অপূর্ব রায়
গত কয়েক বছরে বর্ষাকালে খানাকুল-আরামবাগ-উদয়নারায়ণপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যাত্রাণের কাজে যাওয়া এক রুটিনমাফিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবারই, বন্যার জল কিছুটা নামলে, দুর্গত অঞ্চলে গিয়ে দেখি ঘর হারানো মানুষের দল, ত্রিপলের তাঁবুতে কোনও রকমে বসবাস, ত্রাণের সঙ্গে যেটুকু শুকনো খাবার– চিঁড়ে, গুড়, বিস্কুট নিয়ে যেতে পারি আমরা সেটা পাওয়ার জন্যে হাপিত্যেস করে বসে থাকা (এমন ভাবে লিখছি যেন আমরা ত্রাণ দিয়ে ‘মহান’ কাজ করে ওই গ্রামের মানুষগুলোকে ‘রক্ষা’ করছি, অথচ আমাদের গালভরা ডেভলপমেন্টের জন্যই যে বড় বড় বাঁধ তৈরি, যার ফলশ্রুতি বছর বছর বিধ্বংসী বন্যা, ফলত আমাদের ত্রাণের কাজে যাওয়া, সেসব তো আমরা ঘুণাক্ষরেও বলি না!)।
এবারে দক্ষিণবঙ্গের বন্যার পরেও আমরা গিয়েছিলাম হাওড়া-হুগলীর সীমান্তে, উদয়নারায়ণপুর অঞ্চলে। আগস্টের শুরুতে আমরা যখন গ্রামে ঢুকছি বন্যার জল তখন কিছুটা হলেও ‘নেমেছে’, যদিও গ্রামের বড় রাস্তা অনেক জায়গাতেই ভেঙে আছে, রাস্তার মধ্যে মধ্যে গর্ত হয়ে জল জমে আছে। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরেই নদী, রাস্তাটাকে নদী আর গ্রামের মূল অংশের সীমানা বলা চলে, ফলে রাস্তার উপরে বস্তা দিয়ে বোল্ডার বানিয়ে চেষ্টা চলছে নদীর জল গ্রামে আসা ঠেকানোর। গ্রামে ঢোকার সময়েই আমরা দেখছি উঁচু রাস্তার একধারে তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী বসবাসের ভিড়, প্রতি বন্যাতেই এ এক
চেনা ছবি। বন্যায় ভেসে গেছে মাঠের ফসলও। গ্রামের মানুষের সাথে কথাবলে জানা গেল সরকারি ত্রাণ প্রায় কিছুই আসেনি সেখানে, বিভিন্ন সময়ে নানা স্বোচ্ছাসেবী সংগঠন যেসব ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন সেগুলো একজায়গায় জড়ো করে বিলি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেছেন গ্রামেরই কিছু যুবক। আমরা প্রাথমিকভাবে শুকনো খাবার গ্রামের মানুষদের দেওয়ার পরে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া ত্রিপল, জামাকাপড় ইত্যাদি দিয়ে আসি গ্রামেরই ওই যুবকদের কাছে।
বন্যাত্রাণের কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে খারাপ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমরা হই, প্রতিবারই, তা হল বাচ্ছারা যখন খাবার চায় তখন ওদের লাইন করে দাঁড়াতে বলা। কয়েকদিন খেতে না পাওয়া ওই বাচ্ছাগুলোকে লাইন করে দাঁড়াতে বলাটাই একটা নির্মম ব্যাপার, তবুও আমাদের করতেই হয় ওই নির্মম কাজটা।
এবারে ত্রাণের কাজ সেরে যখন ফিরছি তখন এক মহিলা চেঁচিয়ে বললেন, “পুজোর আগে আবার বান হবে, তখন আসবেন বাবুরা!”
পুজোর ঢের আগে, এ লেখা যখন লিখছি, তখন আবারও বানভাসি বাংলা, এবার উত্তরবঙ্গ, চলছে ত্রাণ সংগ্রহের কাজ। আগামী সপ্তাহেই রওনা দেব উত্তরবঙ্গে, ত্রাণের কাজে…