সৌমিত দেব
লেখক গদ্যকার, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার
[এই লেখাটির জন্যে আমায় যাবতীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন প্রথমা মুখোপাধ্যায। লেখার সঙ্গের ছবিগুলিও ওনার তোলা। ওনার সাহায্য ছাড়া এই লেখা সম্ভবপর হত না।]
এ কথা তো মোটামুটি আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ক্যামেরা আর মডেল দেখতে পাওয়া যায় পুজোর ঠিক আগের কুমোরটুলিতে। মিলান ফ্যাশন উইক কমিটি নাকি চিঠি লিখে ক্ষমাও চেয়েছেন, এত তার ব্যাপ্তি। আর তার কারুকাজ? আহা রে! প্রতিমার পাশেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিল্পী থেকে নোংরা বেড়াল, বরাভয় দেখানো হাতের মধ্যিখান দিয়ে চায়ের ভাঁড়, কে নেই প্রপস লিস্টে! ছোট্ট টিপ, হালকা ন্যাচেরাল লাইট আর ডিএসএলআর। আপনি গোটা জায়গাটার যে কোনও প্রান্তে মডেল দাঁড় করিয়ে দিন, দেড়শো শেয়ার বাঁধা! এপাশে প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা চলছে তো ওপাশে ফটোগ্রাফারের পেজপ্রতিষ্ঠা। অ্যাস্থেটিক নিজে এসে সূর্যমুখী ফুলের ইমোজি দিয়ে ‘ওয়াও’ বলে যাবে! যদিও ‘অসুবিধে’ একটাই, ছবি তুলতে গেলে আজকাল চাঁদা দিতে হয়। ভাবুন একবার! হ্যাঁ… আস্পদ্দাটা খালি ভাবুন একবার! আপনি একটা লোক যেখানে থাকে, খায়, ঘুমোয় সেখানেই নোংরা জুতো পরে ঢুকে পড়বেন, তার কাজের ব্যঘাত ঘটাবেন, তাঁকে আপনার ‘ফ্রেম’ অনুযায়ী তুলি ধরতে বলবেন, সিগারেট খেয়ে প্যাকেট ফেলবেন, জলের বোতল ফেলবেন, মাঝেমধ্যেই আনাড়ি হাতে ধরতে গিয়ে মূর্তির ক্ষতিও করে ফেলবেন, আর তারপর কিনা সেই আপনার থেকেই আবার চাঁদাও চাওয়া হবে? ধম্মে সয়? না… মানে এই জিনিস কি ধম্মের সওয়া উচিৎ? কার্মা বলে কি এই পাপী পৃথিবীতে আর কিছুই এগজিস্ট করে না রে ভাই! হ্যাঁ?
হুঁ হুঁ… অত সহজ নয়। করে, এগজিস্ট করে৷
আর তাই তো যেইদিন প্রথম জনতা কার্ফু হল পড়বি পড় সেইদিনই পড়ল অন্নপূর্ণা পুজো। প্রায় সব অর্ডার ক্যানসেল হয়ে গেল। পাঠাবারই তো পথ নেই! আর সত্যি কথা বলতে কী ভক্তি ইজ ভক্তি সেটা ঠিক কথা, কিন্তু টুপাইস যে ফাদারমাদার। আর মায়ের চাইতে বড় যে কেউ নেই সে কথা ভারতবর্ষকে দেখলেই বুঝতে পারি! তাই ফেরত চেয়ে নেওয়া হল প্রদত্ত বায়নার টাকা। শয়ে শয়ে পড়ে রইল মা অন্নপূর্ণার মূর্তি। কিছু নষ্ট হল, কিছু শিল্পীরা ভেঙে ফেললেন নিজেই। নিজের হাতে গড়া, মায়ায় ভালোবাসায়, অকুণ্ঠ পরিশ্রমে গড়া সৃষ্টি ধ্বংস করতে বাধ্য হলেন নিজের হাতেই। এসব যন্ত্রণা কোনও ওষুধে সারে না। সারেওনি।
জনতা কার্ফুর পর একে একে লকডাউন, আমফান, আরও লকডাউন। পয়লা বৈশাখে লক্ষী গণেশের মূর্তি বিক্রিই হল না এবার। ঝড়ে উড়ে গেছে গেছে স্টুডিও। ভেসে গেছে সৃষ্টি। অবশ্য স্টুডিও বলতে আমরা যে কেতাদুরস্ত, বাতানুকুল, স্টারিনাইট শোভিত, স্যানিটাইজার সিক্ত, কমোড সজ্জিত স্থাপত্যের কথা বুঝি, তেমনটা নয়। বাঁশ, ত্রিপল, টিন দিয়ে তৈরি একটা নড়বড়ে কাঠামো, তার মধ্যেই প্রতিমা গড়া, থাকা, খাওয়া সব। আসলে ঈশ্বর তো ঈশ্বর তাই ওনার এঁটোকাঁটা ছুত অচ্ছুতের বালাই নেই। