছিস? তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি? দূর দূর, এসব না পড়ে আবার কেউ সাহিত্য করে নাকি?” বুঝলুম, আমার বিপদ আসতে চলেছে। পরের দিন নিজের, নাকি সুমিতেরই কী একটা যেন বইয়ের প্রয়োজনেই কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্স কলেজের সেই সামনের ফুটপাথ— রোদ পড়ে আসা রংবেরঙের নতুন-পুরানো বই, সেই— সেইখানটাতেই যেন, সেই নিশ্চিত একটি ফাঁদ, আগে থাকতেই আমার জন্য বরাদ্দ হয়ে ছিল। ২৩৪ নং স্টল, দেবকী বলে যে ছোকরাটি বই দেয় আমায়, তাকে বলতেই কোথা থেকে যেন একখানা প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া হার্ডব্যাক বই এনে ধরিয়ে দিলে সটান। আধছেঁড়া মলাটের উপর রং জ্বলে যাওয়া শিরোনাম: ‘পুওর পিপল এন্ড আদার স্টোরিজ — নভেলস অ্যান্ড নভেলাস বাই ফিওদর দস্তয়েভস্কি’। নেশা ধরে গেল। পিটসবার্গের নয়, কলকাতার।
তা সেই কাঁচাসুন্দরীর সঙ্গেই একদিন গল্প করছিলাম, ঝড় এল ভীষণ। মোবাইলে তাকে লিখলাম, “এমন কালবৈশাখীর সময়ে কাঁচা আম কুড়ুতে যেতে ইচ্ছে হয় না তোমার?” সে বললে, “আমি গ্রামের মেয়ে, ছোটবেলা কেটেছে গ্রামেই— এসব কথা আমার কাছে গল্প নয়, বরং সত্যি— সত্যিই, সবকিছুই।” আমি বললাম, “গাছেও চড়েছ নিশ্চয়ই?” সে বললে, “বড় গাছ বাইনি তেমন, তবে তেমনটা ছোট হলে এখনও উঠে দেখাতে পারি।” বাব্বাঃ, প্রেম বটে আমাদের। বাইরে বৃষ্টি তখন, তুমুল হাওয়ায় সবকিছুই ওলটপালট— আমি তার নাম দিলাম। সেই থেকেই সে কাঁচাসুন্দরী, আমার একার— একান্তের কেউ। আমার ঠাকুর্দা তখন তাঁর তেতলার ঘরে বসে গ্রামোফোন শুনছিলেন। নিধুবাবু কি অমন কারও টপ্পাই বোধহয় চলছিল তখন… আমার কানে আসছিল সুর, “ঢল ঢল কাঁচা, অঙ্গেরও লাবণি, ঢল ঢল কাঁচা…” টুংটাং, টুংটাং… জলতরঙ্গের মতোই।
“আই নো দ্য হাউজেস অন দ্য স্ট্রিটস, আমি রাস্তার উপরের সবকটি বাড়িকেও মনে মনে চিনি। তারাও চেনে আমায়। পথ বেয়ে যখন যাই, তখন তারা আমাকে শুভেচ্ছা জানায়, প্রভাতী সম্ভাষণে সম্বোধিত করে, তারা ভালোবাসে আমায়। তারা আমার সুখদুঃখের খবর জানতে চায়।” দস্তয়েভস্কির লেখা হোয়াইট নাইটস থেকে উদ্ধৃত। ফুটপাথের ধার বেয়ে আমরা হাঁটছিলাম।
এসেছিলাম জোড়াসাঁকোয়, কুমোরটুলি যাওয়ার শখ ছিল। তাকে বললাম, “হেঁটে গেলে কেমন হয়?” সে নীরবে সম্মতি জানালে। হ্যাঁ, এ রাস্তাটির সম্পর্কেও আমি প্রায় দস্তয়েভস্কির মতোই বলে উঠবার ক্ষমতা পোষণ করি যে, “ইয়েস, আই নো দ্য হাউজেস অন দ্য স্ট্রিটস…” রাস্তার দুধারে, পুরানো কড়িকাঠ, স্কুলবাড়ি, মাড়োয়াড়ি হাসপাতাল, নবীনচন্দ্র দাশের পুরানো রসগোল্লার দোকান (যা এখন ধ্বংসস্তুপ হয়ে পড়ে