অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
লাট্টুপাড়ার একঝলক
স্কুলের একতলার ঘর থেকে গোলদিঘির লোহার বেড়া দেখা বন্ধ হয়ে গেল সেই বাষট্টি-তেষট্টি সালে, ভারত-চিন যুদ্ধের বছরে। স্কুলের চারদিকে মোটা-মোটা ব্যাফল ওয়াল। পাড়ায় অন্ধকার। ঘরের আলোয় কাগজের ঠুলি। স্কুল বন্ধ। চতুর্দিকে থমথমে ভাব। কিন্তু, সত্যি বলতে কি, আমাদের মজা। স্কুল বন্ধ, পড়া নেই। খাওয়া-দাওয়া আর খেলা। তার ওপরে যুদ্ধের কবলে পড়বার আশঙ্কায় শিলং থেকে জেঠু চলে এসেছে। পিসিরাও আসে ঘনঘন। রোজই হইচই। ঠান্ডার মধ্যে কম্বল চাপা দিয়ে জেঠুর সঙ্গে গুলতানি চলে। ২০ অক্টোবর ১৯৬২ থেকে যুদ্ধের একমাসে একটি ঘটনা এখনও বলবার মতো– বাড়িতে আমাদের জন্য ‘শুকতারা’ কেনা হত। ওতে হঠাৎই একদিন চিন-বিরোধী গল্প বের হল। বাবা বিরক্ত। এইভাবে ছোটদের মন বিষিয়ে দেওয়া? শুকতারা বন্ধ হয়ে গেল। বদলে এল ‘সন্দেশ’। সত্যজিৎ রায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদক। আমাকে সন্দেশের গ্রাহক করে দেওয়া হল। সত্যজিৎ রায়ের সই করা গ্রাহক কার্ড পেয়ে কী আনন্দ! কিন্তু উনি কে সে-সব তখন জানি না। এইটুকু জানি সুকুমার রায়ের ছেলে। আর যে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়তে খুব ভালো লাগে তার মলাট ওঁর আঁকা। কেউ একজন আমার নামে সই করে কার্ড পাঠিয়েছে তাতেই আমি খুশি। সেই নম্বর এখনও মনে আছে– দুই ছয় এক নয়। এর কিছু বছর পরে, জলবসন্ত হয়েছিল যখন, আমাকে মশারির ঘেরাটোপে থাকতে হত। যাতে একঘেয়ে না লাগে, বাবা আমার হাতে একটা খাতা দিয়ে বললেন, যা ইচ্ছে হয় লিখতে থাক। লিখেছিলাম– একটা গল্প। পাঠিয়ে দেওয়া হল সন্দেশে— ‘হাত পাকাবার আসর’-এর জন্য। কী করে জানি না, ছাপাও হয়ে গেল! তখনই বুঝেছিলাম, আসলে বাবা-ই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, যে কোনও অসুখের একটা ভালো দিক আছে!
যে পাড়ায় থাকতাম সেই স্কট লেনের বাড়ির গায়েই লেডি ডাফরিন হাসপাতাল। অধিকাংশ প্রসূতিরাই ভর্তি হতেন ওইখানে। ঘুম না এলে নিশুতি রাতে শোনা যেত কোনও সদ্যোজাতের কান্নার আওয়াজ। কখনও শোনা যেত প্রসূতির আর্তনাদ। সে আওয়াজের মর্ম বোঝার মতো বয়স হয়নি বলেই বুঝিনি সে দিন।
তখন আমাদের বাড়ির উলটোদিকে হাসপাতালে ঢোকবার বেশ চওড়া একটা ফটক ছিল। হাসপাতালের একতলা, তার সামনের শান বাঁধানো রাস্তা এবং ঘাস ভরা নাবাল জমিও দেখা যেত। পরে সে-সব বুজিয়ে বেশ মোটা উঁচু মজবুত দম আটকানো পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়। ফলে, আগে যেমন হাতের নাগালের আত্মীয় মনে হত হাসপাতালটাকে, পাঁচিল তুলে দেওয়ায় সে অনেক দূরের, ভিনদেশি আত্মীয় হয়ে পড়ে। নিকট আত্মীয়কে এমন জেলবন্দি হয়ে যেতে দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল খুব। আত্মীয় মনে করবার একটা সত্যি কারণ ছিল— সে সময় ওই হাসপাতালেই, দেওয়ালে গাঁথা লম্বাটে টেলিফোন বাক্সের ঠোঁটের মধ্যে পয়সা গুঁজে ফোন করতে পারা যেত। আমাদের ফোন করবার মধ্যে তখন তো দুটি মাত্র জায়গা— বড়মামা আর বড়পিসির বাড়ি! নারকেলডাঙা আর যোধপুর পার্ক। যে যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা প্রিয় মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি, তার সঙ্গেও তো বন্ধুত্ব হবে। হয়েওছিল তাই। টেলিফোন বাক্সটির আচার আচরণ এতটাই চেনা হয়ে গিয়েছিল যে, ঠিক বোঝা যেত কখন পয়সা ফেলতে হবে। বাক্সটি অতীব সৎ— কোনও কারণে ঠিকমতো সবকিছু না হলে পয়সা বেরিয়ে আসত নিম্নাঙ্গ দিয়ে, অন্যায়ভাবে পয়সা আত্মসাৎ করেনি কোনওদিন! কত পয়সা লাগত তখন? পাঁচ কিংবা দশ পয়সা— তার বেশি নয় নিশ্চিত। চার আনার কয়েন লেগেছে অনেক পরে।