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উনিও মিলেমিশেই থাকেন তাদের জড়িয়ে। একবার পুনর্বাসন করে কিছু শিল্পীকে ‘পাকা’ স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ তাঁরা ফিরে এসেছেন আবার কুমোরটুলিতেই। কাজ করতে হবে তো! গড়তে হবে তো! আসলে ব্যপারটা হল যার গড়ার অভ্যাস স্বভাবজাত সে কি আর মাটি ছাড়া থাকতে পারে? কিন্তু মানুষ তো আর ঈশ্বর নয়। তার যে খিদে পায়, ঠান্ডা লাগে, বৃষ্টিতে ভিজে যায় সে, তার জ্বর আসে, শরীর খারাপ হয়, তার পরিবার আছে, বাজার আছে, দায়িত্ব আছে, ইস্কুল কলেজ আছে, আর সবকিছুর ওপরে আছে সৃষ্টি! সৃষ্টির নেশা! একটা মাটির তাল থেকে মা গড়ে দেওয়ার মায়া আছে তার হাতে। সেই মা, যার দিকে দশমীর দিন তাকালে গলা বুজে আসে কান্নায়।
অন্নপূর্ণা পুজোর ঘটনাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছেন আমার মতো অনেকেই। সে কী! কুমোরটুলিতে এসব কাজও হয়? কই আমি তো ভাবতাম কুমোরটুলি মানে একটা ফ্রি ব্যাকগ্রাউন্ড যার ওপর আশ্বিনের শারদপ্রাতে ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ারের সংখ্যা নির্ভর করে! হ্যাশট্যাগ পুজো আসছে। হ্যাশট্যাগ গঙ্গার ধারে খোলা চুল! হ্যাশট্যাগ পজিটিভ ভাইব্স্! তা সেই দুর্গাপুজোও তো এবার ছোট করে হবে। এমনকি প্রতিমার সাইজটাও। ছোট। তাই যে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকা সারা বছর, সেখানে এবার আধপেটাই সার। একবেলা ঘুঘনি রুটি কিনে আরেকবেলার জন্যে ঘুঘনিটা তুলে রাখার অভ্যাস পাকা হচ্ছে দিন দিন।
এ কথা তো মোটামুটি আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ক্যামেরা আর মডেল দেখতে পাওয়া যায় পুজোর ঠিক আগের কুমোরটুলিতে। তা সেই সকল ক্যামেরাপিছু যদি দুজন করেও দাঁড়িয়ে যাই আমরা শিল্পীদের পাশে? যদি বলি আরে আমরা তো আছি, তোমরা চালিয়ে যাও না তোমাদের সৃষ্টি, তোমাদের কাজ! বাকিটা আমরা দেখে নিচ্ছি! আরে সেই তো আমরাই ছবি তুলতে আসব বারবার। প্রতি ক্যামেরাপিছু দুজন, যা আমাদের সামর্থ্য, সেটুক সম্বল করে এইটুকু করতে পারি না আমরা? পারি তো, নিশ্চয় পারি, পেরেও তো ছি! আমফানের পর এগিয়ে এসেছিল কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কয়েকটি পুজো কমিটি। কিন্তু মুশকিলের কথা হচ্ছে সংখ্যাটা সেই ‘কয়েকটি’তেই সীমাবদ্ধ। আরও মুশকিলের কথা হল পেটের সংখ্যা কয়েকটি নয়, বরং অনেক অনেক অনেক বেশি। এই যে এবার প্রতিমা ছোট হচ্ছে এর ফলে প্রতিমা চালাও ছোট হচ্ছে, গয়নাও ছোট হচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্রও ছোট হচ্ছে। ফলে কুমোরটুলির আশেপাশে যে সব মানুষ মাকে সাজিয়ে তোলেন ফি বছর, যাঁরা শোলার কাজ করেন, মায়ের গয়না গড়েন, চালা সাজান, তাদের উপার্জনও ছোট হচ্ছে। খিদের অভ্যাস ছোট হচ্ছে… হচ্ছে… হচ্ছে… আর শুধু প্রতিমাই বা কেন, শোলার কাজ করে এমন একটা দোকান, যাঁরা প্রতিবছর শুধু টোপর বিক্রি করেন আশি হাজার টাকার, তাদের এ বছরের বিক্রি— ২০০০ টাকা! এই যে ফারাকটা, সেটার মিটিয়ে তুলতে ‘কয়েকটি’ শব্দটা যে প্রযোজ্য নয় তা বোধহয় বুঝতে পারছি আমরা সকলেই। তাই এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকেই। তারপর চাঁদাও লাগবে না আর। নিজের লোকের কাছ থেকে চাঁদা নেয় কেউ? উঁহু নেয় না। তবে লোকটাকে ও জায়গাটাকে নিজের ভাবতে হবে। আমার কুমোরটুলি থাকবে নিজের মতোই। কারণ দা শো মাস্ট গো অনের বাংলাটা হল—
আসছে বছর আবার হবে।