আছে, পস্টারিটির অপেক্ষায়)। বড় বড় বটগাছের শেকড় গজিয়ে রয়েছে পুরানো বাড়িগুলোয়। মধ্যে মধ্যে একেকটা গঙ্গায় গিয়ে পড়বার গলি, এঁকেবেঁকে সরু হয়ে চলে যেতে পেরেছে। এসব জায়গাতেই মৃণাল সেন, অঞ্জন দত্তেরা শুটিং করে গিয়েছেন। পুরানো শহর, ঘাট, সন্দেশের ছাঁচ আর পিতলের প্রদীপের দোকান, চিৎপুর রোড— যাত্রা কোম্পানির আপিস। কাঁচাসুন্দরী আর আমার মধ্যেকার দূরত্ব খানিকটাই। আমরা কখনওই, আজ অবধিও দুজন দুজনকে স্পর্শ করবার সামান্যতম ধৃষ্টতাটুকুও দেখিয়ে উঠতে পারিনি। স্পর্শ কেবল সীমাবদ্ধ হয়ে থেকেছে স্বল্পক্ষণের করমর্দনেই। চোখে চোখ রাখাটাও তো একেকটা সময়ে কবিতার চেয়েও বাঙ্ময় হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো দস্তয়েভস্কি নির্দ্বিধায় রাশিয়ান চার্চের সমর্থনেও সরব হতে পারেন, লিখতে পারেন, “আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মস্পর্শী জিনিসটি হল— ঐ শিশুর চোখের জল, জলবিন্দুটুকুই।” পস্টারিটির অর্থ ভাবীকাল— পস্টারিটির অর্থ, চিরকালীন। কি প্রেম, ভাবা যায়।
সময়টা শীতকাল। সরস্বতীপুজোর আর কয়েকটি দিনমাত্রই বাকি ছিল বোধহয়। বাগবাজারের ঘাটটায় এসে দুজনে বসেছিলাম। কিছুদূরেই একখানি কুমোরের ঘর। কাঁচা মাটি দলে দলে মাখছে, খড় আর রঙের গন্ধে জায়গাটা ভুরভুর করে। নাকের পাটা ফুলে উঠতে চায়। গঙ্গায় জোয়ার আসবার সময় তখন। সুন্দরী আমার হাতে একখানা কাগজ ধরালে, বললে, “পড়ো, মুখে বলব না।” আমি জানতুম সে বটানির ছাত্রী হলেও, ছবি আঁকবার তার ঝোঁক আছে। মুক্তোর সমান হাতের লেখাতে সে যে অমন করে যে চিঠিও সাজাতে পারে সেটা অবিশ্যি জানা ছিল না আমার। চিঠি পড়া শেষ হতে দেখলাম, নীরবে সে বসে আছে— চোখের কোণাদুটোয় তিরতির করে জল জমে উঠে পড়ে গেছে কখন, টেরটিও পেতে দেয়নি আমায়। আমি তার হাতদুটি আমার দুই হাতে নিলাম। অল্প নরম, উষ্ণতার একটা ছোঁয়া পেলুম কোথাও। চোখে চোখ আর পড়লে না। মাথাটা সে নামিয়ে রাখলে, সঙ্কোচে, হয়তো বা গোঁড়া একটা আত্মসম্মানের উপলব্ধিতেই।
… অমিত, এই ডেমি-পস্টারিটির যুগে উপন্যাস লেখাটা অসম্ভব। কবিতাই কেবল একেকটা সময়ে টিকে থাকে, টিকে যায়— আবার যায়ও না। সংবেদনশীলেদের কাছে, আজকের এই ভার্চুয়ালিটিটা একটা পরাবাস্তবতার জন্ম দেয়, অমিত। আগেকার দিনের মেয়েদের ডায়েরির মতোই। কোথাও কোথাও যখন আমরা ধাক্কা খাই, আমরা নারী হই কি পুরুষ, আমরা একটা আড়ালের বন্ধু পেতে ইচ্ছে করি। যাকে সেই কাগজের ডায়েরিটার মতোই, নিশ্চুপে সবটুকু বলে দেওয়া যাবে। সেই নীরবতাটুকুই যে আমাদের চাহিদা, বা সেই নীরব সমর্থন, অনুকম্পা, সমবেদনা অথবা … আমি জানি না