পাঁচিল তুলে দেওয়ার ফলে, ফোন করতে গেলে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে হত। আর স্বাভাবিকভাবেই গালপাট্টা দারোয়ান আমাদের মতো না-লায়েক নাবালকদের ফোন করতে দেওয়ার অনুমতি দিতে চাইত না। অতএব, অন্য রাস্তা ধরা হয়েছিল। একজনের কাজ ছিল গালপাট্টাকে বিভ্রান্ত করা। সেই ফাঁকে অন্য ভাই পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়ত। এবং যথারীতি নিখুঁত গোল করে বেরিয়ে আসত। তখনও গালপাট্টা সমানে বকবক করছে অপর ভাইটির সঙ্গে। যাদের এত ছোট থেকে অন্যকে বুঝিয়ে, না-বুঝিয়ে চাঁদমারিতে তীর ছুঁড়ে যেতে হয়েছে সেই মুখোপাধ্যায় ভ্রাতৃদ্বয় পরবর্তীতে রাইট-ভাই দুজনের মতো এরোপ্লেন আবিষ্কার করতে না পারলেও যে কাঠকয়লা কেরোসিন থেকে রেশনের লাইনে কৃতিত্ব দেখাবে তাতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই!
হাসপাতালের দক্ষিণের দেওয়ালের গা ঘেঁষে লাট্টুপাড়া। সারি-সারি কাঠের লেদ। দোকানে লাট্টুর খোল ঝুলছে। যেমন পছন্দ কিনে নাও। বলে দাও কীরকম রং হবে লাট্টুর। সেইরকমই হয়ে যাবে। সবুজ-মেরুন চাই, হবে? হুঁ…। খোলটিকে লোহার ফলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এ অনেকটা ছুরি-কাঁচি শান দেবার যন্ত্র। পা দিয়ে প্যাডল করতেই লাট্টুর খোল ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। সেই ঘুরন্ত লাট্টুর মাথায় ধরা হল সবুজ খড়ি। নিমেষে সবুজ বৃত্ত পাকা হয়ে বসে গেল খোলের মাথায়। তারপরে মেরুন। কিন্তু এ খড়ি ঠিক মেরুন নয়। লাল আর মেরুনের মাঝামাঝি কোনও রং। তাও বসে গেল লাট্টুর শরীরে। এবং এ কোনও হেলাফেলার রং নয়। জলে ডোবাও না লাট্টু, রং ধেবড়াবে না! দু-পয়সা বেশি দিতে পারলে লাট্টুর মাথায় একটা মণিও লাগান যায়। মণি মানে বোর্ড পিনের স্বজাতি। কিন্তু কী মনোযোগ দিয়ে লাগাতে হয়, একটু ব্যাঁকা হলেই লাট্টুর চলন বদলে যাবে। অতএব মাথার ঠিক মধ্যিখানে অলঙ্কারটি হালকা আঙুলের চাপে সোজা লাগাও। কোনওরকমে লেগে থাকলেই হল। তারপর একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখো দশ সেকেন্ড— একদম সোজা লেগেছে তো? একটু এদিক-ওদিক মনে হলে খুলে ফেলে আবার লাগাও। নিশ্চিত? সোজা লেগেছে? এইবার তবলা ঠোকার হাতুড়ি উঠে আসবে মেকানিকের হাতে। মণির ঠিক শিয়রে হাওয়ায় আন্দোলিত হবে হাতুড়ি ধরা হাত। দুবার। লক্ষ্য স্থির। তারপর একটি মাত্র নিশ্চিত শব্দ— ঠক। মণি লেগেছে শিয়রে। গরিমা খুলে গেছে লাট্টুর। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, লাট্টুর আল— গোল না চৌকো? কেমন আল চাই? দমের প্যাঁচ খেলতে লাট্টুর দেহ ভারী হওয়া চাই এবং আলটি গোল এবং বেঁটে। না হলে, হালকা খোল চৌকো আল নাও, হাতের তালুর ওপর ঘোরাতে পারবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে লেত্তিটা শক্তপোক্ত, লম্বা, ভালো চাই। ঘুরিয়েই দুনিয়ার লাট্টু/ ভগবান হারিয়েছে লেত্তি— এইসব গানে চলে, লাট্টুর প্যাঁচ খেলতে, যেখানে লেত্তির টানটাই আসল, হারালে চলবে?