অমিত, আমি যা বলতে চাই— যা কিছু বলতে চলেছি, তুমি কি বুঝবে তা? বুঝতে কি চেষ্টা করবে যে, আমি বা হয়তো আমরা দুজনেই পুরানো দুঃখদের ভুলবার কারণেই পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের আকর্ষণ কেবল আহতের আকর্ষণ অমিত। সে ভালোবাসার জন্ম হয়েছে, তার না পাওয়ার অন্ধকার থেকেই। পাশে পাওয়ার অদম্য আদিমতা থেকেই, মনের আদিমতা— তা শরীরের নয়… অমিত, তোমার সঙ্গে আমার আলাপ পাঁচ মাসের। তার আগে থাকতেই আমার বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে খানিকটা কথাবার্তা চলছিল। তোমাকে সে কথা বলিনি তখন, কারণ তখনও আমরা কেউই বোধহয় ভেবে উঠতে পারিনি যে আমাদের ভালোবাসা হতে পারে। আমি তখন সদ্যই ব্রেক-আপ কাটিয়ে উঠেছি। কেবল একজন বন্ধুর খোঁজ পেতে চেয়েছিলুম। আর সেই তক্ষুণিই তুমি আমার জীবনে এসে হাজির হলে হঠাৎ… অমিত, আর কিছু বলবার বোধহয় মুখ নেই আমার, আর কিছু বলবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে…
সবকিছুই কি কেবল পরিণয়েই পরিণতিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে? নাকি তা হতে পারে কোনওদিন? আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মিষ্টি একটা হাওয়া দিচ্ছিল কোথাও। ফুরফুর করে আমার পাঞ্জাবিটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। আমি তার দিকে চেয়েছিলাম। পাঁচমাস পনেরোদিন পাঁচ ঘণ্টার তেড়ে সাহিত্যসুখ, খাপছাড়া যত কথা, চোখে চোখ, এলোমেলো চুল, হাতের আঙুল— এসব কি সত্যি নয়, একটুও সত্যি নয়? আমি তার দিকে চেয়ে ছিলাম। শহরের প্রতি কটা পুরানো চৌকাঠ, প্রতি কটা ফেরিওয়ালার ডাক, প্রতি কটা মোট-বওয়া ভ্যানগাড়ির উপরকার তেরপলগুলো— আমার অনেক কথাই মনে পড়ে পড়ে যাচ্ছিল। সেও আমার দিয়ে চেয়েছিল তখন। একদিন বৃষ্টিতে ভিজে-নেয়ে থরথর করে কেঁপে কেঁপে ওঠা বিধর্মী ফলওয়ালার মতোই। সে আমার চোখে চোখ রেখে চেয়েছিল। আমি তার হাতদুটি ছুঁয়ে ছিলুম। গঙ্গার বুকে পাল তুলে চলে যাওয়া বিলাসিতা এখন। তেরপলের ছাউনি দেওয়া একখানি ডিঙ্গি-নাও যেন খুব কাছ দিয়ে ভেসে গেল। আমি তার মুখের উপরটায় এসে পড়া অবাধ্য দুটি চুল হাত দিয়ে সরালাম, চোখে চোখ রেখে— নাঃ, চুমু খাওয়াটা যে চিরটাকাল বড্ডই সহজ বলে জেনেছি। আমি বললাম, “দস্তয়েভস্কি কী বলেছিলেন, সবটাই ভুলে গেলে নাকি?” তার আর কোনও জবাব পেলুম না। নটে গাছটিও মুড়োল যেন হঠাৎ, একটুও কোনও সতর্কতার অবকাশ না দিয়েই।
“একটি মুহূর্তের সুখ, একখানি সমগ্র জীবনের পক্ষেও অসীম বলে জানবেন”— হোয়াইট নাইটস, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, প্রকাশকাল: ১৮৪৮।