পাড়ার দাদারা অনেকেই ইয়ো-ইয়ো পকেটে নিয়ে ঘুরত। অনেকে আবার ইয়ো-ইয়ো নাচাতে-নাচাতে পথ চলত। বোধহয় দাদাগিরি ফলাবার জন্যই। আমাদেরও ইয়ো-ইয়ো ছিল অবশ্যই। কিন্তু ওতে তেমন মজা নেই। লাট্টুতে অনেক অভ্যাস, আন্দাজ, শিল্পবোধ এবং বুদ্ধি লাগে। ইয়ো-ইয়ো শুধু অভ্যাস।
আমাদের পাড়ায়, খেলাধুলো, শরীরচর্চা একটা বড় ব্যাপার। পড়াশুনো-করো-বা-না-করো, খেলাধুলো করা চাই-ই। যতদিন না চার ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতা পেরিয়েছি, পাড়ার হয়ে ফুটবল খেলতে যেতে হয়েছে নেবুতলা, তালতলা, কাইজার স্ট্রিট হয়ে রেলের মাঠ থেকে চালতাবাগান হেদুয়া। যারা খেলবে না তাদেরও নিশ্চয় যেতে হবে। না গেলে, দলের হয়ে গলা ফাটাবে কারা? গোলদিঘিতে সাঁতার কাটা, ওয়াটারপোলো খেলা এইসব শিখবে না, তা আবার হয় নাকি? বাবার নির্দেশ, মানতেই হবে। শীতকালে যখন সাঁতার বন্ধ, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে যাও ব্যায়াম করতে, না হলে অখিল মিস্ত্রি লেনের সেল্ফ কালচার ইন্সটিটিউট— জিমন্যাস্টিক্স শেখো। পেট ভরে খাও, ব্যায়াম করো, তাহলেই সবাই ভালো থাকবে— বাবার পৃথিবী এমনই সহজ। কথার অবাধ্য হলে, খড়ম পেটা। না হলে লাঠিপেটা, যা দিয়ে কাচবার আগে কাপড় ভেজানোর কাজও হয়ে থাকে। মধ্যবিত্ত বাঙালির তখন তিনটি ঘরোয়া অস্ত্র। ছেলেমেয়ে মানুষ করবার জন্য লাঠি ও খড়ম। আর চোর ঠ্যাঙানোর জন্য দরজার খিল। দরজার খিল এমনিতে বেশ শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে দুদিকের আংটায় শরীর পেতে শুয়ে থাকে। কিন্তু চোর বা কোনও বেয়াদবকে ঠান্ডা করতে এর জুড়ি নেই। খিল হাতে নির্ভয়ে বদমাশের মোকাবিলা করো। মাথায় বসিয়ে দিও না, রক্তপাত হতে পারে। বরং ঘা কতক লাগিয়ে দাও পিঠে, ঘাড়ে, পায়ে। চোর-বদমাশ সব ঠান্ডা। একবার এমন চোর ঠান্ডা করা হয়েছিল। পুলিশেও দেওয়া হল লোকটিকে। পরদিন স্কুলে পরীক্ষা। সমাজবন্ধু কারা? প্রশ্ন এসেছিল। অলোকের বাবা হাসতে-হাসতে বললেন, সমাজবন্ধুদের মধ্যে পুলিশের নাম লিখেছ নিশ্চয়। আমি হাসতে পারিনি। লিখতে ভুলে গেছি। এমনও হতে পারে, সেই বয়সেই অবচেতনে পুলিশকে সমাজের বন্ধু মনে হয়নি।
(ক্রমশ)